সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্: জন্মশতের শ্রদ্ধা
১
ফ্রান্সের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলের পাইন-ফার-এলম ঘেরা ছোট গ্রাম ইউরিয়াজ। বিয়াল্লিশ বছরের যুবক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ লিখে চলেছেন দ্বিতীয় উপন্যাস—'চাঁদের অমাবস্যা'—সঙ্গ দিচ্ছিলেন মঁসিয়ে পিয়ের তিবো আর মাদাম ঈভন তিবো- সম্পর্কে তাঁরা ওয়ালীর স্ত্রী আন মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবোর বাবা-মা। তিনি লিখতেন মূলত রোববার আর ছুটির দিনগুলোতে। পরনে পায়জামা বা লুঙ্গি, দ্রুত পায়চারি করতে করতে সিগারেট খেতেন একের পর এক আর তারপর একসময় ডেস্কে বসে পড়ে লিখতেন—আন মারির ভাষায় সেই সুদর্শন, রহস্যময় সংকেতলিপিতে, যার সব বর্ণ একটা দণ্ড থেকে ঝুলে আছে বলে মনে হয়। গভীর রাত পর্যন্ত লেখার আনন্দে তিনি বিভোর থাকতেন। লেখার অবসরে, সিগারেট টানার ফাঁকে, সঞ্চারণশীল মেঘের দিকে তাকিয়ে কখনো হয়তো তাঁর মনে হতো, এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো। বিচিত্র আর ঘটনাবহুল, কর্মমুখর তো বটেই।
জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের ষোলশহরে, ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট অর্থাৎ জন্মশতের বছরব্যাপী উদ্যাপন আমরা শুরু করতেই পারি, যেহেতু এক শ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। মাকে হারান আট বছর বয়সে, বৈমাত্রেয় পরিবারের স্নেহ থেকে সে কারণে বঞ্চিত হতে হয়নি। বারো বছর বয়সে ওয়ালী চেয়েছিলেন পাইলট হতে। অল্প বয়স থেকেই আকাশের বিশালতা তাঁকে টানত। এই কারণেই বোধ করি, পরিণত বয়সে তিনি লিটল প্রিন্সখ্যাত স্যাত এক্সুপেরির লেখা ভালোবাসতেন। আনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আমি স্যাত এক্সুপেরির উইন্ড স্যান্ড অ্যান্ড স্টারস বইটি শেষ করলাম। শেষ অধ্যায়টি ছাড়া বইটি আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়, তিনি এমন এক মহান লেখক, যিনি রুটিনে বাঁধা জীবনের হাত থেকে রেহাই পেতে ওড়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।' তাঁর সৎমায়ের বক্তব্য জেনে নিতে পারি—দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত ওয়ালী সারাক্ষণ আমার কাছে কাছে থাকত। রান্নাঘরে গিয়ে আমার কাছে চুপ করে বসে থাকত। বলত, আম্মা আমাকে দিন, আমি তরকারি কুটে দিই। এমন সুন্দর করে শশা-টমেটো কেটে প্লেটে সাজাত। খাবার জিনিস যেনতেনভাবে টেবিলে সাজানো ওর পছন্দ হতো না। বাসার বাইরে কোথাও গেলে আমাকে না জানিয়ে যেত না।' একজন কোমল সংবেদনশীল বালকের পরিচয় পাচ্ছি আমরা সহজেই। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে তিনি খুব আঁকাঅঁাঁকি করতেন। ওয়ালীর সৎখালা আন মারিকে বলেছিলেন, 'একদিন ও পড়া না করে ছবি আঁকছিল। ওর বাবা এসে চুলের মুঠি ধরে টেনে উঠিয়ে ওর আঁকা ছবি ছিঁড়ে ফেলেছিল। ওয়ালী তখন নিচু স্বরে বলেছিল, 'ছবি আঁকা চালিয়ে যেতে হলে আমাকে মাথার চুল কেটে ফেলতে হবে।'
সরকারি চাকরি করতেন বাবা সৈয়দ আহমদউল্লাহ্। ফলে বদলির সূত্রে পুত্র ওয়ালীর শিক্ষাজীবন কেটেছিল সারা বাংলার প্রায় চতুর্দিকজুড়ে—ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফেনী, হুগলী, চূঁচুড়া, কৃষ্ণনগর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মুন্সিগঞ্জ মানিকগঞ্জ এসব স্থানে। ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি, ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন পরে। কলেজের প্রথম বর্ষে থাকতেই ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হলো—'সীমাহীন এক নিমেষে'।
২
১৯৪৫ সালে তিনি ইংরেজি পত্রিকা 'দ্য স্টেটসম্যান' পত্রিকায় চাকরি নেন। এই বছরের ছাব্বিশে জুন তাঁর পিতা প্রয়াত হলেন। অবশ্য তিন মাস আগে, মার্চে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। এই বছরেই বই প্রকাশের সূত্রে সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর।
সওগাত, অরণি, পূর্বাশা, মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, বুলবুল সব তৎকালীন বিখ্যাত ও প্রচারসফল পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথম গল্পগ্রন্থ 'নয়নচারা'র প্রকাশক সঞ্জয় ভট্টাচার্যই। জীবনানন্দের সাথে কখনো আড্ডা দিয়েছিলেন তিনি?
বড় মামা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের সূত্রে কমরেড পাবলিশিং হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। দেশভাগের পর স্টেটসম্যানের চাকরি ছেড়ে রেডিওর চাকরিতে তিনি বেশ অবসর পাচ্ছিলেন, সেই অবসরেই নিমতলির বাসায় বসে লিখলেন 'লালসালু'। অধ্যাপক অজিত গুহ তাঁকে অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। দুই হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল, বিক্রি হয়েছিল মাত্র দুই শ কপি। এই পরিসংখ্যান থেকে অধুনা প্রচারসফল বইপত্রের গুণগত মান বিষয়েও একটা ধারণা পেতে পারি আমরা। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সমকালীন আরেক ধ্রুপদি শিল্পী জয়নুল আবেদিন। এখন ভাবতে ইচ্ছে করে, 'লালসালু'র প্রথম সংস্করণের একটি কপি হাতে নেবার রোমাঞ্চ কেমন হতে পারে! আরেকটি ভাবনাও মনে আসে। 'পদ্মা নদীর মাঝি'র মতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অপূর্ব উপন্যাসের পাশাপাশি 'লালসালু' উপন্যাসটিও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কোমলমতি বালক-বালিকাদের চরিত্রশুদ্ধির জন্যে সম্পাদনার নামে শিল্পরসটাই নিংড়ে ফেলে দিয়েছে।
'লালসালু' মূলত বাস্তব ক্ষুধা আর কল্পিত ঈশ্বরের মধ্যে এক দ্বৈরথই যেন। উপন্যাসটির শেষে আমরা দুটি পরিণতির খোঁজ পাই, একটিতে শিলাবৃষ্টিতে প্রায় সব ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা আর অন্যটিতে বন্যা এসে মজিদের বাঁচার অবলম্বন মাজার ডুবে যাওয়ার সম্ভাব্যতার বিবরণ। অনুবাদে সমাপ্তিটি লেখক বদলে দিয়েছিলেন। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি—এই বাক্যটি কত অমোঘ হয়ে ওঠে, উপন্যাসের প্রথম পাঠকমাত্রেই টের পাবেন।
৩
১৯৫২ সালের অক্টোবরে ওয়ালীউল্লাহ্ সিডনির পিট স্ট্রিটে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে। আন মারি দূতাবাসের ঠিক উল্টো দিকে ফরাসি দূতাবাসে কাজ করতেন। অস্ট্রেলিয়ান স্থপতির দেয়া বড়দিনের পার্টিতে তাঁদের পরিচয়। ভিড় থেকে দূরে একা আত্মসমাহিত ওয়ালীউল্লাহর স্থিতি, নিমগ্নতা টেনেছিল তেইশের তরুণীকে, গল্পের নায়ক তখন একত্রিশ। বন্ধুত্ব গড়াল প্রেমে, তারপর ১৯৫৫ সালে গাঁটছড়া বন্ধন। আন ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন কিন্তু তার অভিঘাত ওই কাবিননামা পর্যন্তই, নিজেদের জীবনে আঁচ লাগেনি। ২০১২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়েছিল আন মারির ওয়ালীস্মৃতিচারণামূলক ছোট্ট বই 'আমার স্বামী ওয়ালী'। সেখানে লেখক, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন কর্মী মানুষের বাইরে আমাদের চোখের সামনে এসে পড়েন একজন বিশ্বনাগরিক অথচ অত্যন্ত বাঙালি একজন মানুষ। তিনি ভালোবাসেন সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে, বাঙালি খাবার খেতে, বুড়ো আঙুল দিয়ে আঙুলের গাঁট গুনতে। সর্বগ্রাসী পাঠক ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর ছেলেবেলার নানা টুকরো ছবি, যৌথ দাম্পত্য ভ্রমণের অনেক গল্প আন আমাদের সাথে ভাগ করে নেন। সবচেয়ে বড় কথা সে পঞ্চাশ ও ষাটের প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক আগুনে সময়টার কথাও আমাদের মনে করিয়ে দেন। আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে দেবেশ রায়ের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের টুকরো—'শিল্প ডেফিনিটলি, নিশ্চিতভাবেই...শিল্পের জন্যই শিল্প। শিল্প কারও কোনো উপকার করতে পারে না। কোনো সমাজ-বিপ্লব করতে পারে না। কিন্তু শিল্পই একমাত্র পারে, যা দেখা যাচ্ছে না, সেটাকে দেখাতে। সেই কারণেই ১৮১৪-১৫ সাল থেকে লেরমেনতভ, পুশকিন, গোগোল এই দিয়ে, দস্তয়েভস্কি-তলস্তয় দিয়ে... এই করতে করতে আপনি যদি ১৮৯২-এ আসেন... যখন চেখভ এবং গোর্কি একই সঙ্গে লিখতে লিখতে বিংশ শতাব্দীতে ঢুকছেন, তাহলে আমি একটা গ্রাফ দেখতে পাই...'আমি' শব্দটার ওপর জোর দিচ্ছি... আরেকজন না-ও জোর দিতে পারেন... যে... এই প্রসেসের ভেতর দিয়ে যে পাঠক যাচ্ছে... তার ছেলে যাচ্ছে... তার মেয়ে যাচ্ছে... তার বংশানুক্রম যাচ্ছে... তার পরিবেশ যাচ্ছে... সে পাঠক ১৮৯২-এ লেনিন না হয়ে পারে না। কারণ, ইতিমধ্যে তার চৈতন্যের জগৎ বদলে গেছে। এইটাই শিল্প-সাহিত্য করতে পারে। একা না... একটা উপন্যাসে না... কিন্তু শিল্প-সাহিত্যই করতে পারে...
(দেবেশ রায়/জারি বোবাযুদ্ধ ২০১০-এর সাক্ষাৎকারের টুকরো), যে সময়ের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বেড়ে উঠেছেন, যেসব মানুষদের সঙ্গ করেছেন এবং ইতিহাসের যে ঘূর্ণিতে তিনি সঞ্চারিত হয়েছিলেন, তাতে ওয়ালীউল্লাহ যেমনটি হয়েছিলেন, তেমনটি না হয়ে তাঁর উপায় ছিল না। সময়ের ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁর জীবন দর্শন আন আমাদের জানিয়েছেন ব্যক্তিগত চিঠির উদ্ধৃতির মাধ্যমে।
ওয়ালীউল্লাহ্ যেসব দেশে গিয়েছেন, ঔপনিবেশিক শক্তির ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন দেখে বিস্মিত হতেন। সায়গনে ফরাসি, ম্যানিলায় হিস্পানি, ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ। আন মারি সূত্রে আমরা জানি। তিনি আমাদের জানান—'মনে পড়ে, আমরা দুজন একসঙ্গে জাকার্তা গিয়েছিলাম—জাভায় বোরোবুদুর বৌদ্ধমন্দির আর বানদুংয়ের কাছে চা-বাগান ঘুরে নিজের দেশের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।' জাকার্তা থেকে ফেরার পথে আট বাক্স বই নিয়ে ফিরেছিলেন তাঁরা। গৃহসজ্জায় ওয়ালী স্ব-উদ্ভাবিত ডিজাইনের আসবাব ব্যবহার করতেন। নিজের আত্মজ-আত্মজার সাথে খেলাধুলা তাঁর অবসর কাটানোর প্রিয় অবসর। বইপত্রে তাঁকে যেমন আত্মবিচ্ছিন্ন যাকে বলে এলিয়েনেটেড মনে হয়, তা তিনি মোটেও ছিলেন না। ১৯৬৯-৭০-এ সপরিবারে চট্টগ্রাম এসেছিলেন তাঁরা, আগ্রাবাদের এক অধুনা বিলুপ্ত রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলেন এবং সেখানকার একজন ওয়েটার তিনিই 'লালসালু'র লেখক কি না, তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি গভীর আনন্দ পেয়েছিলেন।
তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাজে আর মন দিতে পারছিলেন না। ফলে ইসলামাবাদে না ফেরায় সরকারি সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। কর্মতৎপরতাময় একজন মানুষের চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছিল না, আত্ম-অবমাননাকর মনে হচ্ছিল তাঁর। এসব উদ্বিগ্নতার কারণেই আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর মাত্র ঊনপঞ্চাশে। আমি ভাবি, একটি মানুষ জীবনের প্রথম আঠাশ বছর জন্মভূমির বাইরে পা দিলেন না, শেষ একুশ বছর রীতিমতো বিশ্ব পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়ালেন। হয়ে উঠলেন একজন অসামান্য লেখক। আমরা তাঁর চারটে উপন্যাস পড়েছি, গল্পগুলো পড়েছি। নাটক দেখেছি মঞ্চে। এখন এই জন্মশত উপলক্ষে যদি ওয়ালী আর আন মারির পারস্পরিক পত্রাবলি প্রকাশিত হয়, যেমন কিনা আমরা প্রমথ চৌধুরী-ইন্দিরা দেবীর পত্রাবলি পাই, তাহলে তাঁদের মানসচিত্র আমাদের সামনে আরও স্পষ্ট হবে। অবশ্য, এই বছর, জন্মশত উপলক্ষেই তাঁর পুত্রকন্যা সিমিন আর ইরাজের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'পিকটোরিয়াল বায়োগ্রাফি' বা সচিত্র জীবনী, তাঁদের মায়ের লেখা—'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মাই হাজবেন্ড অ্যাজ আই স হিম'। জন্মশতবর্ষে তাঁর নিজের শহর চট্টগ্রাম কি কোনো উৎসব করবে না? ওয়ালী-আনের সংক্ষিপ্ত যুগল জীবন জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়েছিল, বাঙালি ওয়ালী বেঁচে গিয়েছিলেন এক ফরাসিনী পরানসখার সান্নিধ্য পেয়ে। লেখকেরা যেমন পেলে সময় অতিক্রম করে বেঁচে থাকে।