১৩৪ বছর পর সন্ধান মিলল ‘ড্রাকুলার’ লেখক ব্রাম স্টোকারের হারানো গল্পের
গা ছমছমে ভৌতিক কাহিনির মনোযোগী পাঠক এন্তার, কেউ বা ভালোবাসেন ভুতুড়ে সিনেমা। দুই ফরম্যাটেই কিন্তু কিস্তিমাৎ করেছে ব্রাম স্টোকারের 'ড্রাকুলা'। এই উপন্যাস ভৌতিক সাহিত্যে অমর হয়ে আছে। পরবর্তীতে মূল কাহিনির ওপর নির্মিত ছায়াছবিগুলোও জাগিয়েছে শিহরণ। এক কথায়, বিশ্বসাহিত্যের দরবারে এক উজ্জ্বল মণি হয়ে আছেন এই আইরিশ লেখক। খবর বিবিসির
সেজন্যই যখন জানা গেল, ১৩৪ বছর পরে তাঁরই লেখা একটি ছোট গল্প খুঁজে পাওয়া গেছে, তখন তা রীতিমত চাঞ্চল্য জাগায় বটে, অন্তত সাহিত্যমোদীদের তো অবশ্যই টানে এমন খবর। কারণ, এ যে স্বয়ং ব্রাম স্টোকারের আরেকটি ভৌতিক কাহিনি। কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া গথিক হরর 'ড্রাকুলা' প্রকাশিত হওয়ার সাত বছর আগে গিবেট হিল নামের এই গল্পটি প্রকাশিত হয়– ডাবলিনের একটি খবরের কাগজে। আজ থেকে ১৩৪ বছর আগে ১৮৯০ সালে। তবে সেটি নিয়ে পরে আরও কোনো আলোচনা হয়নি। ব্রামের সাহিত্য কীর্তির মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত হয়নি এই গল্পটি, হয়তো ড্রাকুলার খ্যাতির কাছে হারিয়ে যাওয়াই ছিল পরিণতি।
তবে অপেশাদার এক ঐতিহাসিকের দৌলতে এতদিন পরে হলেও তা খুঁজে পাওয়া গেছে। ক্লিয়ারি নামের ওই ব্যক্তি আবার স্টোকারেরই এক ভক্ত।
আর পুরোটা হয়েছে কাকতলীয় ঘটনাক্রমে। ২০২১ সালে কানে শুনতে না পাওয়ার সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিলেন ক্লিয়ারি। তাই রোজ অনেকটা সময় কাটাতেন ডাবলিনে অবস্থিত আয়ারল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগারে। এই ডাবলিনের বাসিন্দা ছিলেন স্টোকার-ও। যাই হোক এভাবে আরও দুবছর কাটে, তারপরেই আসে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের সেই অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত, ওইদিন ১৮৯০ সনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকার ডাবলিন সংস্করণের বড়দিনের সাপ্লিমেন্টের পাতায় অদ্ভুত এক শিরোনাম নজর কাড়ে তাঁর।
'গিবেট হিল' – শিরোনাম পড়লেন, কিন্তু লেখকের নামটা কার? ব্রাম স্টোকার, অসম্ভব এ হতেই পারে না! – এমন প্রতিক্রিয়াই হয়েছিল মিস্টার ক্লিয়ারির।
সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বার্তা সংস্থা এএফপিকে ক্লিয়ারি বলেন, 'গিবেট হিল– শিরোনাম পড়ে আমার মনে হলো– এই নামে ব্রাম স্টোকারের কোনো গল্প আছে বলে তো কস্মিনকালেও শুনিনি। এমনকী তাকে নিয়ে লেখা কোনো জীবনীগ্রন্থ বা পুস্তক বিবরণীতেও নয়, তাহলে!'
তিনি বলেন, 'আমি তখন স্রেফ হতবাক, আর স্তম্ভিত…তখন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমিই কী একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে এই গল্প পড়েছে?'
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে যখন বুঝতে পারলেন, খুঁজে পেয়েছেন স্টোকারের হারানো এক গল্প, তখন পেয়ে বসে আরেক ভাবনা, 'এই আবিষ্কার নিয়ে এখন কী করব?'
গ্রন্থাগার পরিচালক অড্রে হুইট্টি জানান, তখন মি. ক্লিয়ারি আমাকে ডেকে বললেন, 'তোমাদের সংবাদপত্রের আর্কাইভে আমি বিস্ময়কর কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি – বললে তুমিও বিশ্বাস করবে না।'
গর্বের সাথে হুইট্টি বলেন, তাদের লাইব্রেরির আর্কাইভটি বেশ সমৃদ্ধ, সেখানে অপেশাদার হয়েও দারুণ আবিষ্কার করে দেখিয়েছেন ক্লিয়ারি। তবে দুনিয়ায় হইচই মাতানোর মতো আরও অনেক সাহিত্য হয়তো এই আর্কাইভের ভাণ্ডারে আজো লুকানো আছে, করছে ক্লিয়ারির মতো কারো হাতে আবিষ্কারের অপেক্ষা।
স্টোকারের জীবনীলেখক পল ম্যুরে এই গল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, গিবেট হিল প্রকাশের সময় ড্রাকুলা লেখার কাজে সবে হাত দিয়েছিলেন স্টোকার। অর্থাৎ, ড্রাকুলার মতো বিখ্যাত উপন্যাসের লেখক হয়ে ওঠার আগে তাঁর যাত্রা শুরুর একটা স্টেশন ছিল এই গল্প।
গিবেট হিল এগিয়েছে এক নাবিকের কাহিনি নিয়ে, যাকে খুন করে তিনজন বদমাশ, যাদের ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল– যাতে আসা-যাওয়ার পথে এই পরিণতি স্বচক্ষে দেখতে পায় যাত্রীরা।
সারে এলাকায় অবস্থিত গিবেট হিল নামক স্থানই কাহিনির স্থান, ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত চার্লস ডিকেন্স এর উপন্যাস নিকোলাস নিকেলবি'তেও এই স্থানের নাম রয়েছে।
আবিষ্কারের পরে সেটা পল ম্যুরেকে জানান মি. ক্লিয়ারি। তখন তিনিও জানান যে, একশ বছরের বেশি সময় ধরে এই গল্পটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ম্যুরে বলেন, ১৮৯০ সনে ব্রাম স্টোকার একজন নবীন লেখক ছিলেন, ওই সময় তিনি ড্রাকুলার প্রথম কিছু খসড়া লিখছিলেন।
'গিবেট হিল' সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, 'এটা একটা ক্লাসিক স্টোকারের কাহিনি – যেখানে আছে শুভ আর শয়তানি শক্তির লড়াই। এখানেও শয়তানি শক্তি সুন্দরের রূপ নিয়ে ব্যাখ্যার অতীত রূপ ধরে আসে।'
গিবেট হিল গল্পের জন্য ছবি এঁকেছিলেন তৎকালীন আইরিশ শিল্পী পল ম্যাককিনলি, সেই ছবিসহ গল্পটি প্রকাশ করেছে রোটান্ডা ফাউন্ডেশন। ডাবলিনের রোটান্ডা হাসপাতালের জন্য অর্থের জোগান দেয় এই ফাউন্ডেশন, যেখানে কাজ করেন মি. ক্লিয়ারি।
এই প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পুরোটাই যাবে ব্রাম স্টোকারের মা শার্লট স্টোকারের নামে প্রতিষ্ঠিত তহবিলে। এই নারীও শ্রবণ সক্ষমতা হারানোদের বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করেছেন। শিশুদের মধ্যে শ্রবণশক্তি হারানোর বিষয়ে গবেষণায় অর্থায়নের জন্য প্রচারণা চালাতেন শার্লট।
চলতি মাসে ডাবলিনে অনুষ্ঠিত ব্রাম স্টোকার উৎসবেও এই আবিষ্কারের ঘটনা তুলে ধরা হয়।