গাবোর সঙ্গে দ্বিতীয় দিন
মঙ্গলবার, এপ্রিল ৯
সকাল ৯:০০ টা
আজকে প্রায় পঞ্চাশ বছর হল গাবো তাঁর প্রথম টাইপরাইটারটা হারিয়েছেন—যেটা দিয়ে তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প "তেরসে রারে সিগনা সিওন" (তৃতীয় মৃত্যু) লিখতেন। বোগোতার শহরতলির একটা কমদামি হোস্টেলে বাস করা এক অসুখী আইন শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ক্যারিবীয় উপকূলের উত্তাপ খুব মিস করত সে। কদাচিৎ ক্লাসে যেত: আইনশিক্ষা, যে বিষয়ে পড়াটা তার পরিবারের চাওয়া ছিল, তাকে কখনোই টানে নি। ৯ এপ্রিল ১৯৪৮ তারিখের মধ্যাহ্নভোজের সময়ে গাবো খেতে বসতে যাবেন এমন সময় তিনি শুনতে পান যে হোর্হেএলিয়েসেরগাইতান্, কোলোম্বিয়ারপ্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামো যিনি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিলেন, নিহত হয়েছেন।
গাবো আমাদেরকে বলেন তিনি ঐ স্কয়্যারে গিয়েছিলেন "যেসব লোকেরা গাইতানদের রক্তে রুমাল ভিজাচ্ছিল"তাদেরকে খুঁজতে। বোগোতার রাস্তাগুলো পুড়ে গিয়েছিল এবং গাবোর টাইপরাইটার দাবানলের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছিল। কোলোম্বিয়া পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর নয় মাস পরে, এখানে কার্তেহানায়, উনিশ বছর বয়সে, গাবো সম্পাদকীয় লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূচনা করেন।
"একদিন আমি বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম এবং সাভালা, এল ইউনিবার্সোল-এর সম্পাদক, স্কয়্যারের বাইরে তাঁর টাইপরাইটার নিয়ে বসেছিলেন। আমাকে বললেন, 'আমি তোমাকে চিনি'। বলেন, 'এল এস্পেক্তাদোর-এর ছোটগল্পগুলোর লেখক তুমি। আমার সঙ্গে বসে এই যে সম্পাদকীয়টা লেখা শেষ করছি সেটাতে আমাকে সাহায্য কর না কেন তুমি?" আমি কিছু একটা লিখলাম। সাবালা তাঁর পেন্সিল বের করলেন এবং কিছু জিনিস কেটে বাদ দিলেন। পরেরবার যখন আমি সম্পাদকীয় লিখি তখন তিনি কয়েকটামাত্র জিনিস বাদ দিলেন। তৃতীয় বার নাগাদ আমি সম্পাদনাহীনভাবে লিখতে শুরু করি। আমি সাংবাদিক হয়ে গেলাম।"
তিনি আজকে আমার পাশে বসে আছেন। সাদা গুয়াইয়াবেরা পরেন নি, পরেছেন ফিরোজা রঙের ছোটহাতা শার্ট। জুতা সাদাই। তাঁর সঙ্গে আমার সংযোগ দূরবর্তী মনে হচ্ছে কিন্তু আমি এখনো তাঁর গল্পে মজে আছি।
"গল্প লিখে আমি টাকা কামাতে শুরু করি যখন আমার বয়স চুয়াল্লিশ,"তিনি আমাদেরকে বলেন, "প্রথম বাড়ি কিনেছিলাম, যেটা কুয়েরনাবাকা-য়, ১৯৭০ সালের, আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হওয়ার তেইশ বছর পরে। আমি হিসাব করে দেখেছিলাম, আমার ছেলেদেরকে মুভি দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন বারো পৃষ্ঠা লিখতে হত আমাকে, এবং মুভি দেখাতে নিয়ে যাওয়া আর আইসক্রিম কিনে দেওয়ার জন্য লিখতে হত বিশ পৃষ্ঠা। যখন প্যারি-তে ছিলাম, একটানা লিখতাম না এবং অধিকাংশ সময় রাতেই লিখতাম। দিনের বেলা পেটে দানাপানি দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হত আমাকে। এখন আমি জানি দিনের বেলায় লেখাই ভালো, কম্পিউটারে, ভরপেটে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়।"
কফি বিরতি
ফাউন্ডেশনের পরিচালক হাইমেআলবেইয়ো একজন আলোকচিত্রী ঠিক করেছেন এবং আমাদেরকে একটা গ্রুপছবি তোলার জন্য জড়ো করেছেন। এই ফাউন্ডেশন কোনো সনদপত্র দেয় না: "জীবন তার নিজের বিচারেই ঠিক করে দেবে কে যোগ্য আর কে যোগ্য নয়," গাবো বলেছেন। "নিদেনপক্ষে একটা স্মারক হাতে নিয়ে তোমরা সবাই ফিরে যেতে পার,"জেইমে বলেন। "আস, সিঁড়িতে বস।"
গাবো আত্মতৃপ্ত এবং মাঝখানে বসেন। এল ইউনিবার্সোল-এর আলোকচিত্রী আমাদেরকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্য করবার নির্দেশ দেন।
"রাখেন,"বলে চিৎকার করে ওঠেন কেন্দ্রের পরিচালক। "আমি গাবোর সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।"তিনি আমাদেরকে ডিঙিয়ে ওঠেন এবং তাঁর পাশে গিয়ে বসেন।
দুপুর ১:০০ টা
এ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ফিদেল কাস্ত্রোকে আসতেই হয়েছিল। আমরা, বা বলা উচিত আমি, মোক্ষম মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলাম। নীতি বিষয়ে কথা বলতে চান গাবো: একজন প্রতিবেদকের কি উচিত অনুদ্ঘাটিত কোনো নথি পড়া, যেটাতে'সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ'করার সুযোগ থাকে?
তাঁর প্রশ্নটা আমাকে একটা সুযোগ করে দেয়। "এ-ধরনের একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল,"আমি বলি। ১৯৯১ সালে গুয়াদালাহারায় অনুষ্ঠিত প্রথম ইবেরো-আমেরিকান প্রেসিডেন্শিয়াল সামিট-এর উদ্বোধনী সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। কাস্ত্রোকে বলা হয়েছিল প্রত্যেক সম্মানিত বক্তাকে তাঁর বক্তৃতা সাত মিনিট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সবাই ভয়ে ভয়েকাস্ত্রোর পালা আসার অপেক্ষায় ছিলেন, কেননা তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার কথা সর্বজনবিদিত। আমরা সবাই ভাবছিলাম কাস্ত্রো, যিনি ১৯৫৯ সালে বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার পরের দিন একটানা সাত ঘণ্টা স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশনা মেনে চলতে পারবেন কিনা। তিনি কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট কথা বলেছিলেন। ডোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট বালাগের কথা বলেছিলেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
বিরতির সময় সকল সাংবাদিক, আমি সহ, ফিদেলকেঘিরে রেখেছিলেন। সশরীরে তিনি জীবনের চাইতে বেশি প্রভাববিস্তারী, এমনকি তাঁর সামরিক পোশাককে একটু রঙ চটে যাওয়া আর তাঁর শার্টের কলারটাকে খুব বেশি ধূসর হয়ে যাওয়া মনে হলেও। তিনি যখন হেঁটে বাইরে গেলেন, ভীড়টাও পিছুপিছু গেল। মনে হল এটা তাঁর ভালো লাগছিল।
"কমান্ড্যান্ট, ভেন সেরেমোস ব্রিগেডে আমি বেত কেটেছিলাম,"একজন সাংবাদিক চিৎকার করে বলল।
তিনি থামলেন এবং কণ্ঠস্বরটা কোন দিক থেকে আসছে খুঁজলেন। "কোথায়?"
ভীড়ের মধ্যে এক মহিলা একটা সাদা-কালো আলোকচিত্র মেলে ধরলেন—তাঁদের দুজনের একটা যৌথ ছবি যখন তাঁর দাঁড়ি কালো ছিল। "আপনি কি এতে স্বাক্ষর করতে পারেন, কমান্ড্যান্ট?"
"সাত মিনিট কথা বলা কি খুব কঠিন ছিল?"অন্য আরেকজন বলে উঠল।
"আমার সঙ্গে চালাকি করা হয়েছিল,"ফিদেল বললেন। "তাঁরা আমাকে বলেছিলেন আমি যদি সাত মিনিটের বেশি কথা বলি তাহলে গুয়াদালাহারার সবগুলো ঘণ্টা বেজে উঠবে।"
যে হলুদ গদিটার ওপর বসে ছিলেন সেটার পাশে এক টুকরো মোচড়ানো কাগজ দেখতে পেলাম। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ভীড়টা যখন সরে গেল তখন আমি তাঁর আসনের দিকে ফিরে গেলাম এবং কাগজের দলাটা তুলে নিলাম। খুললাম ওটা এবং তাঁর ছোট ছোটদুর্বোধ্য হস্তাক্ষর পড়লাম: "পোর কুয়ানতো তিয়েম্পো হব্রে হাবলাদো?" (আমি কতক্ষণ কথা বলেছি?) বড় খাতাটাতে সব প্রেসিডেন্টের নাম এবং প্রত্যেকে কতক্ষণ কথা বলেছিলেন তার একটা তালিকা করেছিলেন ফিদেল, এক্কেবারে সেকেন্ডের হিসাবসুদ্ধ। চিরকুটটা রেখে দিয়ে আমি চলে আসলাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে আমি আফসোস করি।
"আমি অবশ্যই সেটা লুফেনিতাম,"গাবো বলেন। "বিশ্বাস কর, তিনি যদি মনে করতেন ওটা এতই দরকারি, তাহলে তিনি সেটা ওখানে ফেলে আসতেন না। হ্যাঁ, একটা স্মারক হিসাবে আমি সেটা রেখে দিতাম।"
যেমনটা আশা করেছিলাম, ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেন গাবো। কুবা সম্পর্কে মন খুলে কথা বলেন তিনি, আবেগ ও মনোযোগের সঙ্গে, চেগেভারারপোস্টার দেয়ালে সেঁটে রাখা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মতো। কিন্তু ফিদেল সম্পর্কে নেতিবাচক, আপস প্রকাশক বা এমনকি গোপনীয়তাফাঁস হতে পারে এমন কিছু তিনি বলেন না। "ফিদেল সম্পর্কে আমি যতটা বলি বিবেচনাবোধ থেকে তার বেশি বলি আবেগ থেকে। পৃথিবীতে আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তিনি তাঁদের মধ্যে একজন।"
"একটা স্বৈরাচারী,"কেউ একজন বলে।
"গণতন্ত্রী হওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়।"
দলের মধ্যের আমেরিকান সাংবাদিকটি তাঁর সঙ্গে লেগে থাকে। গাবো তার কথার উত্তর দিতে শুরু করেন, কিন্তু খেয়াল করেন যে আমরা সব টুকে নিচ্ছি। তাঁর কণ্ঠ কঠোর হয়ে ওঠে: "এটা কোনো সাক্ষাৎকার না। আমি যদি ফিদেল সম্পর্কে আমার মতামত প্রকাশ করতে চাই, তাহলে আমি নিজেই সেটা লিখব এবং বিশ্বাস কর, আমি তোমাদের চেয়ে ভালো করেই লিখব।"
হয়তো আমাদের সঙ্গে দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলার কারণে এক ধরণের অপরাধবোধ থেকেই, ফিদেল সম্পর্কে তাঁর লেখা একটা বৃত্তান্তের বর্ণনা দেন তিনি। "এটা আমি তাঁকে পড়তে দিয়েছিলাম। এতে সমালোচনামুখর ছিলাম আমি। মুক্ত প্রেস পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে-বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নি। যেটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছিল সেটা হল, আমি আমার নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম তিনি প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজের পর আঠারো গোল্লা আইসক্রিম খেতেন। 'আমি কি সত্যিই আঠারো গোল্লাআইসক্রিমখেয়েছিলাম?'তিনি আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন।"
মধ্যাহ্নভোজের পরে
"তোমার সিগোরোদো সফর সম্পর্কে আমাদেরকে বল",রুবেন বালেন্সিয়ার উদ্দেশে বলেন গাবো।
সিগোরোদো হচ্ছে কোলোম্বিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চল উরাবার একটা গ্রাম—অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে সহিংস হিসাবে বর্ণিত একটা দেশের অন্তর্গত। কোলোম্বিয়ার পশ্চিম তীরবর্তীউরাবা উপসাগর হল একটা ভৌগোলিক মলটভ ককটেল। এতে আছে দেশের সবচেয়ে উর্বর ভূমি; এটা অস্ত্র ঢোকার আর মাদকদ্রব্য বের হওয়ার পথ; গরিব চাষা আর ধনাঢ্য জমিদাররা এখানে আছে; আছে গেরিলা দল, সামরিক বাহিনী আর মরণপ্রতিজ্ঞ সংঘ। গত বছর নিহত হয় এক হাজার মানুষ, রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। সংবাদপত্রের একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাইশ বছর বয়সী এক ঘাতক ইতোমধ্যে তিরাশি জন লোককে খুন করেছে। ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে একটা নাচঘরে খুন হয় আঠারো জন মানুষ। এ-ধরনের ধ্বংসলীলা প্রায়ই ঘটে।
আমার মনে হত রুবেন সিগোরোদো সফর করার পাত্র না। মুখের অনুপাতে অতিরিক্ত বড় চারকোণা চশমা পরা হাড্ডিসার একটা তরুণ সে, চশমার ওপরে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন এত বেশি চেপেছে যে তার চোখগুলো একেবারে পিচ্চি দেখাচ্ছে। "আমি সেখানে গিয়েছিলাম,"সে বলে, "ঐ অঞ্চলের মানুষের ওপর সহিংসতার প্রভাব বিষয়ে লিখতে, গল্পের মানবিক চেহারাটা খুঁজতে।"
যে-লেখাটা সে প্রকাশ করেছিল সেটা কর্মশালায় সে যেটা জমা দিয়েছিল সেটাই। গাবোর হাতে ধরা আছে ওটা। "তুমি গিয়ে পৌঁছানোর পর থেকে যা যা ঘটেছিল সব আমাদেরকে বল। প্রথম যার সঙ্গে কথা বলেছিলে সে কে?"তিনি জিজ্ঞেস করেন।
"শহরটা ছিল জনশূন্য, মায়েস্ত্রো। বারো বছর বয়সী একটা বাচ্চার দেখা পেয়েছিলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ নাচঘরটা সে চেনে কিনা এবং সে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। ধ্বংসলীলার পর ঘটেছিল একটা অভিনিষ্ক্রমণের ঘটনা, সব কিষাণেরা ভয়ে পালিয়েছিল।"বালেন্সিয়া আমাদেরকে বলে, কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে ফিরছিল সে, কিন্তু খুঁজে পেয়েছিল কেবল আতঙ্ক আর নৈঃশব্দ্য।
মোটরসাইকেল আরোহী এক মহিলা থেমেছিলেন এবং তাকে এগিয়ে দিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আপারতাদো পর্যন্ত, বৃষ্টির সময়ে প্রায় আধঘণ্টার পথ, যেখানে সে আরো কিছু তথ্য পেতে পারে। হোটেল লাসমোলাস-এ উঠেছিল সে। তৃতীয় দিনে একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী লবিতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
"আপনিই কি সেই লোক যে ধ্বংসলীলাটার তদন্ত করছে?"আগন্তুক লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। "চলেন বের হই আর কিছু পান করি। আমার মনে হয় আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।"
"দুঃখিত,"বালেন্সিয়া উত্তর দিয়েছিল। "বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নামার পরে আমি বের হই না। আপনি কি আমার রুমে আসতে চান?"
রুমে আসার পরে একসময় লোকটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনি কী খুঁজে পেলেন? কী জানতে চান আপনি?"
"আমি একজন সাংবাদিক, এই সংঘর্ষটার মানবিক চেহারাটা খুঁজছি আমি।"
"ও, হ্যাঁ।"
"কে আপনি?"বালেন্সিয়া শেষ পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। "আমি একজন ফেরেশতা", লোকটি বলেছিলেন।
"কী ধরনের ফেরেশতা?"
"একটা শাদা ও একটা কালো ডানাওয়ালা ফেরেশতা"
"আর, আপনি আমার সঙ্গে কোন ডানাটা নিয়ে কথা বলবেন?"
"সেটা নির্ভর করে"
"কীসের ওপর?"
বালেন্সিয়া যখন কথা বলে, আমরা সবাই চুপ হয়ে থাকি, তার গল্পে বুঁদ হই। কেমন জানি ঈর্ষা লাগছে আমার, কী এক গল্পই না এটা!
"কিন্তু এখানে আমি যেটা পড়েছি সেটাতো এটা নয়", লেখাটা তুলে ধরে গাবো বলেন। "ঐ গল্পটাই কেন তুমি লিখলে না? এইমাত্র আমাদেরকে যেভাবে গল্পটা বললে সেভাবেই কেন গল্পটা লিখ নি তুমি? আমিতো ঐ গল্পটাই লিখতাম।
"ঐ লোকটার বর্ণনা দাও", তার দিকে তাকিয়ে গাবো বলেন।
রুবেন চুপ করে থাকে।
"ঐ লোকটার চেহারা কি তুমি মনে করতে পার?"
"হ্যাঁ।"
"তার চেহারা দেখে তোমার কোন প্রাণীর কথা মনে পড়েছিল?"
"একটা ইগুয়ানা"
"হ্যাঁ এইতো, আর কিছুর দরকার নাই,"গাবো বলেন। "পুরো ট্রিপটাই তুমি নষ্ট করেছ, বেটা। আমরা সমাজতত্ত্ববিদ নই, আমরা গল্পবলিয়ে, আমরা মানুষের গল্প বলি। মানবিক কণ্ঠস্বর নিয়ে প্রতিবেদন করাটা একজন সাংবাদিককে বড় করে তোলে। সেই গল্প কোথায়?"
রুবেন, যে কিনা গার্সিয়া মার্কেসকে জোর গলায়
মায়েস্ত্রো বলে ডাকে, উত্তর দেয় "এটা সহজ না। সেই গল্প আমি যখনই লিখতে যাই আমার সম্পাদক আমাকে বলেন, 'বালেন্সিয়া, তুমি গার্সিয়ামার্কেস নও। তথ্য আঁকড়ে থাকো!
বিকেল ৩:০০ টা
"দাসা, তুমি কেন তোমার কোনো একটা লেখা আমাদেরকে পড়ে শোনাও না?"গাবো জিজ্ঞেস করেন। আমি অধৈর্য হচ্ছি। দিন প্রায় শেষ। কর্মশালা প্রায় শেষ, এবং গাবো আমার লেখাটা নিয়ে একটা টুঁশব্দও করেন নি। আমি যেহেতু কুবা নিয়ে লিখেছিলাম, তাই আমি মনে করেছিলাম তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখাবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা পড়েছেন বলে উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি।
দাসা লিখেছে মেদেয়িনের আন্ডারগ্রাউন্ডের এক চরিত্র নিয়ে—এমন এক লোকের বৃত্তান্ত যিনি মানুষের চাইতে পশুপাখির সাহচর্য বেশি পছন্দ করেন। তিনি তাঁর নিত্যদিনের বুনেয়েলা, একধরনের ভাজা বড়া, তাঁর একমাত্র খাবার, ভাগ করে খান একটা পোষা ইঁদুরের সঙ্গে। তিনি একটা মুরগিছানাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে হাঁটান এবং ঘরে মক্ষিকা পালেন। দাজা এটা আমাদেরকে পড়ে শোনায়। লেখাটা মর্মস্পর্শী, শৈলী গীতিময়, বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই গীতিময়। প্রথাগত রিপোর্টাজ এটা নয়।
"আমি দাসার লেখায় হাত দেব না,"গাবো বলেন, "এখানে হয়তো সে নতুন কোনো আঙ্গিক আবিষ্কারে রত, এমন একটা আঙ্গিক যেটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।"
তিনি লেখাটাকে ভালো কি মন্দ ভেবেছিলেন, আমরা জানি না।
দাসা শুধু তার লেখার শৈলীর দিক থেকেই দুঃসাহসী নয়। সেই একমাত্র ছেলে যে কিছুটা অবজ্ঞা দেখিয়েছিল: "গাবো খানিকটাআত্মসর্বস্ব।"
দাসাকে পাঠানো হয়েছিল ইবেরো-আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল সামিট কাভার করতে, যেটা ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কার্তাহেনায়। প্রতিবেদকেরা ক্ষেপেছিল, কারণ সভার ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার নেওয়াটা ছিল অসম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে গাবো একটা প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল গাবো বলেছিলেন অভিযোগ না করে বরং সাংবাদিকদের উচিত স্টোরির জন্য পথে বের হওয়া এবং তাদেরকে রুপোর থালায় করে খবর হাতে এনে দেওয়া হবে এমনটা আশা না করা। প্রেসিডেন্টদেরকে পাওয়া না গেলে একজন সাংবাদিক অন্যত্র স্টোরি খুঁজে নেবেন।
দাসা তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলে, "ঐ কথা বলা আপনার জন্য সহজ। এমন মন্তব্য যে আমার কতখানি হতাশাজনক মনে হয়েছিল, বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে, সেটা নিয়ে আমি একটা স্টোরি লিখেছিলাম। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি ওখানে ছিলেন, দরজার ওপাশে, সব রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।
"ওখানে একজন কর্তব্যরত সাংবাদিক হিসাবে তো আমি ছিলাম না।"
দাসা স্বীকার করে গাবোর তিরস্কারটা কাজে এসেছিল। সে একটা বিবরণ দেয়: গত বছর কার্তাহেনায় অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলন কাভার করতে যখন তাকে পাঠানো হয়েছিল, সে তখন নেতৃবৃন্দ যেখানে সমাবেশ করছিলেন সেই সম্মেলনকক্ষে যায় নি। সম্মেলনে উপস্থিত ইয়াসির আরাফাত এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘর্ষ বিষয়ে লেখার জন্য সে বরঞ্চ গিয়েছিল কার্তাহেনার অসংখ্য দরিদ্র বস্তির একটায়—এমন একটায়যেটার নাম সত্যি সত্যি পালেস্তিনা। আরাফাতের সঙ্গে পালেস্তিনায় বসবাসরত এক মেয়ের অবস্থার তুলনা করে সে একটা স্টোরি লিখেছিল, যে-মেয়েটি একটি ধনাঢ্য, পর্যটকভর্তি শহরের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রান্তিকায়িত।
গাবো বলেন, "তুমি শিক্ষাটা নিয়েছো।"
"আপনিও তো ঐ সম্মেলনে ছিলেন।"দাজানাছোড়বান্দা। "আপনি কুবারঅতিথিদের সঙ্গে ওখানে ছিলেন।"
"আমি ওখানে ছিলাম", গাবো অসহিষ্ণুভাবে বলেন, "আমি ওখানে ছিলাম, কারণ তখন একটা কানকথা শোনা যাচ্ছিল যে ফিদেলকে মেরে ফেলা হবে। এবং কুবার নিরাপত্তারক্ষীরা ফিদেলকে সেই মিছিলে যেতে দিচ্ছিল না বলে আমি তাঁর সঙ্গে সেই ঘোড়ার গাড়িতে বসতে গিয়েছিলাম। ওদেরকে আমি বলেছিলাম এই কোলোম্বিয়ায় আমি যেখানে বসব সেখানে কেউ গুলি করবে না। তাই চেপেচুপে আমরা পাঁচজন এক গাড়িতেই বসেছিলাম, ঠেসেঠুসে, মজা করতে করতে। ফিদেলকে আমি যখন বলছিলাম কিচ্ছু হবে না, তখন ঘোড়াটা সত্যিই হেলেদুলে চলতে শুরু করে দিল।"
নৈশভোজ
তিনি আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছেন কার্তাহেনার সবচেয়ে কসমোপলিটান রেস্তোরাঁ লা ভিট্রোলা-য়। সাজসজ্জা যতটা না স্প্যানিশ তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক, কিন্তু সাদা পোশাক পরা সঙ্গীতদল গায় ঐতিহ্যবাহীসোনে। এটা সেই জায়গা যেখানে কোলোম্বিয়ারউচ্চবিত্তরাঅবকাশযাপনের সময় খায়, রাষ্ট্রপতি পান করার জন্য থামেন। সোপঅপেরারতারকারা, খুদে কিন্তু জবড়জং মাদক-কারবারিরা, ধনীর দুলাল-দুলালী তাদের প্রথম অভিসারে, আর কিছু স্থানীয় উচ্চাভিলাষীনয়াচাকুরেও আসে। ন্যুইয়র্কেও রেস্তোরাঁর মতো আহার্য ফর্দ। সুগন্ধি সিরকা দিয়ে তৈরি সালাদোপচার, তরতাজা মোজারেলা এবং মদ, কলম্বিয়ার মানে, উত্তম।
ছোট্ট একটা কামরায় বসি আমরা এবং ফলের শরবতে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষা করি। নাভি থেকে বুক পর্যন্ত চেইন টানা গাঢ় নীল রঙের জাম্পস্যুট পরে গাবো আসেন। দিনের বেলায় যিনি ক্যারিবীয় পুরুষ ছিলেন, রাত নামতেই তাঁকে মনে হয় যেন কোনো একটা ফাঙ্ক বা ডিস্কো অ্যালবামের প্রচ্ছদ থেকে এইমাত্র লাফিয়ে নেমে এসেছেন। তাঁর জুতাজোড়া হুবহু আজকে সকালেরগুলোর একই মডেলের, কিন্তু এখনকারগুলো ছাইরঙা। ওয়েইটারকে ডেকে একটা হুইস্কি দিতে বলেন। দরজার পাশের প্রাইভেট কামরায় চলে যাই আমরা। তিনি বসেন আন্দ্রেয়া আর আমার মাঝখানে।
খাবারের মেন্যু আগে থেকে ঠিক করা: নারিকেলের সস দেওয়া চিংড়ি অথবা ক্রিম দেওয়া স্ন্যাপারের পর ভাজা জুকিনি।
"রাতে খাওয়ার পক্ষে এটা আমার জন্য বেশ ভারী"গাবো অনুযোগ করেন।
হোস্ট আসেন এদিকে। "আপনাদেরকে সস ছাড়া পোড়ানো স্ন্যাপার দিতে পারি? অথবা পাস্তা?""কী রকম?"
"আপনারাকীরকম চান?""সাদাসিধা"
"ব্রোদো দেওয়া পাস্তা কেমন হয়?"
"পাক্কা! আমার জন্য ঐটা আনো"
আমি জানতে চাই আমিও একই খাবার খেতে পারি কিনা; সারাদিন জ্বরজ্বর লেগেছে আমার। "ঐ খাবার দুইটা আনো", গাবো তাকে বলেন।
ওয়াইন দেওয়া হলে, তিনি তা খেতে রাজি হন না এবং হুইস্কিই খেতে থাকেন।
রেস্তোরাঁ ভরে যাচ্ছে। আমাদের টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যায়। সবাই গাবোকে খেয়াল করে। দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলেন তিনি, এবং আমি ওয়েইটারকে তা করতে বলি। গাবোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য নিউজউইক-এর যে-সাংবাদিক বুয়েনোস আইরেস থেকে এসেছেন, তিনি আমার বামপাশে বসা। কিছুক্ষণ উনার সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু আমি আসলে গাবোর সঙ্গেই কথা বলতে চাই, তাঁর সঙ্গে ফিসফাস করি, আমার সহকর্মীদেরকে তাঁর ভাগ দিই না।
আমি তাঁর দিকে ফিরি। নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। জানতে চান কেন এবং ন্যুইয়র্কের কোথায় আমি থাকি। বলি আমি গ্রামে থাকি এবং জানতে চাই তিনি ন্যুইয়র্ক পছন্দ করেন কিনা। খুব পছন্দ করেন তিনি কিন্তু অতিরিক্ত শীতের সময় না, কারণ রাস্তায় হাঁটা ছাড়া আর কিছুই করতে পছন্দ করেন না তিনি। বলি তাঁকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাব এবং তিনি কথা দেন ফোন করবেন।
আমরা কথা বলি কুবা বিষয়ে, র্বারানকিইয়া নিয়ে, বিল ক্লিনটন সম্পর্কে, দ্য ন্যুইয়র্কার আর রোববারের পত্রিকাগুলো নিয়ে। খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে একটা গল্পের কথা বলেন যেটা তিনি লিখতে চান এবং তাঁর একটা হলুদ শার্টের কথা বলেন যেটা তিনি প্রেমে পড়লে পরেন। তাঁর গ্লাস খালি, তাই তিনি আমারটা থেকে পান করেন। "আমি নারীদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করি। পুরুষদের চেয়ে তাদেরকে আমি বেশি চিনি।
তাদের সঙ্গে থাকতেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি; আমি নারীসঙ্গেই বড় হয়েছি।"
ওয়েইটার এগিয়ে আসে এবং গাবোর হাতে একটা শাদা রুমাল দেয়, ভাঁজ করা। সেটা খোলেন তিনি এবং এর ওপর যা লেখা আছে পড়েন। ওয়েইটারকে কিছু বলতে মানা করেন। প্রত্যেকেই যে তাঁর কাছ থেকে কিছু কিছু চায়, এটা হয়তো খুব কষ্টকর। তাঁর একটা বন্ধুর কথা বলেছিলেন একটু আগে, যিনি সাংসদ হতে চান, তাঁর কাছে ফোন করেছিলেন। "গাবো, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু লিখ, কিছু বল, এমনকি যদি সেটা আমাকে অপমান করার জন্যও হয়।"
দরজা খুলে যায় এবং একটা লোক ভিতরে উঁকি দেন। গাবো চোখ তুলে তাকান, উঠে দাঁড়ান আর, দুই হাত মেলে ধরে সামনে আগান। "আহ, আমি, কেলকোয়েঁসিদঁস।"আমার মনে হয় এটাই সেই লোক যিনি রুমালের ওপর লিখে তাঁর কাছে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। আবার যখন এসে বসেন তখন তিনি আমার কানে ফিসফিস করে বলেন, "আমি স্রেফ ঐ জানলাটা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাই।"
তর্জমা: এহসানুল কবির