মৃত্তিকা-বৃক্ষ-পুরাণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাই ছিল আমাদের আমলে ১৯৬০ এর দশকে একটি স্কুলপাঠ্য গল্প। বালক বলাইয়ের আবেগটা বুঝে উঠতে আমাদের সময় লেগেছে:
এক-একদিন ওর কাকির কোলে এসে বসে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, 'ঐ ঘাসিয়াড়াকে বলো না, আমার ঐ গাছগুলো যেন না কাটে।'
কাকি বলে 'বলাই কী যে পাগলের মতো বকিস। ও যে সব জঙ্গল, সাফ না করলে চলবে কেন?'
বলাই অনেকদিন থেকে বুঝতে পেরেছিল, কতকগুলো ব্যথা আছে যা সম্পূর্ণ ওর একারই - ওর চারিদিকের লোকের মধ্যে তার কোনো সাড়া নেই।
বলাইর কষ্টটা তখন আমাদের স্পর্শ করেনি, হয়ত এখনও পুরোপুরি করে না। ঘাসের কথা বাদই থাক, পৃথিবীতে প্রতিবছর আনুমানিক ৬৪ থেকে ৬৫ বিলিয়ন গাছ গুড়ি থেকে কেটে ফেলা হয়। আর এ নিধনযজ্ঞের প্রায় সবটাই হয়ে থাকে যাকে উন্নয়নের নামে।
রাজপ্রাসাদ তৈরি করা এটাও তো উন্নয়ন। কারণ প্রাসাদ বিদেশি পর্যটককে বলে দেবে দেশের বিত্ত ও বৈভবের কথা।
১৭৩১ সাল। রাজস্থানের অরণ্যাঞ্চলে আরো একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করতে হবে। জায়গাটা যোধপুরের জলনদী গ্রামে। মহারাজ অভয় সিং পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজ সব পাঠিয়ে দিলেন। অরণ্যসহ গ্রাম ঘেরাও হলো। এই অঞ্চলের মানুষ গুরু জাম্বাজির অনুসারী - মূলত প্রকৃতি পুজারী, তারা প্রাণী ও বৃক্ষের অনিষ্টকরণের ঘোর বিরোধী। এই গ্রামেরই একজন অমৃতা দেবী জানেন যে বৃক্ষ নিধনে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাও আছে। মহারাজের বাহিনী যখন কুড়াল চালাচ্ছে, তিনি একটি বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরলেন। অমৃতা দেবী গাছের উপর এই অনাচার সহ্য করার চেয়ে জীবন দেয়া শ্রেয় মনে করে গাছকে, আলিঙ্গন করে আঁকড়ে থাকলেন। অন্যরাও তাকে অনুসরণ করল। কিন্তু মহারাজ অভয় সিংয়ের সৈন্যরা মনে করল একটি গাছ ফেলে দেওয়ার চেয়ে অনেক সহজ এর মাথা ফেলে দেওয়া। অমৃতাকে হত্যা করল তারা।
কিন্তু তাতেই ঘটনা শেষ হল না, এগিয়ে এলেন অমৃতার তিন কন্যা, প্রাণ দিলেন তারাও। এবার রুখে উঠল গ্রামবাসী, বন কেটে রাজপ্রাসাদ বানাতে দেবে না তারা। প্রতিবার প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৬৩ জনে।
মহারাজ অভয় সিং শেষে অনুতপ্ত হয়ে তার বাহিনী প্রত্যাহার করলেন এবং প্রাসাদ নির্মাণ পরিকল্পনাও বাতিল করলেন।
বৃক্ষ বাঁচাতে আরও শতবর্ষ আগে দুই নারী ও এক পুরোহিত নিহত হন। তবে অমৃতা দেবীই প্রথম খ্যাতিমান শহীদ।
গত শতকের সত্তরের দশকের চিপকো আন্দোলনও বৃক্ষ এবং পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন।
আপ্পিকো আন্দোলনও বৃক্ষ রক্ষার। আপ্পিকো মানে আলিঙ্গন। বৃক্ষকে আলিঙ্গন। বৃক্ষ বাঁচাতে হলে বৃক্ষকে আলিঙ্গনই করতে হবে। মৃত্যু যদি আসে অমৃতা দেবী যেভাবে তা বরণ করেছেন, মৃত্যুকে সেভাবেই বরণ করে নিতে হবে।
রাজপ্রাসাদ হয়ত নির্মিত হতে পারত, কিন্তু মহারাজা অভয় সিং ঘাবড়ে গেলেন এবং এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, বৃক্ষের আর ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। গাছের জন্য এতো প্রাণনাশের ঘটনা আর কোথাও নেই। বৃক্ষের জন্য আত্মবলিদান সারা পৃথিবীকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।
৪৭০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে গাছ বিরাজ করছে। আর পরিণত হওয়া গাছের সংখ্যা আনুমানিক তিন ট্রিলিয়ন; বৃক্ষ প্রজাতির সংখ্যা আনুমানিক ৬০ হাজার থেকে এক লক্ষ। এর অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে ব্রাজিলে। যে বিপুল সংখ্যক বৃক্ষকে প্রতি বছর জীবন দিতে হয় বড় জোর তার এক তৃতীয়াংশ রোপিত হয়ে নতুন গাছের সম্ভাবনা জাগায়। মানুষের কৃষিজীবনের বয়স ১২,০০০ বছর অর এই সময়ে পৃথিবীর গাছের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৪৬ ভাগ। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ৯০ ভাগে গাছের জন্ম ও বিকাশ হয়নি হয়েছে শেষ ১০ ভাগ সময়ে। অপেক্ষাকৃত বড় গাছের বয়স শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের চেয়ে প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর কম, আনুমানিক ৪২০ মিলিয়ন বছর। গাছের তিন ফুট দৈর্ঘ্য ছাড়িয়ে যেতে অন্তত এই সময়টা লেগেছে। হাজার বছর ধরে গাছ মানুষের পূজনীয়, আক্ষরিক অর্থেই মানুষ গাছের পূজো করে আসছে। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে বলে ধরে নেওয়া হয় পৃথিবীতে গাছের সংখ্যা তার ৪২২ গুণ।
গাছ মানুষকে প্রশান্তি দেয়। গাছ থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক মানুষের মন প্রফুল্ল করে তোলে। ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব বৃক্ষের সাথে পৃথিবী পরিচিত। এ সময় বৃক্ষের বিপন্ন প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০। কোনো কোনো বৃক্ষ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে না; উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গলে বুড়ো মেথুসেলাহর (এটি পাইন গাছ) সন্ধান মিলেছে, বয়স আনুমানিক ৪৮৪৮ বছর: চিলিতে ৩৬০০ বছর বয়সী সাইপ্রেস বা সরলবর্গীয় বৃক্ষ রয়েছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি গাছের বয়স ধার্য হয়েছে ৫০৬২ বছর। দক্ষিণ এশিয়ায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মপূর্বকালের বৃক্ষ আবিষ্কৃত হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। গিঙ্গো বিলবোয়া গাছ হাজার বছর বাঁচে, আবার কোনোটা ২০ বছরও ডিঙ্গাতে পারে না। দেখা গেছে গাছের কান্ডের ৯৫ ভাগই মৃত, তারপরও তা বেঁচে আছে। আড়াআড়ি কাটা গাছের কান্ডের ভেতরকার বৃত্তগুণে বয়স নির্ধারণ করা যায়, একে বলা হয় ডেমডোক্রোনোলজি। অরণ্যের গাছ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে এর কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম্ বৃক্ষরাজি বৃদ্ধি পেলে বিপন্ন জীবের অবলুপ্ত হবার সম্ভাবনা কমতে থাকে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন বিরান প্রান্তরে একটি গাছই এক থেকে ৮০টি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতিকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারে।
মানুষের ভয়ঙ্কর অবিবেচনাপ্রসুত অত্যাচার সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয় গাছকে। যন্ত্রনায় গাছ দুমড়ে মুচড়ে কোচকাতে থাকে, মানুষ মোটেও গা করে না। কোনো একটি প্রাণী হলে চিৎকার করে উঠত। একটি গাছের কাছাকাছি কোথাও একটি গভীর নলকূপ খনন করে বিভিন্ন প্রয়োজনে যখন পানি সরাতে শুরু করা হয়, কখনো আমাদের মনে হয় না পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, কখনো এটাও মনে হয় না আশেপাশের গাছগুলো যে গভীরতা থেকে পানি শোষণ করত, তা আর সেখানেই নেই, সুতরাং পানির কষ্ট এসে যায় গাছের জীবনে।
ঢাকা শহরে কোনো বড় গাছ চোখে পড়লেই দেখা যাবে গাছটি ঘিরে বহু সংখ্যক ইস্পাতের পাতের উপর পোস্টার - তাতে হারানো যৌবন ফিরে পাবার রগরগে বিবরণ থেকে শুরু করে, শ্রীপুরের বটিকার প্রাপ্তিস্থানও গাছের শরীরে পেরেক ঢুকিয়ে ইস্পাতের পাতে লিখে আটকানো আছে। পরিবেশ বিপর্যয় বাড়িয়ে তুলেছে অরণ্যে অগ্নিকাণ্ড। কোনো কোনো অরন্যের আগুন নেভাতে ছ'মাসও লেগে যায়।
লেখালেখির কাগজ, টয়লেট টিস্যু, ঘরে ব্যবহৃত কাঠ ও তক্তা এবং খড়ি সব মিলিয়ে একজন আমেরিকান প্রতি বছর ষোল ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ২০০ ফুট লম্বা একটি বৃক্ষের মুলোৎপাটন করছে, তারা গড়ে ৭৫০ পাউন্ড কাগজ ব্যবহার করে থাকে। একটি একক গাছ গড়ে এক টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেয়। ২৬০০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে একটি গাড়ি যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে একটি গাছে এক বছরে তা হজম করতে পারে। একটি গাছ বছরে ২৬০ পাউন্ড অক্সিজেন নিঃসরণ করে। হিসেবে দেখাচ্ছে ৪ জনের একটি পরিবারের জর্য প্রাপ্তবয়স্ক ২টি গাছই যথেষ্ট।
গান্ধীর স্মরণীয় উক্তি: মানুষের যা প্রয়োজন তা সরবরাহ করার ক্ষমতা ধরিনীর রয়েছে কিন্তু সকল মানুষের লোভ নিবৃত্তি করার সম্পদ তো তার নেই।
সুতরাং লড়াইটা মানুষের লোভের বিরুদ্ধে। গাছ ও প্রকৃতি বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতেই বেশ কটা বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, কোনো কোনোটা রক্তক্ষয়ী: ১৭০০ শতকে রাজস্থানে মারোয়ারে অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে বিষ্ণয় আন্দোলন, ১৯৭৩ সালে উত্তরাখন্ডে চিপকো আন্দোলন, ১৯৭৮ সালে কেরালাতে সাইলেন্ট ভ্যালি বাঁচাও আন্দোলন, ১৯৮২ সালে বিহারের জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন, ১৯৮৩ তে উত্তর কন্নড় ও কর্নাটকে আপ্পিকো আন্দোলন, ১৯৮৫ সালে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন এবং ১৯৯০ সালে উত্তরাখন্ডে তেহরি বাঁধ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
গাছ বাঁচাও এর পাশাপাশি গাছ লাগাও আন্দোলনও চালাচ্ছে: অস্ট্রেলিয়াতে গ্রিনিং অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ওয়ান মিলিয়ন ট্রি মুভমেন্ট, কেনিয়ার গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট, ট্রি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিলিয়ন ট্রি মুভমেন্ট, গ্রিনিং দ্য ডেজার্ট প্রভৃতি আন্দোলন এখন পৃথিবীর দেশে দেশে। এমনকি বাংলাদেশেও ঘটা করে বৃক্ষরোপণের অভিযান হয়। তারপরও ধ্বংসের এক তৃতীয়াংশও সৃষ্টি হচ্ছে না বলেই পরিবেশবিদরা মনে করছেন।
ফিলিপিন্সের সেন্ট্রাল লুজন অঞ্চলের একটি দুই লেন রাস্তাকে চার লেনে উন্নিত করার কর্মসূচি হাতে নিলে ডিজাইনে দেখা গেল প্রকল্পের জন্য ১৮০০ বৃক্ষের মুলোৎপাটন করতে হবে। জনগণ প্রতিবাদ করল, কিন্তু স্পিকার সরেজমিনে দেখে এসে রায় ছিলেন: উন্নয়নে পথে বৃক্ষকে বাধা হয়ে দাঁড়ালে চলবে না, সরে যেতে হবে।
ভারতের কেরালো ব্যাঙ্গালোর সড়ক দুই থেকে চার লেনে বাড়ানোর জন্য ১৬০০০ বৃক্ষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। উন্নয়নপন্থীদের স্লোগান ছিল, বৃক্ষ নিপাত যাক আসুন রাস্তা বানাই।
ইনট্যাক্ট ফরেস্ট-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে ২০০০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে আরন্যক জমি কমেছে ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার, প্রতিবছর বৃক্ষ লালনকারী যে জমি কমেছে তা কোস্টারিকা নামের দেশটির সমান।
শুধু জমি কমে যাওয়া কিংবা গাছ কেটে তক্তা বানানো- এটাই বিষয় নয়, এই হ্রাস জীব বৈচিত্র সঙ্কুচিত করে আসছে। সুমাত্রার বাঘ, ওরাংওটাং কিংবা রাইনো বিপন্ন প্রাণী হয়ে পড়েছে। গাছ নেই, তাদের বিচরণ ক্ষেত্রও কমে গেছে। গাছ কমে যাওয়া কার্বন শোষণ ক্ষমতা কমে যাওয়া। অরন্য নিধন কুড়ি ভাগ গ্রিন হাউস বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বৃক্ষহ্রাস আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বহীনতার হুমকিতে ফেলে দেয়।
আমাজনের দস্যু কাঠুরের ট্রাক পুড়িয়ে দেবার ঘটনা ঘটেছে। শুরুতে গাছ লুটেরা ও করাতিদের সংঘবদ্ধ সশস্ত্র দলের বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার ছিল তীর-ধনুক, গুলতি। এখন তাদের হাতে সীমিত অস্ত্রও এসেছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে তাদের জিপিএস ট্র্যাকারের ক্যামেরা ট্র্যাপ।
নাইজেরিয়ার তারানা অঙ্গরাজ্যের অরণ্যে যে নির্দয় লগার প্রবেশ করেছে তার অন্ততঃ একটি ভালোদিক আছে- নির্বিচারে গাছ কাটাছে না। তাদের চাই রোজউড বৃক্ষ। আফ্রিকান রোজউডের সবচেয়ে বেশি কদর চীন দেশে, সুতরাং লগার বনের ভেতরে ঢুকে বেছে বেছে রোজউডে বৃক্ষের পতন ঘটাচ্ছে। থাইল্যান্ডের অরণ্য থেকে সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ব্ল্যান্ড টিদ্বার। বৃক্ষ কসাইরা কম্বোডিয়ার জঙ্গলে বন বিভাগের পাঁচজন রেঞ্জারকে হত্যা করেছে। এই ঘাতকরাও জিপিএস ট্র্যাকার সাথে রাখে আর হাতে হাতে তাদের থাকে একে ৪৭ রাইফেল।
প্রতিরোধ বড় কঠিন কাজ হতো না যদি না সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন চোরাচালান চক্রের সাথে যুক্ত থাকত। দুর্ভাগ্যবশত ব্রাজিল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত বৃক্ষ ঘাতক কোনো না কোনভাবে রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পেয়ে আসছে।
গাছ বাঁচাতে ১৯২৭ সালের ফরেস্ট অ্যাক্ট!
বাংলাদেশে বৃক্ষ উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে আনীত ১৯২৭ সালের ফরেস্ট অ্যাক্ট-এর একটি মামলার এক বুড়ো বৃক্ষ তস্করের ঘটনা:
সংরক্ষিত বনের ভেতর দীর্ঘক্ষণ ধরে করাত ও কুঠারের আওয়াজ শোনার পর বনপ্রহরীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওয়ানা হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা ধূপধাপ শব্দ শুনে অনুমান করতে পারে যে চোরাই বৃক্ষ নিয়ে তস্কররা পালিয়ে যাচ্ছে। তখন তারা তাদের গতি বৃদ্ধি করে। তস্করদের প্রায় সকলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বয়ঃবৃদ্ধ একজন হুমড়ি খেয়ে একটি গুড়ির উপর পড়ে যায়। বন প্রহরীদের নেতাসহ তাদের সকলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে আটক করতে সক্ষম হয়। এই তস্করচক্র বহুদিন ধরে বন উজাড় করতে থাকলেও এবার তাদের একজন সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হল না। মামলা হল। আইন অনুযায়ী বৃদ্ধের কমপক্ষে ৬ মাসের কারাদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃত চোর ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে গেল। এই বুড়ো মূলচোরের নিয়োজিত ঠিকাদারের একজন অস্থায়ী দুর্বল শ্রমিক মাত্র। বুড়ো বলেই তাকে ধরা পড়তে হয়েছে। প্রকৃত বন মাফিয়া, চোর ঠিকাদার, শ্রমিক সর্দার সবাই নিরাপদই রয়ে গেল। অর্থাৎ তারা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পেল।
জীবন ও বৃক্ষ। সে কালে স্কুল পাঠ্য আর একটি প্রবন্ধের নাম ছিল জীবন ও বৃক্ষ, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখা, '...বৃক্ষের প্রাপ্তি চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। ফুলে ফলে যখন সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন আপনা থেকেই বলতে ইচ্ছা হয় এই তো সাধনার সার্থকতা। বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান। .... নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায়।
সে পাঠক যখন জীবনানন্দ ভক্ত হয়ে উঠে তখন কবিতা শোনে :
এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ
সবুজ পাতার পরে দেখেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ।
আর সুকান্তের চারাগাছ বিস্মৃত হবার নয়।
হঠাৎ সেদিন চকিত বিস্ময়ে দেখি
অত্যন্ত প্রাচীন সেই প্রাসাদের কার্নিশের ধারে
অশ্বথ গাছের চারা।
নিঃশব্দ হাওয়ায় দোল খাওয়া এই চারাগাছ বৃদ্ধ মহীরুহ হয়ে ওঠে, 'শিকড়ে শিখড়ে আনে অবাধ্য ফাটল/উদ্ধৃত প্রাচীন সেই বনিয়াদী প্রাসাদের দেহে।' আসলে পার্থিব মানুষের সূচনাই তো বৃক্ষ ও নিষিদ্ধ ফলের আকর্ষণকে কেন্দ্র করেই। মানুষের স্বর্গচ্যুতি, ইডেন গার্ডেন থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হয় জলকাদার পৃথিবীতে, বৃক্ষনাশা মানুষের সমাজে।
মাহমুদ দারবিশের কবিতা বৃক্ষের কথা বলে :
জলপাইয়ের বন একত্রে সবুজ ছিল
তাই ছিল, আর আকাশ ছিল
নীল অরন্য তাই ছিল!
আজ রাতে কে তাকে বদলে দিল?
দয়াবান বৃক্ষের কথা আছে শামসুর রাহমানের কবিতায় দয়াবান বৃক্ষ তাকে কবিতা সরবরাহ করে, জীবন দান করে।
কার্বন ডাই অক্সাইড এলার্ট ও ট্রি-ট্র্যাপ
সর্বশেষ সংবাদ : ৭ জুন ২০২১ ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) মে মাসের উন্মুক্ত প্রকৃতিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাপ নিয়ে পেয়েছে প্রতি মিলিয়নে ৪১৯.১৩ পার্টস। বলা আবশ্যক উত্তর গোলার্ধে এটি চমৎকার সময়, গাছেরা পল্লবিত হয়, ফুল ফুল ও সবুজের সমারোহ থাকে, অনেকটা কার্বন ডাই অক্সাইড এই বৃক্ষফাঁদে আটকা পড়ে যায়, অর্থাৎ দ্রবীভূত হয়ে যায়। বৈশ্বিক লকডাউনের কারণেও কার্বন আটকা পড়ে যায়, অর্থাৎ দ্রবীভূত হয়ে যায়। লকডাউনের কারণের কার্বন নিঃসরণও কম হয়েছে। বিজ্ঞানী আশঙ্কার কথা জানালেন। প্রাক-শিল্পযুগে এই হিসেব ছিল প্রতি মিলিয়নে ২৮০ পার্টস, এখন প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। ফলে স্বাভাবিক বৈশ্বিক উত্তাপ আরো পড়বে, ঝড়, বন্যা, খরা, অরন্যদহন বেড়ে যাবে, মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। পৃথিবী যখন বরফ যুগ অতিক্রম করে আসে তখন কার্বণ ডাই অক্সাইড প্রতি মিলিয়নে ছিল ৮০ পার্টস। পৃথিবী ক্রমশ বড় দুর্যোগের দিকে এগোচ্ছে। রক্ষার উপায় এখনো আছে- কার্বন নিঃসরণ একদিকে কমানো অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে সবুজ বেষ্টনি সৃষ্টি করা।
মানুষকে রক্ষা করতে নিরন্তর সক্রিয় থাকে গাছ, অথচ সেই মানুষের হাতে গাছ কাটার বৈদ্যুতিক করাত!
একটি বৃক্ষগল্প: আপেল গাছ ও কৃষক
একসময় এক গ্রামে বনের পাশে এক কৃষক বাস করত। তার বেশ বড় একটা বাগান ছিল। বাগানে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও ফুলের সমারোহ। একটা বুড়ো আপেল গাছও ছিল। কৃষক যখন শৈশবে, এই আপেল গাছটা ছিল তার খেলার সাথী। ছায়া তো দিয়েছেই, সুমিষ্ট আপেলও। গাছটা বুড়ো হয়ে একসময় ফল দেয়া বন্ধ করল। গাছ যখন আর ফল দিচ্ছে না কৃষক ভাবল এটা রেখে আর কাজ কী? তার চেয়ে বরং গাছটা কেটে ফেলে ছোট ডালপালা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলেই তো হয় আর বড়গুলোয় চমৎকার কাঠ হবে, মনের মতো আসবাব বানানো যাবে। সে ভুলে গেল যে শৈশবে এ গাছে চড়েছে, আপেল খেয়েছে, গাছের সঙ্গে মধুর সময় কেটেছে। মানুষ কি এমনই হয়! এ গাছ ছিল চড়ুই, কাঠঠোকরা ও অন্যান্য পাখিরও ঘরবাড়ি।
কৃষক যখন আপেল গাছের গোড়ায় কুড়াল মারল এবং গাছটা কাটতে শুরু করল ভীত ও অসহায় প্রাণীগুলো এক এক করে বেরিয়ে এল এবং কৃষককে ঘিরে বিনয়ের সঙ্গে বলল, দয়া করে গাছটা কাটবেন না। আপনি যখন ছোট ছিলেন আমরা আপনার সঙ্গে এই গাছের নিচে খেলতাম। এটাই তো আমাদের বাড়িঘর। আমাদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই।
কিন্তু কৃষক গো ধরেছে, গাছ কাটবেই। কাঠবিড়ালি বলল, আমার আর আমাদের বাচ্চাদের বাড়িটা ধ্বংস করে দেবেন না।
ছোট পাখিরা কেঁদে কেঁদে বলল, এটাই তো একমাত্র ঘর। ভাঙবেন না প্লিজ।
ফড়িংরা এসে বলল, আপনি এই আপেল গাছ কাটতে পারেন না, এটা আমাদের।
কৃষক তার শৈশব এবং এই ছোট্ট প্রাণী-বন্ধুদের কথা ভুলে গেছে। সে গাছের গোড়ায় আবার কুড়াল চালায়। ছোট্ট প্রাণীগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে এবং যেকোনো মূল্যে আপেল গাছটি রক্ষা করার চেষ্টা করল।
তারা বলল, হে কৃষক আপনি যখন মাঠে কঠোর পরিশ্রম করবেন, ক্লান্ত থাকবেন আমরা আপনাকে গান শোনাব, আমরা আপনার বাচ্চাটাকে দেখেশুনে রাখব, সে কাঁদবে না, আমাদের নিয়ে আনন্দে থাকবে।
এসব কথা কৃষকের কানে ঢুকল না, তাদের কান্না তার মনে এতটুকু দয়া সৃষ্টি করল না। কৃষক আরো জোরে কুড়াল চালাল।
হঠাৎ চকচকে কিছু একটা তার চোখে পড়ল। এটা তো মৌচাক, চাকভর্তি মধু। আঙুলে একটু মধু লাগিয়ে মুখে দিল। মিষ্টি মধু তার ভেতরের শিশুটাকে জাগিয়ে তুলল, একের পর এক শৈশবের স্মৃতি এসে জড়ো হলো। মধুটা এত মিষ্টি! আরো একটু মধু এনে খেয়ে নিল। খুশিতে মনটা ভরে গেল। অবাক হয়ে বলল, আহ, কী মজা!
কৃষকের মনের ভেতর একটা বদল ঘটে গেছে, এটা টের পেয়ে মৌমাছি বলল, আপনি যদি গাছটা না কাটেন, তাহলে যত মধু চাই আমরা আপনাকে দেব।
কাঠবিড়ালি বলল, আমি যত বাদাম পাব, তার অর্ধেক অবশ্যই আপনাকে দেব।
গানের পাখিরা বলল, আমরা গান গেয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াব, গান গেয়ে আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলব।
শেষ পর্যন্ত কৃষক বুঝতে পারল, তার কাজটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। সে কুড়াল নামিয়ে রাখল। কৃষক বুঝতে পারল, তার যেমন বাড়িঘর আছে, এ গাছটাও তো কতগুলো সুন্দর প্রাণীর বাড়িঘর। এ প্রাণীগুলো যদি না থাকে, তাহলে তার ছোট্ট সন্তানটি এ আনন্দ কোথায় পাবে? সন্তানের জন্য কৃষক আনন্দের শৈশব চাইল।
বুঝতে পারল, তাহলে গাছটির প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি। আপেল হয় না তাতে কী। কৃষকের ভেতরে জেগে ওঠা ছোট্ট বালকটি তাকে বদলে দিল। কৃষক প্রতিজ্ঞা করল, আর কখনো গাছ কাটার কথা বলবে না। ছোট্ট প্রাণীগুলো তাকে ধন্যবাদ দিল। তারা বিশেষ করে মৌমাছিকে ধন্যবাদ জানাল। কারণ মৌমাছিই কৃষককে তার শৈশবে নিয়ে গেছে। শৈশব জাগিয়ে দিয়েছে তার ভেতরের ভালো মানুষটিকে। তারপর সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে, কৃষকও ভাবে আর একটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
একটি বৃক্ষছড়া দিয়ে উপসংহার টানি, শামসুর রাহমানের চারটি পঙক্তি মনের মধ্যে গেঁথে আছে:
যারা কুটি কুটি কাটে পাতা
তারা বটে পশু
তাদের আছে প্রাণ, সাক্ষী
জগদীশ বসু।