‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখকেরা টাকা পান না’
[বিস্তার সাহিত্যচক্র আয়োজিত সাপ্তাহিক অন্তর্জাল সাহিত্যালাপের আসর 'পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন' এর দশম পর্বে আলোচনায় অতিথি ছিলেন সদ্য প্রয়াত আবুল হাসনাত (১৭ জুলাই ১৯৪৫- ০১ নভেম্বর ২০২০)।
আবুল হাসনাত ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকায় জন্ম নেন। তিনি মাহমুদ আল জামান নামেও লেখালেখি করতেন।
আবুল হাসনাতের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, 'কোনো একদিন ভুবনডাঙায়', 'ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল'।
শিশু কিশোরদের নিয়ে রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়', 'টুকু ও সমুদ্রের গল্প', 'যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে', 'রানুর দুঃখ-ভালোবাসা'।
তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করেন। আমৃত্যু তিনি সাহিত্যপত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ]
আলম খোরশেদ: হাসনাত ভাই, বৈশ্বিক অতিমারির দুঃসহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, এটা আমাদের জীবনকে স্পর্শ করেছে, আপনি কীভাবে এটাকে মোকাবেলা করছেন, কী ভাবছেন এর প্রভাব, পরিণতি নিয়ে?
আবুল হাসনাত: আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো যে, এই করোনা শুধু আমাদের নয়, এই করোনা আসলে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং আমি বলব যে, এই রকম সংকট ঊষালগ্ন থেকে এই পর্যন্ত যে অগ্রগতি আমাদের, সেখানেই একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আমি যে আক্রান্ত হচ্ছি, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, মৃত্যুমুখে পড়ে যাচ্ছি শুধু তা-ই না, এটা আমাদের মনন এবং ভাবনার জগতেও কিন্তু একটি প্রবল ধাক্কা দিয়েছে। এর আগেও প্লেগ বা অন্য সংক্রামক রোগও হয়েছিল, কিন্তু তা করোনার মত সর্বগ্রাসীভাবে মানবসভ্যতাকে সংক্রমণ করেনি বলে আমার ধারণা। এবং এটা বৈশ্বিক একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যারা ঘরে বসে আছেন, লেখালেখি করেন, তাঁদের ভাবনার জগতেও কিন্তু একটা নতুন চিন্তা চেতনার জন্ম দিচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা-- এর ফলে অনেকেই সৃজনশীল হয়ে উঠবেন বা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রাও যোগ করতে পারবেন হয়তো ভবিষ্যতে। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায় যে, সৃজনের নতুন মাত্রা সংযোজন হতে পারে। এটা একটা দিক, আরেকটি দিক হলো, এটা শুধু মননের জগতেই নয়, মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে ছমাস ধরে আমরা মানুষের মুখ দেখি না। আমাদের সবটুকুই তো আসলে মানবিক হওয়ার সাধনা। সেই জায়গাটায় আমাদের ভিতটা একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনা।
আলম: আপনার সাহিত্যজগতে আসার, একেবারে আঁতুড়ঘরের গল্পটা অর্থাৎ কীভাবে আপনি এই জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন?
হাসনাত: আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাম ছাত্র সংগঠন খুব শক্তিশালী ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। আমি ১৯৬৬ সন থেকে ১৯৭১ সন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের লিডার ছিলাম। কিন্তু আমি বক্তৃতা দিতাম না। তবে সব ধরনের কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম। তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদ বলে একটা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ছিল। সেই সংগঠনের আমি দীর্ঘদিন প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম পরে সভাপতি ছিলাম। এই সংগঠনে আসাদুজ্জামান নূর প্রেসিডেন্ট ছিলেন একসময়। আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। মাহফুজ আনাম, ডেইলি স্টারের সম্পাদক উনিও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আমি তখন সভাপতি ছিলাম। এভাবেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকার অর্থেই একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। আর পিছনে ফিরে তাকালে আমি সত্যিই বিস্মিত হই। এটা কী করে সম্ভব হয়েছিল! তখন জাতীয়তাবাদের প্রবল জোয়ার সেখানে বামপন্থি দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গোড়ার মর্মবাণী ছিল, বাঙালিত্বের সাধনা, বাঙালি হওয়া এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জাতির স্বরূপের সন্ধান। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, তখনকার ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, তখন সংস্কৃতি সংসদ ও ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে সত্যিকার অর্থেই একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল, ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি। তখন আমি কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হই। তারা নানাভাবে আমাকে এবং আমার চতুষ্পার্শ্বের বন্ধুবান্ধবকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বামসাহিত্য পাঠ করা, বামসংস্কৃতির প্রতি এবং তাদের এই যে উদ্যোগ বা পরামর্শেই কিন্তু আমাদের অনেকেরই, শুধু আমার একার কথা বললে অন্যায় হবে, রুচি গঠন হয়েছিল। সাংস্কৃতিক রুচি, রবীন্দ্র রুচি এবং এই সংগ্রাম করতে করতে আমরা ৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছি। একটা কথা আপনাকে বলি, আমি বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম বটে, পড়াশোনার আগ্রহ ছিল। কিন্তু ওই অর্থে আমি খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। আমার পড়াশোনা হয়েছে ৭১ এর পরে। কারণ তখন আমি ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম তা বলার নয়। ১৯৭০ সনে যখন ছাত্র ইউনিয়নের কনফারেন্স হয় আমি সহসভাপতি ছিলাম, নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আপনি এই কম্পোজিশন দেখলেই বুঝতে পারবেন, তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে, সেখানে বামধারার ছাত্র আন্দোলনও একটি বড় অবদান রেখেছিল। এগুলোর কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। কিন্তু তখনকার দিনের ছাত্র সংসদের বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটির নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বুঝতে পারবেন, তখন বামধারার ছাত্র আন্দোলন, বাম ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন কত তীব্র এবং প্রবল ছিল। আমার আজকে ভাবতে ভালো লাগে, আমি যৎসামান্য হলেও আমি সেই ধারায় সংশ্লিষ্ট হয়েছিলাম।
আলম: এবার আমরা আপনার কাছে শুনতে চাইব, আপনার সেই সামগ্রিক সাহিত্যিক পরিক্রমাটার কথা। যেটা আপনি বলছিলেন যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। আপনার পঠনপাঠন, লেখালেখি, প্রকাশনা, পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়া-- সব মিলিয়ে ওই পুরো পর্বটা সম্পর্কে যদি আমাদের আরেকটু বিস্তারিতভাবে জানাতেন?
হাসনাত: আমাদের সাহিত্যরুচি স্বাধীনতার আগেই গড়ে উঠেছিল। কথাটা বলেছিলাম- আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম বটে, একাডেমিক পড়াশোনা করতে পারিনি। কারণ আমি ১৯৬৫ সনে 'সংবাদ'-এ ঢুকি জীবিকার তাড়নায়। অর্থকষ্ট ছিল আমার। আমি রাতে ডিউটি করতাম। আর দিনে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র ইউনিয়নের আন্দোলন। তখন যে ছাত্র আন্দোলন ১৯৬২সনের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে শুরু হয়, এটা থামেনি একদিনের জন্যও। ৬২ সনের যে আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলনে ছাত্রলিগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক একটা ব্যাপার গড়ে তুলেছিল। স্বাধীনতার সড়ক নির্মাণ করেছিল। এটা থেকে কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন একদিনের জন্যও সরে যায়নি। আমরা কয়েজন যারা নেতৃত্বপদে ছিলাম, কর্মী হিসেবে ছিলাম তারা সবাই এই আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ওই সময়ে আমার বহু সতীর্থ বন্ধু সংগ্রামী জেলে গেছেন, পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিলেন। ঐ সময়টা সত্যিকার অর্থে অগ্নিগর্ভ ছিল। আপনাকে যে বললাম ৬২ সনের পয়লা ফেব্রুয়ারি আইয়ুববিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলনে আমরা সহযোগী হিসেবে তৎকালীন শিক্ষকসমাজকেও পেয়েছিলাম। এটা কিন্তু খুব বড় পাওনা ছিল আমাদের জীবনে। স্বাধীনতার পরে তো আন্দোলন থেকে সরে এলাম। তারপরে ১৯৭২ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা 'গণসাহিত্য' নামে একটি পত্রিকা করি। সাহিত্যপত্রিকা, মাসিক ছিল প্রথমে। দীর্ঘ ১০ বছর পত্রিকাটি টিকে ছিল। এর সম্পাদক আমি ছিলাম এবং আমার বন্ধুবৃত্তের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আমরা প্রথম দিকে নিয়মিতই বের করেছি। এখন তাকালে ভালোই লাগে। পত্রিকাগুলোর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া সংখ্যাগুলো দেখলে ভালোই লাগে। ৭২ সাল থেকে ৮০/৮৬ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে বের হওয়া এটাতো চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া, আমি তখনও সংবাদে চাকরি করতাম। আমি নিউজে কাজ করতাম রাতে, ৭২ এর পরে দিনেও কাজ করেছি অনেক। আকস্মিক একটা ঘটনায় যিনি সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন তার নামে গ্রেফতারি পরওয়ানা হয় এবং তিনি পরবর্তীকালে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।
আলম: আপনি কি রণেশ দাশগুপ্তের কথা বলছেন?
হাসনাত: না, আমি দাউদ হায়দারের কথা বলছি। তখন সংবাদের সাহিত্যপাতা দেখতেন দাউদ হায়দার। আর আমি ১৯৭২-৭৩ সন এক বছর মস্কোতে ছিলাম। তখনই মস্কো থেকে ফিরেছি। ৭৪ এর প্রথম এক পর্যায়ে এই ঘটনা ঘটে। দাউদ চলে যায়, আমাদের সম্পাদক আমাকে ডেকে বলেন, তুমি দায়িত্ব নাও, যেহেতু কবিতা-টবিতা লেখ। সাহিত্য অনুরাগ আছে, ভালোবাসা আছে। তুমি পাতাটা কর। তো আমি খুব উৎসাহ পাই। কারণ আমি তখন পরিকল্পনা করেছিলাম নিজে সাহিত্যচর্চা করবো এবং সাহিত্য জগতে থাকবো। আপনাকে তো আগেই বলেছি, সংবাদে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া এই সংবাদে কাজ করে জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো সম্পাদক পাওয়া। রণেশ দাশগুপ্ত আমার সহকর্মী ছিলেন। সর্বাবস্থায় তাঁর সহায়তা পেয়েছি। তিনি আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছেন। কখনো কখনো কবিতা পাঠের আসরে গেছেন। কখনও নিজে বক্তৃতা দিতে গেছেন, সঙ্গে আমাকে নিয়ে গেছেন। এই সময়ে আমি সন্তোষ গুপ্ত এবং স্বাধীনতার আগে শহীদুল্লাহ কায়সারকে কাছে পেয়েছিলাম। আমি যে সংবাদ-এ কাজ পেয়েছিলাম সেটা শহীদুল্লাহ কায়সারের জন্যই এবং সেজন্য আমি তাঁর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। উনি আমার অগ্রজতুল্য সহকর্মী ছিলেন। বিপদে-আপদে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। শহীদুল্লাহ কায়সারের নেতৃত্বেই ১৯৬৫ সনে বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির ব্যানারে একটা বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হয়েছিল পল্টন ময়দানে। তিনি তার কনভেনর ছিলেন। আমি সাংস্কৃতিক সাবকমিটির সদস্য ছিলাম। তখন থেকেই শহীদুল্লাহ কায়সারের সাথে আমার একটা অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই সংবাদে চাকরি আমার জীবনকে পুরোটাই পাল্টে দিয়েছিল তখন। তারপর আপনারা জানেন যে, ১৪ই ডিসেম্বর তাঁকে ঘাতক বাহিনী হত্যা করে। আমার জীবনে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তখন। এই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে আমার দীর্ঘদিন সময় লেগেছিল।
আলম: আপনার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের প্রেক্ষাপট বা ঐ সময়কার গল্পটি যদি বলতেন।
হাসনাত: প্রথম কবিতার বই মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন মুক্তধারায় মাঝেমাঝে যেতাম। টুকটাক কাজও করে দিতাম। তারা বাড়িতে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন। এই করতে করতে মুক্তধারার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। তখন আব্দুল হাফিজ মুক্তধারার সামগ্রিক দেখাশোনা করতেন। তিনি আমাকে বললেন যে, আপনি কবিতা লেখেন, আপনি আমাকে পাণ্ডুলিপিদেন। আমি পাণ্ডুলিপিজমা দেই। তাদের একটা সম্পাদক বোর্ড ছিল। আসাদ চৌধুরী, শামসুজ্জামান খান এরা ছিলেন। এদের কাছে মতামত চাইলেন। মতামত অনুকূল ছিল। ওখান থেকে বইটি বের হল। 'জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক'। কাইয়ুম চৌধুরী এটার প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন। আমার নিজের লেখালেখি নিয়ে আমার কোন আকাঙ্খা নাই। কখনো কখনো ভালো লাগে লিখতে। তাই লিখি আরকি।
আলম: পরবর্তীকালে আপনি যে প্রবন্ধসাহিত্য, বিশেষ করে চিত্র সমালোচনার দিকে চলে গেলেন সেটার প্রেক্ষাপটটা আসলে কী ছিল?
হাসনাত: আচ্ছা, ওটার আগে আমি দুটো কথা বলতে চাই। ঐ যে আপনাকে বললাম আহমেদুল কবির আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, আমি তো খুব উৎসাহবোধ করিনি। তখন বজলুল রহমান সাহেব বললেন করুন, বাংলাদেশে সাহিত্যপত্রিকা নাই। আপনি একটা সুযোগ পেয়েছেন, কাজ করে দেখুন না। ফেইল করলে করবেন, সেটাতো কোন ব্যাপার না। আমি তখন থেকে পরিকল্পনা করা শুরু করি। আসলে সত্যি তখন সাহিত্যপত্রিকা নেই বাজারে। থাকলেও খুব একটা প্রভাবশালী নয়। আমার প্রথম থেকেই চিন্তা ছিল যে, এই পাতাটাকে আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের দর্পণ করে তুলব। আমি প্রথমে ভাবলাম যে, কীভাবে বৈচিত্র্য সঞ্চার করা যায়। খালি গল্প-কবিতা ছেপে দিলেই তো আর হলো না! সঙ্গে বৈচিত্র্য থাকা চাই। এবং সেই দিক থেকে প্ল্যান করে অগ্রসর হলাম আমি, সহযোগী হিসেবে পেলাম, সেই সময় আপনারা জানেন যে, অকালপ্রয়াত কাজী হাসান হাবীব দীর্ঘদিন সংবাদে কাজ করেছেন, তাঁকে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দুইদিন আমি বৈঠক করতাম কী লেখা যাচ্ছে না যাচ্ছে। এ নিয়ে পরিকল্পনা করতাম। এবং সত্যিকার অর্থে তখন সে গ্রাফিক ডিজাইনে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায়। আমি আর একটা জিনিস মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এই সাহিত্যপাতাকে আমি কোন দলীয় মুখপত্র করে তুলব না, আমার তো একটা দলীয় আনুগত্য ছিল, আমি তখনো কমিউনিস্ট পার্টির একজন মেম্বার, কালচার সাব পার্টিতে কাজ করি। আমি তার কোন প্রতিফলন ঘটাব না এই পাতায়। এটাকে বাংলাদেশের সাহিত্যের দর্পণ করার জন্য যা যা প্রয়োজন, যার কাছে গিয়ে এপ্রোচ করার করব। আস্তে আস্তে আমি একটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলাম প্রবীণ এবং নবীনদের। এই আস্থা অর্জনের ফলে সংবাদের সাহিত্যপাতা একবছরের মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে। সবারই আলোচনার বিষয় হলো যে, আমি কীভাবে এটা করছি? সংবাদের অবস্থা ভালো নয়। যৎসামান্য একশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা সম্মানী দিয়ে লেখা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু পাতাটা যাতে বিষয়বস্তুতে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে সে জন্য অনেক বিষয় আমি সংযোজন করেছিলাম।
চিত্রকলায় আমার অনুরাগ ছিল বলে, চিত্রকলার সমালোচনা এবং বিশ্ববিখ্যাত বিংশ শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমস্ত চিত্রশিল্পীর কাজের প্রতিলিপি ছাপা শুরু করি। এবং ওটা একটা চরিত্র নির্মাণ করে। ঢাকায় তো তখন প্রচুর এক্সিবিশন হচ্ছিল। আমি চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটা এক্সিবিশন কভার করতে। আমি দেখলাম যে স্থাপত্য নিয়ে বাংলায় লেখালেখি হয় না প্রায়। রবিউল হুসেন ভাইকে ধরে স্থাপত্যের বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। তারপরে একবছর দুই বছর যাওয়ার পরেই, আমি ভাবলাম যে আরো বৈচিত্র্য সঞ্চার করা দরকার। তখন সৈয়দ শামসুল হককে দিয়ে কলাম লেখানো শুরু করলাম। হৃৎকলমের টানে, খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং আরেকটা পাক্ষিক কলাম লিখলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সাহিত্য পরিমণ্ডলের অর্জন এবং চর্চা নিয়ে। এই পাতায় সৈয়দ শামসুল হকের যখন কলাম শেষ হল উনি তাঁর অসাধারণ উপন্যাস বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ ওখানে প্রকাশ করলেন। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি এদেশের নবীন ও প্রবীণ লেখকদের মেলবন্ধনে পত্রিকার সাহিত্যপাতাটি যেন পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে। আর একটা বিষয়, এখন আমার খুব কষ্ট ও দুঃখ হয়, আমি কিন্তু রবীন্দ্র সংখ্যাগুলো খুব যত্ন নিয়ে করেছিলাম, তখন একপর্যায়ে হাবীব চলে গেলেন। রফিক আজাদ তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন, উনি বেশি বেতন পেয়ে চলে গেলেন। তারপর বীরেন সোম দীর্ঘ দিন আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তো এদের যে যত্ন, এদের যে অভিনিবেশ, একটা গল্পকে দুইবার পড়ে ইলাস্ট্রেশন করা এটা তখনকার দিনে খুবই দুর্লভ ব্যাপার ছিল। আমি এতটুকু বলব, নিজের কথা এর বেশি আর কি বলব।
আলম: আমি আপনার কথার সূত্র ধরে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে চাই। কারণ আপনি বার বার বলছিলেন, সংবাদের ঐ সাহিত্য পাতায় নবীন ও প্রবীণদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। এবং এটি শুধু কথার কথা নয়। একেবারে আক্ষরিক অর্থে সত্য। কারণ, আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু, কীভাবে কীভাবে যেন আমিও সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমি স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে কখনো কিছু কবিতা, কিছু গল্প, অনুবাদ ডাকযোগে আপনার কাছে পাঠাতাম, আপনার যেটা ভালো লাগতো সেটাই ছাপতেন। কে আলম খোরশেদ, কোত্থেকে লেখা আসছে, এসব আপনার জানার কোন প্রয়োজন ছিল না। এবং সংবাদ-এ আপনার অফিসে যাওয়াটাও বারণ ছিল। আসলে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। পুরনো ঢাকার বংশালের ছোট একটা গলির মধ্যে সংবাদ অফিসের দোতলায় ঘুপচি একটা ঘরে আপনি বসতেন। আমরা বিল নিতে গেলে নিচ থেকেই সেটা নিয়ে আমাদের চলে আসতে হতো মাঝে মাঝে। একবার মাত্র শুধু আমার দোতলায় যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তা-ও খুব ভয়ে ভয়ে। দেখলাম আপনি খুব গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে টেবিলের উপর ঝুঁকে কাজ করছিলেন। হাসনাত ভাই আমরা আপনার সাহিত্য জীবনের, সম্পাদক জীবনের এবং বাংলাদেশের সাহিত্যের বিষয়ে আপনার কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু মতামত ও মূল্যায়ন শুনতে চাই। কারণ, আপনি দীর্ঘদিন সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কালি ও কলমের মত পত্রিকা প্রকাশ করছেন। সব ধরনের লেখকদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রয়েছে। আপনার কী মনে হয় স্বাধীনতার এত বছর পর বাংলাদেশের সাহিত্য এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? তার শক্তির জায়গাগুলো কোথায়, তার সংকটইবা কোথায়? কারা এখন ভালো লিখছেন? আরও কীভাবে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পারি আমরা। সে-বিষয়ে একজন সম্পাদক এবং লেখক হিসেবে আপনার নিজের কিছু মূল্যায়ন যদি থাকে...
হাসনাত: একটু বলি, সংবাদের অভিজ্ঞতাগুলো টেনে আমি কথাগুলো বলছি। সেটা হলো--আপনি তো সংবাদের সাহিত্য পাতার পাঠক ও লেখক ছিলেন। আপনি জানেন, তখন অনেকে অভিযোগ করতো যে, সংবাদের সাহিত্য পাতায় শুধু প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা বেরোয়। এর প্রত্যুত্তরে আমি তখন বলেছিলাম যে, প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সাহিত্য পাতা বেরোয়। আপনারা পর্যালোচনা করে দেখবেন যে, এই চারপাতায় কজন নবীন লেখক আছে, আর কজন প্রতিষ্ঠিত লেখক আছে। তো এই পর্যালোচনার ফলাফল খুবই পজেটিভ ছিল। সত্তর ভাগ লেখা নবীনদের ছাপা হতো। আর ত্রিশ ভাগ লেখা প্রতিষ্ঠিতদের ছাপা হতো। তখন ওটা দেখে মনে হত যে, প্রতিষ্ঠিতরা বোধহয় এখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। ব্যাপারটা একেবারেই তা ছিল না। বহু অজ্ঞাত অখ্যাত লেখক অথচ তাদের লেখা ভালো, এরকম অনেকে সংবাদের সাহিত্য পাতায় লিখেছেন এবং তারা আত্মবিকাশের একটা পথ পেয়েছেন এই সাহিত্য পাতার মধ্য দিয়ে।
আপনাকে আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা আমি বলি। কিন্তু আমি কোনোভাবেই মানের সাথে কম্প্রোমাইজ না করে যেখানে মফস্বলের লেখা ভালো হতো, আমি অবশ্যই ছাপতাম। শুধু কবিতা কিংবা গল্প নয়, সমালোচনার ক্ষেত্রেও আমি অনেককেই চিনতাম না। ডাকে লেখা আসতো, সেই লেখাগুলো পড়ে পছন্দ হলেই আমি ছাপতাম। এরই ধারাবাহিকতায় আমি কালি ও কলমে কাজ করছি। তবে একটা সংকটের কথাও বলি আপনাকে, সেটা কি খোলাখুলি বলব?
আলম: হ্যাঁ নিশ্চয়ই। এটার মাধ্যমে আমরা বর্তমান বাংলা সাহিত্য বিষয়ে আপনার মূল্যায়নটাও পেয়ে যাব নিশ্চয়ই।
হাসনাত: একটা সংকটের কথা হচ্ছে, যত সহজে কবিতা পাই, ধরুন এক সংখ্যার জন্য পঞ্চাশটা কবিতা আসে। আমরা ছাপতে পারি গড়ে পনেরোটা কবিতা বা কখনো কুড়িটা কবিতা। এতবেশি কবিতা আসে। কিন্তু আমি যখন অনুরোধ করি একটা প্রবন্ধ লিখতে, মননশীল প্রবন্ধ, যেখানে জিজ্ঞাসা আছে, যেখানে নতুন কোন ভাবনার রয়েছে, তখন কেউ লিখতে চায় না। আমি এজন্য বলছি যে, খোলাখুলি বলি, আমরা কেউ গদ্য লিখতে চাই না। আমরা গদ্য লেখার মধ্য দিয়ে কোন ভাবনা প্রকাশ করতে চাইনা। আমরা টেবিলে অনেকে অনেক কথা বলি। কিন্তু লিখিতভাবে কেউ কিছু বলতে চাই না। আপনি বিশ্বাস করুন, বহু নবীন বন্ধুকে বই দিয়ে আমি শুধু পুস্তক সমালোচনা লিখতে বলেছি। কিন্তু আমি লেখা পাইনি। এটা আমার বেদনার দিক, কষ্টের দিক, একটা দুই পৃষ্ঠার রচনা হলেও তার মধ্যে একটা বিশ্লেষণের ব্যাপার থাকবে বা সাহিত্য সমালোচনার ব্যাপার থাকবে। তাই না? এভাবেই তো সাহিত্য এগোয়। নতুন ভাবনা দিয়ে স্পন্দিত না হলে সেটা কোথাও যায় না। সেই জায়গায় সংকটটা খুব তীব্র।
আলম: অর্থাৎ মননশীলতার জায়গায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।
হাসনাত: আমি একেবারে অভিজ্ঞতা থেকে বললাম যে, একটা বই সমালোচনা পর্যন্ত অনেকেই করতে চাননি তখন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত চমৎকার কবিতা লিখেছেন। ছন্দ আছে মিল আছে কিংবা ভাবনার প্রকাশ আছে কবিতায়। কিন্তু তিনি যে একটা প্রবন্ধ লিখে নতুন কোন মাত্রা সৃষ্টি বা সঞ্চার করবেন এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। সেজন্য মাঝেমাঝে খুব কষ্ট হয়।
আলম: আপনি নিজেও পরোক্ষভাবে হলেও একটা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আছেন, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। সেই অভিজ্ঞতা এবং সামগ্রিকভাবে আপনার নিজের বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা থেকেই বলুন, আমাদের প্রকাশনা কি শিল্প হয়ে উঠতে পেরেছে আদৌ? না পেরে থাকলে কোথায় সংকট? তার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
হাসনাত: গত দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা প্রকাশনার জগতকে সেরকম নেগেটিভলি না দেখাই ভালো। প্রকাশনা শিল্প কিন্তু সত্যি সত্যিই শিল্প হয়ে উঠছে। এবং নতুন নতুন প্রকাশক, প্রকাশনার জগতে আসছেন, সমস্ত অনিশ্চয়তা নিয়েও প্রকাশনাশিল্পে টাকা বিনিয়োগ করছেন এবং সবাই যে সফল হচ্ছেন তা না। অনেকেই নতুন নতুন বই বের করছেন। ভালো বইও বের হচ্ছে টুকটাক। সেদিক থেকে প্রকাশনা শিল্প যে একেবারেই শিল্প হয়ে ওঠেনি এটা আমি বিশ্বাস করি না।
আপনি দেখুন যে বেশ কয়েকটি পাবলিকেশন বৃহৎ আকারে টাকা ইনভেস্ট করছেন এবং লাভজনক হিসেবে এই ব্যাবসাটাকে গড়ে তুলেছেন। আমরা কতটা পেরেছি সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু অনেকেই প্রকাশনা শিল্পকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলছেন এবং প্রকাশনা শিল্প একটা বড় জায়গায় গেছেও। কিন্তু করোনা এসে বোধয় একটা আঘাত দিচ্ছে এবং এটা সাসটেইন করার জন্য আমার মনে হয় অন্যান্য শিল্পখাতে যেমন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে সেটা এই শিল্পেও দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
আলম: আপনি বলছিলেন যে অনেক প্রকাশনা সংস্থা অর্জন করেছে, তার সুফল লেখকরা কতটা পাচ্ছেন সেটাও বোধয় ভাবার দরকার আছে। আপনি নিজেও একটা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত--সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু যদি বলতেন যে, আসলে সংকট যদি থেকে থাকে, কোন জায়গায় প্রধান সংকটটা?
হাসনাত: প্রথম উত্তর আপনাকে দিই, প্রকাশনা জগৎ থেকে কিছু খ্যাতিমান এবং কিছু প্রতিষ্ঠিত লেখক টাকা পয়সা পাচ্ছেন ঠিকই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা পয়সা পান না লেখকেরা। আমি একটা প্রকাশনা সংস্থার সাথে যুক্ত আছি। এর বাইরে গিয়ে আমি কথাগুলো বলছি। আমি জেনারেলি বলছি, কারণ, এটা নিজের কথা। এই লেখকেরা, সত্যিকার অর্থে আজকে বাংলাদেশে কয়েকজন লেখক ছাড়া, অধিকাংশই বইটা পেয়েই সন্তুষ্ট হয়ে যান। বছরের পর বছর তাঁর বই যে বাজারে চলছে তাঁর সম্মানী তিনি ডিমান্ডও করেন না, তাই টাকাও পান না। আসলে আমাদের বাংলাদেশে লেখকদের কোন সংগঠন নাই তো। ফয়েজ ভাই, ফয়েজ আহমেদ চেষ্টা করেছিলেন লেখকদের একটা সংগঠন গড়ে তুলতে। লেখকদের সংগঠন থাকলে আজকে সংগ্রাম করতো এবং একটা নীতি নির্ধারণ করে দিত। সত্যি কথা বলতে আমাদের অনেকের বই তাই প্রকাশও হয় না। আবার কোনভাবে একটা বই যদি বের হয়, এটাতেই আমরা সন্তুষ্ট থাকি। কয়জন প্রকাশক আছেন যে, বছরের শেষে হিসাব করে ঐ টাকার চেক বা অর্থ লেখকদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
আমি মুক্তধারার চিন্তাভাবনার ভিতর এটা দেখেছি। আশির দশকে চিত্তবাবু পয়লা বৈশাখ থেকে পরের বছরের চৈত্র মাস পর্যন্ত যা পাওনা হত লেখকদের দিয়ে দিতেন। দশটা বই বিক্রি হলেও তার রয়ালটি দিতেন। ১২% রয়ালটি, সাড়ে দশ পার্সেন্ট রয়ালটি এরকম। উনি রয়ালিটি কম দিতেন। কিন্তু তারপরও তিনি দিতেন। এই প্র্যাক্টিসটা আমাদের এখানে হয়নি। কিছু মনে করবেন না, আমি কিছু খোলাখুলি কথা বলছি।
আলম: না, না। আমরা তো এটাই জানতে চেয়েছিলাম, এই পেশাদারিত্বের জায়গাটা বিষয়ে।
হাসনাত: আমি এই প্রসঙ্গে আর বলতে চাই না। কারণ এটা খুব অপ্রিয় ব্যাপার।
আমরা অনেক সময় বাংলা একাডেমি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করে থাকি। এখানে কিন্তু লেখককেই ফাইট করতে হবে প্রকাশকের সঙ্গে। এখানে বাংলা একাডেমির শীর্ষ একজন ব্যক্তি হয়ে কেউ আমার রয়ালটি আদায় করে দেবে এটা কাম্য নয়। লেখককেই লেখকদের জন্য সংগ্রাম করতে হবে, বলতে হবে। আর আমাদের এখানে হয়কি, একটা সংগঠন গড়ে উঠলে তার মধ্যে আদর্শ এবং নীতিপ্রশ্নে এমন কতগুলো বিষয় তৈরি হয়ে যায় যে সেটা আর বেশিদিন চলে না। ফয়েজ আহমেদ ভাই খুব চেষ্টা করেছিলেন। অনেকেই জড়িত হয়েছিলেন। মুনতাসির মামুন, আমরাও জড়িত ছিলাম। কাজ হয়নি আরকি।
আলম: এটা কি মূলত অনৈক্যের কারণে?
হাসনাত: হ্যাঁ, একদম। অনৈক্যের কারণে। ওরা এমনকি সংবাদপত্রের প্রত্যেক এডিটরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সম্মানী বাড়াবার ব্যাপারে বলেছিলেন। আপনারা নিউজ প্রিন্টে টাকা খরচ করতে পারেন, কালিতে খরচ করতে পারেন। লেখকদের সম্মানীটা কেন দেবেন না? কেন মাত্র দুইশত টাকা দেন। কেন হাজার টাকা নয়? এ ধরনের ব্যাপারগুলো হয়তো গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে।
আলম: আপনার কি পরিকল্পনা রয়েছে? আপনার নিজের লেখালেখি বা দেশের সাহিত্য, সব মিলিয়েই আপনার স্বপ্ন বা পরিকল্পনার কথা যদি একটু বলতেন।
হাসনাত: আমার নিজের লেখা নিয়ে খুব বড় কোন আকাঙ্খা নেই। টুকটাক লিখি। নানান ধরনের প্রবন্ধ, কবিতা। তারপরও অদূর ভবিষ্যতে দুহাজার একুশকে সামনে রেখে কিছু একটা করতে চাই, যদি কেউ এগিয়ে আসেন।
- অনুলিখন: আলী প্রয়াস