গ্রিক পুরাণের আলোয় ল্যুইস গ্লিকের নোবেল
অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবার ২০২০ সালের সাহিত্যে নোবেল শিরোপা পেলেন আমেরিকার নারী কবি ল্যুইস গ্লিক। নোবেল কমিটি গ্লিককে এই শিরোপার যোগ্য মনে করেছেন তাঁর 'চিনতে ভুল হয় না এমনি সন্দেহাতীত কবি কণ্ঠস্বরের জন্য যার সাথে এক নিরাভরণ রূপময়তা মিলে ব্যক্তির অস্তিত্বকে করে তোলে মহাজাগতিক ও শাশ্বত।'
১৯৪৩ সালে জন্ম নেয়া এই কবি এখন বাস করছেন ম্যাসাচুসেটসের কেম্ব্রিজে। ১৯৬৮ সালে 'প্রথম জাতক (Firstborn)' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ। বইটিতে বিবিধ বীতরাগ ও ক্রুদ্ধ স্বরের উপস্থিতি সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। জন কীটস বা এমিলি ডিকিনসনের কবিতার সাথেও ল্যুইস গ্লিকের কবিতার প্রায়ই তুলনা করা হয়।
অদ্যাবধি এই কবি রচনা করেছেন মোট বারোটি কবিতা সঙ্কলন এবং কবিতা বিষয়ক বেশ কয়েক খণ্ড প্রবন্ধ সংগ্রহ। শৈশব, পারিবারিক জীবন এবং বাবা-মা ও ভাই-বোনের আন্ত:সম্বন্ধও তাঁর কবিতার মূল বিষয় হিসেবে ঘুরে-ফিরে আসে। গ্রিক পুরাণ ও গ্রিক পুরাণে বিধৃত চরিত্রাবলী যেমন আগামেমনন বা ইউরিদিস থেকে গ্লিক প্রায়ই তাঁর প্রেরণা চয়ন করে থাকেন।
নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে ল্যুইস গ্লিকের কবিতাকে বলা হয়েছে 'নিষ্ঠুরভাবে অকপট' এবং 'কাব্যিক আবরণ আভরনহীণ দৃঢ় ও নিরাপোষ।' তবে একইসাথে তাঁর কণ্ঠস্বর 'কৌতুকপরায়ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত।'
নোবেল পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় গ্লিক জানান যে তিনি 'অবাক' হলেও অবশ্যই 'সম্মানিত' বোধ করেছেন। টনি মরিসন বা ডরিস লেসিংয়ের পর তিনি সাহিত্যে নোবেলজয়ী ষোড়শ নারী। লেখালিখির পাশাপাশি ল্যুইস গ্লিক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপকও বটে।
ছাত্রজীবনে সারাহ লরেন্স কলেজ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ল্যুইস গ্লিক তাঁর কবিতার পরিমিতি, সংবেদনশীলতা, একাকীত্ববোধ, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর জন্য আলোচিত। শুরুর কাব্যগ্রন্থগুলোয় বাতিল হয়ে যাওয়া প্রেম, পারিবারিক দ্বৈরথ ও অস্তিত্বগত হতাশা নিয়ে কাজ করলেও পরের কবিতায় আত্মযন্ত্রণা প্রকাশই তাঁর মুখ্য অভিপ্রায়। কবি ও সমালোচক রোসান্না ওয়ারেনের মতে গ্লিকের মূল শক্তি হলো তাঁর 'লিরিক বা পদাবলীকে দূরায়ত করার ক্ষমতা।' প্রথম জাতক (Firstborn), জলাভূমিতে বাড়ি (The House on Marshland), উদ্যান-১৯৭৬ (The Garden), একিলিসের বিজয়-১৯৮৫ (The Triumph of Achilles), আরারাত-১৯৯০ (Ararat) বা বুনো আইরিস- ১৯৯২ (The Wild Iris) সহ বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থে সাদামাটা দৈনন্দিন কথার সাথে গ্রিক পুরাণের সংশ্লেষ অহরহ ঘটান এই কবি।
'একিলিসের বিজয়' কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে সমালোচক ওয়েন্ডি লেসার যেমন কবির ভাষার 'দৃঢ় সরলতা' বিষয়ে মুগ্ধতা জানিয়েছেন। প্রত্যাখ্যান, ক্ষতি, একাকীত্ব বারবার এতটাই ফিরে আসে গ্লিকের কবিতায় যে তাঁর কবিতার চরিত্র যেন মূলত: 'কালো' বা তমসাবৃত। প্রতারণা, মৃত্যু, প্রেম আর বিচ্ছেদবোধই যেন এই কবির কবিতার মূল সুর। 'সিলভিয়া প্লাথ ব্যতীত আর খুব কম কবির কবিতাই এতটা বিচ্ছিন্ন, বিষাদগ্রস্থ অথচ বিচ্ছিন্নতার নান্দনিকতায় ভরা' বলেও গ্লিক সম্বন্ধে ভাবেন সমালোচকেরা। গ্লিকের কবিতায় প্রাচীন গ্রিসের নারী ভবিষ্যদ্বক্তাদের কণ্ঠ যেন শুনতে পাওয়া যায় বলে মনে করেন 'নিউ রিপাব্লিকে'র সমালোচক হেলেন ভেন্ডলার। 'গ্লিকের কবিতার উচ্চ কণ্ঠ প্রত্যয়, যদিও বিনয়ী, সরল ও স্বাভাবিক; তবু সেই কণ্ঠের আধিপত্য ও দৈবী স্বরই এই কবিতাগুলোকে আলাদা করে। এ যেন কোন সামাজিক ভবিষ্যদ্বানী নয়- বরং আত্মিক ভবিষ্যদ্বানী- যা খুব কম নারীরই অধিকৃত করার সাহস রয়েছে।'
'বুনো আইরিস' কাব্যগ্রন্থের পরই মৃত্তিকাভূমি- ১৯৯৬ (Meadowlands) কাব্যগ্রন্থে গ্লিক পুনরায় গ্রিক ও রোমক পুরাণ তাড়িত। ওদিসিয়ুস ও পেনেলোপের কণ্ঠস্বরের পুন:সৃজনের মাধ্যমে গ্লিক যেন আজকের পশ্চিমে বিবাহ ব্যবস্থায় নর-নারীর সঙ্কটকেই তুলে ধরেন। আবার ১৯৯৯ সালে রচিত কাব্যগ্রন্থ 'ভিটা নোভা'-য় কবি তাঁর ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও ধ্রুপদী পুরাণের দৃশ্যকল্পকে একাত্ম করেছেন। ২০০১-এ কবির কাব্যগ্রন্থ 'দ্য সেভেন এজেস'-এ ৪৪টি কবিতায় একইভাবে ফিরে এসেছে কবির ব্যক্তিজীবন ও গ্রিক পুরাণ।
২০০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থে (Averno)গ্লিক গ্রিক পুরাণের ধরিত্রী দেবী দিমিতার ও তাঁর কন্যা যাকে পাতালরাজ তুলে নিয়ে গেছিল ইচ্ছার বিরুদ্ধ বা বলপ্রয়োগের দৈহিক মিলনের জন্য- সেই মাতা-কন্যার বেদনা-বিধূর সম্বন্ধকেই যেন প্রকাশ করেছেন। দারুণ বুদ্ধিমত্তায় গ্রিক পুরাণে 'ভাল নারী' হিসেবে স্বামীর জন্য বহু বছর অপেক্ষারত স্ত্রী পেনেলোপে এবং 'মন্দ নারী' হিসেবে চিত্রায়িত 'সাইরেন' বা বিভিন্ন দ্বীপে নাবিকদের পথভ্রষ্ট করতে যে কুহকিনী জলপরীদের কথা বলা হয়েছে, আজকের আমেরিকার প্রেক্ষাপটে গ্লিকের কবিতায় বারের কোন ওয়েট্রেস হয়ে ওঠেন প্রাচীন 'সাইরেনে'র নতুন সৃজন। অনুগত পেনেলোপে আর 'কুহকিনী' সাইরেন উভয়েরই সান্নিধ্য ভোগ করেন 'ওদিসিয়ুস' বা 'পুরুষ।' ভোগ করে এসেছে প্রাচীন যুগ থেকে। অথচ না 'পেনেলোপে' না 'সাইরেন' বা কুহকিনী জীবনভর পায় এতটুকু স্বস্তি।
নিচে 'ইজেল'-এর পাঠকদের জন্য গ্লুকের পাঁচটি কবিতার অনুবাদ দেওয়া হলো:
পেনেলোপের জেদ
জানালায় উড়ে এসে বসে একটি পাখি। এই পাখিদের
পাখি ভাবা ভুল, আসলে ওরা আসে দূরের খবর নিয়ে।
তাই ত' ডানা ঝাপটে ওরা যখন জানালার কাঁচে এসে বসে,
বসে নীরব, নিখুঁত হয়ে, যেন বা খোদ ধীরতাকে বিদ্রুপ করতেই
এতটা নিঃশব্দ ওরা, তারপর মাথা তুলে পাখিগুলো
গান শোনাবে এই দুঃখিনীকে, গান ত' নয়
যেন ত্রি-স্বর সাবধানী সঙ্কেত, তারপর কালো মেঘের
মত পাখিগুলো উড়ে যাবে জানালা থেকে দূরের
জলপাই কুঞ্জে। কিন্ত কে এমন ভারহীন
পাখিদের পাঠাবে আমার কাছে? বিচার করতে আমার জীবন?
আমার ভাবনাগুলো গাঢ় আর স্মৃতিও সুপরিসর;
পাখিদের মুক্তিকে কেন হিংসে করব আমি
যখন পেয়েছি মনুষ্য জন্ম? ক্ষুদ্রতম হৃদযন্ত্রের
এই পাখিরাই পেয়েছে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা।
কুহকিনী
যেই না প্রেমে পড়লাম, অমনি আমি অপরাধী হয়ে গেলাম।
তার আগে আমি ছিলাম একজন ওয়েট্রেস।
আমি তোমার সাথে শিকাগো যেতে চাইনি।
চেয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করতে, আমি চেয়েছি
তোমার স্ত্রী কষ্ট পাক।
কোন ভাল নারী বুঝি ভাবে এমনটা? নিজের সাহসের
জন্য আমার প্রশংসা পাওয়া দরকার।
তোমার বাসার সামনের বারান্দায় আমি অন্ধকারে বসেছিলাম।
সব কিছু আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল:
তোমার স্ত্রী যদি তোমাকে যেতে না দ্যায়,
তার মানে সে তোমাকে ভালবাসেনি।
তোমাকে ভালবাসলে সে কি চাইতো না
তুমি সুখী হও?
আজকাল মনে হয়
যদি কম ভাবতাম,
তবে হতে পারতাম শ্রেয়তর মানুষ।
আমি ছিলাম রেস্তোরাঁর এক ভাল ওয়েট্রেস।
একসাথে আটটি মদের পেয়ালা বইতে পারতাম।
আগে প্রায়ই তোমাকে আমার স্বপ্নগুলো বলতাম।
গত রাতে আমি দেখেছি এক নারী একটি অন্ধকার বাসে বসা-
স্বপ্নে সে কাঁদছিল যখন কিনা বাসটা দূরে সরে যাচ্ছিল।
সে তার এক হাত নাড়ছিল; আর একটি হাতে
শিশু ভরা একটি ডিমের ঝুড়ি সে নাড়ছিল।
এই স্বপ্ন বাঁচাবে না এই কুমারীকে।
একটি উপকথা
জ্ঞানী সেই রাজার কাছে
একই দাবি নিয়ে এসেছিল দুই নারী,
দুই নারী তবে একটিই শিশু।
রাজা জানতেন এদের একজন মিথ্যে বলছে।
তাই বললেন শিশুটিকে দ্বি-খন্ডিত করা হোক;
যেন একজনও শূণ্য হাতে ফিরে না যায়।
এই বলে যেই না সেই রাজা তরবারী খুললেন
খাপ থেকে, একজন দাবি ছেড়ে দিল।
আর এটাই ছিল সঙ্কেত ও শিক্ষা।
ঠিক যেমন তুমি যখন দ্যাখো
তোমার মা দ্বি-খন্ডিত হয়ে যাচ্ছেন
তাঁর দুই কন্যার মাঝে:
আর তখন মা'কে বাঁচাতেই
তুমি তোমার দাবি ছেড়ে দিলে:
নিজেকে ধ্বংসের ঝুঁকি নিয়েও,
তোমার মা ঠিকই জেনে যাবেন
যে কে ছিল তাঁর ন্যায়পর দুহিতা,
যে সহ্য করতে পারেনি মায়ের
এই দ্বি-খন্ডিত হওয়া।
রূপোলী লিলি ফুল
রাতগুলো আবার শীতল হয়ে উঠেছে, ঠিক যেন
বসন্তের শুরুর রাত্রি, রাতগুলো হয়ে উঠেছে শান্ত।
এমন সময় কথা বলা হলে তুমি কি বিরক্ত বোধ করবে?
আমরা একাকী এখন; এখন ত' আমাদের নীরব রইবার
কোন যুক্তিই নেই আসলে।
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, উদ্যানের মাথায় জেগেছে
পুরো চাঁদ?
এর পরের চাঁদ আর দেখা হবে না আমার।
বসন্তে যখন জেগেছিল চাঁদ, তখন বোধ হয়েছিল
যেন এই সময় অনন্ত। তুষারকণা মুখ খুলছে আবার
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মেপলের জমাট বাঁধা বীজেরা
ঝরে পড়ছে শৈত্য প্রবাহে।
শুভ্রতার উপরে শুভ্রতা, যখন বার্চ গাছের মাথায় জাগে চাঁদ
আর গাছ যেখানে দ্বিধা-বিভক্ত,
সেই তুষারের খাড়িতে জমেছে প্রথম ড্যাফোডিলের পাতায়,
চাঁদের আলোয় জেগেছে লিলি ফুলের নরম সবুজ-রূপোলী অবয়ব।
শুকতারা ('একদা আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম...')
সে অনেক অনেক দিন আগে আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম;
আর আমি রোপণ করেছিলাম একটি ডুমুর চারা।
এখানে, ভারমন্টে, কোন গরমকাল নেই।
ডুমুর গাছ রোপণ ছিল আসলে একটি পরীক্ষা:
গাছটি যদি বাঁচে তার মানে তুমি আছো।
গাছটি না বাঁচলে তুমি নেই। অথবা তুমি
বাঁচো শুধুই গরম আবহাওয়ায়,
তপ্ত সিসিলি অথবা মেক্সিকো কি ক্যালিফোর্নিয়ায়,
সেই সব গরম দেশে অকল্পনীয় সংখ্যায় জন্মায়
যত মিষ্টি খুবানী আর ভঙ্গুর পিচ ফল।
হয়তো সিসিলিতে তারা তোমার মুখশ্রী দেখতে পায়;
এখানে আমরা কোনমতে দেখতে পারি তোমার পোশাকের প্রান্ত।
জন ও নোয়ার সাথে টমেটোর আবাদ ভাগ করে নিতে
আমাকে হতে হবে যথেষ্ট শৃঙ্খলাপরায়ণ।
যদি অন্য কোন ভুবনে থেকে থাকে কোন ন্যায়বিচার,
যেখানে আমার মতই যাদের প্রকৃতি জোর করে রেখেছে
কঠোর মিতাচারে, অন্য পৃথিবীতে আমাদের পাওয়া উচিত
সব কিছুর সিংহভাগ, যাবতীয় ক্ষুধার বস্তÍ ও বাসনা
তোমার প্রশংসা হয়ে ওঠে। আর আমার চেয়ে
তীব্রতায় তোমার প্রশংসা করেনা আর কেউ,
আর কে এত বেদনার সাথে দমিত রেখেছে তার বাসনা,
আর কে বেশি আমার চেয়ে তোমার ডান পাশে বসার অধিকারী?
যদি সে থাকে, সেই চির অমর ডুমুর গাছ,
তার নশ্বর ফলের ভাগীদার হওয়া,
যে ডুমুর গাছ আহা কোনদিন
কোথাও ভ্রমণ করে না।
তথ্যসূত্র: ১. দ্য পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন,
২. দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউ,কে,।