রাজাদের পাগলামি আর রক্তপিপাসা
পাগলা রাজাদের গপ্প উঠলে তুঘলকের নাম আসবেই। উপমহাদেশে তুঘলক হয়তো এ খাতে নামকাম কামিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বের দরবারে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে দুনিয়ায় পয়লা হওয়ার 'যোগ্যতা' অর্জন করেছেন ৬০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ব্যাবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার।
সব পাগলা রাজা-রানির গালগল্প তুলে ধরা যাবে না। যাদের নিয়ে ইতিহাসবেত্তারা বইয়ের পর বই লিখেছেন, তাদের সবাইকে আঁটসাঁট শব্দের খুদে নিবন্ধে আঁটানো সম্ভব নয়।
১. মার্কিন খ্যাতনামা হিস্ট্রিডটকমের ওয়েবসাইট ১০ উন্মাদ রাজার যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে প্রথমেই নিয়ে এসেছে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারকে। তাকে সব উন্মাদ রাজার পিতামহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়েছে, নেবুচাদনেজার সাত বছর পশুসুলভ উন্মাদনায় ভোগার কথা প্রথম পুরুষে বর্ণনা করেছেন ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব ড্যানিয়েলে। এই বর্ণনাকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরে হিস্ট্রিডটকমে আরও বলা হয়েছে, হিব্রু ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করে নিজ প্রাসাদ ছেড়েছুড়ে বনে চলে যান নেবুচাদনেজার। বাইবেলে বর্ণিত নেবুচাদনেজারের পাগলামি এক অবকাঠামোয় রূপ নেয়। বিশ্ব রাজকীয় উন্মাদনাকে এ কাঠামোতে ফেলে বিচার করে জুডিও-খ্রিষ্টান। বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের স্রষ্টা এই রাজা প্রাচীন জেরুজালেম নগরী এবং এর পবিত্র মন্দির ধ্বংস করেন। ব্যাপক লুটপাট করেন। বিলুপ্তপ্রাপ্ত আক্কাদীয় ভাষায় তার নামের অর্থ 'হে প্রভু নেবু, আমার পুত্রকে রক্ষা করো।'
নেবুচাদনেজার নিজেকে ঈশ্বর ঘোষণা করেন। মেঘমণ্ডলীর ওপরে অধিষ্ঠান করবেন এবং নিজেকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাবেন এমন ঘোষণা দেন তিনি। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদে বলা হয়েছে, নিজ শাসনামলে নেবুচাদনেজার মানুষের মনে ভয়াবহ ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন।
পাগলা রাজা হিসেবে যাদের নাম নেওয়া হয়, তারা সবাই নিষ্ঠুরতার জন্য এমন নাম পেয়েছেন, তা নয়। নোংরা থাকার জন্য কেউ কেউ ইতিহাসে পাগল হিসেবে পরিচয় পেয়েছেন। এরকম এক রাজা হলেন ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই। রাজসিংহাসন হিসেবে তিনি ব্যবহার করতেন অস্থায়ী কমোড। ৭৭ বছরের জীবনে তিনি নাকি মাত্র তিনবার গোসল করেছেন। বলা হয় দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ কর্মীরা রাজপ্রসাদ ত্যাগ করতে থাকেন। তাদের ফেরাতে রাজা লুই গোটা প্রাসাদ সুগন্ধি ফুলে ফুলে ভরে দেন।
নিজ শরীরের দুর্গন্ধ ঢাকা দিতে পোশাকাশাক বাজারের সেরা খোশবুতে ডুবিয়ে নিতেন। তারপর তা পরিধান করতেন। তারপরও গোসলের ধার ধারতেন না। 'আমার যেমন বেণী তেমন রবে চুল ভেজাব না, আমি বেণী ভেজাব না' বলে একটা জনপ্রিয় গান আছে। সে গীতি লেখক রাজা লুইয়ের গোসলে অনীহা সম্পর্কে জানতে পারলে কী লিখতেন, সে কথা ভাবতে পারেন!
ক্ষমতা মানুষকে কীভাবে এবং কতটা উন্মাদ করে তোলে তার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায় রোমান সম্রাট কালিগুলাকে। হিস্ট্রিডটকমে পাগলা রাজাদের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রাখা হয়েছে কালিগুলাকে। কালিগুলার পুরো নাম জুলিয়াস সিজার অগাস্টাস গেরমানিকাস; ডাক নাম গাইয়াস। ১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগস্টে জন্ম নেওয়া কালিগুলা। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ৪১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান বা তাকে হত্যা করা হয়।
কালিগুলার পিতা গেরমানিকাস ছিলেন সফল এক সেনাপতি ও রোমের জনগণের কাছে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বাবাকে একটি যুদ্ধে সঙ্গ দিয়েই কালিগুলা মানে 'ছোট সৈনিকের বুট' নাম তিনি অর্জন করেছিলেন। কালিগুলার ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। তারপর দীর্ঘদিন কেটেছে দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে। ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ক্ষমতায় গ্রহণ করেন। এখানেও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কালিগুলা ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেই কেউ কেউ মনে করেন।
কালিগুলাকে ক্ষমতায় পেয়ে প্রথমে রোমের মানুষ উল্লসিত হলেও সে উল্লাস ছয় মাসের বেশি টেকসই হয়নি। ততদিনে স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছেন কালিগুলা।
ঔদ্ধত্য, ভয়াবহ যৌন বিকৃতি, অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার সীমাহীন অপব্যবহার, লাগামছাড়া বিলাসিতা, কথায় কথায় মুণ্ডুচ্ছেদ, ছুতানাতায় সম্মানীয় ব্যক্তিদের অবমাননা ও তাদের প্রতি রূঢ় আচরণÑএভাবে যদি তালিকা তৈরি করেন, তবে তার যেকোনোটিই হবে বিশাল। নিজ ক্ষমতার প্রতি সামান্য হুমকি বলে যাকেই মনে করা হয়েছে, তারই মাথা ধর থেকে কেটে আলাদা করে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন কালিগুলা।
সম্রাটের জন্মদিন মনে রাখতে না পারাকেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতেন কালিগুলা। তাকে দেওয়া হতো মৃত্যুদণ্ড। রাজদরবারের তিন অমাত্য এভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। এদিকে রাজতহবিলের ঘাটতি পূরণে ১৪ থেকে ৬০-এর অধিক বৃদ্ধা পর্যন্ত সব নারীকে বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেন এ সম্রাট। নারীদের কেউ কেউ ভয়াবহ এই অসম্মানের জীবন থেকে রক্ষার জন্য আত্মহননের মতো চরম পথ বেছে নিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু এতে রাজরোষ গিয়ে পড়ল গোটা পরিবারের ওপর। হতভাগীর পরিবারের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হতো। এই ছিল সেই কালিগুলার কালিমাখা শাসন।
ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকার লোভে যুদ্ধযাত্রা করেন তিনি। তবে ততদিনে রোমান বাহিনী দুর্বল হয়ে গেছে। হত্যা করা হয়েছে রোমের অনেক সেনাপতিকে। কালিগুলার সেই রোমান বাহিনী দিয়ে আর যা-ই হোক, যুদ্ধ হবে না। এবারে ভিন্ন পথ ধরলেন কালিগুলা। নিজ বাহিনীর সেনাদের সাগরসৈকত থেকে নুড়িপাথর,ঝিনুক সংগ্রহের নির্দেশ দেন। আর এসব বোঝাই থলি ও বাক্সপেটরা নিয়ে ফিরলেন দেশে। জনগণ ভাবল, সম্রাট কালিগুলো ফিরেছেন সোনা-রুপার বোঝা নিয়ে। তবে তারপরও কালিগুলার উন্মাদ ও খুনে আচরণের বদল হলো না।
কালিগুলার রক্তঝরানো আচরণ ও ব্যভিচারী উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে জনগণ। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে অভিজাতদেরই একাংশ। কালিগুলার রাজত্বে আর যা-ই থাক, বাক্স্বাধীনতার বালাই ছিল না। ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশের কোনো সুযোগ সাধারণ মানুষের ছিলনা।
রোমান সভ্যতায় মৃত সম্রাটদের মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হতো। কিন্তু কালিগুলা চাইতেন বেঁচে থাকতেই লোকে তাকে পূজা করুক। নিজেকে তিনি একসময় দেবতা হিসেবেও ঘোষণা করেন। এ উপলক্ষে উপাসনালয় নির্মাণ করেন। উপাসনালয়ে নিজের মূর্তি স্থাপন করার নির্দেশ দেন। রোমান দেবতাদের পোশাক পরে কালিগুলা জনগণের সামনে আসতেন। রোমান উপাসনালয়ে পূজার জন্য নিজের মূর্তি বসানোর নির্দেশও জারি করা হয়।
তারপর? হত্যার মাধ্যমেই কালিগুলাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন সেনা কর্মকর্তা ক্যাসিয়াস কায়েরিয়া। প্রকাশ্য দিবালোকে ভাষণ দেওয়ার সময় তাকে হত্যা করা হয়। তার দেহে প্রথম আঘাত করেন ক্যাসিয়াস কায়েরিয়া। মুক্তিপাগল ঘাতকদের হাত থেকে কালিগুলার স্ত্রী ও কন্যাও রেহাই পাননি।
কালিগুলার অভিষেক অনুষ্ঠানে জনতা ধ্বনি তুলেছিল 'আমাদের সন্তান', আমাদের তারকা। তার নির্মম মৃত্যুতে সে জনতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তার সে অভিষেক অনুষ্ঠানের কথা সেদিন কেউ আর স্মরণ করেননি।
ব্রেন্ড রালফ লুইসের পুস্তক 'ডার্ক হিস্ট্রি অব দ্য কিংস অ্যান্ড কুইনস অব ইউরোপ'-এ লিখেছেন, ইতিহাসে অনেক অন্ধকার অধ্যায় থাকতে পারে। ইউরোপ মহাদেশের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর এলিজাবেথ বাথরি এবং গিলস ডি রইসের কথা বলা যায়। তারা দুজনেই গণহত্যা চালিয়েছেন। ডি রইস তার দুর্গে যে অপরাধ তৎপরতা চালিয়েছেন, তাই ফরাসি লোককাহিনির গল্প হয়ে উঠেছে। ফরাসি লোককাহিনীর বর্বর ব্লুবিয়ার্ড চরিত্রটি তৈরি হয়েছে গিলস ডি রইসের আদলে। তিনি নিজের সাত স্ত্রীকে খুন করে তাদের লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন আলমারিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড দেশটির উপনিবেশ কঙ্গো ফ্রি স্টেটের জনসংখ্যা ৭০ শতাংশ নিকেশ করেছিলেন। আর এমন কাজটি করা হয় ভয়াবহ শাস্তি বিধান এবং নৃশংস শোষণ করার মাধ্যমে।
নিজ পুস্তক সম্পর্কে ব্রেন্ডা লুইস লিখেছেন, এ বই মোটেও দুর্বল চিত্তের পাঠকের জন্য নয়। এটা লিখতে যথেষ্ট সাহস দেখাতে হয়েছে। পড়ার জন্যও একই রকম সাহসের দরকার পড়বে। তিনি লিখেছেন, এ বইতে ইউরোপের রাজাদের বর্বরতার কাহিনিকেই প্রধান উপজীব্য করা হয়নি। বরং রাজকীয় জীবনের পাগলামির কথাও তুলে ধরা হয়েছে। রাজপরিবারের রক্ত বিশুদ্ধ রাখার প্রবণতা থেকেই রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের মাত্রাতিরিক্ত চল রাজপরিবারে পাগলামি ডেকে এনেছে। রক্ত সম্পর্কের মধ্যে বিয়েশাদি কখনো কখনো প্রায় অজাচারের পর্যায়ে চলে গেছে। এ ধরনের বিয়ের ফলে রাজপরিবারে দানব জন্মেছে এবং পরিবার কখনোই তাদের নিয়ে কথা বলার সৎসাহস দেখাতে পারেনি।
স্প্যানিশ হ্যাপসবার্গ এবং বাভারিয়ার উইটেলসবাকসের উন্মাদনা ছিল ভয়াবহ। তারা জীবনভর এতে ভুগেছেন। তারা আজীবন যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। অসুস্থ ভয় তাদের তাড়া করে ফিরেছে। হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছেন। হিংস্রতা তাদের খুনির কাতারে নিয়ে গেছে। নির্মম পরিহাস হলো, কেউ কেউ ঠিকই ঠাহর করতে পারতেন যে তাদের মানসিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। তারপরও তারা পাগলামিতে মত্ত হয়ে উঠতেন।
২. 'আ ডার্ক হিস্ট্রি: দ্য পোপস, ভাইস মার্ডার অ্যান্ড করাপশন ইন ভ্যাটিকান' পুস্তকে ব্রেন্ডা রালফ লুইস সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন হিসেবে পরিচিত পোপতন্ত্রের কালো অধ্যায় তুলে ধরেন। পৃথিবীতে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চলছে পোপতন্ত্র। এ রকম প্রাচীন আর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেখানেও পাগলামি, গণহত্যা, পতিতালয় পরিচালনা, মদ্যপানসহ পোপদের নানা কীর্তিকলাপ রয়েছে। আর সবই উঠে এসেছে ব্রেন্ডার বইতে।
পোপ ফরমোসু(৮৯১-৮৯৬) গলিত মরদেহ তুলে বিচার করে তার উত্তরাধিকার। গলিত মরদেহ পরপর দুবার তাইবার নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়। পোপ দ্বাদশ জন(৯৫৫ -৯৬৪) কেবল পতিতালয় পরিচালনা করেই ক্ষান্ত হননি। একজন কার্ডিনালকে কানা করে দেন। আরেকজনকে করে দেন খোজা। মাতাল অবস্থায় তিনি শয়তানের প্রতি পানীয় উৎসর্গও করেন। ২০ বছরের রাজত্বকালে ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন তৃতীয় ইননোসেন্ট(১১৯৮-১২১৬)। অন্যদিকে পোপ ষষ্ট আলেকজান্ডারের(১৪৯২- ১৫০৩) তিন বা চার রক্ষিতার ঘরে আট সন্তান হয়েছিল। ঘুষের জোরে পোপ হয়েছিলেন তিনি। নিজের আত্মীয়স্বজনের বড় বড় পদে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া হাতিয়ে নেন বিপুল বিত্ত-সম্পদ। বইটির সূচনায় লেখক বলেন, অনেক পোপই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন, হত্যাকাণ্ড করেছেন, ঘুষ দিয়েছেন, তস্করবৃত্তিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন। দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যভিচার করেছেন। কেউ কেউ এমন নৃশংসতা দেখিয়েছেন যে তাদের সমসাময়িকেরাও হতবাক হয়ে গিয়েছেন।
পাগলামির সেসব গল্প বা সরস কাহিনি কিংবা রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের পুরোটা পরিবেশন করতে গেলে আরেক কেতাব লিখতে হবে।
৩. কিন শি হুয়াং (শাসনকাল: ২৪৭-২১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
চীনের প্রাচীর নাম নিতে গেলে যার নাম নিতে হবে,তিনি সম্রাট কিন শি হুয়াং। ২২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ তিনি একীভূত চীনের প্রথম সম্রাট হন এবং কিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী পণ্ডিতদের হত্যা করেছেন। তার সমালোচনামূলক সব বই পোড়ানোর আদেশ দিয়েছেন তিনি। চীনের প্রাচীরের প্রথম পরিকল্পনাকারী হিসেবে রাজ্যের প্রতিটি সক্ষম পুরুষকে প্রাচীর নির্মাণে পাঠান। অজস্র প্রাণের বিনিময়ে প্রাচীর নির্মিত হলো। নির্মাণশ্রমিকদের অনেকেই মাত্রাহীন পরিশ্রম এবং অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং বিশ্রামের অভাবে প্রাণ হারান। তার কল্যাণকামী অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে জড়িত হয়ে রয়েছে বেপরোয়া রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। শেষ জীবনে অমরত্ব লাভের বড় সাধ ছিল সম্রাটের। সে জন্য সন্ধান করে বেরিয়েছেন অবিনশ্বর জীবনলাভের নানা অলৌকিক ওষুধ। কথিত আছে, অমরত্ব লাভের আশায় পারদের তৈরি ভুল ওষুধ খেয়ে ৫০ বছর বয়সে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। জীবিত থাকাকালীননিজের সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন তিনি।জমকালো সমাধিসৌধের মেঝেতে পারদের জলাশয়, ছাদে হিরে আর রুপোর নক্ষত্র আর ছয় হাজারেরও বেশি টেরাকোটা সৈন্যের মূর্তি রয়েছে। এর নির্মাণশৈলী গোপন রাখতে শ্রমিকদের হত্যা করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।
৪. শুরুতেই বলেছি তুঘলকের কথা। তার শাসনামলের বর্ণনা দিয়েই শেষ হবে রচনা। পাগলামি বলতে যা বোঝায় তার সাথে তুঘলক রাজবংশের শাসক সুলতান মুহম্মদ আদিল বিন তুঘলক শাহের নাম জড়িত। সাধারণভাবে তিনি মুহম্মদ বিন তুঘলক নামে পরিচিত। দিল্লির এই সুলতান শাসন করেছেন চতুর্দশ শতাব্দীতে।
বৈপরীত্যে ভরপুর তার জীবন। বলা হয়, একাধারে তিনি ছিলেন মহানুভব এবং নিষ্ঠুর, বিদ্বান এবং বোকা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ভীষণরকম ব্যর্থ। ইতিহাস তাকে 'পাগলা রাজা'র 'সুখ্যাতি' দিয়েছে। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পাগলামিতে ভরপুর কাণ্ডকারখানাকে 'তুঘলকি কাণ্ড' হিসেবে ইতিহাসে পরিবেশিত হয়েছে। একদিন গরিব চাষির ছেলেকে আঘাত করার শাস্তি হিসেবে কাজির বিচারে ক্ষতিগ্রস্তের হাতে চাবুকের আঘাত মাথা পেতে নিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সামান্যতম বিদ্রোহের আভাস পাওয়ামাত্রই সন্দেহভাজনকে হত্যা করে দুর্গদ্বারে ঝুলিয়ে রাখতে দ্বিধা করেননি। কিংবা ছুড়ে দিতেন হাতির পালের সামনে।
অথচ তার ছিল গভীর জ্ঞান ও অগাধ পাণ্ডিত্য। যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত, ধনুর্বিদ্যা এমনকি চিকিৎসাবিদ্যার মতো বিষয়েও জ্ঞান অসামান্য পর্যায়ে ছিলো তার।
রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে দৌলতাবাদ বা দেবগিরিতে স্থাপন করার কাজকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় খেয়ালিপনা বলা হয়। দিল্লিকে প্রায় জনমানবহীন করে ফেলেন। প্রায় ঘাড় ধরে প্রজাদের নিয়ে যাওয়া হয় দৌলতাবাদে। আরোপ করা হয় অপরিমিত কর। ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে জানতে পারি, দিল্লি নগরী মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল।
৫. ইতিহাস একজন ব্যর্থ শিক্ষক। তার কাছ থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। রাজরাজরাদের দিন শেষ। কিন্তু পাগলামিতে ভরপুর মত্ত শাসকের দিন কখনোই শেষ হওয়ার নয়। তাদের কাহিনিও অশেষ। তবে ক্ষমতায় থাকার সময় হয়তো সে গল্প বা কাহিনি অনেক সময়ই প্রকাশ করা যায় না। অপেক্ষা করতে হয়। আর এ কথা সবাই জানেন, সময়ের ব্যাপারে ইতিহাস মোটেও কৃপণ নয়।