বৃষ্টিভেজা মাটির সুবাস ‘মিট্টি আতর’
তাজমহলের পুবদিকে, চার ঘণ্টার ধূলি-ধূসর পথ উজিয়ে গেলে দেখা মিলবে কন্নৌজ শহরের। সাদা-মার্বেলের বিস্ময়কর সৃষ্টি তাজমহল সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত, যা তিনি তার তৃতীয় এবং সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীর স্মরণে নির্মাণ করেন। মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল ষোলশ তের সালে তাদের তেরতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তাজ হলো শাহজাহানের সেই হৃত ভালোবাসার প্রতি প্রণতির তীব্র প্রকাশ। তবে আরও কিছু ব্যক্তিগত উপায়ে তিনি সম্রাজ্ঞীকে হারানোর শোক যাপন করতেন। এর একটি, জাহান আর কোনোদিন সুগন্ধি ব্যবহার করেননি।
সুগন্ধি তেল, যা ভারতে 'আতর' হিসাবেই পরিচিত—এই দম্পতির অন্যতম ব্যবহার্য উপাদান ছিল। তখনো এবং আজও, কন্নৌজ হচ্ছে উৎকৃষ্ট সুগন্ধি প্রস্তুতকারী স্থান—জুঁইয়ের তেল, গোলাপ জল, ভেটিভার ঘাসের গোড়ার আড়ক (বাংলায় যা 'গন্ধ বিনি ঘাস' নামেও পরিচিত), যা নাসারন্ধ্রে ঠাণ্ডা-শীতল পরশ এনে দেয়, এসব।
আতর তৈরির এই প্রক্রিয়া ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই; যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা উন্মেষেরও কয়েক হাজার বছর পূর্বের মাটির তৈরি পাতন পাত্র আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু বর্তমান কন্নৌজ এমন একটি ঐতিহাসিক সুগন্ধি প্রস্তুতকারী কেন্দ্র, যা এই শহরের পুরোভাগেই বিদ্যমান। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসীই কোনো না কোনোভাবে সুগন্ধির এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত।
সুগন্ধির প্রাচীন ঐতিহ্যের পাশাপাশি, কন্নৌজবাসী দুর্দান্ত এক দক্ষতাও অর্জন করেছে: তারা বৃষ্টির ঘ্রাণও ধারণ করতে সক্ষম!
সকল ঝড়ই একটি ঘ্রাণ বয়ে আনে আর তা ছেড়ে যায় প্রকৃতিতে। গ্রীষ্মের ঝড়ো হাওয়ার ঠিক আগে বাতাসকে পরিপূর্ণ করতে পারে, এমন ধাতব শক্তি ওজোন স্তর থেকে নেমে আসে, বৈদ্যুতিক নির্গমনের সঙ্গে অণু-পরমাণুর মিথস্ক্রিয়ায় যা তৈরি হয়—এই ক্ষেত্রে আলোর সঙ্গে অক্সিজেনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। ঠিক একইভাবে, জল-প্লাবনের সময় রাস্তায় উপচে আসা নর্দমার জলে বা জলাশয় থেকে উঠে আসা পরিচিত সোঁদা-পচা গন্ধটি জিওসমিন নামক যৌগ থেকে আসে।
জিওসমিন হলো ব্যাকটেরিয়ার একটি উপজাত, যা পদার্থকে পার্থিব তথা মাটিময় ঘ্রাণ দেয়। বৃষ্টির ফোঁটাও মাটির সংস্পর্শে এসে এই ঘ্রাণ সংবহন করে। ফলে এহেন ঘ্রাণ, পৃথিবীর সকল মহাদেশের সমস্ত ফুলের মতোই আলাদা আলাদা হতে পারে—হ্যাঁ, গোলাপ সুবাসের মতোই, পথ চলতি কোনো কার্নিশের মতো, আপনার দ্রুতবেগে ছুটে চলা গাড়িটির ভেতর হুট করে ঢুকে পড়ে যেমন।
বৃষ্টির গন্ধ এমনই, যা বৃষ্টির ধরন, পৃথিবীর যে অংশে তা ঝরে পড়েছে তার ধরন এবং আমাদের নাসারন্ধ্রের বিষয়ভিত্তিক পূর্বস্মৃতির ওপর নির্ভর করে। শহুরে বৃষ্টিতে যেমন বাষ্পীভূত এসফল্টের ঘ্রাণ মিশে থাকে, তেমনি গ্রামাঞ্চলের বৃষ্টির ঘ্রাণ ঘাসযুক্ত, মিষ্টি। মহাসাগরে বৃষ্টির ঘ্রাণ নোনতা-কটা, খনি অঞ্চল হতে বেয়ে আসা, ঝিনুক খোলের আধার ছুঁয়ে নামা ঝরনার জোয়ার-জলের মতোই তীব্র গন্ধযুক্ত।
দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার মরুভূমিতে বিরল ঝড় বায়ুমণ্ডলে ক্রিয়েসোট তেল এবং সেজ গাছের গন্ধ সমেত ঝাপট মারে। আর দক্ষিণ-পূর্বে, ঘন ঘন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আকস্মিক ঝড় ভেজা পাইন বনের স্যাঁতসেঁতে সতেজতা ছেড়ে যায়।
টমাস ওল্ফ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই অপূর্ব ঘ্রাণকে অভিহিত করেছেন, 'নির্মল কিন্তু ভয়াতুর' হিসেবে। তবে ভারতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, পশ্চিম আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে, পৃথিবীর জলবায়ু যেখানে চূড়ান্ত রকমের বিশৃঙ্খল, তেমন অঞ্চলে বৃষ্টির ঘ্রাণ খুব কড়া, যেখানে মরুভূমির শুষ্ক-শুকনো অংশে পৃথিবীর সবচেয়ে নাটকীয় মৌসুমী ঝড় পাক খেয়ে বেড়ায়। এখানকার শুকনো মাটি বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল আর এ অঞ্চলে জনজীবনের শৈশব থেকে শুরু করে ধর্ম-সংস্কৃতির সবই বৃষ্টির ছাঁটে তৈরি। এহেন জনগোষ্ঠির কাছে বর্ষার আগমন স্মৃতিগন্ধবাহীই বটে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসক ও লেখক সঞ্জিব চোপড়ার কাছে ভারতে, দীর্ঘ-প্রতীক্ষায় থাকা শুকনো মাটিকে ভিজিয়ে দেওয়া বৃষ্টির ঘ্রাণময় গন্ধটিই হলো 'জীবনের গন্ধ'। তপ্ত মাটি যখন বৃষ্টির জল শুষে নেয়, ঠিক তখনই পৃথিবীর কৌম গন্ধটি বেশ শক্তিশালীভাবে ধরা দেয়। আর এই ঘ্রাণ এতই তীব্র যে, খরায় ধুঁকতে থাকা প্রাণীরা বহু বহু দূর থেকে ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে আসে জলাশয়ের দিকে।
উনিশ শ পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে অস্ট্রেলিয়ার দুই খনিবিদ, ইসাবেল জয় বিয়ার এবং রিচার্ড গ্রেনফেল টমাস মনোরম আর তীব্র সুগন্ধির উৎস সন্ধানে যাত্রা শুরু করেন। অবশেষে, তারা উদ্ভিদ হতে নিঃসরিত তীব্র গন্ধযুক্ত জৈব যৌগের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে থাকা যৌগের সম্পর্ককেই 'গন্ধ' হিসেবে অভিমত দেন।
টারপেনটিন ও রজন পদার্থের প্রধান উপাদান 'টারপেন' মূলত উদ্ভিদ বা ফসলের যে অংশে তেলজাতীয় পদার্থ রয়েছে, তার থেকে উৎসারিত। পাইনের সতেজতায়, গোলমরিচের শীতল অভিব্যক্তিতে, আদার ঝাঁজে যা মিশে রয়। শিলা ও কাদামাটি স্পঞ্জের মতোই বায়ুমণ্ডল থেকে টারপেন ও অন্যান্য অণু শোষণ করে এবং শুকনো মওসুমে মরুভূমির মতো জায়গাগুলিতে যৌগের দুর্দান্ত মজুদ তৈরি করে।
আর এ মতন মজুদে বর্ষার জল গড়ালে? শুকনো মাটি চুঁইয়ে জল যখন সেই গন্ধ-মজুদে পৌঁছায়, তখন বাতাসে তার তীব্র প্রকাশ ছড়িয়ে পড়ে। খরার প্রবণতায় গন্ধ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে; কেননা ভূ-অভ্যন্তরে পাথরের স্তরগুলিতে সেই টারপেন অণু দীর্ঘসময় লেগে থাকার ফলে পাথরের গায়ে জেঁকে বসেছে আরও।
উনিশ শ চৌষট্টি সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, বেয়ার ও টমাস বৃষ্টিধারার এই সুগন্ধির একটি নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তারা নাম দিলেন 'পেট্রিকর'। গ্রীক পুরাণে গ্রীক শব্দ পেত্রা মানে শিলা এবং ইকর মানে দেবতাদের রক্ত; এই দু'য়ে মিলে পেট্রিকর। তবে বিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন, বেয়ার ও টমাসই বৃষ্টি বা ঝড়ের গন্ধ প্রথম শনাক্তকারী নন। এমনকি তারাই এটি প্রথম খুঁজে বার করেন, তেমনও নয়। প্রকৃতপক্ষে, তারা যে গন্ধ বা ঘ্রাণটির কথা বলেছেন, তা ইতোমধ্যে কন্নৌজে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রোদে পোড়া মাটি থেকে গন্ধকে বিযুক্ত করে এবং প্রাচীন পাতন কৌশল খাটিয়ে একে আহরণ করা হতো, যার নাম মিট্টি আতর বা মাটির সুগন্ধি।
অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের ওই নিবন্ধ যখন পাঠ করছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল, কন্নৌজবাসী কি আজও, এই অর্ধ শতাব্দী পরেও বৃষ্টির সুগন্ধি তৈরি করছে? ফলে, আমি শক্তি বিনয় শুক্লার খোঁজ লাগালাম, বিনয় ভারতীয় সরকারি সংস্থা ফ্রেগরেনস অ্যান্ড ফ্লেভর ডেভলপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক আর সংস্থাটি স্থানীয় সুগন্ধি ও গন্ধসার তেল বিকাশে নিয়োজিত।
ফিরতি খবরে আমি রীতিমতো শিহরিত হলাম এটা জেনে, কন্নৌজবাসী এখনো মিট্টি আতর তৈরি করছে এবং আগামি বর্ষার প্রাক্কালে যদি কন্নৌজে আসতে পারি, তাহলে নিজেই এই প্রক্রিয়া চাক্ষুষ করতে পারব!
আট হাজার মাইল উড়ে এসে এবং ট্রেনে চেপে উত্তর-মধ্য উত্তর প্রদেশের এমন একটি প্রাচীন শহরে নিজেকে দেখতে পেলাম, যে শহর আজও অতীতের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। শহরের উপকণ্ঠে, কয়েক মাইল ধরে প্রসারিত সুগন্ধি ফসলে ভরা মাঠ, কিছুদূর পরপর মাঠের মধ্যে ছোট আকারের ইটের তৈরি চিমনি, সংখ্যায় শ'খানেক (বলা ভালো, এই চিমনিগুলোও কন্নৌজের পরিচায়ক)।
আতরের ঐতিহ্যের মতোই, আজও কন্নৌজে চিমনির জন্য বিশেষ ইট বানানো হয়। যেমন শতাব্দী আগে তৈরি হতো লাল মাটির উপরিভাগ থেকে ছেনে ছেনে, স্তুপ করে, ছাঁচে ভরে, আগুনে পুড়িয়ে... পিতামহ, প্রপিতামহ এবং প্রপ্রপিতামহরা যেমন মাটি ছেনে, স্তুপ করে, ছাঁচে ভরে, আগুনে পুড়িয়ে ইট বানাতেন। ফসলের সারিতে, সাদা জুঁই ফুলেরা স্টার ফিশের আদলে ফুঁটে আছে গাঢ় সবুজ সমুদ্র হয়ে। গুল-হিনার ঝাড়ে ফুঁটে থাকা ছোট ছোট ফুলগুলো যেনে সাদা আগুনের শিখা হয়ে ছড়িয়ে আছে দিগন্তে।
এমনিতে হিনা বা মেহেদি পাতার কদর আকাশচুম্বী। নারীদের হাতে-পায়ে-চুলের সজ্জায় এই পাতা বাঁটা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এর ফুল থেকেও একটি সূক্ষ্ম আর মিষ্টি গন্ধের আতর তৈরি হয়।
এক লিটার শুদ্ধ হিনা আতর তৈরিতে প্রায় একশ পাউন্ড গুল-হিনার পাপড়ি এবং এক লিটার খাটি চন্দন কাঠের তেল মেশাতে হয়! এখানকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারগুলো খুব ভোরে কিংবা ছায়া ছায়া সন্ধ্যায় সুগন্ধি গাছ থেকে ফুল বাছে। পাটের বস্তায় পাপড়িগুলো ভরে, শুকিয়ে আসার আগেই দ্রুত শহরের স্টিম ডিস্টিলারিগুলির দিকে ছোটে।
কন্নৌজ শহরে এমন দুই ডজন স্টিম ডিস্টিলারি বা বাষ্পীয় ভাঁটিখানা রয়েছে। বর্তমানে, কন্নৌজ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগতভাবে একটি জেলাও, যার অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় পনের লাখ। তবে শহরের পুরনো অংশটিই সুগন্ধের প্রাচীনতম ঐতিহ্যকে পুরোভাগে ধারণ করে আছে; শহরের এই অংশের আনুমানিক চল্লিশ হাজার গেরস্থ কোনো না কোনোভাবে সুগন্ধি শিল্পে যুক্ত।
শহরে ঢুকেই খেয়াল করলাম, পথের ধারে ছোট ছোট বাড়ি আর সব বাড়ির সামনেই একটি করে সুগন্ধি-আতরের দোকান। কোনো এক পূজার সময় ছিল সেটা; দেখতে পেলাম বাহারি রঙে সাজানো এক দেবতার ছোট ছোট বিগ্রহ বসানো আছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। রাস্তার মাঝখানে দুয়েকটা গরু ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর মাঝখান দিয়েই ধূপকাঠি বোঝাই সাইকেল আরোহী ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। টানা রাস্তা জুড়েই কন্নৌজের বিস্তৃত ব্যবসাপাতির খবর, হিন্দি ও উর্দুতে লেখা 'সুগন্ধি, সুরভিত তামাক এবং গোলাপজল'।
বিনয় শুক্লা এমন একজন মানুষ, সহকর্মীরা যাকে সুপারস্মেলার (একজন তো আগ বাড়িয়ে ঘোষণাই দিলেন: ওর নাক হচ্ছে পৃথিবীর সকল নাকের বাবা!) নামে ডাকে। এই যাত্রায় তিনিই আমার আমন্ত্রয়িতা এবং গাইড। শুক্লা ইউরোপীয় সুগন্ধি শিল্পশালা হতে প্রশিক্ষিত। নিজ দেশের আতর শিল্পকে আধুনিকতার কাছে, বিদেশি বাজারের কাছে হারতে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে, ভারত যখন মুক্তবাজার অর্থনীতি শুরু করে, তখন ব্র্যান্ড-সচেতন তরুণ ভারতীয়রা ফরাসি পারফিউমের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এর এক দশক বা তারও আগে থেকে, তামাকজাত পণ্যে সুগন্ধি ব্যবহারের অংশ হিসেবেই আতর শিল্পটি ধুঁকে ধুঁকে টিকে ছিল এবং এখনো আছে। তবে বেশ কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপকরণ নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তামাক বর্জনের ঘোষণায় এই শিল্পের বাজার এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।
যেদিন কন্নৌজে পৌঁছলাম, সেদিনই বড় রাস্তার ওপারে, আবর্জনায় ঠাসা গলিপথের শেষে, সিয়ারামের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। এই পরিবারটি বাড়ির পিছনের একটি কূয়া থেকে সুগন্ধি মাটি তুলে স্থানীয় সুগন্ধি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। বর্ষার সময় বৃষ্টির জলে কূয়াটি ভরে যায়, গ্রীষ্মের শুরুতেই কূয়াটি শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলে মাটি তোলার কাজ চলে। সিয়ারামের পরিবার—মা, বাবা এবং বাড়ন্ত শিশু, সবাই শুকনো মাটি গুঁড়ো করতে কাঠের হাতা ব্যবহার করে। সেই গুঁড়ো মাটিতে জল মিশিয়ে ছাঁচে ভরে মাটির চাঁই বানায়। তারপর ভাঁটিখানায় শুকিয়ে আনে। এই শুকনো মাটির চাঁইকে স্থানীয়রা 'খাপড়ি' নামে ডাকে। আর পরিণত হওয়া এই খাপড়িই 'মুন্না লাল সন্স অ্যান্ড কোং'-এ এসে পৌঁছায়।
পরদিন আমরা পুরানো কন্নৌজের সরু, ঘোরানো-প্যাঁচানো পথ খুঁজে মুন্না লাল সন্স অ্যান্ড কোং-এর দেখা পাই। সেখানে এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম শ্রী অখিলেশ পাঠক ও চতুর্থ প্রজন্মের সদস্য অখিলেশের কন্যা স্বপ্নিলের দেখা মেলে। স্বপ্নিল বছর চব্বিশের এক তরুণী, যে সদ্যই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছে, বড় হয়েছে বোর্ডিং স্কুলে এবং পরিবারের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি বাণিজ্যটির ঠায়-ঠিকুজি জানতে মাত্রই শহরে ফিরেছে।
এই পরিবারের প্রতিটি প্রজন্মই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাভেলির সম্প্রসারণ করেছে। নির্মিত ভবনের অদূরেই লাইলাক ঝোপের ছায়ায় বিশ্রামরত মহিষের পালটি, বসবাসের ভবন আর সুগন্ধি তৈরির কারখানাকে আলাদা করেছে। অখিলেশ আমাকে জানালেন, তার দাদা মুন্না লাল উনিশ শ এগার সালে এই ব্যবসায়ের গোড়াপত্তন থেকেই বৃষ্টির সুবাসকে ছানতে পেরেছিলেন; মুন্না লাল পরে এই কৌশল অখিলেশের বাবাকেও শিখিয়েছিলেন, যিনি একসময় পুত্র অখিলেশকে একই কৌশল সেখাতে সমর্থ হন।
কন্নৌজ যদি গত শতাব্দীর আবহে বিদ্যমান হয়, তবে যে ডিস্টিলারিগুলিতে এহেন বৃষ্টির সুবাস ছেনে তোলা হয়, সেসব তাহলে সহস্রাধিক কালের পুরনো কৌশল। কোনো কৃত্রিম আলোকসজ্জাহীন, এই শিল্পে ব্যবহার্য আধুনিক এমন ভারি কোনো যন্ত্রপাতি নেই, আধুনিকতার কোনো লেশমাত্রই নেই। ছাদ এবং পাশের খোলা দেয়াল দিয়ে প্রাকৃতিক আলো এসে পড়ছে, বড় বড় তামার পাত্রের নিচে গনগনে আগুন, পাত্রগুলোকে ওরা 'ডেকচি' নামে ডাকে, সারি সারি ইটের তৈরি উনুনের ওপর ডেকচিগুলো যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনো প্রাণীর বৃহদাকায় ডিম!
কন্নৌজে প্রচলিত প্রাচীন এবং শ্রমসাধ্য এই ধীর-পাতন পদ্ধতিকে ডেগ-ভাপকা বলা হয়। যখন ফুলের নতুন তাজা সরবরাহ আসে, তখন কারিগররা ডেকচিতে গোলাপ বা জুঁই বা অন্যান্য ফুলের পাপড়ি ঢেলে, ডেকচিতে জল ভরে তার ওপর ঢাকনা এঁটে দেয়। বাষ্প আটকে রাখার জন্য ঢাকনার চারাপাশে মাটির লেই দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উনুনে জ্বালানী হিসেবে কাঠ বা গোবরের ঘুটে ব্যবহৃত হয়। তারপরে সুগন্ধির ধারক পাত্রটিতে চন্দন কাঠের তেল ভরা হয় এবং পাত্রটি সংলগ্ন মাটির গর্তে রেখে দেওয়া হয়।
ডেকচি থেকে বাঁশের একটি পাইপ সুগন্ধির ধারক পাত্রটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। চন্দন কাঠের তেল পূর্ণ সেই পাত্রে বাষ্পরূপী সুগন্ধি চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমা হয়। সিয়ারাম ও অখিলেশ পাঠক পরিবারের মতো, ডিস্টিলারি কারখানার শ্রমিকরাও পিতা এবং প্রপিতামহের কাছ থেকে বংশ পরম্পরায় যথাযথ দক্ষতা অর্জন করেছে।
আগুনের তাপকে খুবই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এই কারিগরদের। তাই উনুনের আঁচ এমন রাখতে হয়, যেন ডেকচির ভেতরকার জল বাষ্পীভূত হওয়ার জন্য যথেষ্ট গরম থাকে; আবার এমন গরমও যেন না হয়, যা সুগন্ধকে পুড়িয়ে ফেলে। ধারক পাত্রটিকে অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণে ঠাণ্ডা হতে হয়, যাতে করে বাষ্প তরলে পরিণত হয়ে চন্দন তেলের সঙ্গে মিশে আসল সুগন্ধি তৈরি হতে পারে। ঘণ্টায় ঘণ্টায়, ধারক পাত্রটিকে ভেজা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে শীতল রাখা হয়। এই পক্রিয়ায়, সাধারণত একশ পাউন্ড পাপড়ির নির্যাস জমা হতে প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা সময় নেয়।
আমি যেদিন পরিদর্শন যাই, সেদিন, ডিস্টিলাররা এমন আতর তৈরি করছিল, যা কোনো উদ্ভিদ থেকে নয়; বরং সিয়ারামদের তৈরি মাটির খাপড়ি থেকে প্রস্তুত হচ্ছিল। উপরে বর্ণিত পাতন প্রক্রিয়ায়, এই খাপড়ি থেকেও সুগন্ধি বেরিয়ে আসতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। ধারক পাত্রে জমা হওয়া আরক থেকে সুগন্ধি-তেলের অংশটি (যা পরে আতর হিসেবে ব্যবহৃত হবে) ছেনে নেওয়ার কাজটি খুবই সাবধানে করতে হয়; পূর্ব অভিজ্ঞতা ও যথেষ্ট দক্ষতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। এই ছেনে তোলা সুগন্ধি তেলের অংশটি 'কূপ্পি' নামক এক ধরনের চামড়ার বোতেলে ভরে বোতলের মুখটা ভালো করে এঁটে দেওয়া হয়।
বিনয় শুক্লা জানালেন, কূপ্পিতে সংরক্ষিত না করা মানে হলো আতরকে 'হেলাফেলায় নষ্ট করে ফেলা', পাশাপাশি আধুনিক উৎপাদন কৌশল এবং বিশেষত প্লাস্টিকের ব্যবহারেও শুক্লার সাফ আপত্তি। কেননা, 'সুগন্ধি আরককে চামড়ার বোতলে রাখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক যেমন আপনি আপনার ত্বকে সুগন্ধি আতর মাখেন, তেমন। চামড়ার বোতলে রাখা আতরে অবশিষ্ট কোনো আর্দ্রতা থাকলে তা ছাড়তে এবং এর আসল সুরভির উপলব্ধি এনে দিতে সাহায্য করে, ঠিক যেমন শুকনো মাটিতে বৃষ্টির জল।
মিট্টি আতর সন্ধানের এই ভ্রমণে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল রাজু মালহোত্রা নামের তিন-তারকা সম্বলিত দোকানির সঙ্গে আলাপ। রাজুর মালিকানাধীন এই খুচরা আতরের ব্যবসা তিন পুরুষের। রাজু নিজেই দোকানের কাউন্টার সামলান। কাউন্টারের পিছনে ধাতব তাকগুলো নানা আকারের কাঁচের বোতলে ভর্তি। বোতলে বোতলে জুঁই, চম্পা, গোলাপ, কেওড়া, তিন ধরনের পদ্ম, আদা লিলি, গার্ডেনিয়া, ফ্রেঙ্গিপানি, ল্যাভেন্ডার, রোজমেরি, উইন্টারগ্রিন, জেরানিয়াম এবং এ রকম আরও কতক সৌরভ, যার নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।
কাউন্টারেই মিট্টি আতরের এক ইঞ্চি মাপের লম্বা কাঁচের বোতলে রাখা ছিল। বোতলের ছোট্ট সোনারঙা ছিপিটি মুচড়ে খুললাম। চোখ বন্ধ করে ভারতীয় বৃষ্টির ঘ্রাণ টেনে নিলাম। ঠিক যেন সোঁদা মাটির গন্ধ! সিয়ারামের বাড়ির সেই কূয়ো থেকে তোলা শুকনো মাটিতেও এমন গন্ধই পেয়েছিলাম। আমার শৈশব এবং যে ভূখণ্ডে আমার বসবাস, সেখানকার বৃষ্টির ঘ্রাণের চাইতে এই ঘ্রাণ একেবারেই আলাদা। ওজোন ভরা বাতাস, ভেজা শ্যাওলা, উলফ কথিত 'নির্মল কিন্তু ভয়াতুর'। তবে এই সৌরভের আবেদন এক কথায় দুর্দান্ত: উষ্ণ, জৈব, খনিজ সমৃদ্ধ।
এ হলো দীর্ঘ অপেক্ষার ঘ্রাণ, চল্লিশ বা তারও অধিক বছর সময় ধরে একটি চন্দন গাছ তার হৃদয়সম গুড়িতে সুগন্ধকে আটকে রেখেছে, বাড়তে দিয়েছে; জুলাইয়ে বর্ষা নামার আগে উত্তর ভারতের বিখ্যাত চিটচিটে গরম, ধুলোবালিময় গ্রীষ্ম; উনুনের নিয়ন্ত্রিত আঁচে জ্বলা ধীর-আগুনের তাপে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে আসা।
সুপারস্মেলার শুক্লার কাছে জানতে চাইলাম, মিট্টি আতর শুঁকে আপনার কি মনে হলো? তিনি বললেন, 'এ তো আমার ঘ্রাণ, আমার দেশের মাটির ঘ্রাণ।'
- অনুবাদ: মাহমুদ আলম সৈকত