কার কবিতা কে লেখে
১
মানুষের রক্তের অন্তর্গতে গুজবের প্রতি মুগ্ধতা আছে। বলা ভালো, বংশানুক্রমিক জিনবহনে। সভ্যতার আদি যুগে অসংখ্য গুজব, ভ্রান্তিদর্শন মানুষের মধ্যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এক বিকল্প বোধ তৈরি করেছিল। সময়ের পরিক্রমায়, সভ্যতার অগ্রবর্তিতায় গুজবের প্রগতিশীল ভূমিকা আর নেই বরং এটি এখন বায়ুবেগে বিস্তারলাভ করে জনপদ ধ্বংস করতে পারে। মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই 'ফেব্রিকেটেড লাই' তথা অলংকৃত মিথ্যে বিশাল জমি দখল করে আছে ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবন, রাজনীতি এবং শিল্পযাপনে। সাহিত্যেও যে এমন ঘটনা ঘটে তা বিশ্বসাহিত্যে কিংবদন্তি লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে কেন্দ্র করে ঘটা এক ঘটনার শুলুক সন্ধান করা যেতে পারে। ঘটনার উৎসে যাওয়ার আগে এ থেকে উদ্ভূত প্রায় সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার কথা পড়ে নিতে পারি।
২০১৪ সালে মার্কেসের মৃত্যুর দিন কতক পর বাইশে এপ্রিল ভারতের রায় বেরিলিতে তাঁর বক্তৃতায় প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দক্ষিণ আমেরিকান এক লেখকের চিঠির কথা বলেন, তিনি নিশ্চয়ই মার্কেসের কথাই বলছিলেন। অথচ, আদতে চিঠিতে একটা কবিতা 'লা মারিওনেতা' নাম, ইংরেজিতে 'দ্য পাপেট'। বক্তৃতায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, 'সম্প্রতি একজন দক্ষিণ আমেরিকান লেখক প্রয়াত হয়েছেন। তিনি তার বন্ধুদের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। দিন কতক আগে চিঠিটা পড়েছি। তিনি তার চিঠিতে বলেছেন, সারা জীবন ধরে আমরা বলা না বলার দোলাচলে থেকে যাই। কিন্তু তার কথায় আরও তিনি বলছেন, আমাদের অবশ্যই হৃদয়ের কথা বলতে জানতে হবে। এ অনুভূতি আমার মধ্যেও এসেছে। দেখুন, নির্বাচনগুলো কোন বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কেমন ধরনের রাজনীতির খেলা চলছে চারদিকে, এই গৌতম বুদ্ধ এবং মহাত্মা গান্ধীর ভূমিতে... এই অঞ্চলের চারিত্র্য কেমন বদলে গিয়েছে।'
২
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বিখ্যাত লেখক হওয়ার আগে ছিলেন একজন সাংবাদিক। ১৯৪৮ সালে আইন বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে, তিনি 'এল ইউনিভার্সেল' সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ এই সময়কালে এল হেরাল্ডো' স্থানীয় পত্রিকায় তাঁর নিবন্ধমালা প্রকাশিত হতো। সেখান থেকে তিনি 'এল এসপেকতাদোর'-এ চলে আসেন। ১৯৫৮ সালে এল মোমেন্তো থেকে প্রস্তাব পেয়ে সম্পাদক হিসেবে ভেনেজুয়েলা যান। কলম্বিয়ান নেভি নিয়ে এমন এক সাহসী নিবন্ধ লিখেছিলেন, যা সেখানকার কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করে।
এর ফলে পদোন্নতির নামে এক রকমের নির্বাসনে তাঁকে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনুসন্ধানী মন সাংবাদিকতার ভাঁড়ারে অজস্র অভিজ্ঞতা জড়ো করে। পরবর্তীকালে জিনি এইচ বেল ভিলাদার মতো সমালোচক ঔপন্যাসিক হিসেবে সর্বমান্য হওয়ার প্রেক্ষাপট হিসেবে চিহ্নিত করেন সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতা। মানুষের দিনানুদিনের খুঁটিনাটি বাস্তবতা চিত্রণে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। নিবন্ধ লেখক হিসেবে তাঁর সারবত্তা জীবন দেখার অনুপুঙ্খ-চিহ্নিত। মার্কেসের নাম প্রায়ই সংবাদপত্রে এসেছে তার জীবিতকালে; সে তাঁর নিবন্ধের জন্যে যতটা না, তার চেয়ে তার উপন্যাস ও ব্যক্তি মার্কেস বিষয়জনিত কারণে, ঔপন্যাসিক মার্কেস সাংবাদিক মার্কেসকে আড়াল করে দিয়েছে। মার্কেস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একটা কথা চাউর হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় একটা চিঠি। মার্কেসের বিদায়ী চিঠি! যেখানে তিনি হৃদয়ছোঁয়া ভাষায় তার লেখালেখির জীবনকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দিচ্ছেন।
৩
'যদি মুহূর্তের জন্য ঈশ্বর ভুলে যায় যে আমি মূলত পুতুল এক ত্যানা কাপড়ের মতো, এক টুকরো জীবন উপহার দিয়েছে আমায়, তাহলে সম্ভবত আমি যা ভাবি তার সবটুকু উচ্চারণ করতাম না, বদলে যা বলি, সেসব ভেবে নিতাম। বস্তুসমাবেশের মূল্য দিতাম বটে, তার জাগতিক নয় বরং তারা অন্তরে কী অর্থ লুকিয়ে রেখেছে তার জন্যে। অল্পই ঘুমাতাম আমি, অধিক স্বপ্ন নেমে আসত আমার চোখে, বুঝে যেতাম চোখ বন্ধ করার প্রতিটি মিনিটে আমরা ষাট সেকেন্ড আলো হারিয়ে ফেলি।
আমি হাঁটতাম যখন অন্যেরা স্থির।
জেগে উঠতাম যখন অন্যেরা ঘুমে।
অন্যের কথা শুনতাম আমি, আর কত ভালোবাসতাম ভালো চকোলেট আইসক্রিম! ঈশ্বর যদি এক টুকরো বেঁচে থাকা দেন আমায়, আমি পরতাম সাধারণ পোষাক, সূর্যের প্রথম আলোর মুখোমুখি দাঁড়াতাম, নগ্ন শরীর নয় কেবল খোসাছাড়ানো আত্মাসহ। ওগো আমার ঈশ্বর, আমায় যদি হৃদয় দিতে একটা, তাহলে আমি ঘৃণা লিপিবদ্ধ করতাম বরফে আর সূর্যদর্শনের অপেক্ষায় থাকতাম। ও আমার প্রভু, যদি এক খণ্ড জীবন পেতাম প্রতিটি দিন আমি মানুষকে বলতাম, দেখো তোমাদের কতটা ভালোবাসি। প্রতিটি নারী ও পুরুষকে বিশ্বাস করাতাম তাদের আমি প্রিয় বলে মনে করি আর আমি ভালোবাসায় বাঁচি। প্রমাণ করে দিতাম, বুড়ো হয়ে গেলে প্রেমে পড়া বারণ এ কথা ভুল, প্রেমে পড়া বন্ধ করলেই বরং লোকে বুড়ো হয়ে যায় অজ্ঞাতে। এক শিশুর প্রতি, আমি তাকে ডানা দিতে পারি, কিন্তু কেবল তাঁকেই শিখতে দাও ওড়ার পদ্ধতি।
বড়োদের প্রতি, আমি তাঁদের শেখাতে পারতাম, বুড়ো হতে হতে মৃত্যু আসে না। মৃত্যু আসে বিস্মরণে। ও আমার মানুষ, কত কিছুই না তোমার কাছে শিখেছি... আমি শিখেছি প্রত্যেকেই পাহাড়ের খাঁজ নির্বাচন করে বাসস্থান হিসেবে, সত্যিকারের আনন্দ কেমন করে পাওয়া গেল, তার চড়াই-উৎরাইয়ে আছে। আমি শিখেছি যখন প্রথমবার এক নবজাতক বাবার হাত ধরে, সে তা চিরকালের জন্যেই ধরে। আমি জেনেছি অন্যকে দাঁড়াতে সাহায্য করলেই তার দিকে দৃষ্টিপাতের অধিকার মেলে। কতকিছুই না তোমার কাছে শিখেছি, শেষ পর্যন্ত কাজে আসিনি অধিক। কারণ, যখন তারা স্যুটকেসটার ভেতর রাখল আমায়, দুর্ভাগ্য আঁকড়ে ধরায় মারা যাচ্ছিলাম।
সব সময় যা অনুভব করছ, সেটাই বলো এবং করে ফেলো মনে যা আছে তা-ই।'
এই সেই কবিতা।
এই কবিতা পেরুভিত্তিক কাগজ লা রিপাবলিকায়, ২০০০ সালের ২৯ মে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে মার্কেস 'পুতুল' শিরোনামে এই চিঠি-কবিতাটি লিখে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পাঠান। পরদিন মেক্সিকান সংবাদপত্র লা ক্রোনিকা প্রথম পাতায় ছাপায়।
শিরোনামে 'মার্কেস জীবনের গান গেয়েছেন।' দ্রুত এই বিদায়ী কবিতা বা চিঠি সারা দুনিয়ায় ছড়ায়। রেডিওতে অজস্র ভাষার অনূদিত অবয়ব পঠিত হয়। এমনকি ভারতীয় পরিচালক মৃণাল সেন হিন্দুস্তান টাইমসে জানান, এই কবিতা তাকে কতটা আলোকিত করেছে। আদতে মার্কেসের বিদায়ী চিঠি বলে প্রচার হওয়া লেখাটি মেক্সিকান ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ও পাপেটিয়ার জনি ওয়েলশের লেখা একটি কবিতা। 'মোফলেস' শীর্ষক পুতুলনাট্যের জন্য রচিত। তিনি ইনফোরেড রেডিওতে প্রতিক্রিয়া জানান, একের রচনা অন্যের নামে প্রচারিত হওয়ায় তিনি গভীর অস্বস্তি বোধ করছেন। অন্যদিকে মার্কেস মৃত্যুর অধিক ব্যথা পেয়েছিলেন এমন সস্তা রচনা লোকে তাঁর প্রণীত ভাবছে বলে মনে করছেন ভেবে।
লেখার শক্তির অপরিসীম। মার্কেসের লেখা নয়, বিদায়ী চিঠি একটি সাহিত্যিক চালিয়াতি, কিন্তু এই লেখা সহস্র মানুষকে আলোড়িত করেছিল। সাহিত্যে এ যাবতীয় ঘটনা আরো রয়েছে।