হে চশমাখানি ফিরে এসো আমার নয়নে
আমার চশমাজীবন ষাট বছরের হবার কথা ছিল। কিন্তু নিজের তৈরি করা ফাঁদে সাতটি বছর চাপা পড়েছে, আমার প্রকৃত চশমা বয়স ৫৩ বছরের। দূরের জিনিস কম দেখছি বুঝতে পারছি, কিন্তু বলছি না কারণ তাতে আমার একটি আংশিক প্রতিবন্ধী দশা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ব্যাপারটা যাতে ধরা না পড়ে, সে জন্য স্কুলে আগে আসতাম, বসতাম ফার্স্ট বেঞ্চে, যেনো ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডের কোনো লেখা আমার দৃষ্টি ফসকে না যায়। তিনটি স্কুলে পড়েছি: ক্লাস ওয়ানের মধ্যভাগ থেকে ক্লাস ফাইভ রাজাবাজার রোটারি প্রাইমারি স্কুল; ক্লাস সিক্স ও ক্লাস সেভেন অর্ধেক ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ (এখন নাম বিজ্ঞান কলেজ, তখন আমাদের শিক্ষকদের একজন ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, পরে তিনি ঢাকা কলেজে আবারও আমার শিক্ষক) এবং মধ্য সেভেন থেকে শুরু করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত গর্ভনমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখার কথা বলেছিলাম; তখন জবাব পেয়েছিলাম, চশমা পরে 'ফুটানি' করতে হবে না। প্রথম দুটি স্কুলে মূলত বাসা থেকে নৈকট্যের কারণে প্রথম সারির বেঞ্চে বসা নিশ্চিত করতে পারতাম। কিন্তু ল্যাবরেটরি স্কুলে যোগ দেবার পর দূরত্ব বেড়ে যায় এবং প্রায়ই আমাকে শেষের দিকে বসতে হয়। পাশের বন্ধুটির সাথে চুক্তি হয়: বোর্ডের প্রশ্নটা আমি তোর খাতা দেখে টুকে নেব। তুই চাইলে আমার খাতা দেখে উত্তর লিখবি। আমাদের এই দেখাদেখির একপর্যায়ে শিক্ষক পশুপতি দে আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে বললেন, খাতা দেখে লিখছিস কেন? অপমানিতও বোধ করলাম।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে আম্মাকে বললাম, আমি বোর্ডের লেখা দেখতে পাই না, দূরের জিনিস ভালো দেখি না। আম্মা জানালেন আব্বাকে। আমাদের পারিবারিক আমলাতন্ত্রটা এমনই ছিল, আম্মার মাধ্যমে আব্বার কাছে পৌঁছতে হতো। পরে সুবিধামতো সময়ে আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন সেকালের চোখের বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওয়াদুদের কাছে। চশমা যাদের নিতে হবে এমন দুজন করে রোগী ভেতরে ঢুকাতেন, একজন দূরে দেয়ালে ওপরের দিকে টাঙানো হরফগুলো পড়তেন প্রথমে খালি চোখে, তারপর চশমা দিয়ে। দেয়ালে টাঙানো তিনটি হরফ বোর্ড: ইংরেজি, বাংলা এবং ডানে-বাঁয়ে কিছু চিহ্নযুক্ত আর একটা ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে হরফ ছোট হয়ে আসছে। যখন আমার পালা এল, আমি নির্দ্বিধায় পড়ে ফেললাম:
E
F P
T O Z
L P E D
P E C F D
সম্ভবত আর একটা লাইন। ডাক্তার ওয়াদুদ আব্বাকে বললেন, চোখ ঠিকই আছে। ছেলেকে গুঁড়া মাছ আর শাকসবজি খাওয়াবেন। আব্বা বললেন, কিন্তু সে তো কেঁদে কেঁদে তার মাকে বলেছে, ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা দেখতে পায় না, স্কুলে বকা খায়।
ডাক্তার সাহেব পরক্ষণেই আমাকে আবার বসিয়ে বললেন, এবার বাংলা বোর্ডের হরফগুলো পড়ো। আমি কোনোভাবে চোখ কচলে কেবল একটা হরফ পড়তে পারলাম। তিনি বললেন, ইংরেজির ৫ লাইন পড়তে পারলে বাংলার ৫ লাইন অবশ্যই পড়তে পারবে।
কিন্তু আমি কোনোভাবেই দুই লাইনের বেশি পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত তিনিই ধরে ফেললেন এবং আব্বাকে বললেন, আপনার পণ্ডিত ছেলে যখন মাঝামাঝি জায়গায় বসেছিল ইংরেজি বোর্ডটা মুখস্ত করে ফেলেছে, বাংলাটার ওপর নজর দেয়নি।
মাইনাস ২.২৫ পাওয়ারের চশমা নিতে হবে এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে আব্বার সাথে সোজা নিউমার্কেট। অপটিক্যাল কর্নার নামের দোকান থেকে আব্বার পছন্দ অনুযায়ী কিছুটা গোলাকার চশমা নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক পর বাড়ি ফিরলাম। ডাক্তার ওয়াদুদ বলেই দিয়েছিলেন প্রথম দিকে সমতল জায়গাও উঁচু-নিচু মনে হতে পারে, পদক্ষেপ দেবার সময় ভয় লাগতে পারে, তিন দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দ্বিতীয় দিনেই আমার চোখে চশমা অ্যাডজাস্ট করে গেল। সত্যিই ভালো দেখতে পাচ্ছি কি না, তা পরীক্ষার করার জন্য পরদিনই আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে সবচেয়ে সস্তা ছয় আনার টিকেটে বলাকার স্পেশাল শো দেখলাম। আমি রীতিমতো মুগ্ধ, সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সিনেমাটি সম্ভবত 'ওয়ান মিলিয়ন ইয়ার্স বিসি', নায়িকা রেকুয়েল ওয়েলচ। মনে হলো এত দিন আমি প্রায় অন্ধই ছিলাম—এ কী দৃষ্টি উন্মোচন!
ক্লাস টেন নাগাদ পাওয়ার দাঁড়াল মাইনাস ফাইভ। আরও বছর পাঁচেক পর মাইনাস ৭.৫০তে স্থির হলো। এখনো তাই চলছে। স্কুলজীবন চশমা পরলে যেসব খেতাব প্রাপ্য হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপটা দেড় ব্যাটারি। ক্লাসে আমি একাই চশমাধারী হলে খেতাব এড়ানো যেত না, চশমা ধারণের প্রশ্নে আমার সিনিয়র আরও কজন ক্লাসমেন্ট থাকায় বড় বাঁচা বেঁচে যাই। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য আমাকে বলতেই হচ্ছে, ঠিক একই কারণে মানিক বন্দোপাধ্যায়কেও চশমা নিতে হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, 'স্কুলে বোর্ডের লেখা দেখতে না পাওয়ার এক মাসের মধ্যে আমাকে চশমা নিতে হয়। চশমা চোখ নয়, কিন্তু বন্ধুরা আমাকে চারচোখা বলে কত যে তামাশা করেছে, তার ঠিক নেই!'
চশমার সাথে আমার জীবনটা এতই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে যে এটা শরীরেরই একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হয়ে উঠেছে। হাত-পা ইত্যাদির নবায়ন সম্ভব না হলেও চশমার নবায়ন করা যায়। চশমাবিহীন আমার বন্ধু ও স্বজনদের দেখলে আমার মনে হয় তারা সম্ভবত প্রতিবন্ধী।
আমি বহু বছর আগে চক্ষুদান ক্যাম্পেইন চলাকালে চক্ষুদান করব এমন ফর্মে পাকা সই দিয়ে ফেরার পর আমার পরিবারের সদস্যরা বলল, ফর্মে লিখে এসো চশমাসহ চক্ষুদান নতুবা তোমার চক্ষুধারী বিপদে পড়বেন। সেটা আর লেখা হয়নি।
চশমা নেবার প্রথম বছরেই যথারীতি স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা দেবার পর আমার আব্বা ও আম্মার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের দুটি গ্রামে দাদা ও নানার বাড়িতে যাই। আমার আত্মীয়দের মধ্যে এত কম বয়সী চশমাধারী কেউ না থাকায় আমাকে হরেক রকম কথা শুনতে হলো:
ক. কিসের চোখ খারাপ, অল্প বয়সেই 'ফ্যাসাং' শুরু করেছে।
খ. পাপে ধরেছে, মাইয়া মাইনসের দিকে চোখ গেলে এমনই হয়।
গ. আয়নায় নিজেকে দেখেছ, লাগে তো শিয়াল পণ্ডিতের মতো।
কেউ কেউ চশমাটা নিয়ে নিজের চোখে লাগিয়ে পরীক্ষা করলেন—চশমার লাভটা কী? যেহেতু তাদের চোখ ভালো, কেউ দেখলেন ঝাপসা, কেউ দেখলেন উঁচু-নিচু, কেউ তওবা অস্তাগফিরুল্লাহ বলে চোখ কচলাতে শুরু করলেন।
কপালে চশমা উঠিয়ে চশমা খুঁজে না পাবার যে ঐতিহ্যবাহী রোগ, বয়সের টানে আমিও এখন চশমা খুঁজি। তখন স্কুলজীবনে পড়া সুকুমার রায়ের ছড়াটা মনে পড়ে যায়:
ঠাকুরদাদার চশমা কোথা?
ওরে গণ্শা, হাবুল, ভোঁতা,
দেখ্না হেথা, দেখ্না হোথা—খোঁজ না নিচে গিয়ে।
কই কই কই? কোথায় গেল?
টেবিল টানো, ডেস্কো ঠেল,
ঘরদোর সব উলটে ফেল—খোঁচাও লাঠি দিয়ে।
খুঁজছে মিছে কুঁজোর পিছে,
জুতোর ফাঁকে, খাটের নিচে,
কেউ বা জোরে পর্দা খিঁচে—বিছানা দেখে ঝেড়ে—
ঠাকুরদাদার চশমা কোথা?
পইপই করে সব জায়গায় খোঁজ হচ্ছে—টেবিলে, ডেস্কে, কুঁজোর পেছনে, জুতোর ফাঁকে, খাটের নিচে—সবাই ঘেমে একসার। ঠাকুরদাদার তো একই কথা। 'চশমাটার কি/ঠ্যাং গজালো নাকি?
যেমন বলা দারূণ রোষে,
কপাল থেকে অম্নি খ'সে
চশমা পড়ে তক্তপোশে—সবাই ওঠে হেসে!
আমি ঠাকুরদাদার ব্যামোতে আক্রান্ত—অন্তত চশমার বেলায়, কপালে তুলে বটেই, অনেক সময় চোখে রেখেও হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি—'আমার চশমা কোথায়?' ঠাকুরদাদা যদি সুকুমার রায়ের বাবার বাবা হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কালীনাথ রায়, তিনি ফার্সি ভাষার পণ্ডিত, ফার্সি দলিলের পাঠোদ্ধার ও অনুবাদ করে বেশ পয়সাকড়ি কামিয়েছিলেন। তারই পুত্র কামদারঞ্জন রায় জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরীর পালক পুত্র হিসেবে নাম বদলের পর হয়ে যান উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। কেমন ছিল কালীনাথের চশমা? আমার প্রথম চশমা আব্বার পছন্দের, অনেকটাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চশমার মতো দেখতে।
মফিজ চৌধুরীর চশমা
ডক্টর মফিজ চৌধুরীর সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, সবুজাভ মলাটের কোরিয়ার কবিতা অনুবাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী এক কপি হাতে দিয়ে বললেন, যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে মফিজ চৌধুরী আর জাহাঙ্গীর চৌধুরী একই ব্যক্তি, যদি না লাগে, তাহলে কী আর করা, পুরোনো খবরের কাগজের সাথে বেচে দিয়ো।
আমি বললাম, আপনি কোরিয়ান ভাষা জানেন? তিনি বললেন তলস্তয়ের বড় বড় বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে ফ্রেঞ্চে—অনূদিত তলস্তয় থেকে। কোরিয়ান জানলে ভালো, না জানলেও সমস্যা নেই।
কয়েক বছর পর আর একটি বই দিলেন ভাইসেন্তি আলেকজান্দারের কবিতা। তারপর তারই অনূদিত হ্যামলেটের পাণ্ডুলিপি ঘাঁটাঘাঁটি করতে দিলেন।
আমি বেশ কয়েক মাস যোগাযোগ না করায় ১৯৮৯-এর একদিন বাসার ঠিকানা মিলিয়ে তিনি হাজির হলেন এবং তার মিষ্টি, খানিকটা অনুনাসিক ভাষায় আমাকে বকাঝকাও করলেন। যাবার সময় তিনি আর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না। চশমা যে ছিল, চোখে নয়, হাতে, আমিও দেখেছি। খোঁজাখুঁিজ করে পাওয়া গেল না। সম্ভবত আমাকে বিব্রতাবস্থা থেকে বাঁচাতে তিনি বললেন, মনে পড়েছে, চশমা আনিইনি, টেবিলে রেখে এসেছি।
দুনিয়াশুদ্ধ সকলেই তাকে সম্বোধন করেন, স্যার। করবেনই তো—স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী। আমি বলি ভাই, আমার ধৃষ্ঠতায় আমার আব্বাও অবাক; আব্বার চেয়ে ছয়-সাত বছরের বড় এই মানুষটিকে আমি কেমন অবলীলায় বলছি, মফিজ ভাই!
তার বাড়ি ১ নম্বর ইন্দিরা রোড, আমার আব্বারটা ৮৯ পূর্ব রাজাবাজার—এখন শমরিতা হাসপাতালের অংশ। বড়জোর পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ।
সকালে ঘুম ভাঙতেই শুরু হলো আমার চশমা উদ্ধার অপারেশন। আমাদের সোফাটা পুরোনো কেনা, খানিকটা ইঁদুর খাওয়া, যে সোফাটাতে মফিজ চৌধুরী বসেছিলেন, সেটি উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করলাম, পলিথিন ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে সোফার এই ফাঁকা, ওই ফাঁক এবং ইঁদুর খাওয়া গর্ত দিয়ে হাত চালালাম— কলম, সুতার রিল এবং এমনকি কয়েক বছরের পুরোনো মুরগির ঠ্যাংয়ের হাড়ও বেরিয়ে এল, চশমার দেখা নেই। অগত্যা উল্টো করে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ছুরিকাঁচি নিয়ে সোফা সার্জারি করি। নিচের আস্তরণ কিছুটা খুলতেই চোখে পড়ে স্প্রিং আর নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে আটকে আছে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অনুবাদক মফিজ চৌধুরীর চশমা। অপারেশন সাকসেসফুল। আমি চশমা নিয়ে ছুটলাম তার বাসায়। একাই থাকতেন পরিবারবিচ্ছিন্ন অবস্থায়। চশমা হাতে নিলেন, চোখে দিলেন এবং বললেন, চশমাটা দেখতে আমারটার মতো হলেও এটা অন্য কারও। তোমার বাবার চশমাখেকো সোফা তাহলে আরও কারও কারও চশমা খেয়েছে।
কিন্তু এই সোফায় বসে চশমা হারিয়েছেন—মফিজ চৌধুরী ছাড়া আর কারও কথাই মনে এল না। চশমা হারানোর অভিযোগও কেউ করেননি। তাহলে এই গায়েবি চশমা এল কোত্থেকে?
আবার ফিরে এসে সোফা উল্টাই। এবার খোঁচাখুঁচি একটু বেশিই করতে হয়। বেরিয়ে আসে একটা আধুলি, একটা কলম, একটা চাবির গোছা—জং ধরা তিনটি চাবি এবং শেষ পর্যন্ত আরও একটি চশমা।
আমি আবার ছুটি, আমি নিশ্চিত এটাই মফিজ চৌধুরীর চশমা।
আমি তাকে সোফাবৃত্তান্ত বলি—গুলশান ১ নম্বরের বিদেশিদের ব্যবহার করা আসবাবপত্রের দোকান থেকে ১৯৮০ সালে পুরোনো সোফা কিনে আমার বইপত্রের ঘরটিতেই স্থাপন করি।
তিনি বললেন, তাহলে এই সোফাটা যাদের বাড়িতে প্রথম ছিল, তাদের কারও সর্বনাশ করে চশমাটা গর্ভে ধারণ করে তোমাদের বাড়িতে এসেছে। তারপর আমারটা! যত তাড়াতাড়ি পারো বেঁচে দাও, নতুবা আরও যে কার চশমা খাবে!
কিন্তু এতটাই পুরোনো হয়ে গেছে যে এর রিসেল ভ্যালু হবে সামান্যই।
কাজী মোতাহার হোসেনের চশমা
কাজী মোতাহার হোসেনের পাশে বসার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার প্রজন্মের দু-চারজনের বেশি মানুষের হবার কথা নয়। আমার হয়েছে কোনো সভামঞ্চে নয়, কোনো পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠানে নয়; হয়েছে পুরান ঢাকার একটি বিয়ের প্যান্ডেলের একেবারে পেছনের সারির চেয়ারে। বিয়েটা আমার বন্ধু তপন আর ভূগোল বিভাগের ছাত্রী ডেইজির। কাজী সাহেব পাত্রীপক্ষ। আমি উভয় পক্ষ। ডেইজিও আমার সাথে ঘনিষ্ঠ। আমি আগেই পৌঁছাই, কিন্তু প্যান্ডেলের শেষ প্রান্তে এসে দেখি, আমারও আগে আসা একজন চশমা পরা স্মার্ট বুড়ো একটা বই পড়ছেন। আমি যে তার পাঠের ব্যাঘাত ঘটাতে যাচ্ছি, সে কাণ্ডজ্ঞান আমার তখন ছিল না বরং আমি যে তাকে চিনতে পেরেছি, এই বাহাদুরিটা ফলাবার প্রচেষ্টা আমার ছিল। আমি এগিয়ে এসে সালাম দিই এবং তিনি বলেই ফেললেন, এত পেছনে এসে বসলাম, তবুও তোমাদের অত্যাচার থামল না।
আমি সরি বলতেই তিনি বললেন, এখন চুপ করে আমার পাশে বসে থাকো। আমি তাই করলাম, কিন্তু তিনি চুপ করলেন না। আমি তাকে কেমন করে চিনি জিজ্ঞেস করলে কোনো রকম পণ্ডিতি না ফলিয়ে বললাম, আমাদের পাড়ার মিলি আপার নানা হিসেবে আপনাকে চিনি।
তিনি বললেন, অঅঅ...আমি তাহলে মিলির নানা, আমার নিজের কোনো পরিচয় নেই।
শুনেছি তিনি কানে কম শুনতেন, তবুও কেমন করে যে আমার সব কথা শুনলেন! তিনি আবার পড়তে শুরু করলেন। আমি উঠে আসার জন্য উসখুস করছি।
তিনি বললেন, আমার চশমা কোথায়? তুমি আমার চশমা নিয়েছ? আমি থ। ফোল্ডিং চেয়ারে নিচে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাথা উঁচিয়ে বললাম, চশমা তো আপনার চোখে।
আমি দ্রুত সরে এলাম, কাজী মোতাহার হোসেন যদি আমাকে চশমা চুরির দায়ে সোপর্দ করেন, রেহাই নেই। খানিকটা এগিয়েই পেয়ে গেলাম রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইকে। বললাম, প্যান্ডেলের শেষে ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন আছেন।
বাংলা সাহিত্যে চশমা
ধাঁধাকে যদি লঘু সাহিত্য বিবেচনা করা যায়, তাহলে আমার চশমাহীন প্রাইমারি স্কুলজীবনে যে ধাঁধার জবাব দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিলাম, তবুও উত্তর দিতে পারিনি, সেই ধোঁয়াশা প্রশ্নটি ছিল: 'বল, কোন সে শয়তান/নাকে বসে ধরে দুই কান?'
যখন জবাবে বলা হলো—চশমা নাকে বসা কানে ধরা মেলাতে পারলেও শয়তান কেন—মেলাতে তখন পারিনি, এখনো মেলে না। প্রথমটাকে ছন্দোবদ্ধ করতেই শয়তানকে আহ্বান করা হয়েছে। অবশ্য অর্থোডক্স চিন্তায় এটাই বলা হতে পারে, চশমা ঈশ^রবিরোধিতার নামান্তর। ঈশ^র যার দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দিয়েছিল, ঘষা কাচ চোখে লাগিয়ে ঘাটতিটুকু পূরণ করা শয়তানি ছাড়া আর কি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক লেখায় চশমার উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে লেখার চশমা পরিহিত পণ্ডিতজন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে, তার নাম জুতা আবিষ্কার। রাজা হবুচন্দ্র সারা রাত ভেবে ভেবে হয়রান—ধরণিতে পা রাখামাত্র 'মলিন ধুলা লাগিবে কোন পায়'। গবুচন্দ্র রাজ্যের সব পণ্ডিত একত্র করলেন—মস্ত চামড়ায় ঢেকে দেবার পরামর্শও এল কিন্তু তা তো সমাধান নয়, তাতে মানবজাতি রাজা-উজিরের পায়ের ধুলা থেকে বঞ্চিত হবে—
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।
অনেক ভেবে কহিল, 'গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?'
কহিল রাজা, 'তাই যদি না হবে,
পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?'
রবীন্দ্রনাথের সূর্যচশমা
রবীন্দ্রনাথের 'স্পাই' সতীশের কথা মনে পড়ে? চশমাহীন গোয়েন্দা তো ভাবাই যায় না:
দেয়াল ঘেঁষে ওই যে সবার পাছে
সতীশ বসে আছে।
থাকে সে এই পাড়ায়,
চুলগুলো তার ঊর্ধ্বে তোলা পাঁচ আঙুলের নাড়ায়।
চোখে চশমা আঁটা,
এক কোণে তার ফেটে গেছে বাঁয়ের পরকলাটা।
গলার বোতাম খোলা
প্রশান্ত তার চাউনি ভাবে-ভোলা।
সর্বদা তার হাতে থাকে বাঁধানো এক খাতা,
হঠাৎ খুলে পাতা
লুকিয়ে লুকিয়ে কী-যে লেখে, হয়তো বা সে কবি,
কিম্বা আঁকে ছবি।
আল মাহমুদের স্মরণীয় কবিতা: একটি চশমা উড়িতেছে, শুধু।
একটি চশমা শুধু উড়িতেছে
ডানা আমি গুটিয়েছি। উড়িতেছে চশমা আমার
কানা চোখে থাকে না সে উড়ে যায় আকাশ ভেদিয়া
মানচিত্র ছেড়ে গিয়ে খোঁজে তার বিচিত্র আহার
পরদেশী জোড়াকাচে কে দিয়েছে অসম্ভব বিয়া?
কানাচোখে থাকবে না উড়ে যাবে অনন্তের কাছে
মেখের উপর বসে ডিম দিবে, ওম দিবে ডিমে
যাতে ফের বৃষ্টি হয় সৃষ্টি হয় পৃথিবীর গাছে
পুষ্পের সমারোহ; ফলভার অনন্ত অসীমে
ফেটে গিয়ে খুলে দিবে তার সব রহস্যের দ্বার
একটি চশমা শুধু ঘুরিতেছে দেখিতেছে সব
কে কোথায় অন্তর্বাস খুলে বলে ওঠে, আমার আমার
এইসব অন্ধকার এইসব আলোর উৎসব।
নয়নবিহীন হে চশমাখানি ফিরে এসো আমার নয়নে
অশ্রুসিক্ত হয়ে তুমি বসে থাকো অন্ধকার কবির শয়নে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'গৃহদাহ' উপন্যাসে কেদারবাবুকে দেখা যাবে তার চশমা মোছার কাজে ব্যস্ত, আর নিষ্কৃতির বড়কর্তা 'চোখে চশমা আটিয়া গ্যাসের আলোকে নিবিষ্ট চিত্তে জরুরী মকদ্দমার দলিলপত্র দেখিতে ছিলেন।'
শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন 'সবুজ চশমা' আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন 'বটুকবুড়োর চশমা' আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'বিপিন বাবুর চশমা'। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'ভুতুড়ে চশমা'র মুরারি বাবু কেবল দুই দাঁত ওঠা নাতিকে কোলে নিতে, পাজি খোকা একটানে চশমা ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে মারে।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'জন্ম ও মৃত্যু'তে চশমার ভেতর দিয়ে লেখকের দিকে কে তাকায়? জন্ম না মৃত্যু? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখলেন, 'চশমার আড়ালে'।
বনফুলের অমলার বিয়ের প্রস্তাবটা দরে বনল না বল ভেস্তে গেল। দ্বিতীয় প্রস্তাবে পাত্র নিজেই অমলাকে দেখতে এল। 'নাম হেমচন্দ্র। এবারও অমলা লুকিয়ে আড়াল থেকে দেখলে, বেশ শান্ত সুন্দর চেহারা। ধপ ধপে রঙ, কোকড়া চুল, সোনার চশমা, দিব্যি দেখতে। আবার অমলার মন ধীরে ধীরে এই নবীন আগন্তকের দিকে এগিয়ে গেল। ভাবলে, কত কি ভাবলে। এবার দরে বনল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ হলো না।'
বুদ্ধদেব বসুর ঢাকার স্মৃতি: 'চোখে সোনার চশমা গিলে করা চুড়িদার পাঞ্জাবিতে সুপ্রসাধিত সেই যান-বিরল পথেও অতি সতর্ক সাইকেল চালিয়ে আস্তে আমাকে ছাড়িয়ে যান ডক্টর সেন, সংস্কৃত বাংলার অধ্যাপক সুশীল কুমার।'
চশমা কি শুধু পুরুষের? নারীর নয়? গুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখতেই পারেন:
নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!
হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও।
কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা
চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে
কাছাকাছি আনো
নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!
এর বাইরেও সাহিত্যে নানা চরিত্রের চোখে চশমা উঠেছে, চশমা পরিধেয় বস্রের মতোই, এর বর্ণনা সেকালের-একালের লেখকদের লেখাতেও আসতে বাধ্য।