গোলাপী এখন কোথায়?
মিস্টার বুকেট, আমি ৩১ বছর ধরে ভাবছি আপনার গোলাপীকে নিয়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী হিসেবে আপনি কর্মরত ছিলেন, সময়টা ১৯৮০ সাল। ডিসেম্বরে হঠাৎ আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ভর্তি করা হয় মহাখালীর একটি হাসপাতালে। সেখানেই আপনার পরিচয় ঘটে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট গোলাপীর সাথে। সে নিয়মিত আপনার সেবা-শুশ্রূষা করত। আর এভাবেই ছিপছিপে শ্যামলা বর্ণের সেই দীর্ঘাঙ্গিনী তরুণী আপনার মন জয় করে নেয়। ভালোবাসা আর প্রেমের গণ্ডি পেরিয়ে আপনারা একসময় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দীঘল চোখের সুভাষিনী গোলাপী আপনার জীবনসঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়।
নরসিংদীর চরসিন্দুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের দরিদ্র মেয়েটির জীবন অপার ঐশ্বর্যে ভরে ওঠে। আপনার সংস্পর্শে তার জীবনযাত্রায় এক আমূল পরিবর্তন চলে আসে। আগে থেকেই সে একটু স্বাধীনচেতা ধরনের ছিল। আর আপনার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে টি-শার্ট আর জিনস প্যান্ট পরে মুখে ডানহিল সিগারেট নিয়ে অজপাড়াগাঁয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, মুক্ত পাখির মতো। গ্রামের অনেকেই এটা পছন্দ করত না। তবে রক্ষণশীল এক জনগোষ্ঠীর বিপরীতে গোলাপী যেন ছিল এক মূর্তিমান প্রতিবাদ, তীব্র স্রোতের প্রতিকূলে এগিয়ে চলা এক সাহসী যোদ্ধা।
বিদ্যুৎবিহীন সেই আদি গ্রামে ছিল গোলাপী আর বুকেটের ডাকবাংলো। রাত্রিবেলায় সেখানে জেনারেটরের সাহায্যে জ্বলে উঠত বৈদ্যুতিক আলো। কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে ঘুরে বেড়াত দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর। ছিল ভিনদেশি বিড়াল, যার গলায় ছিল সোনার চেইন। কুকুর আর বিড়ালদের খাওয়ানো হতো প্যাকেটজাত খাদ্য। এসব বিষয় ছিল গ্রামের মানুষের চিন্তারও অতীত। গ্রামের মানুষের প্রবল আগ্রহ আর কৌতূহলের কেন্দ্র ছিল ওই বাংলোবাড়িটি। তাদের ব্যবহৃত নিশান জিপটি দাঁড় করানো থাকত বাংলো থেকে কিছুটা দূরে। এক রাতে ওই জিপের জানালার কাচ ভেঙে বুকেট সাহেবের কয়েক বোতল সিভাস রিগ্যাল আর বিয়ারের কার্টন চুরি করে নিয়ে যায় গ্রামের কয়েকজন যুবক। এ নিয়ে ভীষণ তোলপাড় শুরু হয় সমস্ত এলাকাজুড়ে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই কথা।
বুকেট সাহেব, আপনি কয়েক বছর পর গোলাপীকে নিজ দেশ পশ্চিম জার্মানিতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর সে ফিরে এল, তবে আপনাকে ছাড়া। জানা গেল, কিছুদিন পর আবার সে আপনার কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু সেই যাওয়া আর হলো না।
সাহেব, আপনি কি জানেন পরবর্তী সমযয়ে আপনার গোলাপীর জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল? নানা রকম ষড়যন্ত্র আর মামলা-হামলায় দুর্বিষহ হয়ে ওঠে গোলাপীর জীবন। প্রবল দারিদ্র্য এসে গ্রাস করে তাকে, ডানহিল সিগারেট বদলে যায় আলাউদ্দিন বিড়িতে। প্রবল ঝড়ে পথ হারানো পাখির মতো বিভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকে সে গ্রাম, শহর, বন্দরে। গা ভাসিয়ে দেয় বিপথগামী প্লাবনে।
তারপর একদিন (১৯৯৩) গোলাপী বাড়ি ছেড়ে রওনা হয়ে যায় ভারতের উদ্দেশে। তখন শুনেছিলাম ভারত থেকে পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার চেষ্টা করবে সে। এরপর কী ঘটেছে জানা নেই। তবে তার আর দেশে ফিরে আসা হয়নি। ৩১ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে।
আজ থেকে দেড় দশক আগের কথা। আমি তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত বন্য প্রাণী সম্পর্কে লিখে যাচ্ছি। অনেকে তখন ভাবতেন আমি কোনো পত্রিকাতে চাকরি করি। বেশির ভাগ সময় আমি ঢাকাতেই থাকতাম। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এলে গোলাপীর অন্ধ মা জোহরা কাজী, সবাই যাকে বইচা নামে চিনত, প্রায় সময়ই আমার কাছে আসতেন। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতেন, 'বাবা আমার মাইয়ারে নিয়া পত্রিকায় লেখো, আমার মাইয়ারে আইন্যা দাও।'
তারপর একবার গোলাপী আর মিস্টার বুকেটের একটি যুগলবন্দী আলোকচিত্র নিয়ে আসেন। ছবিটি তাদের বিয়ের এক বছর পরে তোলা। নানাবিধ কারণে এই বিষয়টা নিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনি। আসলে অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, গোলাপী হয়তো জার্মানিতে আছে বুকেট সাহেবের কাছে।
গোলাপীর অন্ধ মা, সুলতানপুর কাজীবাড়ির বইচা মেয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে একসময় মরে গেল। ৩১ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, আজও কেউ গোলাপীর খবর জানে না। একটা মানুষ এত সময় ধরে নিরুদ্দেশ, নিঃসন্দেহে অত্যন্ত রহস্যময় ঘটনা। তবে এ বিষয়ে আমার মাথায় শুধুই দুটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
মিস্টার বুকেট, আপনি কেন গোলাপীর সঙ্গে এমন করলেন?
গোলাপী এখন কোথায়? গোলাপী জার্মানী পৌঁছাতে পেরেছিল?