মার্কেসের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার: ‘আমাকে নিয়ে মিথগুলো হয়তো আমার জীবনের চেয়েও চমকপ্রদ’
১৯৯৪ সালের ৬ মে কিউবার হাভানায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে আমার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত এক আলাপের সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত সাংবাদিক মরিসিও ভিসেন্ট। সে আলাপেরই সংক্ষেপিত অংশ এ লেখা। তখন কলম্বিয়ান লেখকের বয়স ছিল ৬৭। সেদিন অনেক খোলাখুলি কথা বলেছিলেন তিনি, যাকে বলে প্রাণখুলে আলাপ। তার কিছুদিন আগেই লেখকের অভ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস প্রকাশিত হয়েছিল।
এ সাক্ষাৎকারটি এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। এটির সম্পূর্ণ সংস্করণ সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন টিন্টালিবর-এর ১১৭ তম ইস্যুতে পাওয়া যাবে। সাক্ষাৎকারে মার্কেস কথা বলেছেন সংগীত, ক্যারিবিয়ান, অর্থ, প্রেম, তার বই ও তার আইডিয়া নিয়ে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস: তারা হয়তো এটিকে বাজে বা ভালো একটি কৌতুক হিসেবে নিয়েছে… তবে আমি বিশ্বাস করি, নিঃসঙ্গতার একশ বছর সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার একটি ভ্যালেনাতো (একটি কলম্বিয়ান ফোক গান)। আর আমি এ কথা একদম সিরিয়াসলি বলছি। বইটি আর গানের নান্দনিকতা, ধারণা, উপাদান সবই একই: এ গল্পগুলো হারিয়ে গেছে, হারিয়েছে পরিচিত বিস্মৃতিতে। লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরা একটি ৩৮০ পৃষ্ঠার বোলেরো (একটি কিউবান রোমান্টিক গান) আর আমি এ কথাটিও অন্তর থেকেই বলছি। যখন ভ্যালেনাতো গান কী, সেটাই কেউ জানত না, তখন, আমার মনে আছে, ছোটবেলায় ফেস্টিভ্যালে আসা অ্যাকর্ডিয়ন বাদকদের আমি শুনতে যেতাম। কারণ ওখানেই ভ্যালেনাতো সংগীতের উৎপত্তি… তারা ছিলেন পর্যটক সংগীতশিল্পী, এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়াতেন, অন্য কোথাও ঘটা কোনো ঘটনা নিয়ে গান গাইতেন। সেগুলো ছিল বহমান খবরের কাগজের মতো, যে খবরগুলো ওই অ্যাকর্ডিয়নদের সঙ্গে সঙ্গে চলত।
প্রথমে আমার কাছে সংগীতের চেয়ে তাদের বলা গল্পগুলোই বেশি আকর্ষণীয় লাগত। কিন্তু তারপর সেসব গল্পের ইতিহাস, তথ্য — এবং বিশেষ করে জীবন ও অঞ্চল — সবসময় আমার কাছে সংগীতের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। আমার একটা অনুভূতি আছে যে, আমার সবগুলো বইয়ের মধ্যে অভ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনসই ক্যারিবিয়ানকে সবচেয়ে বেশি তুলে ধরতে পেরেছে। লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরায় থাকা শহরটির ক্যারিবিয়ান সত্তাটি অভ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস-এর মতো জোরদার নয়। আদতে আমরা ক্যারিবিয়ানরা প্রকৃত অর্থে যেমন — বিভিন্ন জাতির মিশ্রণে সৃষ্ট নতুন একটি সংস্কৃতি — তা যদি আপনি দেখতে চান, তাহলে সেটা পাবেন এ বইটাতেই।
প্রশ্ন: যদিও অভ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস-এর পটভূমি কলম্বিয়ার কার্তাহেনায়, আমার কাছে এটাকে এখনো বহমান অভিজ্ঞতা ও যাপিত জীবনসমৃদ্ধ কিউবান উপন্যাস হিসেবে মনে হয়।
উত্তর: বইয়ের কোথাও কিন্তু বলা নেই শহরটি কার্তাহেনা — আর সেটা পুরোটা কাকতালীয় নয়। আমি অনিশ্চয়তায় আগ্রহী, আমি শুধু এটাই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম যে এ বইয়ের গল্প যেন ক্যারিবিয়ান কোনো শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এ বইয়ের আগে আমি ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতির আফ্রিকান উপাদান নিয়ে এত বেশি নিবিড়ভাবে কাজ করিনি। ঔপনিবেশিক সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি এবং স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের অতি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে কার্তাহেনায় এ সংস্কৃতি কিউবার মতো অত জনপ্রিয় বা সুসংরক্ষিত হয়নি। [বইয়ে থাকা] সব তথ্য স্রেফ কার্তাহেনা থেকে জানা সম্ভব হতো না… এমনকি হয়তো ক্যারিবিয়ানের একক কোনো শহর থেকেই নয়।
একটা বিষয় আমি বারবার বলি, আর সেটা নিয়ে কেউ ভাবান্তর দেখায় না, কিন্তু ক্যারিবিয়ান একটি ভৌগোলিক এলাকা নয় বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক অঞ্চল। এটায় কেবল ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অন্তর্ভুক্ত নয়। আমার জন্য ক্যারিবিয়ানের শুরু যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে — লুইজিয়ানা ও ফ্লোরিডার সবটুকু — এবং এর শেষ মাথা উত্তর ব্রাজিল পর্যন্ত। তাই এটি কোনো ভৌগোলিক নয় বরং সাংস্কৃতিক অঞ্চল।
আমি ব্রাজিল আর কিউবা থেকে ক্যারিবীয় আফ্রিকান সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করেছি। সেগুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যেন মনে হয়েছে সবকিছু কার্তাহেনায় ঘটেছে। আমার জন্ম আরাকাতাকায়। এ শহরটি কলম্বিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত, কিন্তু অতটা ভেতরেও নয়। তারপরও এটি বিশুদ্ধ ক্যারিবিয়ান — আর এ অঞ্চলের সাংস্কৃতির মৌলিক গড়াপেটা হয়েছে সংগীতের দ্বারা।
বোধহয় সবচেয়ে বেশি ক্যারিবিয়ান শহরটি হলো পানামা। এ শহরে সবাই ক্যারিবিয়ান অনুভূতি পায়; আমি সেটা পাই বাস্তুতান্ত্রিকভাবে। ক্যারিবিয়ান বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশে আমার শরীর ক্রমশ চাঙা হয়ে ওঠে, আমি সেভাবেই এ অনুভূতিটা লাভ করি। যখন ইউরোপ থেকে ফিরে আসি তখন এ অনুভূতিটা সবচেয়ে সহজে হয়, এ শহরটা ক্যারিবিয়ানে আমার প্রথম যাত্রাবিরতি। আমি বিমান থেকে নামি, নিঃশ্বাস নিই, ব্যস মুহূর্তেই আমি যেন এক সম্পূর্ণ আলাদা মানুষে পরিণত হই। আমার মনে হয় মানুষের জীবনে বাস্তুতান্ত্রিক পরিস্থিতি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ — এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়নি।
প্র: এটা কি সত্য যে আপনার আয় করা প্রথম পেসো নিয়ে আপনি ক্যারিবিয়ানে একটি সমুদ্রভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন?
উ: সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমাকে নিয়ে থাকা মিথগুলো সংগ্রহ করা যেত। কারণ হয়তো সেগুলো আমার জীবনের চেয়ে আরও বেশি আকর্ষণীয়!
প্র: হয়তো আপনি নিজেই ওই মিথগুলোতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন?
উ: বেশ, বিষয়টা দেখা যাক: বার্সেলোনায় আমি যখন দ্য অটাম অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক লিখছিলাম, তখন একটা মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম যে, আমি আমার বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশটা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। এমন অনেক ব্যাপার ছিল যেগুলো আর আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি জাগাত না: আমি সমুদ্রের রং, গন্ধ ভুলে গিয়েছিলাম। আমার মনে হলো, বাস্তবতাকে প্রকাশে যেসব সুনির্দিষ্ট বিষয় আমার লাগত, সেগুলো আর আমি মনে করতে পারছি না। আবেগ, অনুভূতি, আমার শিকড়বোধ কখনো হারায়নি, কারণ একজন লেখক যেখানেই যান, তিনি সঙ্গে করে তার শব্দমালা নিয়ে যান; কবি তার শব্দরাজিকে বহন করেন, আর উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু — সর্বত্রই ওসব শব্দ তার সঙ্গে থাকে। কিন্তু কিছু জিনিসের প্রকৃতি আমি আর মনে করতে পারছিলাম না: গন্ধ, শব্দ, তাপমাত্রা। চারপাশ ঠান্ডা হলে উত্তাপকে অনুভব করা বেশ কঠিন, আর উল্টোটা হলে শীতলতাকে।
আমার মন খুব উতলা হয়ে উঠল, কারণ উপন্যাসটা এগোচ্ছিল না। তাই আমি একটি বিরতি নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। ওই ভ্রমণে আমি স্যান্টো ডমিঙ্গোতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পুরো ক্যারিবিয়ান হয়ে কার্তাহেনায় ঘুরে বেড়ালাম। এরপর আমার যা দরকার ছিল সব নিজের মধ্যে ফেরত এল, বইটা লেখার জন্য যে জোশটুকু জরুরি ছিল। আমি এক লাইন নোটও নিইনি: পুরো ব্যাপারটাই ছিল ওই মুহূর্তের মধ্যে বাঁচা, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, একে একে ক্যারিবিয়ান সব দ্বীপ ভ্রমণ — স্রেফ চারপাশটা দর্শন বাদে আর কোনো কিছু না করেই। আর আমাকে এ কাজের পেছনে এক বছর সময় দিতে হয়নি: কখনো এখানে তিনদিন তো ওখানে সপ্তাহখানেক। এরপর যখন ফিরলাম, বইটা তরতর করে শেষ হলো। আমি তখন স্রেফ মজ্জার ভেতর ঢুকে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা বিস্মরণের চেয়ে আলাদা… [কারণ] আপনি কখনোই নিজের শেকড়ের শৈলীকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না।
প্র: আর বার্সেলোনার সেইসব রাতে কোন বোলেরোগুলো শুনতেন?
উ: ক্যারিবিয়ানের বাইরে কিছু বোলেরো শুনেছি: বাখের, তবে উৎসটা সেই জনপ্রিয় সংস্কৃতি থেকেই। দিনশেষে সব সংগীতেরই, হোক সেটা বনেদি বা জনপ্রিয় (পপুলার/পপ কালচার), উৎস কিন্তু ওই জনপ্রিয় গানগুলোই। বেলা বার্তকের একটা জনপ্রিয় ছবি আছে, যেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে একটি সিলিন্ডার আকৃতির রেকর্ডার নিয়ে ড্রাকুলার দেশ ট্রান্সিলভানিয়ায় কৃষকদের কাছ থেকে গল্প সংগ্রহ করছেন। তার সবগুলো সংগীতেরই উৎস ওই জনপ্রিয় সংস্কৃতি। একই কথা সত্য ছিল বাখের জন্য, খাটে ভ্যালেনাতোর জন্য, প্রায় বলা যায় সব ক্যারিবিয়ান সাহিত্যের জন্য। আমার কাছে সংগীত কেবল ধ্রুপদি আর জনপ্রিয়তে আটকে থাকে না… আমি [অনেক সংগীত শোনার পর] কেবল সংগীতের জঁরাকে দুই ভাগ করি — যেগুলো আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, আর যেগুলো আমি সবচেয়ে কম পছন্দ করি। কিন্তু আপনি বলতে পারবেন না যে ধ্রুপদি সংগীত সংগীত নয়, বা জনপ্রিয় সংগীত সংগীত নয়, অথবা বোলেরো সংগীত নয় কিন্তু চা-চা সংগীত। আমি বিশ্বাস করি, এগুলো সবই মানুষের সুমহান মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ, কারণ এমনকি সবচেয়ে দুর্বল সংগীতগুলোতেও কিছু না কিছু আছে। গান শুনতে শুনতে অবশ্য আমি লিখতে পারি না, কারণ, একটা পর্যায়ে আমার আগ্রহ লেখার চেয়ে ওই গানের কথায় বেশি আটকে যায়।
সংগীত আমাতে সাহিত্যের চেয়ে বেশি স্পর্শ করে, অথবা হয়তো হতে পারে আমি সংগীত বেশি পছন্দ করি, বা সাহিত্যের চেয়ে সংগীত আমাতে বেশি ভর করে। লিখতে বসে গান শুনি না, কিন্তু গানে আমি সবসময় ডুবে থাকি, বিশেষ করে যখন আমি লিখি। বার্সেলোনায় যখন ছিলাম — নিঃসঙ্গতার একশ বছর শেষে খানিকটা বিরতি তখন, ভাবছি এরপর কী — তখন আমি প্রচুর গান শুনেছি। আমি সবসময় গান শুনেছি — মোটের ওপর মার্জিত (কালচারড) সংগীত — কিন্তু কখনো কোনো ধরাবাঁধা নিয়মে শোনা হয়নি। আমি কেবল শুনেই গেছি, যেখান থেকে ওই গান আসুক না কেন। বার্সেলোনায় [১৯৬০-এর দশকে] সুবিধা ছিল, সব জায়গায় গান শোনা যেত, এটা অতিমাত্রায় একটি মিউজিক্যাল শহর। আমি তখন বিশেষ করে শুনতাম বেলা বার্তকের থার্ড পিয়ানো কনসার্তো, খুব ভালো লেগেছিল। এরপর যখন দ্য অটাম অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক লিখছিলাম, তখন এটা অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।
বইটা যখন বেরোলো, তখন অনেক সাহিত্য ও সংগীত বিশেষজ্ঞ চেষ্টা করলেন আমাকে দেখাতে যে, বইয়ের কম্পোজিশন, গঠন কিছুটা বেলা বার্তকের কনসার্টের ওপর ভিত্তি করা… যদিও তারা আমাকে যেসব ব্যাখ্যা দিতেন সেগুলো আমি কখনো বুঝতাম না। অভ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস সংগীতের কোন জঁরায় পড়েছে সেটাও ভাববার বিষয়! আমার নিজের কোনো ধারণা নেই, কিন্তু খুব সম্ভাবনা আছে যে এ বইয়েরও নিজস্ব একটা সংগীত আছে। [উপন্যাসটার জন্য] আমি যেটা চেয়েছিলাম সেটা হলো এটা যেন কোনোপ্রকার বৈসাদৃশ্য ছাড়াই একটা সংগীত হয়ে ওঠে। তা হওয়ার জন্য আপনাকে ২০০ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের ওপর চার বছর প্রতিদিন কাজ করতে হবে, যাতে তার সুরে কোথাও একটু ভিন্নতা না তৈরি হয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত