মৃত্যু নিয়ে জীবনানন্দ দাশের আচ্ছন্নতা
১.
জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে যে ক'টি আলোচনা আমি পড়েছি তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
শিবাজীবাবু নিজেই লিখেছেন, ১৯৮১-তে প্রকাশিত 'প্রসঙ্গ জীবনানন্দ' বইটিতে জীবনানন্দ দাশের যে কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা ১৯৮১-তে প্রকাশিত 'আলেপৃথিবী' অবধির।
তাতে কবিতার সংখ্যা কত?
৪৩৮!
অর্থাৎ শিবাজীবাবু যখন আলোচনা করছেন, প্রায় ২৫০০ কবিতা অগোচরে থেকে যাচ্ছে!
আমি বলছি না ৩০০০ কবিতা নিয়ে আলোচনাই সফল আর আংশিক কবিতা নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ।
তবে এটা তো ঠিক, চোখের সামনে থাকলে, কাজে না লাগলেও, সেই কাজে না লাগা কবিতাগুলোও একভাবে আলোচনার ভারসাম্য রক্ষা করে।এতে কিন্তু শিবাজীবাবু বা তার মতো অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অমলেন্দু বসু, বীতশোক ভট্টাচার্য এমনকি বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের দোষ নেই।
আমি শুধু বলতে চাইছি, এই ২০২১ অবধি, জীবনানন্দ দাশের সব কবিতা আলোচনাই আংশিক।এবং আংশিক কবিতা নিয়েই।
অরুণকুমার সরকার জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন।
১.মনোময় জগৎ
২.কর্মময় জগৎ
৩.নবতর উৎসাহের মনোময় জগৎ
শিবাজীবাবু তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও মনন দিয়ে এই পর্যায়গুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন।আমি আর সেই আলোচনায় বিস্তারিত যাচ্ছি না।
তো আজ এই ২০২১-এ যখন আমার হাতে জীবনানন্দ দাশের প্রায় ৩০০০ কবিতা, কী দেখছি আমি!
হাজার বিচ্ছুরণ তার, হাজার রূপকথা ও হাজার ভাঙাচোরা আয়না।
আমি শুধু সংক্ষেপে একটা কথা শুধু বলতে চাই।
জীবনানন্দের কাছে কবিতা ও জীবন একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ!
জীবনানন্দের পরীক্ষাগারে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গিনিপিগটির নাম শ্রীজীবনানন্দ দাশ! নিজেকে নিয়ে এত এক্সপেরিমেন্ট খুব কম কবিই করেছেন।
আমার মনে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের যাত্রা তাঁর 'আমি'-কে 'অপর' করে তোলার পথ ধরে।
যেভাবে 'কারুবাসনা'-র ফাস্টপার্সন কথক 'মাল্যবান'-এ এসে 'অপর' হয়ে যায় বা 'প্রেতিনীর রূপকথা'র আমি 'সুতীর্থ'-এ এসে তুমি হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার 'আমি' ক্রমশ দ্রুত সোমনাথ সেন, জোড়া হালদার, বিমল দালাল, চারু ঘোষাল, নিমাইচরণ,সান্যাল নামের 'অপর' বা জীবনানন্দেরই অলটার ইগো হয়ে উঠতে থাকে।
বোদল্যের 'কেলাসিত আত্মন' -এর কথা বলেছিলেন, নিটশে বলেছিলেন 'farthest' আমির কথা, র্যাবো বলেছিলেন 'I is another', কিয়ের্কেগার্দ বলেছিলেন হাসি ও কান্নার দুই মুখের কথা। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এ আমির আবরণ তাঁকে ঘিরে আছে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা এক (egoism) থেকে বহু (altruism) হওয়ার সাধনা।খুব সহজ নয় এই পথ। ধীরে ধীরে আমিত্বের মোড়ক খসাতে হবে। বর্জনের সেই পথ জটিলসুন্দর। সফলতা নয় নিষ্ফলতায় তাকে ছোঁয়া।
একদিন জলের মতো যে ঘুরেঘুরে একা কথা কয়েছিল আজ সে হেগেল বিক্রি করতে এসেছে।
দড়ি হাতে একা একা যে যুবকটি গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিল আজ সে বগি-গাড়ি তমাল-তলায় সারারাত ভিজেছে একাকী।
ক্রমশ প্রিন্টারের শয়তান, কাগজের সম্পাদক, স্ট্রেচার, বেলুন জগৎ, নিমাইয়ের ঘোড়া, মুদির বাটখারা, পাদটীকা ও ঘড়ির কাঁচ কবিতার জায়গা করে নিচ্ছে।
২০২১-তে এসে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে হলে এইসব কথা মনে রাখতে হবে।
২.
মৃত্যু নিয়ে জীবনানন্দ দাশ যতটা আচ্ছন্ন ছিলেন আর কিছু নিয়েই বুঝি নয়।
যখন 'ছায়া আবছায়া' কবিতার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করি তখন দেখি জীবনানন্দ দাশ এই পর্যায়ে 'সমাধি'-কে কেন্দ্র করে বেশকিছু কবিতা লিখেছেন।
খোঁজ করতে করতে এমন একটা তথ্য পেলাম যা অন্যভাবে আমাকে আলোড়িত করল।
'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকার ১৯২০-র একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এমন একটি তথ্য:
'বিগত ১৪ই পৌষ ১৩২৭ বুধবার প্রাতে সর্বানন্দ ভবনস্থ সমাধি-প্রাঙ্গনে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস, কুমারী বিনোদা দাস, সুপ্রভা দাস, শিশু করুণানন্দ দাসের সমাধিস্তম্ভে প্রস্তর-ফলক স্থাপন উপলক্ষে পারলৌকিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।'
তার মানে সংবেদনশীল জীবনানন্দ দাশ বারবার হয়তো এই সমাধিগুলো দেখেছেন, কাছে গেছেন, স্পর্শ করেছেন এবং তা নিয়ে ভেবেছেন।
ব্রাহ্মরা সাধারণত দাহ-ই করতেন। তবে দাহের পর চিতাভষ্ম নিয়ে এসে অনেক সময় সমাধি স্থাপন করতেন।
কী লিখেছেন জীবনানন্দ এই সমাধি নিয়ে?
'তোমাকে দিয়েছি আমি ব্যথা তিলে তিলে;
তুমিও যে ব্যথা দিয়েছিলে
না জেনে এগিয়ে গেছ আজ তুমি ---হয়তো জানলে
সমাধির নীচে ঘুম ভাঙবে তোমার।'
একজন রমণীর কথা বলেন জীবনানন্দ। যে আজ সমাধির নীচে শুয়ে আছে।
যার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বিনুনীর গন্ধ এল। রাশি রাশি চুলের কলঙ্কে যেন দেখা যাবে হাড়ের চিরুনি।১৩৩০-এ যেমন টানত এক নিবিড় রমণী!
লিখছেন:
'সমাধীর নীচে শুয়ে তুমি
মানুষকে হতবাক ক'রে দিয়ে মুখপাত্রীর পটভূমি
অনন্ত --- অনন্ত কাল; ---যদিও কোথাও আলো পাখি নেই , একটিও পাতা
গায় না'ক --- নড়ে নাক' সমাধির নীচে মহানায়িকার মাথা।'
বারবার ফিরে আসছেন কবি সমাধির কাছে, প্রার্থনা করছেন যেন, ক্ষমা চাইছেন, করুণা ভিক্ষা করছেন:
'সমাধির নীচে শুয়ে আছ ---তোমাকে জানাই:
যত দিন পৃথিবীতে ছিলে তুমি, ---উপেক্ষা করেছি আমি ---দিয়েছি আঘাত;
জানাতে এসেছি সেই ভুল আজ'
বিনোদা দাস সত্যানন্দ দাসের সব থেকে ছোটো বোন। জীবনানন্দ দাশের পিসি। অল্প বয়সে মারা যান। জীবনানন্দ দাশের হয়তো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সেই স্মৃতি মনে আছে। অথবা কাকা প্রেমানন্দ দাসের স্ত্রী সুপ্রভার কথা। অল্প বয়সে কাকিমার কোনো স্মৃতি।
আসলে জীবনানন্দ দাস নামক সিসমোগ্রাফে যে সামান্য কম্পনও অনুভূত হত।
আর তাই তো লিখতে পারেন:
'হাড়ের চিরুনি দিয়ে তোমার মাথার থেকে খুলে
সব চুল টেনে দিও হৃদয়ের 'পরে
ডেকে নিও সব ঘুম চোখের ভিতরে
শিয়রে ---পায়ের থেকে কাঠি রেখো তুলে'