যন্ত্র বনাম সাহিত্যিক: অনুবাদ যুদ্ধের শেষ সীমান্ত
আমার জীবন শেষ করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ... Thank you for completing my life
তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে বহিয়া যায়...Tatini picks up Hillol and goes out to Kallol
যদি তারে না-ই চিনি গো, সে কি আমায় নেবে চিনে?... If there is no sugar, will you take me to China?
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুগল ট্রান্সলেটে বাংলা ভাষার সংযোজনের পর সম্ভবত এর প্রথম ব্যবহার ছিল হাস্যরস উৎপাদনে। সেখান থেকে আজ মেশিন ট্রান্সলেশন বা যান্ত্রিক অনুবাদ এতটা এগিয়ে এসেছে যে আমরা দেখছি ফোনের সাহায্যে নতুন দেশে গিয়ে অনায়াসে খাবার অর্ডার করা যাচ্ছে, দরদাম করা যাচ্ছে কেনাকাটায়। বাংলায় চ্যাটজিপিটি বা গুগল ট্রান্সলেট এখন এত ভালো কাজ করে যে অনেক পেশাদার অনুবাদক মোটামুটি প্রথম খসড়া সেভাবেই তৈরি করে নিয়ে সম্পাদনা করে থাকেন (আর কেউ কেউ সম্পাদনাটুকুও করেন না, তবে সেটা অন্য আলাপ)। কিন্তু দাপ্তরিক বা ব্যবহারিক অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আমাদের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই কমিয়ে আনলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিন্তু এর দৌড় এখনো সীমিত।
পাবলো নেরুদার সবচাইতে জনপ্রিয় কবিতাগুলির একটি—Puedo escribir los versos más tristes esta noche—লিখেছিলেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে। মার্কিন কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম স্ট্যানলি মারউইন এর চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ করেন। পড়া যাক এর প্রথম ছয়টি পঙ্ক্তি:
Puedo escribir los versos más tristes esta noche.
Escribir, por ejemplo: 'La noche está estrellada,
y tiritan, azules, los astros, a lo lejos.'
El viento de la noche gira en el cielo y canta.
Puedo escribir los versos más tristes esta noche.
Yo la quise, y a veces ella también me quiso.
Tonight I can write the saddest lines.
Write, for example, 'The night is shattered,
and the blue stars shiver in the distance.'
The night wind revolves in the sky and sings.
Tonight I can write the saddest lines.
I loved her, and sometimes she loved me too.
এর প্রথম ছয় লাইন মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় যান্ত্রিক অনুবাদ, প্রথমে গুগল ট্রান্সলেটর তারপর চ্যাটজিপিটি:
আমি আজ রাতে সবচেয়ে দুঃখজনক আয়াত লিখতে পারি।
উদাহরণস্বরূপ লিখুন: 'রাত্রি তারাময়,
এবং তারাগুলি কাঁপছে, নীল, দূরত্বে।'
রাতের বাতাস আকাশে ঘুরছে আর গান গায়।
আমি আজ রাতে সবচেয়ে দুঃখজনক আয়াত লিখতে পারি।
আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং মাঝে মাঝে সেও আমাকে ভালোবাসত।
(গুগল ট্রান্সলেট)
আমি আজ রাতে সবচেয়ে দুঃখের কবিতাগুলো লিখতে পারি।
লিখতে পারি, উদাহরণস্বরূপ: 'রাত্রি তারায় ভরা,
আর দূরে নীলাভ তারা কাঁপছে।'
রাতের বাতাস আকাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে।
আমি আজ রাতে সবচেয়ে দুঃখের কবিতাগুলো লিখতে পারি।
আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম এবং কখনো কখনো সেও আমাকে ভালোবেসেছিল।
(চ্যাটজিপিটি ৩.৫)
চ্যাটজিপিটি মোটামুটি ভালো ফলাফল দিলেও গুগলের অনুবাদ বিভিন্ন দিক থেকেই ব্যর্থ। গুগল সব জানলেও বুঝতে পারছে না যে এখানে verse-কে আয়াত বলাটা কেমন বেখাপ্পা! গুগলের কাজ একজন সাহিত্যিকের অনুবাদের সাথে তুলনা করলে এর আড়ষ্টতা আরও প্রকট হয়:
সবচেয়ে দুঃখের যে লাইনগুলি, আজ রাতে লিখতে পারি আমি তা-ই।
যেমন লিখতে পারি, 'তারাচ্ছন্ন রাত্রি
আর নীল নীল তারাগুলি দূরে বসে শুধু কাঁপছে'।
আকাশের বুকজুড়ে রাতের বাতাস ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে, আর কী জানি কী গাইছে।
সবচেয়ে দুঃখের যে লাইনগুলি, আজ রাতে লিখতে পারি আমি তা-ই।
তারে ভালোবাসতাম, কখনো বুঝি বা সে-ও বাসত আমারে।
(বর্ণালী সাহা, ২০১৫)
কার্লোস ফুয়েন্তেসের উপন্যাসিকা 'Vlad' স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় তার 'Inquieta Compani' সংকলনের অংশ হিসেবে। উপন্যাসে ইভস নাবারো তার স্ত্রী আসুনসিওনের সাথে প্রাতরাশের কথা বলে:
Un desayuno, como debe ser, de una hora de duración. Es decir, un lujo en el mundo actual. Es, para mí, el cimiento del día. Un momento de miradas amorosas que contienen el recuerdo no dicho del amor nocturno y que rebasan aunque incluyen el placer culinario...
গুগল ট্রান্সলেট এর ইংরেজি করে বেশ ভালো:
A breakfast, as it should be, lasting an hour. That is to say, a luxury in today's world. It is, for me, the foundation of the day. A moment of loving glances that contain the unspoken memory of nocturnal love and that go beyond, although they include, culinary pleasure...
অন্যদিকে বাংলায় গুগলের অনুবাদ হোঁচট খায়:
একটি প্রাতরাশ, যেমনটি হওয়া উচিত, এক ঘণ্টা স্থায়ী। বলা যায়, আজকের পৃথিবীতে একটি বিলাসিতা। এটা, আমার জন্য, দিনের ভিত্তি। নিশাচর প্রেমের অব্যক্ত স্মৃতি ধারণ করে প্রেমময় দৃষ্টিভঙ্গির একটি মুহূর্ত এবং যেগুলিকে ছাড়িয়ে যায়, যদিও তারা রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দ অন্তর্ভুক্ত করে...
একজন অনুবাদকের বাংলায় কেমন হতে পারে দেখা যাক:
সকালের এই নাশতা সেরে উঠতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায় আমাদের। আমি মনে করি এ রকমই লাগা উচিত, তার পরও আজকের দিনে এটা বিলাসিতাই। তবে আমাকে এটা দিনের শুরুর একটা বেশ ভালো ভিত্তি গড়ে দেয়। প্রাতরাশের সময়টা আমার কাছে প্রেমের চোরাদৃষ্টি হানার আদর্শ সময়, যে দৃষ্টিতে লুকানো থাকে নৈশপ্রেমের অব্যক্ত স্মৃতি, যা আরও বিস্তৃত হতে থাকে, রান্নাঘরে আনন্দসীমাকেও অতিক্রম করে যায় বহু দূরে...(আলীম আজিজের অনুবাদ, ২০১৪)
উদাহরণগুলো থেকে আমরা ভেবে দেখতে পারি, সাহিত্যের সেরা অনুবাদ আসলে কেমন? মূল লেখার সবচেয়ে নিকটবর্তী ভাষান্তর? নাকি অনেকগুলো কাছাকাছি বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটি সংস্করণ? সাহিত্যের অনুবাদ ভাষার রূপান্তর মাত্র নয়, উৎস এবং লক্ষ্য এই দুই ভাষার মধ্যকার রহস্যময় আলো-আঁধারিতে ফুটে ওঠা এক নতুন রূপ। অনুবাদকের বিবেচনা এবং সংবেদনশীলতা এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তাকে আক্ষরিক অর্থের চেয়ে লেখার সামগ্রিক ভাবের দিকে মনোযোগ দিতে হয় বেশি। শব্দের অর্থ আর ব্যঞ্জনার অসংখ্য ছোট ছোট লাভ আর লোকসানের জটিল হিসাবনিকাশ করে নির্ধারণ করতে হয় লেখাটির কোন বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে জরুরি। এই বিবেচনাবোধ এখন পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তার নাগালের বাইরে। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস অনুবাদের ক্ষেত্রে নিউরাল মেশিন ট্রান্সলেশন সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীদের বিচারে কেবল ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মানের অনুবাদ করতে পারে। মূল এবং লক্ষ্য ভাষার সাহিত্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মডেল ব্যবহার করে হয়তো এ রকম ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা ভালো নিউরাল মেশিন ট্রান্সলেশন পাওয়া যাবে, কিন্তু একজন সাহিত্যিকের মতো কাজ পাওয়ার আশা করা যায় না এখনো।
'Catching Fire: a Translation Journey' 'ক্যাচিং ফায়ার: আ ট্রান্সলেশন জার্নি' (২০২২) বইয়ে ব্রিটিশ অনুবাদক ড্যানিয়েল হান চিলিয়ান লেখক দিয়ামেলা এলতিতের 'Jamás el fuego nunca' উপন্যাসের অনুবাদ করতে গিয়ে তাকে কী কী বিপাকে পড়তে হয়েছে, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। উপন্যাসে একটি অধ্যায় শুরু হয়েছে শুধু চারটি শব্দ দিয়ে, 'Frentista, estalinista, asesina loca.' প্রথম শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ হবে frontist—যে সামনে থাকে। বাংলায় অনুবাদ করতে চাইলে গুগল ট্রান্সলেট এই শব্দটিকে ব্রাজিলের পর্তুগিজ ভাষার শব্দ হিসেবে শনাক্ত করে অর্থ দেয় গ্যাসস্টেশন বা পেট্রলপাম্পের পরিচারক। ইংরেজিতে এর ঠিক কোনো প্রচলিত পরিভাষা নেই। হান ধারণা করেন, এটা চিলির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো বামপন্থী তকমা হতে পারে। তিনি একজন চিলিয়ান অনুবাদকের কাছে জানতে পারেন ফ্রন্তিস্তা কথাটা পিনোশেবিরোধী একটি চরমপন্থী গেরিলা দলের সদস্যদের গালি দিতে ব্যবহার হয়। অনুবাদক হিসেবে হানকে তখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তিনি কি মূলকে আক্ষরিক ভাবে অনুসরণ করবেন? নাকি পাঠকের বোধগম্যতা এবং লেখকের ভঙ্গিমার ওপর জোর দেবেন? প্যারামিলিটারি, কমিউনিস্ট গুন্ডা ইত্যাদি বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনার করার পর শেষ পর্যন্ত তিনি বেছে নেন—এক্সট্রিমিস্ট/চরমপন্থী, আর শব্দের ক্রম ভেঙে দ্বিতীয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন: স্টালিনিস্ট/এস্টালিনিস্টা, কারণ, এটা শুনলেই কিন্তু পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়Ñকোন দিকে কথা এগোচ্ছে। আবার স্প্যানিশ ভাষায় যদিও বোঝা যায়, যাকে নিয়ে বলা হচ্ছে সে নারী, ইংরেজিতে কিন্তু যায় না। ফলে হান asesina loca-কে (উন্মাদ খুনি) অনুবাদ করেন crazy killer bitch হিসেবে। চূড়ান্ত ফলাফল: 'Stalinist. Extremist. Crazy killer bitch.' যন্ত্র যেখানে নিখুঁত ফলাফল দিতে চায়, মানুষের সৃজনশীলতা সেখানে খুঁতের মধ্যেই সৌন্দর্য এবং অর্থ তৈরি করে। সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রে তাই যান্ত্রিক অনুবাদের অবস্থান সুদঢ় নয়।
সাহিত্যে না হলেও সংবাদ বা ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়ালের অনুবাদের ক্ষেত্রে এখন যান্ত্রিক অনুবাদের সম্পাদনা বা পোস্ট-এডিটিংই আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পোস্ট-এডিটিংয়ের মান বিভিন্ন রকম হলেও তা করা যায় কম খরচে এবং দ্রুত। যথারীতি বাংলা বা ইউরোপের বাইরের ভাষার ক্ষেত্রে এখনো তেমন কাজ না হলেও ইউরোপীয় ভাষায় সাহিত্যিক পোস্ট-এডিটিং নিয়ে অনেক গবেষণা ইতিমধ্যেই হয়েছে। তাতে দেখা যায়, মৌলিক এবং সৃষ্টিশীল লেখার চেয়ে প্লটনির্ভর উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি কার্যকর। লেখায় যখনই রূপক, চিত্রকল্প বা বাগধারার ব্যবহার আসতে থাকে, যন্ত্র ভুগতে থাকে। অনুবাদে যত বেশি সৃজনশীলতা লাগে, ততই মানুষের করা অনুবাদ যন্ত্রের অনুবাদকে ছাড়িয়ে বহু দূরে এগিয়ে যায়। দুরূহ কোনো অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে অনুবাদক যন্ত্রের সহায়তা নিতেই পারেন, কিন্তু যন্ত্রের ওপর নির্ভর করলে অনুবাদে খুব সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য তৈরি হয়। একটা বাক্যের হয়তো তিন রকম অনুবাদ হতে পারে, কিন্তু যন্ত্র এর মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার পর যদি সেটার সম্পাদনা করা হয়, বৈচিত্র্য ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। আবার একই বইয়ের মধ্যে লেখা যত এগোতে থাকে, দেখা যায় অনুবাদক/সম্পাদক ততই ক্লান্তির কারণে কিংবা পাঠের মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হয়ে যান্ত্রিক অনুবাদটিকে তেমন কোনো পরিবর্তন না করেই গ্রহণ করতে থাকেন।
কিন্তু বই যদি বিক্রি হতে থাকে, তাহলে তার সাহিত্যগুণ বা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে কি আদৌ চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন আছে? সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইউরোপের প্রকাশনাশিল্পে পোস্ট-এডিটেড সাহিত্য ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে বেশ বড় জায়গা। Nuanxed নামে একটি এজেন্সি চালু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে ২৫০টির বেশি বাণিজ্যিক অনুবাদ উপন্যাস বের করেছে। তাদের প্রধান নির্বাহী আটলান্টিক ম্যাগাজিনকে বলেছেন, 'প্রকাশকেরা একবার আমাদের সাথে কাজ করলে বারবার ফিরে আসছে।' এর পেছনে তাদের সম্পাদনার মান ভূমিকা রেখে থাকতে পারে, অথবা বাণিজ্যিক উপন্যাসের পাঠকেরা মোটামুটি মানের অনুবাদ দিয়েই সহজেই সন্তুষ্ট, সেটাও হতে পারে। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন দ্রুত অনুবাদের প্রবণতা ইউরোপে তৈরি হয়নি।
ঐতিহাসিকভাবেই অনুবাদ নিয়ে অসন্তোষ আর বিতর্কের শেষ নেই। দান্তের কাব্য যখন ফরাসি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়, ইতালিয়ান ভাষায় নতুন বুলি তৈরি হয়—traduttore, traditore, অর্থাৎ অনুবাদক, প্রতারক! সেই আশঙ্কা থেকেই বুঝি প্রচ্ছদে এখনো অনেক প্রকাশক অনুবাদকের নাম দেন না। ১৯৭৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নোবেলজয়ী লেখক মিগেল আস্তুরিয়াসের একটি উপন্যাসের পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে লেখকের ভাষার ভূয়সী প্রশংসা থাকলেও অনুবাদক গ্রেগরি রাবাসার কোনো উল্লেখ ছিল না—মনে হচ্ছিল মূল বইটি ইংরেজিতেই লেখা। রাবাসা এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'পর্যালোচক সম্ভবত জানেন না যে তিনি একটি অনুবাদ পড়েছেন। এই জন্যই বইয়ের জ্যাকেটে অনুবাদকের নাম থাকা প্রয়োজন।'
অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনুবাদককে কতটা কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে, আর কতটা মূল লেখককে-এ নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরোনো। তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে যান্ত্রিক অনুবাদ। দুনিয়াজুড়েই প্রকাশকেরা আজকাল সরাসরি বই অনুবাদের কাজ না দিয়ে মেশিন ট্রান্সলেশনের পোস্ট-এডিটিং করার কাজ দিতে চাইছেন। আমাদের দেশে এমন অনেক লেখক, প্রবন্ধকার এবং অনুবাদক আছেন, যারা এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আমেরিকার অথরস গিল্ড তাদের ওয়েবসাইটে লেখকদের জন্য প্রকাশনার চুক্তিপত্রে লেখকের অনুমোদন ছাড়া লেখার মেশিন ট্রান্সলেশন যেন না হয়, এই শর্ত কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তার একটি নমুনা দিয়েছে। কিন্তু অনুবাদক তার কাজের অংশ হিসেবে যন্ত্রের সহায়তা নিতেই পারেন, তাতে বাধা দেওয়ার উপায় নেই। বিশ্বজুড়ে এখনো মানুষ যার যার মাতৃভাষাতেই সবচেয়ে বেশি পড়ে, সেটা কাগজের বই হোক বা ডিজিটাল কনটেন্ট। মানুষের কাছে কম খরচে দ্রুত তাদের ভাষায় বই পৌঁছে দিতে যান্ত্রিক অনুবাদের তুলনা নেই।
১৯৭৮ সালের এক দিনে বেসবল খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যান হারুকি মুরাকামি। খেলার এক উত্তেজনায় ভরা মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে হয়, তিনি একটি উপন্যাস লিখতে পারবেন। মুরাকামির লেখা এই ঘটনার বিবরণ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন টেড গুসেন, সেখান থেকে বাংলা অযান্ত্রিক অনুবাদ:
'আমি সেই অনুভূতিটি স্পষ্ট মনে করতে পারি। মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে কী যেন থরথরিয়ে নেমে আসছিল, আর আমি আমার দুই হাতের মধ্যে সেটাকে পরিষ্কারভাবে ধরে ফেললাম। কেন সেটা আমার হাতের মুঠোয় ধরা দিল, তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। আমি তখনো জানতাম না, আর এখনো জানি না। কারণটা, যা-ই হোক, ঘটনাটা ঘটেছিল। সেটা ছিল একটা দৈব বাণীর মতো। কিংবা হয়তো এপিফ্যানি এর চাইতে ভালো শব্দ।'
মুরাকামি জাপানি ভাষাতেও এই ক্ষেত্রে ইংরেজি এপিফ্যানি শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। সেদিন রাতে তিনি তার বাড়িতে রান্নাঘরের টেবিলে বসে লিখতে শুরু করেন। কয়েক মাস পর প্রথম পাণ্ডুলিপিটি তৈরি হয়, কিন্তু তা তার আশানুরূপ হয় না। মুরাকামি আবার সেই টেবিলে অলিভেটি টাইপরাইটার নিয়ে লিখতে শুরু করেন, কিন্তু এবার ইংরেজিতে। ইংরেজি যেহেতু তার প্রথম ভাষা নয়, লেখার ভাষাটা ছিল স্বভাবতই সরল এবং নিরাভরণ। কিন্তু লিখতে লিখতে মুরাকামি একটা স্বতন্ত্র ছন্দ খুঁজে পান:
'আমার যেহেতু জন্ম ও বেড়ে ওঠা জাপানে, জাপানি ভাষার শব্দ আর নকশা আমার মধ্যে এত বেশি ঠেসে ছিল, যেন গবাদিপশুতে ভরা একটা গোলা। আমি যখন আমার চিন্তা আর অনুভূতিকে শব্দে নিয়ে আসতে চাইতাম, এই পশুগুলো এলোপাতাড়ি বিচরণ করা শুরু করত, আর লেখাটা ধসে পড়ত। একটা বিদেশি ভাষায় লিখতে শুরু করায় সেটার সীমাবদ্ধতাগুলো এই ঝামেলাটা দূর করে দিল।'
বিস্ময়করভাবে মুরাকামি মাতৃভাষায় যা লিখতে পারছিলেন না, ইংরেজিতে তা পারলেন, আর তারপর নিজের উপন্যাস ইংরেজি থেকে জাপানিতে অনুবাদ করলেন। মুরাকামির এই নিরপেক্ষ ভাষাকে অনেকে 'translationese' বলে সমালোচনা করলেও তার এই অ-জাপানি সাহিত্য তাকে বিশ্বনন্দিত করে তুলল:
'আমি প্রথমে ইংরেজিতে লিখে তারপর জাপানিতে "অনুবাদ" করার মধ্য দিয়ে একটা নিরপেক্ষ নিরাভরণ শৈলী খুঁজে পাই, যা আমাকে সাবলীল করে তোলে। আমি কিন্তু জাপানি ভাষায় পানি মিশিয়ে তার কোনো জলীয় সংস্করণ তৈরি করতে চাইনি, আমি চেয়েছিলাম তথাকথিত সাহিত্যের ভাষা থেকে যথাসম্ভব দূরে সরে গিয়ে আমার নিজস্ব স্বাভাবিক একটা কণ্ঠস্বর তৈরি করতে।'
মুরাকামি যেভাবে অনুবাদের মধ্য দিয়ে নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছেন, যন্ত্রের হাতে অনুবাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সোপর্দ করলে হারিয়ে যায় এই অলৌকিক সম্ভাবনা। সাহিত্য যখন এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় কথা বলে ওঠে, আমরা একটি লেখা শুধু নতুন করে পাই না, দুটি ভাষা এবং দুজন সাহিত্যিকের সম্মিলিত মিথস্ক্রিয়ায় পাই নতুন কিছু। কিন্তু এ-ও ঠিক যে প্রযুক্তির ব্যবহার অনুবাদকের মূল্যবান সময় এবং শ্রম বাঁচানোর একটা পথও খুলে দিয়েছে। কোনো একদিন হয়তো যন্ত্র মানুষের অনুবাদকে ছুঁয়ে ফেলবেই। তখন পৃথিবীর সব মানুষ যেন একই ভাষায় কথা বলবে, ভাষার কোনো ব্যবধান আর থাকবে না। বিশ্বের সেরা বইগুলো হয়তো স্বল্পতম সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য অনুবাদ একটি জাদুকরী প্রক্রিয়া, যেখানে ভাষা কী জানি কী গান গায় আর অব্যক্ত কোন স্মৃতি ধারণ করে প্রেমের চোরাদৃষ্টি হানে। অনুবাদ লড়াইয়ের শেষ সীমান্তে এসে যন্ত্র আর মানুষ উভয়েই পরাস্ত হয় ভাষার রহস্যের কাছে।