শেখ আবদুল হাকিম: এলোমেলো কিছু কথা
বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সুবাদে আমরা তখন সবে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় এসেছি। বাবার ইচ্ছা, এখানেই স্থায়ী হওয়া। ছোটবেলা থেকে মাকে দেখেছি নেশগ্রস্তের মতো গল্পের বই পড়তে। আমরা যখন যে শহরে বদলি হয়েছি, মায়ের পয়লা কাজ ছিল সেখানকার লাইব্রেরির সদস্য হওয়া। একটু বড় হওয়ার পর লাইব্রেরি থেকে মায়ের জন্যে বই এনে দেওয়ার দায়িত্ব চেপেছিল আমার ঘাড়ে। সেইসূত্রে বইয়ের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। মাঝেসাঝে ওসব বই উল্টেপাল্টে দেখলেও মাথামুণ্ড কিছুই মাথায় ঢুকতো না। সে আমলে ছোটদের বইয়ের আকাল ছিল। কালেভদ্রে দুয়েকটি বই হাতে এলে গ্রোগ্রাসে গিলতাম।
সে যাই হোক, ঢাকায় আসার পর তখন সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি, কুয়াশা ৩৫, ৩৬ মারফত কুয়াশা সিরিজের সাথে পরিচয় হলো। পরপর বেশ কয়েকটা বই হজম করার পর হঠাৎ করে সিরিজটা কেন জানি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু নেশা তো ছাড়ে না। বাংলাবাজার, বিজয় নগর, বায়তুল মোকাররমসহ নানা জায়গা থেকে পুরোনো কুয়াশা জোগাড় করে নেশার আগুনে ঘি ঢেলে চললাম। এই সময় শুরু হলো সেবায় যাতায়াত। যদি পুরোনো কুয়াশার কোনও কপি মেলে! পেয়েছিলামও! কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের কুয়াশা বেরুনোর ঘোষণা এলে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।
তখন কুয়াশা ৪২ থেকে সম্ভবত ৪৮ পর্যন্ত বইগুলোর প্রুফ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বইয়ের প্রুফ দেখার হাতেখড়ি আমার সেই সুবাদেই। এমনি আনাগোনার সূত্রে একসময় শেখ আবদুল হাকিমের দেখা পাই। দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়ন, ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঠোঁটের উপর একজোড়া গোঁফ, মুখে সিগারেট। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবী। প্রথমে ভেবেছিলাম ইনিই বুঝি কাজী আনোয়ার হোসেন। পরে, জানলাম ওনার নামই শেখ আবদুল হাকিম। কুয়াশা লেখেন।
পরবর্তীকালে হাকিম ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরে ১৯৮৫ সালে আমি যখন রানওয়ে জিরো-এইট অনুবাদের মাধ্যমে সেবার অন্দরমহলে ঢোকার পাসপোর্ট পেলাম, তখন জানতে পেলাম হাকিম ভাই মাসুদ রানাও লিখেন। প্রায়ই দেখতাম তিনি মাসুদ রানার পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির। হাকিম ভাইই মাসুদ রানার লেখক, এটা আমার কাছে তখন নতুন খবর। কুয়াশা কিন্তু ততদিনে ফের বন্ধ হয়ে গেছে। তার আগে ১৯৮৪ সালে থেকে প্রকাশিত রহস্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি। কাজীদার অনুমতি নিয়ে রহস্যপত্রিকায় বেশ কয়েকটি ফিচার এবং গল্প (ওয়েস্টার্নসহ) লিখেছিলাম তখন। হাকিম ভাই কেন জানি আমার লেখা বেশ পছন্দ করতেন। কুয়াশা তথা সেবার গোঁড়া পাঠক হিসাবে হাকিম ভাইয়ের তরফ থেকে এই স্বীকৃতি আমার জন্যে বিরাট পাওনা ছিল।
সত্যি বলতে, হাকিম ভাই কি লিখেননি! কাজীদার নামে বেরুনো পাপে মৃত্যু, দাঁড়াও পথিক! বন্দীনির মতো বেশিরভাগ রহস্যউপন্যাসই হাকিম ভাই বলেছেন তার লেখা। তিনি ওয়েস্টার্ন লিখেছেন। ছদ্মনামে টিন এজ রোমাঞ্চ সিরিজ লিখেছেন। রোমান্টিক উপন্যাস লিখেছেন। শামসুদ্দিন নওয়াব নামে অসংখ্য বই অনুবাদ করেছেন। জাকি আজাদ নামে একটা সিরিজেরও জনক তিনি। তাঁর অনূদিত গডফাদার, আততায়ী, কামিনী পড়লে বোঝা যায় কি শক্তিশালী লেখক তিনি। মাসুদ রানার কিছু কিছু বই আর চরিত্র বহু পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে, কাঁদিয়েছে। মূল বই থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে তিনি চরিত্রগুলোকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছেন। এখানেই তার মুন্সিয়ানা! তার লেখা মাসুদ রানা সিরিজের অকস্মাৎ সীমান্ত, নীল ছবি, আক্রমণ বা সংকেত পড়লে অবাক হতে হয়, কিভাবে অনায়াসে তিনি পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছেন! কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করেছি নাম বা খ্যাতির প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। স্রেফ পেশাদারের মতো একের পর এক কাজ করে গেছেন।
সেবা প্রকাশনীতে আমার প্রায় দশ বছরের সংশ্লিষ্টতার সময়ে হাকিম ভাইয়ের সাথে বহুবার দেখা-কথা হয়েছে। আমাদের সেই প্রথম দেখার কথা তার মনে থাকার কথা নয়, মনে ছিলও না। কিন্তু আমি সে কথা ভুলিনি।
যাহোক, এক সময় মতভিন্নতার কারণে হাকিম ভাই সেবা থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। প্রায়ই ফোনে আমাদের আলাপ হতো। আমি বেশ কয়েকবার তাঁর বাসায় গেছি। একবার দুপুরে একসাথে খেয়েছি। আমার খাওয়ার পরিমাণ দেখে তিনি তো হেসে খুন। বলেছিলেন, এতো কম খেয়ে বাঁচেন কীভাবে?
মাসুদ রানার লেখক স্বত্ব নিয়ে কাজীদার সাথে বিরোধ বাধলে তিনি কপিরাইট অফিসে মামলা করেছিলেন। এই সময় সেবার অনেক লেখককে তার পক্ষে সাক্ষী দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাননি, অথচ মাসুদ রানা যে তার হাত দিয়েই লেখা, সেটা ছিল সর্বজনবিদিত। খোদ কাজীদাও বিভিন্ন সময় সেটা স্বীকারও করেছিলেন। কপি রাইট কর্তৃপক্ষের রায় তাঁর পক্ষে ঘোষিত হলে হাকিম ভাই যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। যদিও সেই রায় এখন উচ্চতর আদালতের নির্দেশে আটকে আছে।
হাকিম ভাই চলে যাওয়ার তিন-চারদিন আগেও টেলিফোনে তাঁর সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়। গডফাদারের নতুন সংস্করণের প্রুফ দেখে দেওয়ার অনুরোধ ছিল তাঁর। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কি একটা কথায় অনেক হেসেছেন তিনি। কথা বলার সময় ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি যে মাত্র কদিন পরেই চিরতরে চলে যাবেন। শনিবার (২৮ আগস্ট ২০২১) সন্ধ্যায় টিভিতে তাঁর মৃত্যুর খবর দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেছি।
হাকিম ভাইয়ের সাথে এ জনমে আর দেখা হওয়ার নয়। যেখানেই থাকুন, তিনি যেন ভালো থাকেন।