কয়লা কাহিনী
শিল্প যুগের শক্তি যোগানো কয়লাই এই গ্রহকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বাববার এর পেছনে লুকিয়ে থাকা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক তেরোটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত একটি প্রধান বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় লাগাম টেনে ধরতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শতকের শেষদিকে মার্কিন অর্থনীতির মোট আকারের প্রায় দশ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত জাতি সংঘের সায়েন্টিফিক প্যানেল অন গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে চরম বিপর্যয় রুখতে হলে আগামী কয়েক বছরের ভেতরই বিশ্ব অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এই পরিবর্তনের মূল কথা: যত দ্রুত সম্ভব কয়লার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসা।
কিন্তু বিশ্ব নেতৃত্ব সক্রিয় হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও প্যারিস চুক্তির পর তিন বছর পেরুনো সত্ত্বেও কয়লার অন্তর্ধানের আলামত চোখে পড়েনি। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির এক মূল্যায়নে শেষতক বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহার নিশ্চিতভাবেই কমে আসবে বলে মনে হলেও পরিবেশগত পরিবর্তনের চরম ক্ষতি ঠেকানোর পক্ষে যথেষ্ট দ্রুত সেটি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তবিক টানা দুই বছরের কমতির ধারায় থাকার পর গেল বছর বৈশ্বিক কয়লা উৎপাদন ও ব্যবহার দুটোই বাড়ন্ত। সস্তা, পর্যাপ্ত এবং সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণকারী কয়লা সারা দুনিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের একক বৃহত্তম উৎস হয়ে আছে। সৌর এবং বায়ু শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তিগুলো সহজলভ্য হয়ে উঠলেও এমনটা ঘটছে। অচিরেই সমর্থকদের কাছে কয়লা অর্থনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে ফেলবে।
তাহলে কয়লা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন কেন?
তার কারণ কয়লা বেশ শক্তিশালী জিনিস। জমির নিচে কয়েক মিলিয়ন টন কয়লা মওজুদ রয়েছে। শক্তিশালী সরকারগুলোর মদদপুষ্ট বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান প্রায়ই সাবসিডিয়ারির চেহারায় বাজার তৈরির জন্যে হাত ছাড়া হওয়ার আগেই উঠে পড়ে লাগে। ব্যাংকগুলো এখনও এথেকে ফায়দা লুটছে। সুবিশাল জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের নকশা করা হচ্ছে। কয়লা ভিত্তিক কারখানাগুলো আবার রাজনীতিকদের তরফে সস্তায় বিদ্যুৎ যোগানোর- এবং নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার- নিশ্চিত উপায়ও বটে। কোনও কোনও দেশে এটা উৎকোচের একটা লোভনীয় উৎস হয়ে আছে।
এমনকি নবায়নযোগ্য শক্তির দ্রুত বিস্তার ঘটলেও এখনও তার সীমাবদ্ধতা রয়েই গেছে। বাতাস বইলে বা সূর্য উঠলেই বায়ু বা সৌর শক্তির দেখা মেলে। সেজন্যে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের নতুন সংস্কার দরকার।
'কয়লা ভিত্তিক কারখানার এখনও টিকে থাকার মূল কারণ আমরা আগেই এটা নির্মাণ করে ফেলেছি,' বলছেন ভারতের কয়লা বিশেষজ্ঞ হার্ভাডে এনার্জি পলিসি সংক্রান্ত বিষয়ে পিএইডডি ডিগ্রি অর্জনকারী রোহিত চন্দ্র।
কয়লার ভবিষ্যৎ নিয়ে যুদ্ধ চলছে এশিয়ায়
গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের আবাস এশিয়াই এখন কয়লার বৈশ্বিক ভোক্তার চার ভাগের তিনভাগের প্রতিনিধিত্ব করছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনার পর্যায়ে থাকা চার ভাগের তিন ভাগের বেশি কয়লা ভিত্তিক কারখানা রয়েছে এশিয়াতেই। কয়লার ক্রমবিকাশ পর্যালোচনাকারী জার্মান প্রচারণা গ্রুপ আর্জেওয়াল্ড-এর মতে যার সংখ্যা সব মিলিয়ে ১২০০র মতো। আর্জেওয়াল্ডের প্রধান হেফ্ফাশাকিং এইসব কারখানাকে 'প্যারিস লক্ষ্যমাত্রার প্রতি চরম আঘাত' বলছেন।
ইন্দোনেশিয়া আরও বেশি হারে কয়লা উত্তোলন করছে। ভিয়েতনাম আরও নতুন নতুন কয়লা ভিত্তিক কারখানা নির্মাণের লক্ষ্যে জমি পরিষ্কার করছে। ২০১১ সালে ঘটা পারমাণবিক চুল্লীর বিপর্যয় সত্ত্বেও কয়লাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
তবে বিশ্বের মূল বোঝা হচ্ছে চীন। এই দেশটি সারা দুনিয়ার অর্ধেক কয়লা ব্যবহার করে। চীনের বিভিন্ন কয়লা খনিতে ৪.৩ মিলিয়নেরও বেশি শ্রমিক নিয়োজিত। ২০০২ সালের পর থেকে চীন বিশ্বের কয়লা উৎপাদনের ৪০% যোগ করেছে, মাত্র ১৬ বছরের ভেতরই এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। 'তিন দফা হিসাব করতে হয়েছে আমাকে,' বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির একজন উর্ধ্বতন এনার্জি অ্যানালিস্ট কার্লোস ফের্নান্দেস আলভারেস। 'ভেবেছিলাম ভুল হচ্ছে। এটা পাগলামি।'
বায়ু দূষণের কারণে প্রবল প্রতিবাদের ফলে চীন এখন সৌর এবং বায়ু শক্তি স্থাপনার ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতায় পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কয়লা ভিত্তিক কারখানা নির্মাণ শ্লথ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কয়লার বিকল্পের পক্ষে প্রচারণাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষকদের একটি দল নতুন নতুন কারাখানা নির্মাণ অব্যাহত এবং অন্যান্য প্রকল্প বন্ধ করার বদলে স্রেফ ধীর গতিতে চালানো হচ্ছে বলে উপসংহারে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালে চীনের কয়লা ব্যবহার বেড়েছে, যদিও সেটা আগের চেয়ে কম। ২০১৮ সালে তা আবার বাড়তে শুরু করে।
চীনের কয়লা শিল্প এখন কেনিয়া থেকে পাকিস্তানে নতুন বাজারের খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর্জেওয়াল্ডের সূত্রে চীনা কোম্পানিগুলো সতেরোটি দেশে কয়লা ভিত্তিক কারখানা নির্মাণ করছে বলে জানা যায়। দেশটির আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ জাপানও যোগ দিয়েছে এই খেলায়। মূলত জাপানি ব্যাংকের অর্থায়ন ভিত্তিক জাপানি কোম্পানিগুলোর পরিকল্পিত কয়লা প্রকল্পের প্রায় ৬০ ভাগই দেশের বাইরে।
কয়লার বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশ্বের শেষ সীমান্ত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশেষ লক্ষণীয়।
'এমনকি গাছপালাও মারা পড়ছে।'
ভিয়েতনামে খুব কাছ থেকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যক্ষ করেছেন ন্গাইথিকাহন। যুদ্ধাবসানের এক বছর পর ১৯৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় বাড়ির কাজ করার কথা মনে আছে তার। উত্তরাঞ্চলীয় গ্রামে দিনে বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যেত। বৃষ্টির সময় বিদ্যুতের দেখা মিলত না। আবার বিদ্যুৎ এলেও সেটা আসতো অনতিদূরের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। তার মা কাপড় শুকোতে দিলে ছাইয়ের আস্তর পড়ত তাতে।
আজ ভিয়েতনামের ৯৫ মিলিয়ন মানুষের প্রায় প্রতিটি ঘরেই বিদ্যুৎ আছে। মিস ন্গাইয়ের এখনকার আবাস রাজধানী হ্যানয়ে নির্মাণের হুজুগ শুরু হওয়ায় সিমেন্ট আর লোহার চাহিদা হু-হু করে বাড়ছে- এদুটোই প্রচুর শক্তি হজম করে। অর্থনীতি লাফিয়ে ছুটছে। এবং ১৬০০ কিলোমিটারব্যাপী সাগর উপকূল বরাবর মূল জাপান ও চীনের বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি কয়লা ভিত্তিক কারখানা নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এমনি একটা প্রকল্প পড়েছে হ্যানয়ের দক্ষিণের এক জেলে গ্রাম ন্গি সনে। এখন এটা সুবিস্তৃত শিল্প এলাকায় পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালে এখানে প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। জাপানী সাহায্য সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশরন এজেন্সির খরচে জাপানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মারুবেনি এটা নির্মাণ করে।
আরও বিশাল দ্বিতীয় কয়লা ভিত্তিক কারখানাটি তৈরি হচ্ছে এর পাশেই। এটাও একটি কোরিয় কোম্পানির পাশাপাশি মারুবেনিই নির্মাণ করছে। ব্যক্তিখাতের অর্থযোগানদারদের অর্থিক ঝুঁকি হ্রাসে নিয়োজিত জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন নামে একটি রপ্তানি ঋণ প্রতিষ্ঠান অর্থায়নে সহায়তা দিচ্ছে।
ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ছায়ায় ন্গায়েন থি থু থিয়েন রাস্তার ধারে চিংড়ি শুকোনোর সময় তিক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করছিলেন। বাড়ির সামনেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি ছাইয়ের কূপ খনন করার পর বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন তিনি। 'কয়লার গুঁড়ো আমার বাড়িটা কালো করে ফেলেছে,' বলেছেন তিনি। 'এমনকি গাছপালাও মারা যাচ্ছে। ওখানে থাকা সম্ভব না।'
নতুন কারখানার জন্যে নতুন বন্দরের দরকার হবে, তাই রাস্তার ধারে চিংড়ি শুকোতে দেওয়া অন্যরাও ভীষণ ক্ষুব্ধ। এর ফলে ওখানে জেলে নৌকা বেঁধে রাখা তাদের স্বামীরা বাস্তুচ্যুত হবে।
মহিলারা চিংড়ি ভর্তি ঝুড়ি খালাস করার সময় ধূলি উড়িয়ে সাঁই সাঁই ট্রাক যাচ্ছে। চওড়া কিনারার টুপি, মুখের মুখোশ, দস্তানায় শরীর ঢেকে রেখেছেন ওরা। ।
এখন দেশের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতার ৩৬ শতাংশই কয়লার অবদান। সরকারী হিসাবে ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৪২ শতাংশে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এইসব কারখানা চালাতে ২০৩০ সাল নাগাদ ৯০ মিলিয়ন টন কয়লার দরকার হবে ভিয়েতনামের।
তবে কয়লা প্রকল্পগুলো সামাজিক বিরোধিতাও উস্কে দিচ্ছে, ভিন্নমত দমনকারী একটি দেশে যা বিরল। ২০১৫ সালে গ্রামবাসীরা দক্ষিণপুবে একটি চীনা প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে একটি মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ মেকং বদ্বীপে আরেকটি প্রকল্প বাতিল করেছেন।
ভিয়েতনামের বেশিরভাগ প্রকল্পই পুরোনো, দূষণ সৃষ্টিকারী প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মারুবেনিসহ বহু বিনিয়োগকারীই সম্প্রতি ভবিষ্যতে এইসব প্রকল্পে সহায়তা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইমেইলের মাধ্যমে জনৈক কোম্পানি মুখপাত্র বলেছেন, 'স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখতে' তারা ন্গি সন প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে।
ভিয়েতনাম বলছে প্যারিস চুক্তির অধীনে নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথেই রয়েছে দেশটি। তেমনি ঢের বিশাল কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে চীনা ও ভারতও একই কথা বলছে। কিন্তু এইসব লক্ষ্যমাত্রা দেশগুলো নিজেরাই স্থির করেছে, এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রার বিপর্যয়কর স্তরে পৌঁছানো ঠেকাতে তা যথেষ্ট হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে।
আগামী ডিসেম্বরে পোল্যান্ডের কয়লার প্রাণকেন্দ্রে অনুষ্ঠেয় অন্তার্জাতিক জলবায়ু বিষয়ক আলোচনা শুরুর আগে এইসব বিষয় সামনে এসে পড়ছে। আমেরিকার প্রতিনিধি দল ওই সম্মেলনে কয়লার পক্ষে বক্তব্য রাখার পরিকল্পনা করছে, ঠিক জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত গেল বারের আলোচনার মতো।
সাধারণ মানুষের মনে কয়লা শ্রমিকরা বহুদিন থেকে শিল্পের পৌরুষের প্রতীক হয়ে আছে। কঠোর দৈহিক শ্রমের যুগ যখন রোবট নয়, শ্রম, বিশেষত পুরুষের শ্রমই অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে গতি দিয়েছে।
এই ধারণাটিই রাজনীতির মূলে রয়ে গেছে। জার্মান খনি শ্রমিকরা দেশটির চরম দক্ষিণপন্থী দলের সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছে। পোল্যান্ডের ডানপন্থী সরকার নতুন কয়লা খনি উদ্বোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন কয়লার সমর্থক হিসাবেই ক্ষমতায় এসেছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়লা খনির কাজকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সফল হননি। তবে কয়লা চালিত বিদুৎ কেন্দ্রের নিঃসরণ হ্রাস সম্পর্কিত নিয়মকানুন শিথিল করতে এনভায়োরনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তার এই বার্তা আমেকিরায় সমাদর পেয়ে থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সুবিধার নয়। প্রাকৃতিক গ্যাসসহ আরও সস্তা জ্বালানি রয়েছে। এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩১ ভাগই আসছে গ্যাস থেকে। বাণিজ্য যুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়লা আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ২০১০ সালের পর থেকে এযাবৎ দুই শোটিরও বেশি কয়লা ভিত্তিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাম্পের মিথ্যা দাবি সত্ত্বেও কয়লার ব্যবহার ক্রমেই কমছে। ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম দেড় বছরে এই ব্যবহার মোটামুটি ৪ শতাংশ বাড়লেও গত এক দশকে কয়লা খনিতে কাজের সংখ্যা বিপুলভাবে কমেছে।
'আমাদের হাতে কয়লা আছে, প্রতি বছর আরও বেশি কয়লা উৎপাদন করছি আমরা।'
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ১৩০ কোটি মানুষের ভারতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ একেবারেই ভিন্ন। মধ্য ভারতীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার জ্বালানির দায়িত্বে থাকা পেশাদার সিভিল সার্ভেন্ট অজয় মিশ্র এটা জানেন।
পাঁচ বছর আগে প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে রাজ্যটির অবস্থা ছিল জেরবার। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের সময়ও সিলিং ফ্যান থমকে যেত। বিভিন্ন কলকারখানা চলত ডিজেল চালিত এঞ্জিনে। তেলেঙ্গানার মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
বিদ্যুৎ সমস্যা মেটাতে রাজ্য কর্মকর্তাদের একটা কিছু করা জরুরি হয়ে পড়ে। সূর্যের লাগাম টেনে কিছু সময়ের জন্যে তারা তেলেঙ্গানাকে ভারতের নেতৃস্থানীয় সৌর শক্তি উৎপাদক রাজ্যে পরিণত করেন। শত শত বছর ধরে সরকারী কর্মকর্তারা মধ্য ভারতের পাহাড়পর্বত এবং বনের মাটির তলায় বিস্তৃত কয়লার বিশাল খনির উপর ভরসা করে ছিলেন।
তেলেঙ্গানায় এখন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু থাকে। কৃষকরা জল সেঁচের জন্যে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। গত বছর এই সুবাদে তেলেঙ্গানার মূখ্য নির্বাচিত কর্মকর্তা কে. চন্দ্রশেখর রাওয়ের নির্বাচনী বৈতরণী পেরুনো সহজ হয়েছে।
'আমাদের হাতে কয়লা আছে,' বলেছেন মিশ্র। 'প্রতি বছর আরও বেশি কয়লা উৎপাদন করছি আমরা। আগামী ১০০ বছর এটা আমাদের হাতে থাকবে।'
তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদ থেকে চার ঘণ্টার দূ ভচ্টাচ পুলি শ্যাফটের গভীর থেকে থেকে গভীরে নিয়ে যায় তাদের। পুলির ক্যাঁচক্যাচ আর জমিনের গভীরে ঝরে পড়া টুপটাপ পানির শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। এখানে ওখানে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে খনি শ্রমিকরা, অন্ধকারে শরীরের বেল্টে লাগানো ফ্লাশ লাইটের ঝলক বাদে ওদের অবয়ব কোনওমতে চোখ পড়ে।
জমি থেকে আনুমানিক ৯০০ ফুট গভীরে কালো শীতল বাতাসে পায়ের নিচে নরম ভেজা কয়লা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় খনির দেয়াল ধসে পড়ল। ছোট ছোট টুকরো টাবে তুলে বাইরে এনে কয়লার ট্রাকে বোঝাই করার পর চারদিকে চিকিচিকে আস্তর ফেলে গ্রামের রাস্তা ধরে ছুটল ওগুলো।
কয়লা উৎপাদনে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ বিশাল। তাই উপরের খনিসহ সমস্ত কয়লা খনিই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। তেমনি বেশিরভাগ বিদুৎকেন্দ্রও। কয়লা দেশটির বিশাল রেলওয়ে নেটওয়ার্কে ভর্তূকী যোগায়।
ভারতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বিশুদ্ধ জ্বলানির প্রবক্তা হিসাবে তুলে ধরতে চান। কিন্তু মোদী কয়লা খনিও উদ্বোধন করে চলেছেন। তার সরকার পরিবেশবাদীদের ক্ষেপিয়ে তুলে খনিসহ শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান ত্বরান্বিত করেছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো দেশ জুড়ে নতুন নতুন কয়লা চালিত কারখানা নির্মাণ করছে। সবগুলোই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অর্থায়ন করছে।
নয়া দিল্লীতে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের জ্বালানি সচিব অজয় ভালা ৫০ গিগাওয়াটের অতিরিক্ত ক্ষমতার উৎপাদনের কাজ চলার কথা বলেছেন। এমনকি এক দশক আগেও ভারতের বিদ্যুৎ বিপুল চাহিদা হিসাবের সময়ের একটা ভগ্নাংশ মাত্র এটা। এসব কারখানার অনেকগুলোরই আরও বেশি দূষণকারী পুরোনোগুলোকে প্রতিস্থাপিত করার কথা ছিল। কিন্তু সহসা কয়লার বিদায়ের সম্ভাবনা নেই, বলেছেন তিনি। অন্তত যতক্ষণ না সৌর ও বায়ু শক্তি মওজুদ করার সাশ্রয়ী এবং দক্ষ কৌশলের দেখা মিলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতকে অবশ্যই কয়লা পরবর্তী যুগের উপযোগী করে বিদ্যুৎ গ্রিডকে ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যাটারি প্রযুক্তি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। মাইক্রোগ্রিড প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। বর্তমানে বহু কয়লা ভিত্তিক কারখানা উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করছে, বেশ কিছু অলস পড়ে আছে। নতুন জ্বলানি দক্ষতা চাহিদাকে এমন একটা পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারে যখন ব্যয়বহুল কয়লা ভিত্তিক কারখানাগুলো বাড়তি হয়ে পড়বে। পরিত্যক্ত এই সম্পদ অর্থায়নকারী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই বর্তাবে।
আপাতত ভারতের জ্বলানির ৫৮ ভাগই আসছে কয়লা থেকে।
'আমি ইচ্ছা করে কয়লা ব্যবহার করছি, ব্যাপারটা তা নয়,' বলেছেন ভালা। 'কিন্তু উপায় নেই।'