সংহার ও সংরক্ষণের গল্প
কৈশোরে বাঘ শিকারে নামার একাধিক সুযোগ হয়েছিল রবি ঠাকুরের। অতিপ্রিয় ও অপ্রতিরোধ্য অগ্রজ জ্যোতি দাদার সাথে কিশোর রবি দু-দুবার শিলাইদহে বাঘ শিকারে বেরিয়েছিলেন। জ্যোতি দাদার বন্দুকের গুলিতে একটি বাঘ মারাও পড়েছিল।
সেই বাল্যস্মৃতি নিয়ে পরবর্তীকালে কোনো দিন আমরা রবি ঠাকুরের কাছ থেকে বড় কোনো সাহিত্যকর্ম পাইনি। তার কারণটা অনুমান করা কি সম্ভব! সম্ভবত একজন শিকারি আর পরিণত রবি ঠাকুরের চরিত্রে মেলা ফারাক ছিল। তা ছাড়া শিকার নিয়ে সাহিত্যকর্ম করার দিনও তো তখন শেষ হয়ে আসছিল।
মানুষ আদিকাল থেকে হিংস্র বন্য প্রাণীর সাথে লড়াইয়ে সফল ব্যক্তির বীরত্বগাথা আর ব্যর্থজনের শোকগাথা লিখে আসছে। মানুষের আদিতম লিখিত সাহিত্যকর্ম 'গিলগামেশ উপাখ্যান' তেমনই এক বীরত্বগাথা, যেখানে নায়ক উথনাপিশিতম খালি হাতে লড়াই করে একসাথে দুটি সিংহকে কাবু করেছেন।
হিংস্র প্রাণী ও মানুষের সংঘাতকে এককালে যথার্থই 'লড়াই' আখ্যা দেওয়া হতো। মানুষের হাতে চোখা পাথরের অস্ত্র ওঠানোর ক্ষণ থেকে ওই লড়াইয়ে হিংস্র প্রাণীর পাল্লা হালকা হয়ে মানুষেরটা ভারী হয়েছে। লড়াইটা আরও অসম হয়েছে মানুষ যখন বল্লম, তির আর পাথর ছুড়ে মারার কৌশল আয়ত্তে এনেছে।
তারপর আগ্নেয়াস্ত্র এসেছে মানুষের হাতে। তখন মানুষ ও হিংস্র প্রাণী মুখোমুখি হলে তাকে আর লড়াই আখ্যা দেওয়া যায়নি; তার নাম হয়েছে 'শিকার'। ইংরেজিতে এর নাম হয়েছে 'গেম'; অর্থাৎ খেলা। 'খেলা' নামকরণটা স্পষ্টতই অনুপযোগী; কারণ, এই খেলায় মানুষের প্রতিপক্ষ বন্য প্রাণীর দলটিকে তো বলাই হয়নি যে খেলাটা শুরু হয়েছে।
সম্ভবত উনিশ শতকের শেষ দিকে বন্দুক নামক অস্ত্রটি সহজলভ্য হবার পর থেকেই শিকার নিয়ে সাহিত্যকর্ম করায় ভাটা পড়ে গেছে। হিংস্র প্রাণীর সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়ানো মানুষের চেয়ে বন্দুকের মুখে দাঁড়ানো প্রাণীর মধ্যে বীরত্ব বেশি প্রকাশিত বলে মনে হয়েছে। শিকারিকে বাহবা দেওয়ার চেয়ে লোকে নিহত প্রাণীর জন্য শোকাতুর হতে শুরু করেছে।
হিংস্র প্রাণীকে প্রতিরোধ করা, পরাজিত করা কিংবা বধ করাটা আজ আর আত্মাহুতি দিতে আগ্রহী কোনো বীরের কাজ বলে গণ্য হয় না। বন্য প্রাণী শিকার করাটা মূলত ধনী, আয়েশি আর বেশি বয়সী মানুষের বিনোদনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শিলাইদহে জ্যোতি দাদার বাঘ শিকারটিও তো তেমন এক বিনোদনই ছিল।
দর্শনার্থী ও দোকানির ভিড় ঠেলে এখন যারা শিলাইদহে রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে যান, তারা হয়তো ওখানে একদিন বাঘ শিকার করা হয়েছিল জেনে অবাক হবেন। কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই; তখন বাংলাদেশের সবখানেই বাঘ ছিল। বাঘ বলতে চিতাবাঘ বুঝতে হবে। চিতাবাঘ হলো 'লেপার্ড'; 'টাইগার' নয়।
গড়াই নদীর তীরে আমার নিজের গ্রামটি শিলাইদহ থেকে বড়জোর দশ কিলোমিটার দূরে। আমি সেখানে চিতাবাঘ শিকার হতে দেখেছি ১৯৬০ সাল অবধি; শিলাইদহে জ্যোতি দাদার সেই বাঘ শিকারেরও নয় দশক পরে।
বাঘের মতো অতিকায় এক বিড়ালের নামই চিতাবাঘ। সেই বিড়ালগুলো কখনো মানুষ মারত না। ওরা শিয়াল, খাটাশ, গুইসাপ ইত্যাদি বন্য প্রাণী শিকার করে জীবন ধারণ করত। তবে মাঝে মাঝে ওরা কৃষকের গরু-ছাগল অথবা গৃহস্থের পোষা কুকুর বধ করত। গ্রামবাসী তখন তার প্রতিবিধান করতে উঠেপড়ে লাগত। অর্ধভুক্ত লাশের কাছে মাচা বেঁধে বসে থেকে গাঁয়ের লোক রাতে ক্ষুধার্ত চিতাবাঘকে গুলি করে মারার চেষ্টা করত।
কিশোর রবির বয়সে আমারও ভাগ্য হয়েছিল হিজলাবট গ্রামে একটি বাঘ শিকার দেখার। একদিন গড়াই নদীতীরে একটি বাছুরের অর্ধভুক্ত দেহ পাওয়া গেল। অমনি গাছে গাছে মাচা বাঁধা হলো এবং সূর্য ডুবলে কয়েকটি দোনলা বন্দুক নিয়ে লোক মাচায় উঠে গেল। মাঝরাতে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ হলো। সকালে জানলাম, একটি বাঘ মারা পড়েছে।
যার মাচার কাছে আসার ফলে বাঘটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, তিনি আমাদের গাঁয়ের কম্পাউন্ডার। গাঁয়ের মানুষ তাকে মাল্যদান করেনি; ভাগ্যবান বলেছে। অন্য মাচায় যারা রাত জেগে বসে ছিলেন, তারা নিজেদের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়ে বন্দুক গুটিয়ে ঘরে গেছেন।
নিহত বাঘের মাংস নিতে দশ গ্রামের মানুষ এসে হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের বিশ্বাস, বাঘের মাংস খেলে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হয়। আমি ভেবেছিলাম, জীবন রক্ষায় ব্যর্থ এক পশুর মাংসে যদি অত ঔষধি গুণ থাকে, তাহলে অব্যর্থ শিকারির দেহে না জানি কত গুণ আছে!
বাংলাদেশের অনন্য বাঘশিকারি পচাব্দী গাজীর সাথেও সাক্ষাতের এক বিরল সুযোগ হয়েছিল আমার। সে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। পাখি দেখার জন্য আমরা সুন্দরবনের প্রান্তিক লোকালয় আংটিহারায় ছিলাম এক সপ্তাহ। প্রকৃতিপ্রেমী খসরু চৌধুরী আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পচাব্দী গাজীর কাছে।
পচাব্দী গাজী তখন বার্ধক্যে ও রোগভারে ন্যুব্জ। কথা হলো অতি সামান্য। তার চিকিৎসার জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে কথা কইলেন খসরু চৌধুরী। বাঘের মাংসের জাদুকরি ঔষধি গুণ নিয়ে এককালে আমার গাঁয়ের মানুষের যে বিশ্বাস ছিল, সে কথাটা মনে পড়ল অকারণেই।
শুনেছি, নিজ হাতে ৫৭টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার মেরে পচাব্দী গাজী এককালে পাকিস্তান সরকারের সনদ-ই-খিদমত উপাধি পেয়েছিলেন। আর সেই বাঘশিকারি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসার অভাবে কষ্টকর দিন যাপন করছেন!
জানলাম, কৈশোরেই পচাব্দী গাজী বাঘ শিকার করতে সুন্দরবনে গেছে তার পিতা মেহের গাজীর সাথে। তার বাবা ও দাদা প্রফেশনাল বাঘশিকারি ছিলেন এবং বাঘ শিকার করতে গিয়ে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণেই তারা মারা যান।
পচাব্দী গাজী অবশ্যই সৌখিন শিকারি নন; শিকার তার প্রফেশন। তিনি সুন্দরবনে ২৩টি মানুষখেকো বাঘ মারার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। এদিক দিয়ে তিনি বাংলাদেশের জিম করবেট। জিম করবেট অনেক মানুষখেকো বাঘ মেরেছিলেন; কিন্তু শিকারের আনন্দে হত্যা করেননি।
জিম করবেট কিংবা পচাব্দী গাজীর দুঃসাহসিক শিকারের গল্পে গেইম-হান্টিংয়ের আমেজ, তথা সংহারের উল্লাসটা স্তিমিত অথবা অনুপস্থিত। সম্ভবত ভারতবর্ষে সেটাই ছিল শিকার নিয়ে সাহিত্যকর্মের অন্তিম দিন। বিশ্বের অন্যত্র সেদিন শেষ হয়েছে আরও আগে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দার্শনিক রালফ অয়াল্ডো এমারসনের দুটি পুস্তক যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে পুরোনো পৃথিবীতেও বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল। বই দুটির নাম 'নেচার' ও 'সেলফ রিলায়েন্স'। প্রকৃতির কাছে গিয়ে আর নিজের মধ্যে প্রবেশ করে আত্মপ্রেম অতিক্রম করার কথাই বলেছিলেন এমারসন।
এমারসনের সাহচর্যে ও লেখনিতে প্রভাবিত একজন তরুণ লেখক ম্যাসাচুসেটস স্টেটের এক বনে দুই বছর একাকী বাস করার পর একটি বই লিখলেন। বইটির নাম 'ওয়াল্ডেন'। লেখকের নাম হেনরি ডেভিড থ্রো। আমাদের মুনি-ঋষিদের তিরোধানের যুগযুগান্ত পার হলে পরে থ্রো নতুন করে বললেন বনে গিয়ে জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা। ধ্রুবতারা হয়ে রইল তাঁর 'ওয়াল্ডেন' দুই শতক ধরে।
এমারসন-প্রভাবিত আর এক প্রকৃতিপ্রেমী সেকোয়া বন, ইয়েসোমিতি বনাঞ্চল, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরলেন। তার নাম 'জন মিয়র'। তার লেখনী যেন জীবন্ত সেকোয়াগাছকে শহরের গৃহকোণে এনে তার শিকড় ও শাখা বিস্তারের সুযোগ করে দিল।
বিশ শতককে সহজেই প্রকৃতিপ্রেম আর প্রকৃতি-সংরক্ষণ নিয়ে সাহিত্যকর্ম করার কাল বলে চিহ্নিত করা যায়। শিকারের দিন সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি ঠিকই; কিন্তু নিধন নিয়ে 'গিলগামেশ উপাখ্যান' লেখার কাল যে গত হয়েছে, তা বলা যায়।
সন্দেহ নেই, শিকার মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সংহারের উল্লাস আমাদের আদিম তাগিদ। তবুও আজকের বিশ্ব শিকারের চেয়ে সংরক্ষণ বেশি চায়। বন্দুকের চেয়ে বাইনোকুলার ও টেলিস্কোপ বেশি বিক্রি হয়। শিকারের চেয়ে সংরক্ষণ নিয়েই মানুষ বেশি লেখালেখি করে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে বিশ শতকের এই মধুর ও প্রাণবন্ত সুরটি রবি ঠাকুরের কবিমানসকে উজ্জীবিত করেছিল, সন্দেহ নেই। পাতার মর্মরেতে প্রাণ কাঁপে যে কবির, যিনি নদীর জলে কান পেতে থাকেন আর ফুলের ভাষা বুঝতে চান, তাঁর জন্য বিগত শতাব্দীর সংহার ও সম্ভোগবাদী ধারায় প্রভাবিত হওয়া সম্ভব নয়।
শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ উৎসব শুরু করেছিলেন ১৯২৭ সালে। অমন অতি প্রয়োজনীয় একটি উদ্যোগের মূল্য বুঝতে আমাদের আরও অনেক দিন লেগেছে।