এই মুখ ও মুখোশের দিন
গত বছর কোভিড-১৯ যখন মাত্র ছড়িয়ে পড়ছে আর আমরা তাড়া-হুড়ো করে লকডাউনে গুটিয়ে পড়ছি ঘরের ভেতর, তখনই প্রথম দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বৃটিশ নিবন্ধ রচয়িতা অ্যান্ড্রু ডিকসনের একটি প্রবন্ধ লকডাউনে শেক্সপিয়র: মড়কের সময় নির্জন বাসেই কি তিনি কিং লিয়ার লিখেছিলেন? চোখে আসে। এই প্রবন্ধটি পাঠের মাধ্যমেই জানতে পারি যে শুধু কিং লিয়ার নয়, শেক্সপিয়রের রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাটকটিতেও মড়কের প্রসঙ্গ আছে। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা এই নাট্যকার শুধু যে প্লেগের সময় কিং লিয়ার লিখেছেন এবং নাটকের প্রেক্ষাপটে অতিমারীর খাঁ খাঁ, বিরাণ সময় এসেছে তাই নয়, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটেও দেখা যাচ্ছে ফ্রায়ার লরেন্স দ্বারা প্রেরিত বার্তাবাহক মড়কে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে এই বার্তাবাহক নির্জনবাস অবলম্বনে বাধ্য হন। কাজেই বার্তাবাহকের কাছে যে চিঠিটিতে বলা হয়েছিল যে জুলিয়েট আসলে মারা যায়নি, সেই খবর রোমিওর কাছে আর পৌঁছায় না। আর এজন্যই কি জুলিয়েটদের বাসায় আয়োজিত বলনাচের অনুষ্ঠানে রোমিও মুখোশ পরে ঢুকেছিল? সেটা কি শুধুই বৈরী পরিবারে নিজের পরিচয় ঢাকার জন্য নাকি মড়কও একটি কারণ ছিল?
কোভিড-১৯ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যোগ করছে নতুন কিছু শব্দ-বন্ধ। যেমন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, সামাজিক দূরত্বসহ নতুন নানা শব্দ শিখছি আমরা। কিন্ত সত্যি বলতে কতটা নতুন এই শব্দাবলী? প্রাচীন গ্রিসে প্রথম পার্সোনা বা মুখোশের উদ্ভব হয়েছিল। এ্যাম্ফিথিয়েটারে অভিনয়ের সময় গ্রিক অভিনেতারা বিভিন্ন মুখোশ পরতেন মূলত: তাদের চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে। ডাক্তার, রোগী, শিক্ষক, ছাত্র, রাজা, সৈন্য, বর বা বধূ, পিতা-মাতা বা সন্তানের চরিত্রে থাকত ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ। পরবর্তীতে আধুনিক মনস্তত্বে পার্সোনালিটি শব্দটির উদ্ভব এই পার্সোনা শব্দ থেকেই। মনস্তত্ববিদ কার্ল ইয়ুংয়ের মতে, পার্সোনা হচ্ছে তাই যেটা কোন ব্যক্তির সত্যিকারের বাস্তবতা নয়, তবে সে নিজে এবং অন্যরাও তাকে তেমনটা ভাবে। রবার্ট জনসনের মতে পার্সোনা বা মুখোশ হচ্ছে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক আবরণ বা পোশাক। আবার পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়ার ছৌ নাচে ব্যবহৃত ছৌ মুখোশগুলি প্রধানত পৌরানিক চরিত্রের ওপর যেমন, মহিষাসুরমর্দিনী, রাম-সীতা, রাম-রাবনের যুদ্ধ ইত্যাদি৷ অনেকক্ষেত্রে সাঁওতাল দম্পতির মুখোশ রূপক হিসাবে ব্যবহার হয়৷ মুল মুখোশের চারধারে দু ফুট পর্যন্ত গয়না ও কাপড় দিয়ে বিভিন্নভাবে অলঙ্করণ করা হয়৷ দুর্গা, লক্ষ্মী, কার্তিক এর মুখোশগুলি গাঢ় হলুদ বা কমলা রঙ করা হয়৷ শিব, সরস্বতী ও গনেশের মুখোশগুলি সাদা রঙ করা হয়৷ আবার মা কালীর মুখোশটিতে করা হয় কালো রঙ৷ অসুরের মুখোশের ক্ষেত্রে সাধারণত গোঁফ, দৃশ্যমান দন্তপাটি ও বিষ্ফারিত চোখসহ কালো বা গাঢ় সবুজ রঙ করা হয়৷ দক্ষিণ ভারতের কথাকলি নাচ বা জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাবুকি নাটকেও দীর্ঘ সময় ধরে এমন পুরু মেকাপ নেওয়া হয় যা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর মুখে এনে দেয় মুখোশের ব্যঞ্জনা।
অতীতের মহাকাব্যগুলো যেমন গ্রিসের ইলিয়াড-ওডিসি, ভারতের রামায়ণ-মহাভারত, ইরানের শাহনামেহ বা ইরাকের গিলগামেশ জাতীয় ধ্রুপদী আখ্যানগুলোয় বীরেরা যুদ্ধক্ষেত্রে লৌহবর্ম পরে বক্ষদেশ রক্ষার পাশাপাশি মাথায় তামার শিরস্ত্রাণ পরছেন চোখ-নাক-মুখমন্ডলকে রক্ষা করতে। পাশাপাশি প্রাচীন যুগে প্রায় সব সভ্যতাতেই নারী তার মুখ ও মাথা ঢাকছে লজ্জা-সম্ভ্রম বা সামাজিক শুচিতা প্রভৃতির প্রয়োজন মেটাতে। শুধুই ভারতীয় নারীর দীর্ঘ ঘোমটা বা আরব-ইরানের নারীর বোরখার নেকাব নয়, ইউরোপেও অভিজাত নারীরা টুপি বা স্কার্ফ মাথায় পরছেন প্রথম মহাযুদ্ধ অবধি। আরবে আবার মরুর তপ্ত লু হাওয়ায় বা বালু ঝড়ে মরুর নারীর মত বেদুইন পুরুষও দীর্ঘ সাদা আলখিল্লা আর শুভ্র মস্তকাবরণ দিয়ে চোখে-মুখে এসে পড়া খর রোদের উত্তাপ ও বালু থেকে নিজের চুল ও মুখমন্ডলকে প্রায়শই রক্ষা করতে সক্ষম হন। মেরু দেশে এস্কিমো নারী বা পুরুষ ভালুক থেকে শুরু করে সীল মাছের চামড়ার পোশাক বা নর্ডিক-স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোয় ফারের কোট বা মুখ ঢাকা টুপি সবাইকেই পরতে হয় তীব্র শীত থেকে আত্মরক্ষার জন্য। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম, কোথাও বীরের বীরত্ব, কখনো নারীর কাছ থেকে সমাজের প্রত্যাশিত শুচিতা আর কোথাও বা শত্রুর কাছে নিজের পরিচয় লুকাতে ব্যস্ত যোদ্ধা বা গোয়েন্দাও পরছেন, ব্যবহার করছেন এমন সব শিরস্ত্রাণ, ঘোমটা বা নেকাব অথবা বড় টুপি যা তাকে এক ধরণের আড়াল দিচ্ছে বা খানিকটা হলেও মুখোশ ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছে।
কিন্ত অতীত যুগে এইসব শিরস্ত্রাণ, ঘোমটা বা দীর্ঘ টুপি কি শুধুই বীরের আত্মরক্ষা, নারীর লজ্জা নামক ভূষণ বা গোয়েন্দার গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহৃত হতো? অতীতে কি মড়ক ছিল না? ছিল ত' বটেই। "ইলিয়াড"-এর হোমারে যেমন গ্রিক শিবিরে পেটের পীড়া ছড়িয়ে পড়ার বিবরণ আছে। শেখ সাদির কাব্যে দামেস্ক নগরীতে এক কঠিন দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর বিবরণ আছে। মিশরের নৃপতির স্বপ্ন ব্যখ্যা করে নবী ইউসুফ বা জোসেফ সাত বছরের সমৃদ্ধির পর সাত বছরের খরা, দূর্ভিক্ষ ও মড়কের কথা বলেছিলেন। বৌদ্ধ ভারতের জাতক কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের "অভিসার''-এ নগরের নর্তকী বাসবদত্তার রূপ-লাবণ্যময় আহ্বান উপেক্ষা করে সুদর্শন, তরুণ সন্ন্যাসী উপগুপ্ত জানান,
অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে?/ এখনো আমার সময় হয়নি,/ যেথায় চলেছ, যাও তুমি ধনী,/ সময় যেদিন আসিবে, / আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে।
প্রায় এক বছর পর ফিরে চৈত্র এলে নগর প্রাচীরের বাইরে কলহাস্যময় জনতা গুটি বসন্তে সংক্রমিত বাসবদত্তাকে সংক্রমণের ভয়ে ফেলে রেখে গেলে, উপগুপ্ত সেই অসুস্থ নারীর মুখে শীতল জল ছিটিয়ে ও সারা দেহে চন্দন মাখিয়ে শুশ্রুষার চেষ্টা করে জানান যে আজ রজনীতে তাঁর অভিসারের সময় হয়েছে এবং বাসবদত্তার কাছে তিনি এসেছেন। পুরো ঘটনায় সেই জাতকের সময়ের ভারতের মড়কের একটি বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নগর গণিকা বাসবদত্তাকে সমাজের নানা মানুষের সংস্পর্শে আসতে হতো বলে সংক্রমিত হবার ঝুঁকিও ছিল পুরলক্ষীদের চেয়ে বেশি। চন্দন প্রলেপ দিয়ে গুটি বসন্তের সাথে লড়াইয়ের বিবরণও জানা যাচ্ছে। পুরগণিকার রূপ-মদিরা গ্রহণে অনিচ্ছুক ভিক্ষু উপগুপ্ত তার অসুস্থতার সময়ে সেবার মাধ্যমে "অভিসারের নতুন সংজ্ঞা জানান ও শ্রেষ্ঠী-পুরোহিত শাসিত ভারতে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব কিভাবে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছিল সেটাও এই আখ্যান থেকে স্পষ্ট। বাংলাদেশের রাখাইন আদিবাসী বা মিয়ানমারে রাখাইন বা বার্মিজ বৌদ্ধ কিশোরী-তরুণীদের ভেতর মুখে চন্দনের প্রলেপ মেখে সারাদিনের কাজ করার সংস্কৃতি রয়েছে যা সারা দিনের কায়িক শ্রম ও রোদের ভেতরেও এক সহজাত, প্রাকৃতিক রূপচর্চা। এমনকি রোহিঙ্গা নারীদের ভেতরেও মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা এই অভ্যাস চোখে পড়বে।
প্রাচীন যুগ থেকেই আমাদের সভ্যতার বিবরণে মুখোশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। শুরুতে মানবসভ্যতায় শেষকৃত্যের সময় মুখোশ বেশি ব্যবহার করা হত। মিশরের সমাধিক্ষেত্রগুলোয় মৃতের মুখে একটি সোনার পাত লাগিয়ে দেয়া হতো যাতে করে মৃতের মুখে পচন না ছড়ায়। এরপর সভ্যতা আরো অগ্রসর হলে গাছের বাকল এবং চামড়া আর মোমের মিশ্রণেও মুখোশ প্রস্তুত হতে থাকে। অবশেষে ইতালীর ভেনিসে মখমল বা কালো সাটিনের মুখোশ তৈরি হলো এবং রেনেসাঁর সময়ে গোটা ইউরোপে এই মুখোশ পরা ছিল খুবই ফ্যাশন-দুরস্থ এক বিষয় (কমেডি ডেল আর্টে)। গ্রাম-বাংলায় চৈত্রের গাজনে এবং তারই ধারাবাহিকতায় নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মুখোশের মিছিল আমরা দেখেছি। খেয়াল রাখতে হবে যে চৈত্রের শেষের দিকটায় একটা সময় বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত কলেরা বা উদরাময়, ওল-উঠা, গুটি বসন্ত প্রভৃতি রোগ। এসবের সাথে পথ্য হিসেবে বিভিন্ন ধরণের শাক বা তিতা খাওয়ার পাশাপাশি এই মুখোশ মিছিলের কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেটা গবেষণা করা যেতে পারে। যাতে হাওয়ায় বাহিত বিভিন্ন বীজাণু সংক্রমিত না হয়!
মুখোশ যখন মানুষের রক্ষায়
আজ থেকে ২,০০০ বছর আগে রোমকরা প্রথম সুরক্ষা মুখোশ আবিষ্কার করে। প্রাণীর মূত্রথলে দিয়ে নির্মিত এই মুখোশগুলো খনিতে শ্রমিকদের বিষাক্ত হাওয়া থেকে রক্ষা করতেও ব্যবহৃত হতো। ষোড়শ শতকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এই মুখোশ সংস্কার করেন এবং নাবিকদের মুখের উপর একটি ভেজা কাপড়ের মুখোশ ব্যবহারের প্রস্তাব দেন যা কিনা নাবিকদের নৌযুদ্ধের সময় নানা রাসায়নিক অস্ত্রের বিক্রিয়া থেকে বাঁচাবে।
চৌদ্দ থেকে আঠারো শতকের ভেতর ইউরোপে কয়েক দফা মড়ক দেখা দিলে ডাক্তাররা সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। আক্রান্ত রোগীর কাছে গেলে রোগীর মুখ ও নাসারন্ধ্র থেকে ছড়িয়ে পড়া জীবাণু ডাক্তারদেরও সংক্রমিত করতো। লুই ত্রয়োদশের ডাক্তার শার্ল দ্যু লোরমে তখন পাখির ঠোঁটের মত দুটো গর্ত সম্বলিত একটি মুখোশ তৈরি করেন যেটা পরলে উক্ত দুই গর্ত বা ছিদ্রপথে ডাক্তাররা শ্বাস নিতে পারবেন। একটি সেদ্ধ পিচবোর্ডে দু'টি গর্ত তৈরি করে এমনটা করা হতো আর ভেতরে রাখা হতো শুকনো ফুল, সুগন্ধযুক্ত গুল্ম, মশলা বা কর্পূর জাতীয় নানা জীবাণুনাশক উপাদান।
আঠারো শতক বা শিল্প বিপ্লবের সময়ে অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠলে ইতালীর বার্নানো রামাজ্জিনি পেশাগত পরিচ্ছন্নতার জনক হিসেবে আবির্ভূত হন। অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে কর্মরত শ্রমিকদের মুখে গজ কাপড় আচ্ছাদিত করার প্রথা তিনিই চালু করেন। গোর খোদক, নদর্মা সাফকারী বা এমনকি হাসপাতালের কর্মীদের জন্য নাক ও মুখ বরাবর ভেজা এক টুকরো স্পঞ্জের উপর পাতলা তবে শক্ত এক টুকরো কাপড় রেখে তার সাথে ভিনেগার বা লেবুপানি মাখিয়ে এক নতুন ধরণের মুখোশ আবিষ্কার করা হয়েছিল। এছাড়াও রং গুঁড়াকারী, প্লাস্টারকারী বা টুপি প্রস্তুতকারীদের জন্যও এই মুখোশ ব্যবহার করা হতো। উনিশ শতকের শেষে এক জার্মান ডাক্তার প্রথম সাজির্ক্যাল অপারেশন বা অস্ত্রোপচারের সময় ডাক্তারদের জন্য সার্জিক্যাল মাস্ক পরার নিয়ম চালু করেন।
১৯১৪-১৮ সালের প্রথম মহাযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ দেশের প্রতি কম্ব্যাট গ্যাসের ব্যবহার শুরু হলে, ১৯১৫ সালের এপ্রিলে জার্মান বাহিনী কর্তৃক মিত্রশক্তির উপর প্রথম গ্যাস বোমা হামলার এক সপ্তাহের ভেতরই গজ কাপড়ের মুখোশ তৈরি করে ফেলে মিত্র বাহিনী যা পরলে গ্যাস বোমার বিষাক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যেহেতু এই গজ কাপড়ের মুখোশ এমন সব রসায়নে ভেজানো হত যাতে করে ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
হালের সার্জিক্যাল বা মেডিক্যাল মাস্কের বহু আগেই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা মড়কের সময় পাখির ঠোঁটের আকৃতির মুখোশ পরতেন ডাক্তাররা। সেসময় মানুষ বিশ্বাস করতো যে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া দূর্গন্ধ থেকে মানুষ অসুস্থ বা সংক্রমিত হয়। এজন্যই পাখির ঠোঁটের আকৃতির এই মুখোশের ভেতর ভেষজ লতাপাতা, সুগন্ধী মশলা ও শুকনো ফুল রাখা হতো দূর্গন্ধ তাড়ানোর জন্য।
উত্তর আমেরিকায় ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মড়ক ছড়িয়ে পড়ার আগে সাজর্নরা মুখোশ পড়তেন। কিন্তু মড়ক যখন ছড়িয়ে পড়লো, তখন গোটা পৃথিবীর সব শহরে মুখোশ তৈরির প্রবিধান চালু হলো। ঐতিহাসিক ন্যান্সি টোমসের মতে মার্কিনী জনতা মুখোশ পরাকে "জন চৈতন্য ও শৃঙ্খলার প্রতী'' হিসেবে গ্রহণ করলো। ইতোপূর্বে মোজা বোনা ও সৈন্যদের জন্য ব্যান্ডেজ তৈরিতে ব্যপৃত নারীরা মুখোশ তৈরিকে তাদের দেশপ্রেমিক কর্তব্য হিসেবে মেনে নিল। তবে ১৯১৮ সালের সেই মড়কের সময় মার্কিনীদের মত কানাডীয়রা শুরুতেই মাস্ক বা মুখোশ পরায় আপত্তি জানায়। ঐতিহাসিক জেনিস ডিকিন ম্যাকগিনিসের মতে মুখোশ পরার নিয়ম সত্ত্বেও মানুষ পরতো না বা শুধুমাত্র পুলিশ ঘটনাস্থলেই এলে দ্রুত মুখোশ পরে নিত।
জাপানে অবশ্য স্প্যানিশ ফ্লু-এর সময় থেকেই মানুষ মুখোশ পরতো। সমাজতত্ত্ববিদ মিতসুতোশি হোরির মতে তখন মুখোশ পরাটা জাপানী সভ্যতায় "আধুনিকতার প্রতীক'' হিসেবে বিবোচিত হতে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরও জাপানীরা মুখোশ পরে বের হতো যতদিন না আর ১৯৭০ সাল নাগাদ মানব সভ্যতা অনেকগুলো ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সক্ষম হয়। তবে ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে এলার্জি বা বিশেষত: পলেন এলার্জি বা ফুলের রেণু থেকে সৃষ্ট এলার্জি নিরোধে মাস্ক পরার অভ্যাস পুনরায় দেখা দেয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের "দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক" বা শহীদুল জহিরের "সেই সময়"-এ পলেন এলার্জির ভাল বিবরণ পাওয়া যায়। একুশ শতকে সার্স ভাইরাস ও এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার পর থেকে আবার মাস্ক পরার প্রচল বাড়ে। মিতসুতোশি হোরির মতে, "মানুষের মাস্ক পরা হচ্ছে এই নিও-লিবারেল সময়ে রাষ্ট্রগুলোর স্বাস্থ্য নীতির প্রতি মানুষের উত্তর'' যেখানে কিনা ব্যক্তি নাগরিককে নিজেরই নিজের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার দিকটি দেখতে হয়।
একুশ শতকে সার্স সংক্রমণের সময় চীন সরকার তার নাগরিকদের মাস্ক বা মুখোশ পরার মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকানোর পরামর্শ দেয়। গত বছর কানাডায় এক চৈনিক ছাত্র যে মাত্রই উহান প্রদেশে তার বাবা-মা'র কাছ থেকে ফিরেছিল, তার কোভিড-১৯ দেখা দেয়। তবে সে কানাডায় ফেরার পথে মাস্ক পরেছিল এবং কানাডায় পৌঁছেও কোয়ারেন্টাইনে ছিল বলে অন্য কাউকে সে সংক্রমিত করেনি।
শেষকথা: মাস্ক নিয়ে যত যাই বলি না কেন আমরা, যেহেতু কোভিডের দ্বিতীয় বর্ষে আমরা পা রাখলাম এবং ফাইজারের টিকা আমাদের গরম আবহাওয়ায় কার্যকরী হবে না এবং অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনের দুটো ডোজ নিয়েও পুরো আস্থা অর্জন করা যাচ্ছে না, আমাদের সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সবাই মাস্ক পরুন, নিজে সুরক্ষিত থাকুন এবং অন্যকেও সুরক্ষিত রাখুন।