বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে জিদানের সেই (কু)খ্যাত ঢুসের নেপথ্য কাহিনি
যদি প্রশ্ন করা হয় যে ২০০৬-এর বিশ্বকাপে কোন দৃশ্যটি সবচেয়ে স্মরণীয়, তাহলে অনেকেই উত্তরে ফাইনাল ম্যাচে জিদানের সেই ঢুসের কথাই বলবেন। তুমুল আলোচিত সেই দৃশ্যটি এখনো আমাদের মনোজগৎ থেকে হারিয়ে যায়নি।
ইতালীয় ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে জিনেদিন জিদান চমকে দিয়েছিলেন পুরো বিশ্বকে। হঠাৎ এ কাজটি করে লাল কার্ডও দেখতে হয়েছিল তাকে। ফ্রান্স-ইতালির ফাইনালে ফ্রান্স সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাটির প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, বিশেষ করে মাতেরাজ্জির জন্য।
পরিবার থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য দূরে ছিলেন। তাদের জন্য কিছু একটা করার অভিপ্রায় থেকেই ভেবে রেখেছিলেন যে বিশ্বকাপের পর নিজের সন্তানকে প্যারিস ডিজনিল্যান্ডে নিয়ে যাবেন। ডিজনিল্যান্ডে গিয়ে বিভিন্ন রাইডে চড়ার পাশাপাশি মিকি মাউসের সঙ্গে ছবি তুলবেন, আনন্দ করবেন, আরও কত কী! বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে মাতেরাজ্জি সেটা করতে পারলেন না, ছুটি বাতিলের জন্য তাকে পরামর্শ দেওয়া হলো। নিজের সন্তানদের কাছে কীভাবে এটি খোলাসা করবেন, তা নিয়েই চিন্তিত ছিলেন তিনি।
'প্রথমবারের মতো আমি বাবা হিসেবে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না', এমনটাই বললেন মাতেরাজ্জি। বার্লিনে ঘটে যাওয়া বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই অঘটনের পর বেশি সময় পেরোয়নি। আর ঠিক এরকম একটা অঘটনের পরই এত দ্রুত ফ্রান্সে ফিরে যাওয়াকে তখন উসকানিমূলক আচরণ হিসেবেই দেখা হতো।
বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে না পারার বিষয়টি পুড়িয়েছে তাকে। জিদানের মাথার ঢুস তিনি খেয়েছিলেন, তিনিই কি বরং এ ঘটনার ভিক্টিম নন? তাহলে কেন তাকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে? 'দ্য লাইফ অব আ ওয়ারিওর' শীর্ষক আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, 'সম্ভবত এটাই আমার ভাগ্যে ছিল। আমি যা কিছু অর্জন করি, তা কখনোই পুরোপুরিভাবে উপভোগ করার সুযোগ আমার হয় না; কারণ, তাতে কেউ না কেউ বাদ সাধবেই। ফাইনালের সেই হেডবাটের পরও নিরন্তর সমালোচনা এবং বিতর্ক আমার পিছু ছাড়েনি।'
দ্য অ্যাথলেটিকের জেমস হর্নকাসেলের সাংবাদিকতা জীবনের প্রথম কাজটি ছিল মাতেরাজ্জিকে ঘিরে। চ্যাম্পিয়নস লিগের গেমে ইন্টার মিলানই হয়তো আর্সেনাল কিংবা চেলসির বিপক্ষে খেলতে পারত। কিন্তু রবিন ফন পার্সি কিংবা দিদিয়ের দ্রগবাদের বল জুলিও সিজারের গোলপোস্টে আসা থেকে ঠেকানোর জন্য মাতেরাজ্জি তখন ইন্টার মিলানের ডিফেন্ডার হিসেবে খেলছিলেন না। সেসময় তিনি বরং উচ্চ আদালতে নিজের চরিত্রকেই ডিফেন্ড করার চেষ্টায় ছিলেন।
বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ডেইলি মেইল দাবি করল, মাতেরাজ্জি নিজেই জিদানকে উসকে দিয়েছিলেন। জিদানের মাকে উদ্দেশ্য করে বাজে কথা বলেছেন, বর্ণবাদী কটূক্তি করেছেন এমন মিথ্যা অভিযোগে তাকে দুষল ট্যাবলয়েড এ পত্রিকাটি। তারা পরবর্তী সময়ে ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছে। ঠিক তেমনি ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সান এবং দ্য ডেইলি স্টারও মাতেরাজ্জির আনা একের পর এক মানহানির মামলায় ক্ষমা চেয়েছে।
২০১০ সালে ইন্টার মিলান প্রথম ইতালীয় ক্লাব হিসেবে ট্রেবল (সিরি আ, কোপা ইতালিয়া এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) জিতে নিয়েছিল। ইন্টার মিলানের ট্রেবল জয়ের পাশাপাশি মাতেরাজ্জি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে যেন ট্রেবল জিতে নিলেন। একের পর এক আইনি মোকদ্দমায় জয়লাভের কারণে দ্য টাইমস সেসময় তার আইনি উপদেষ্টাকে সেরা আইনজীবী হিসেবেও ঘোষণা করেছিল। মাতেরাজ্জির জন্য অবশ্য সেটি কোনো নিছক খেলা ছিল না।
তার পাশে তার জয়োৎসবে যখন বাকিরা বসল, তখনো তাকে আলাদাভাবে খুব উৎফুল্ল হতে দেখা গেল না। অলিম্পিয়াস্টেডিয়নের সেই ফাইনালের ততদিনে দুই বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তিনি তখনো সেটির ধকল সামলে ওঠার চেষ্টায় আছেন। ডেইলি মেইলের মিথ্যাচারের পর মাতেরাজ্জি মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন। বাইরে থেকে তাকে যতই সাহসী মনে হোক না কেন, দিন শেষে নিজের সন্তানদের নিয়ে ইউরো ডিজনিতে ঘুরে আসার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়াও তাকে ভাবিয়েছিল অনেক।
মাতেরাজ্জি এবং জিদানের মধ্যেকার বাক্যবিনিময় কিংবা পরবর্তী সময়ে সেই ঢুসটি তেমন বিপত্তি বাধায়নি। বরং ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই যদি দুজনের কথা হয়ে যেত, তাহলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মিথ্যা কিছু রটনার সুযোগ পেত না। কিন্তু দুজনই ম্যাচের পর নীরবতা অবলম্বন করায়, সবাই তা নিয়ে যাচ্ছেতাই বলার সাহস ও সুযোগটি পেয়েছে। ফাইনাল থেকে এটি মানুষের আকর্ষণ সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ২০০৬-এর ফাইনালকে অধিকাংশ মানুষই মনে রেখেছে মাতেরাজ্জি এবং জিদানের এ ঘটনা দিয়ে।
জার্মানিকে সিগনাল ইডুনা পার্কে হারাবার পর ২০০৬-এর বিশ্বকাপে ইতালি আর কাউকেই ভয় পায়নি। এই স্টেডিয়ামে ইতিপূর্বে তৎকালীন স্বাগতিক দল জার্মানি কখনোই হারেনি। এরপর দুর্বার গতিতে ইতালি এগিয়ে চলেছিল। তবে ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে ফ্রান্সের চেয়ে বরং ব্রাজিলকেই চেয়েছিল তারা।
১৯৯৮-এর কোয়ার্টার ফাইনালেও পেনাল্টির মাধ্যমে ইতালিকে হারিয়েছিল ফ্রান্স। জুভেন্টাসে জিদানের সাথে কাজ করার সুবাদে মার্সেলো লিপ্পি তার সক্ষমতার ব্যাপারে ভালোভাবে অবগত ছিলেন। যত খেলোয়াড়কে তিনি কোচ করেছেন, তাদের মধ্যে জিদানই ছিল সেরা এরকম মন্তব্যও করেছিলেন তিনি।
'৯৮-এর ব্যালন ডি'অরজয়ী জিদান সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি নিজের ওপর ভালো নিয়ন্ত্রণও রাখতেন। ফাইনালের পাঁচ মিনিটের মাথাতে তিনিই যখন পেনাল্টি নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন সেটি ছিল সবার কাছে প্রত্যাশিত।
ইতালির বুফন তখন বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক। গোলপোস্টে নজর জিদানের, অদম্য সাহসী জিদান তার শ্রেষ্ঠত্বেরই পরিচয় রেখেই নিজের সমাপনী ম্যাচটি খেলতে যেতে চেয়েছিলেন। নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে এগোলেন তিনি। তার পেনাল্টিটি হওয়া চাই একদম নিখুঁত।
জিদান করেছেনও তা-ই, স্কাই ইতালিয়ার ধারাভাষ্যকার ফাবিও ক্যারেসা ধন্দে পড়ে গিয়ে প্রথমে চিৎকার করে বলে উঠলেন, 'নো গোল!' কিন্তু গোললাইন টেকনোলজির কথা বোধ হয় আমলে নেননি ফাবিও। মূলত এই পদ্ধতিতে ইলেকট্রনিক সাহায্য ব্যবহার করে নির্ধারণ করা হয় যে গোল আদৌ হয়েছে কি না। রিপ্লেতে দেখা গেল যে জিদানের বলটি বাউন্স করে এক ফুট ভেতরে পড়ে আবার বাইরে চলে এসেছে। অর্থাৎ গোল হয়েছে! জিদান ততক্ষণে সতীর্থদের সাথে উল্লাসে মত্ত।
পেনাল্টির কারণে পিছিয়ে পড়ায়, মাতেরাজ্জি এর ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টায় ছিলেন। সেসময় বিশ্বকাপে কোনো ভিএআর প্রযুক্তি ছিল না। ইতালিকে পেনাল্টি খেতে হয়েছিল ফ্লোরেন্ত মালুদাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। কিন্তু মাতেরাজ্জি তাকে অত জোরে ধাক্কাও দেননি বলে দাবি করেছেন। তাই পেনাল্টির সিদ্ধান্তটিকে তিনি বেশ কঠোর হিসেবেই দেখেছেন।
উইলি স্যাগনোলের বিপরীতে থাকা অবস্থায় মাতেরাজ্জি কর্নার কিকের চেয়ে আত্মঘাতী গোলকেই বেশি ভয় পেয়েছেন। একের পর এক এমন অঘটন দেখে তিনি মনে মনে ভাবলেন, 'আজকের রাত হয়তো আমার জন্য না।' তবে ইতালিকেও বেশি সময় পিছিয়ে থাকতে হয়নি। ফাইনালের জন্য প্রস্তুতির সময়ই সতীর্থরা তাকে বলেছিল যে ফরাসি মিডফিল্ডার প্যাট্রিক ভিয়েইরা মাতেরাজ্জির দক্ষতাকে ভয় পান। ডার্বি ডিইতাালিয়াতে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা আগেও খেলেছেন, তাই নিজের দক্ষতা সম্পর্কে মাতেরাজ্জিরও একটা ধারণা ছিল।
মাতেরাজ্জির করা গোলেই দ্রুত সমতা ফেরায় ইতালি। গোল করার পর তিনি সেটি উৎসর্গ করলেন নিজের মা আনাকে; মাতেরাজ্জির বয়স যখন ১৫, তখনই আনা মারা গেছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন তিনি, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে, এখনই চোখ থেকে পানি বেয়ে পড়বে এরকম একটা অবস্থা।
মাতেরাজ্জি বললেন, 'আমার মা সেখানেই ছিলেন। আমি যখন ভিয়েরার ওপর দিয়ে অতিক্রম করে বলটিকে জালের পেছনে ফেললাম, মা সেখানে ছিলেন। পিচের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে যখন আমি একা কান্না করলাম, বিশ্বকাপটিকে চুমু খেলাম কিংবা সতীর্থদের সাথে সানন্দে গান গাইলাম, মা সেখানে ছিলেন।'
নিজের মেয়ের নামও মায়ের নামেই রেখেছেন তিনি। মাকে হারানোর বেদনা, মায়ের প্রতি তার নিরন্তর ভালোবাসা থেকে বোঝা যায় যে অন্য কারও মাকে তিনি কখনোই অপমান করবেন না। 'যারা আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, কেবল তারাই এসব লিখতে পারবেন যে বার্লিনে আমি জিদানের মাকে অপমান করেছিলাম। মাকে হারানোর কষ্ট কেমন, তা আমি ভালোভাবে জানি, তাই আমি কখনোই অন্য কারও মাকে নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করব না।' এমনটাই বলেছেন তিনি।
মাতেরাজ্জির মতে, পেনাল্টি এরিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় জিদান তাকে বললেন, 'তুমি যদি আমার শার্টটি চাও, ম্যাচ শেষে এটা নিতে পারবে।' কিন্তু মাতেরাজ্জির কাছে ইতিমধ্যেই জিদানের জার্সি ছিল, পূর্ববর্তী একটি ম্যাচেই তারা নিজেদের জার্সি রদবদল করেছেন। এ জন্য তিনি ঠাট্টাচ্ছলে জিদানকে বললেন, 'আমি বরং তোমার বোনকেই নিতে চাই।' রুচিহীন এ কথাটি তখন মাতেরাজ্জিকে বিশেষ ভাবায়নি। বরং ইতালীয়দের অনেকের কাছে এটা ডালভাতের মতো।
তবে এ কথা জিদানের মেজাজ চড়িয়ে দিল। চিরাচরিত দুর্বোধ্য ব্যক্তিত্বের খোলস থেকে জিদান হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। ছোট বোন লাইলার সাথে সেদিনই তার বেশ কয়েকবার ফোনে আলাপ হয়েছে। তাদের মা অসুস্থ এবং লাইলা তার দেখভাল করছিলেন। জিদান তখন রীতিমতো একটি চাপের মধ্যে। এ ছাড়া ফাইনাল ম্যাচের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তার সুদীর্ঘ এবং সফল ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচও ছিল সেটি। মাতেরাজ্জির সেই বাজে মন্তব্যটি তার মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
লা'একুইপকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অঘটনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জিদান বলেছেন, 'আমার মা সম্পর্কে মাতেরাজ্জি কোনো বাজে মন্তব্য করেনি। ও এটা প্রায়ই বলেছে, এবং এটা সত্যি কথাই। কিন্তু ও আমার বোনকে নিয়ে অপমানজনক কথা বলেছে, আর আমার বোন সে সময় আমার মায়ের সাথেই ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'পিচে একে অপরকে খেলোয়াড়েরা নানান ধরনের কথা বলে। মাঝেমধ্যে কুরুচিপূর্ণ কথাও সেখানে থাকে। কিন্তু এজন্য আপনি কোনো পাল্টা জবাব দেন না। তবে সেদিন যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। আমার বোনের ব্যাপারে এরকম মন্তব্য করে ও আমাকে রাগিয়ে দিয়েছিল। স্রেফ কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিল এটি। এরপরই সেটির সমাপ্তি ঘটে।'
তবে মাতেরাজ্জি কখনোই ঢুসের মতো কিছু কল্পনা করেননি। জিদান যখন তার দিকে রেগেমেগে আসছিলেন এবং মাথায় ঢুস দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। সিদ্ধান্তটা যতই স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা আবেগপ্রবণ হোক না কেন, জিদানের ঢুস মারার কৌশল দেখে মনে হবে যেন তিনি এতে একদম পারঙ্গম, যেন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসবের তথ্যচিত্র দেখেই কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজের মাথাকে নুইয়ে যেভাবে মাতেরাজ্জির বুকে তিনি আঘাত করেছেন, ফুটবল পিচে এরকম ঢুসের দেখা সচরাচর মেলে না।
ইতালীয় ফুটবলার ক্যানাভারো নিজেও ঘটনাটিকে স্বচক্ষে দেখেননি। কিন্তু প্রায় ১০ ফিট দূরে অবস্থান করলেও সজোরে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজটি তিনি ঠিকই শুনতে পেয়েছিলেন। ইতালির অন্য খেলোয়াড়েরাও কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। স্রেফ বুফনই স্বচক্ষে সেই হেডবাট দেখেছিলেন। আর এটি তাকে স্তব্ধ করে দেয়। সেই ম্যাচের আর্জেন্টাইন রেফারি হোরাসিও এলিজোন্দো বুঝতেই পারেননি, কত বড় হুলুস্থূল কা- এখানে ঘটে গেছে। মাতেরাজ্জি কেন মাটিতে পড়ে আছেন, তা এলিজোন্দো বুঝতে পারছিলেন না।
অলিম্পিয়াস্টেডিয়নের ৬৯ হাজার দর্শকের চোখ ছিল এলিজোন্দোর ওপর। পুরো পৃথিবীর ৭১৫ মিলিয়নেরও বেশি দর্শক-শ্রোতাও জানতে চাচ্ছিলেন যে এলিজোন্দো এখন কী সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ, রিপ্লের বদৌলতে তারা জিদানের সেই ঢুস মারার ক্লিপ লুপে বারবার দেখতে পারছিলেন, যেটি করতে এলিজোন্দো তখনো অপারগ।
এলিজোন্দো তার সহকারী দারিও গার্সিয়ার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, তিনি কিছু দেখেছেন কিনা। না, তিনি দেখেননি। তার লাইনসম্যান রডল্ফো ওটেরো, যিনি মাঠের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছিলেন, তার কাছ থেকেও যথারীতি একই জবাব এল। শেষমেশ চতুর্থ রেফারি হিসেবে থাকা লুইস মেদিনা কান্টালেহো জানালেন, 'হোরাসিও, হোরাসিও, আমি দেখেছি। জিদান সজোরে মাতেরাজ্জিকে খুব বাজেভাবে মাথা দিয়ে ঠুস মেরেছেন।'
ফ্রান্সের জোডিয়াকের কোচ রেমন্ড ডমেনেখ পরবর্তী সময়ে দাবি করেছেন যে কান্টালেহো ডাগ-আউটের পাশে থাকা কোনো মনিটর থেকে দেখেই এ কথা বলেছেন এবং নিজের অজান্তেই ইতিহাসের প্রথম ভিআর (ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) বনে গেছেন। তবে এলিজোন্দোর কাছ থেকে ঘটনার সত্যতা জানা যায়।
ব্লিজার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এলিজোন্দো বলেছেন যে কান্টালেহোর সাথে কথোপকথনের সময় ঘটনাস্থলেই তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে কীভাবে কান্টালেহো এটি দেখতে পেলেন। এ ছাড়া ম্যাচ শেষে তিনি আবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন যে কান্টালেহো কি এটি মনিটরে দেখতে পেয়েছেন নাকি সরেজমিনেই? কান্টালেহো তখন উত্তর দিয়েছেন যে তিনি সামনাসামনি পিচেই এটি ঘটতে দেখেছেন।
অফিশিয়াল দল হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেফারির তালিকায় হোরাসিও-কান্টালেহোরা থাকবেন। যা-ই হোক, জিদানকে তখন মাঠ থেকে বের করা বাদে এলিজোন্দোর হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। জিদানকে লাল কার্ড দেখানোর পরপরই পুরো স্টেডিয়ামে নেমে এল সুনসান নীরবতা।
ফরাসি টিভি নেটওয়ার্ক টিএফ১-এর ধারাভাষ্যকার থিয়েরি গিলার্দি তখন বিলাপের সুরেই বলে উঠলেন, 'না, জিদান, এভাবে না। এটা সম্ভব না। কী ঘটে গেল! এটাই শেষবার।' তবে জিদানের এমন ঘটনা এবারই প্রথমবারের মতো ছিল না। চ্যাম্পিয়নস লিগে হামবুগের্র এক প্লেয়ারকে মাথায় ঢুস মারার পাশাপাশি জিদান পার্মার এক খেলোয়াড়কেও ঘুষি মেরেছিলেন।
১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে পেনাল্টিতে ব্রাজিলের বিপক্ষে ইতালির ৩-২-এ পরাজয়ের পর দেখা গিয়েছিল বিমর্ষ ইতালীয় স্ট্রাইকার রবার্তো ব্যাজিওকে। নিজের পেনাল্টি কিক মিস করে ব্যাজিও একদম ন্যুব্জ হয়ে গিয়ে ছিলেন। ঠিক সেরকমই আরেকটি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে ২০০৬-এর বার্লিন ফাইনালে। দেখা যায় যে বিশ্বকাপ ট্রফিটির সামনে দিয়ে একরাশ নৈরাশ্য নিয়ে জিদান হেঁটে যাচ্ছেন।
অতিরিক্ত সময় শেষে শুট-আউটেও মাতেরাজ্জি নিজের পেনাল্টি আর মিস করলেন না। অন্যদিকে ফরাসি ফুটবলার ট্রেজেগে নিজের পেনাল্টি মিস করে বসলেন।
সত্যি বলতে, ২০০৬-এর বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না জিনেদিন জিদানের। কিন্তু শত অনুরোধের পর অবসর থেকে ফিরে এসে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করান জিদান। এরপর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে ফ্রান্সকে ফাইনালেও তুলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী জিদান।
কিন্তু লাল কার্ড খেয়ে নিজের শেষ বিশ্বকাপের ফাইনাল জেতার স্বপ্ন অসম্পূর্ণই থেকে যায় তার। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে ২০০৬-এর বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি।
ফরাসি এই ফুটবলারের মতে,পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এতে গর্বিত হওয়ার কিছু নেই, তবে এটাও আমার ক্যারিয়ারের একটা অংশই বটে। সেসময় আমি খুব হতাশ ছিলাম। আর এমন সব মুহূর্তে আপনি এমন কিছু করে বসেন, যা ভুল। গিলার্দি ঠিকই বলেছে। এভাবে শেষ হওয়ার ছিল না। কিন্তু এভাবেই শেষ হয়েছে। মেনে নেওয়া কঠিন। ১৯৯৮-এর ফাইনালে আমি দুটো গোল করেছিলাম, সেটি যেমন আমার জীবনের একটি অংশ, ঠিক এটিও আমার জীবনের আরেকটি অংশ।
ফাইনালের এক সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই জুরিখে একটি শুনানি হলো। সেখানে দুই ম্যাচের জন্য মাতেরাজ্জি নিষিদ্ধ হলেন। তার কাছে সেটি ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি দাবি করেছেন যে তার লিগ্যাল টিমের কাছে এমন ফুটেজও ছিল, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে অতীতে জিদানও ঠিক একইরকম বাজে মন্তব্য করেছেন। তবে সেটি তারা আর ব্যবহার করেননি। কারণ, এই ইস্যু ততদিনে এমনিতেই বেশ উত্তপ্ত। তাই আগুনে নতুন করে ঘি না ঢেলে কীভাবে তা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টায় ছিলেন তারা।
তার মতে, তার বিপক্ষে রায় লেখার কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছিল। ফিফা তাকে শাস্তি দিতে চাইল। ততদিনে অবসরপ্রাপ্ত ফুটবলার জিদানকে সাজা হিসেবে বলা হলো যেন তিনি ফিফার জনসেবা কর্মসূচিতে অংশ নেন, তিন দিনের কমিউনিটি সার্ভিসের শাস্তি পেলেন তিনি। 'জিদান যে অপরাধ করেছেন, এই সাজা কি যথোপযুক্ত ছিল? আমার চেয়ে তার সাজা মাত্র একদিন বেশি!' এরকম প্রশ্ন তুলেছেন মাতেরাজ্জি।
যা-ই হোক, এরপর বহুদিন দুজনের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। ২০১০-এর নভেম্বরে মিলানের এক হোটেলের পার্কিং লটে তাদের দেখা হয়। চ্যাম্পিয়নস লিগে এসি মিলানের বিপক্ষে খেলার জন্য রিয়াল মাদ্রিদ তখন সেই শহরেই অবস্থান করছে। আর জিদান নিজেও ততদিনে রিয়ালের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা, ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আর হোসে মরিনহোর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
দুজনের মধ্যে সেদিন কী বাক্যবিনিময় হয়েছিল, তা খোলাসা করেননি মাতেরাজ্জি। তবে আলাপের সিংহভাগ তিনি নিজেই চালিয়েছেন। কথা শেষে করমর্দনও করেছিলেন দুজন। মাতেরাজ্জি চেয়েছিলেনও ঠিক তা-ই। তবে এতে জিদানের অনুভূতি কেমন ছিল, তা জানা যায়নি।
কাতারে আলজেরীয়-বংশোদ্ভূত ফরাসি শিল্পী আদেল আবদেস সেমেদের ব্রোঞ্জের তৈরি একটি ভাস্কর্য সেই তুমুল আলোচিত-সমালোচিত দৃশ্যটিকেই অমর করে তুলেছে। ২০১৩ সালে নির্মিত এ ভাস্কর্যটি কিনে নিয়েছিল কাতার জাদুঘর। দোহায় একটি সড়কে এটি বসানো হলেও জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই তখন এটিকে কর্তৃপক্ষ সরিয়ে নেয়। কিন্তু এখন এটি আবার দোহার স্পোর্টস মিউজিয়ামে ফিরে যাচ্ছে।
জিদান নিজেও একজন শুভেচ্ছাদূত হিসেবে এবারের কাতার বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে উপস্থিত নিমন্ত্রিত। ২০০৬-এ যেভাবে ফুটবলার হিসেবে তার ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি এসেছিল, তা তিনি মেনে নিতে নারাজ। তাই তার ইচ্ছে ফ্রান্সের জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে একদিন বিশ্বকাপ জয করা।