গঘতরিকা, সাঁইত্রিশ যোগেতে…
``আগমে আছে প্রকাশে ষোলকলাই পূর্ণশশী
পনেরই পূর্ণমাসী শুনে মনের ঘোর গেল না।।
সাতাইশ নক্ষত্র সাঁইত্রিশ যোগেতে
কোন সময় চলে সাঁইত্রিশেতে``।।
- লালন
কথা সামান্যই
তাঁকে কী নামে ডাকে লোকে?
গঘ?
ভিলহেম?
ভ্যান গঘ?
ভিনসেন্ট?
`আগম-নিগম চরাচরে- তারেই ভিন্ন জাত বলে`।
ঘরের আদুরে শিশুকে যেমন স্নেহাতিশয্যে নানা নামে ডাকা হয়, তেমনি আমাদের শিল্পের বরপুত্রকে আমরা আমাদের পছন্দের নামে ডাকতে পারি। একটা সময়ে নিতান্ত আত্মপরিজন আর পরিচিতরা ছাড়া তার নামই বা কে জানতো? তাঁর মৃত্যু পরবর্তী ১৩০ বছরে গোটা দুনিয়ার যে সব মানুষ তার নাম জানেন তার হিসেবের সংখ্যাটি অনেক বড়। দিন দিন তা কেবল বেড়েই চলেছে।
পৃথিবীর মানুষের যৌথ সম্পদ ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ আছেন শুধু নয়, বেশ তীব্রভাবেই আছেন তার প্রমান এখনো তাঁকে নিয়ে আপামরদের আগ্রহ।
বাউন্ডুলে জীবনের তীব্র রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, আত্মদহন, বৈরাগ্যের তাড়নায় কত যে ডেরা বদল, কখনো রীতিমত ঘাড়ধাক্কা কিংবা উদ্বায়ী রোগের প্রকোপে ঠিকানা বদল হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। অথচ মাত্র শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত কিনা মাত্র ১০ বছরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের শিল্পপ্রকল্প কালটিতে তিনি প্রায় ২০০০ শিল্পকর্মের বিশাল তালিকা ধরিয়ে দিয়ে, দে চম্পট!
সিনা বরাবর গুলি চালিয়ে নিজেই তাঁর যে স্থায়ী ঠিকানা ক্যানভাস তা থেকে প্রস্থানের শেষ দৃশ্যটি ঝটপট এঁকে ফেলেন। এমন মনপুত বিদায় তাঁর আরাধ্য ছিল সে সিদ্ধান্ত আমাদের নিপাট সাধারণ প্রাণে মায়া ধরায়। এত কেবল বাউন্ডুলের ভিটে উচ্ছেদ নয়, জীবন উপেক্ষা করে বেপরোয়া আস্ফালনে আমাদের মায়াকে ম্লান করে দিয়ে মৃত্যুসিথানে সূর্যমুখী ও হলুদ-সহচরীদের অনুসরণ করতে বলে আগেই বুঝি সৃষ্টিকাজে দস্তখত এঁকে ছিলেন। আমরা কেবল সে সৃষ্টিকাজকে পড়তে শিখি। পড়তে হয় বলেই। যে পথের রচয়িতা স্বয়ং ভিনসেন্ট ভিলহেম ভ্যান গঘ।
"আমি ব্যক্তিগত উদ্ধত স্বর ছুঁড়ে ফেলেছি
কাঁধ থেকে অন্যের বোঝার মতো করে।
এই সেই রুক্ষ্ দেবদূত যার সঙ্গে মিশে ছিল
তুলির টান আমার রেখার টানে।
চলো, তোমায় নিয়ে যাই সেই দৃষ্টিপথে,
আকাশে, যেখানে তারাদের মাঝে স্পন্দিত ভ্যান গঘ।"
-আর্সেনেই তারকোভস্কি
দু'মাস ধরে ভ্যান গঘ তাঁর জন্য নির্ধারিত কক্ষের বাইরে যেতে পারেননি। তিনি তার বোনকে এক চিঠিতে লেখেন, 'কখন ও যদি আমি মাঠের মধ্যে যেতে পারতাম, এমন ভাবনার উদয় হলে নিঃসঙ্গতার এমন এক অনুভুতি আমাকে আবিষ্ট করে এবং এসব থেকে নির্গমনের জন্য অস্থির হয়ে উঠি...'। ভিনসেন্ট এসব দুশ্চিন্তা পরিহার করে ছবি আঁকতে শুরু করেন। এই সময়ে ভ্যান গঘ সেন্ট রেমি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চূড়ান্তভাবে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন। তিনি থিও'র সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলে থিও খোঁজখবর নিতে শুরু করেন এই ভেবে যে, এইবার প্যারিসের কাছাকাছি কোথাও ভিনসেন্টের চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করবেন।
গঘ হয়তো সত্যিই দেখতে পারত যাপনের মধ্যবর্তী শূন্যতাগুলো, স্বপ্নদের হারিয়ে যাওয়াগুলো! নাকি যন্ত্রণা পেরিয়ে যেতে যেতে স্রেফ অসহায় নিরুত্তাপ উচ্চারণ নেমে আসতো কন্ঠ বেয়ে!
"I heard the roar of a wave that could drown the whole world
I heard one hundred drummers whose hands were a-blazing
I heard ten thousand whispering and nobody listening
I heard one person starve, I heard many people laughing
Heard the song of a poet who died in the gutter
Heard the sound of a clown who cried in the alley
And it's a hard, it's a hard, it's a hard,
it's a hard And it's a hard rain's a-gonna fall…"
যে সময় টলস্টয় হতাশা এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্কটের সাথে লড়াই করছিলেন, প্রায় একই সময়ে ইউরোপের অন্য এক সৃজনশীল আইকন তাঁর নিজের মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যের অন্ধকারের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী কিছু শিল্পকর্ম আঁকছিলেন, তখন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ (জন্ম- মার্চ ৩০, ১৮৫৩, মৃত্যু -জুলাই ২৯, ১৮৯০) তাঁর যন্ত্রণাদায়ক মানসিক অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন - ঘন ঘন হতাশার পর্ব, উদ্বেগে নিশ্চল করে দেওয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলি জীবনে শেষবার দেখা দেয় ১৮৯০ সালে, তার সাঁইত্রিশতম জন্মদিনের ঠিক পরে।
ভাই থিওকে তাঁর উত্তাল স্বত্বা ও তৎজনিত ফলাফলের সঙ্গে তাকে একাকার করে লেখা। "জীবন আমার কাছে খুব প্রিয় হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে, এবং আমি খুব আনন্দিত যে আমি জীবনকে খুব ভালোবাসি। কেননা আমার জীবন এবং আমার ভালবাসা একীভূত।``
তাঁর ভালবাসবার এই এক চূড়ান্ত অহমিকা!
"... দু: খবোধ এবং চরম একাকীত্ব।"
ভিনসেন্টের কাছে থিওকে লেখা একটি অপ্রকাশিত চিঠিতে ভিনসেন্ট তার সাম্প্রতিক একটি চিত্রকর্মের বর্ণনা করেছেন: গমক্ষেতে কাক। তিনি বলেছিলেন যে এটি "অশান্ত আকাশের নীচে বিস্তীর্ণ গমক্ষেত চিত্রিত হয়েছে", তিনি আরও যোগ করেছেন: "দুঃখ এবং চরম একাকীত্ব প্রকাশ করার জন্য আমাকে আমার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে হয়নি।"
ঠিক আগের বছরের জুনে উন্মদাশ্রমের স্বযাচিত অতিথি মনের মত কোন মডেল না পেয়ে আঁকবার মতো জনমনুষ্যি হাতের কাছে না পেয়ে নিজের হৃদয়কেই তিনি ক্ষত বিক্ষত করতে শুরু করে দিয়েছেন। সেসব ধূসরিম আত্মচিত্রণে মানুষের আত্মপরিচয়কে ধরে রাখার প্রয়াস কী অপরিমেয় সৌন্দর্যেই না বিবৃত হয়ে আছে।
মাকে একটি চিঠিতে তিনি তখন লিখেছিলেন, `তোমাকে পাঠানো এই ছবিতে তুমি দেখতে পাবে, যদিও আমি প্যারিস লন্ডন এবং আরও কত মহানগরে ঘুরে বেড়িয়েছি, দেখতে এখনো জুন্ডার্টের এক চাষার মতোই আসলে রয়ে গেছি... আমার বিচারে চাষিদের চেয়ে আমি নিম্নতর বর্গের মানুষ। তফাৎটা হলো, ওরা মাঠে হালচাষ করে, আমি করি ছবিতে।`
এই অভিনিবেশ শিল্পঘটনায় তাঁর একান্ত সহজাত ও মজ্জাগত, হৃদ্গত সৌন্দর্য্যে দীপ্যমান। ভিনসেন্ট নিজেরই অস্তিত্বের গরজে ভাইয়ের কাছে তাঁর অন্তর্জীবন ব্যক্ত করেছিলেন।
সাঁইত্রিশ বছরের জীবন
ভিনসেন্ট ভিলহেম ভ্যান গঘ প্রণীত শিল্প তাঁর জীবনের বিষাদনাট্যের দৃষ্টান্ত হয়ে যায় সাঁইত্রিশ যোগেতে, আগমে হয় প্রকাশে ।
ঐতিহাসিক বিশ্বশিল্প চরিত্র। কল্পনার ভ্যান গঘ! যে গঘ তুখোড় প্রাণ। শিল্প পাগল। তাঁর লজিকের ধার ধারার টাইম কই? পাগল ব্যাকরণ ভাঙ্গে। যে ভিনসেন্ট চিহ্নায়কের আঘাত আর সনাতন শিল্পচিন্তার চিত্রকল্প ভাঙা তথা অনাগত কালের শিল্পের ইতিহাস লেখেন।
জাগিয়ে তোলেন।
জানিয়ে দেন।
নিজস্ব তরিকায়।