বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েনে ব্যবসায় মন্দা, জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় কলকাতার হাজারো ব্যবসায়ী
বাংলাদেশ সংকটের কারণে হাজার হাজার মানুষ জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় আছেন বলে সতর্ক করেছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সেন্ট্রাল কলকাতার ব্যবসায়ীরা।
তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চলমান টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে অথবা সম্পত্তি বন্ধক রেখে সেন্ট্রাল কলকাতায় ব্যবসা শুরু করেছেন।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে বেশ কয়েকজন সদস্য আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা এবং দুদেশের মধ্যে চলা সম্পর্কের সংকটে অনেক ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫ হাজার হোটেল ও গেস্টহাউস রয়েছে। এখন ওইসব হোটেল-গেস্টহাউসে ঘর ভাড়া নেওয়ার হার ৫ শতাংশেরও কম বলে জানিয়েছেন হোটেল মালিকরা।
চৌরঙ্গি লেনের একটি গেস্টহাউসের মালিক বৈঠকে বলেন, ৩০ লাখ রুপি দিয়ে তিনি ওই সম্পত্তিটি লিজ নিয়েছেন। মাসে ভাড়া দিতে হয় ১.১৭ লাখ রুপি। বাংলাদেশি অতিথি না আসায় তার দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানান তিনি।
তার মতো একই অবস্থা আরও অনেক ব্যবসায়ীর।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলেন, 'বড় হোটেলগুলো হয়তো কিছু সময়ের জন্য এই মন্দা সহ্য করতে পারবে। কিন্তু এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন ছোট গেস্টহাউস লিজ নিয়েছেন, যেখানে কক্ষ রয়েছে মাত্র তিন বা চারটি। তারা স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখেছেন, জমি বিক্রি করেছেন অথবা চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। তারা আর এই ক্রমবর্ধমান ক্ষতির বোঝা টানতে পারছেন না।'
হোটেল মালিক, মুদ্রা বিনিময়কারী, ট্রাভেল অপারেটর, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ব্যবসায়ী মিলিয়ে এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা ১৫০-এর বেশি।
আরেক ব্যবসায়ী সংগঠন মার্কুইস স্ট্রিট ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ওয়েলফেয়ার সোসাইটিও শনিবার একই ধরনের আরেকটি বৈঠক করে। বৈঠকে অংশ নেওয়া সবাই ভারত সরকারকে ভিসা সংকট সমাধান এবং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে 'মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক' আগের মতো বজায় রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
হায়দার আলী খান বলেন, তাদের অ্যাসোসিয়েশনসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে এই বিষয়টি 'সর্বোচ্চ গুরুত্বের' সঙ্গে দেখার জন্য লিখিতভাবে জানাবে। কারণ এর সঙ্গে বহু মানুষের 'জীবিকা জড়িয়ে আছে'।
ট্রাভেল এজেন্টস ফেডারেশন অভ ইন্ডিয়ার জাতীয় কমিটির সদস্য এবং পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি অনিল পাঞ্জাবি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমি দুই দেশের সীমান্তে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছি। সীমান্তের উভয় পাশেই ব্যবসা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের একত্রিত হয়ে সমাধান বের করতে হবে। সরকারকে ভিসা সমস্যার সমাধান করতে হবে।'
এখন কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে ফ্লাইট চলাচল কমে গেছে। পাশাপাশি বাস অপারেটররাও তাদের পরিষেবার সীমিত করে দিয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত এক পরিবহন অপারেটর বলেন, যাত্রীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় তিনি সীমান্তের দুপাশে তার কর্মীদের সম্পূর্ণ বেতন দিতে পারছেন না।
কিড স্ট্রিটের বাসিন্দা, চিকিৎসক ও সিপিএম নেতা ফুয়াদ হালিম বৈঠকে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, '২০২২ সালে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ছিল ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এখানে বাণিজ্য একমুখী নয়। মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে উৎপাদিত তুলা মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মিলগুলোতে প্রক্রিয়াজাত হয়। এটি কাপড়ে রূপান্তরিত হয়ে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে যায়। সেই কাপড় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। তারপর প্রস্তুত পণ্য সারা বিশ্বে বিক্রি হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাহিত অর্থের একটি বড় অংশ ভারতেও ব্যয় হয়।'
দুদেশের সম্পর্কে চলমান উত্তেজনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিকিমের পর্যটন খাতও। কারণ, রাজ্যটিতে ঘুরতে যাওয়া আন্তর্জাতিক পর্যটকদের বড় একটি অংশই বাংলাদেশি। এই পর্যটকের অনেকেই শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে সিকিমে যায়। তবে শিলিগুড়ি বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় রাজ্যটির পর্যটন খাত চ্যালেঞ্জে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে নর্থইস্টলাইভ টিভি-র প্রতিবেদনে।
সিকিম ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে রাজ্যটিতে বাংলাদেশি পর্যটক গিয়েছিল ৪০ হাজার ৫৯৭ জন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ২৭ হাজার ১২৬ জন। অর্থাৎ সিকিমে বাংলাদেশি পর্যটক ক্রমেই বাড়ছিল।
নর্থ সিকিম চলতি মাসে পর্যটকদের জন্য ফের খুলে দেওয়া হয়েছে। এলাকাটিতে পর্যটকের প্রবাহে অনেক বেড়েছে। নর্থ সিকিমের আন্তর্জাতিক পর্যটকের প্রায় ৫০ শতাংশই বাংলাদেশি।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর দেওয়া সাময়িক নিষেধাজ্ঞায় পর্যটন-নির্ভর সিকিমের অর্থনীতিও বড় ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।