ফুটবল মাঠের শেষ বিচারক রেফারি ও তাদের সাড়া ফেলা (বাজে) সিদ্ধান্ত!
১.
জনপ্রিয় গানে বর্ণিত মোক্তার বা ব্যারিস্টার যা-ই থাকুক না কেন, যতই সুর করেই বলেন, আছেন আমার মোক্তার/আছেন আমার ব্যারিস্টার- লাভ নেই। শেষ বাঁশি বেজে ওঠার আগপর্যন্ত দ--মু-ের একান্ত মালিক হলেন রেফারি সাহেব বা রেফারি বেগম সাহেব! ফুটবল দুনিয়ায় অন্যতম কঠিন কাজ হলো রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন। ফুটবলের মাঠে শেষ বিচারে পার করার সকল দায় এবং সব দায়িত্ব বর্তায় রেফারির ওপর। রেফারির দায়িত্বে যিনিই থাকুন না কেন, তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ফলে তার বরাতে সব সময় ফুলের মালা জোটে না। বরং খেলোয়াড়, টিম ম্যানেজার এবং ফুটবল ভক্তদের সমালোচনার বিষাক্ত হুলে বিদ্ধ হতে হয়, কখনো কখনো। সাধারণভাবে আশা করা হয়, ন্যায়বিচারের দেবীর মতোই রেফারিও অন্ধ হবেন। ভক্তদের সমালোচনার তীব্র কামড় উপেক্ষা করতে পারবেন, বেশির ভাগ সময়ই সিদ্ধান্ত নেবেন, আর তা সঠিক হবে। যার মধ্যে এমন গুণ পাওয়া যাবে, তাকেই বলা হবে সুরেফারি। অর্থাৎ একজন রেফারি কেবল কর্মফলের, ফুটবলের নিয়ম মেনে খেলার ওপর ভর করে বিচারের বাঁশি বাজাবেন। এমনটাই হওয়া উচিত।
উচিত কিন্তু হয় না। জীবনে এমন ঘটনা কম ঘটেনি। ফুটবলের মাঠেও এর ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় না। রেফারিও মানুষ। তিনি ভুল করতেই পারেন। এটি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়েও মুখ খোলার অবকাশ থাকে। অনেক সময় মনে হয়, ভুল নয় ভিন্ন কোনো টানে, স্বার্থ বা অর্থের মোহে রেফারিও 'ভুল' করেন, বাজে সিদ্ধান্ত দেন। কাতার বিশ্বকাপে এমন 'ভুল'কা- ঘটবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারেন!
এ ছাড়া রয়েছে DOGSO! শব্দটি অনেকেরই পরিচিত। এদিয়ে বোঝানো হচ্ছে, Denial of an obvious goal-scoring opportunity! এটি ইউরোপীয় ফুটবলেরে একটি নোংরা কৌশল। যার গালভরা নাম হলো ট্যাকটিক্যাল ফাউল। এ ধরনের ফাউল করে গোল খাওয়ার আশঙ্কা বাতিল করা যায়। কিংবা খুব কমিয়ে আনা যায়। তবে এ ফাউলের জন্য হলুদ কার্ড খেতে হয় না। হলুদ কার্ড খাওয়ার মতো কা- না ঘটিয়ে ফাউল করাটাই 'শিল্প'! এ 'শিল্পের' মুখে অসহায় হয়ে পড়েন বেচারা রেফারি। তবে এটা আমাদের আলোচনার মূল নয়। মূল হলো 'জেনেশুনে বিষপানের' মতো বুঝেশুনে বাজে সিদ্ধান্ত দেওয়া। অতীতে রেফারিদের কিছু বাজে সিদ্ধান্তের দিকে এবারে তাকাতে পারি আমরা।
ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে খেলায় হলুদ কার্ড খেলেন নেইমার (২০১৪)
উদ্বোধনী খেলায় ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ব্রাজিল ৩-১ গোলে জয় অর্জন করে। তবে কিছু কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ছায়া পড়ায় বিজয়ের গৌরব পুরোপুরি কলঙ্কহীন হতে পারেনি।
খেলার ২৭ মিনিটে লুকা মদরিচের মুখের পাশে কনুই চালানোর দায়ে নেইমারকে হলুদ কার্ড দেখান জাপানের রেফারি ইউচি নিশিমুরা। সেলেসাও তারকা খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বের করতে হলে খানিকটা সাহসের দরকার। অ্যালেন শেয়ারারসহ ফুটবল প-িতরা মনে করেন, ঠিক সে কাজটাই করেছেন নিশিমুরা।
বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনার রেফারি জয় পাইয়ে দেন ব্রাজিলকে
চলতি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে কোপা আমেরিকা খেলায় ব্রাজিলকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিল কলাম্বিয়া। অবশ্য শেষে রিও-ডি-জেনেরোর নিলতনসান্তোস স্টেডিয়ামে 'বি' গ্রুপের ম্যাচে কলাম্বিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয় পায় ব্রাজিল।
খেলা শুরুর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই ব্রাজিলকে গোল দেয় লুইস দিয়াস। বাইসাইকেল কিকে দুর্দান্তভাবে গোলটি দেওয়া হয়।
এক গোলে এগিয়ে থেকে কলম্বিয়ার ডিফেন্ডাররা নিজদের গোল রক্ষার দিকে সব শক্তি নিয়োগ করে। খেলার প্রথমার্ধে এ গোল শোধ করতে পারেনি সেলেসাওরা। তবে ৬৬ মিনিটির মাথায় রেনান লোদির ক্রসে ফিরমিনোর শক্তিশালী হেডে গোল হয়। এ গোল নিয়ে আপত্তি তোলে কলম্বিয়া। রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটা পাসের সময় রেফারির গায়ে লেগেছিল।
লাতিন আমেরিকান ফুটবল ফেডারেশনের (কনমেবল) নিয়ম অনুযায়ী রেফারির গায়ে লাগার পর বল যদি মাঠেই থাকে, তবে ড্রপ বলের মাধ্যমে খেলা শুরু করতে হবে। কিন্তু রেফারি নেস্তার পিতানোর তা করেননি। রেফারির গায়ে বল লাগার পর ড্রপ বলের জন্য প্রস্তুত ছিল কলম্বিয়া। তাদের এই ক্ষণিক দ্বিধাকেই কাজে লাগিয়ে গোল দেয় ব্রাজিল।
কলম্বিয়ার খেলোয়াড়দের প্রতিবাদের মুখে ৫-৬ মিনিট খেলা বন্ধ থাকলেও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন আর্জেন্টিনিয়ার রেফারি। ফলে গোলটিকে মেনে নিতে হয়। আবারও শুরু করতে হয় খেলা।
তবে বিতর্কের শেষ এখানেই নয়। ইনজুরির সময় বাড়িয়ে ১০ মিনিট করেছিলেন রেফারি। অতিরিক্ত সময় এতটা কেন বাড়ান হলো তারও জবাব নেই। বরং এ কারণে সৃষ্টি হয়েছিল অসন্তোষ। এই বাড়তি সময় পাওয়ায় জয়সূচক গোলটি করেন অধিনায়ক কাসেমিরো।
খেলা শেষ হওয়ার আগেই বাজল বাঁশি, তারপর
ঘটনাটি প্রথম বিশ্বকাপের। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্সের খেলায় বাঁশি বাজিয়ে দেন রেফারি। ১-০ গোলে বিজয়ের ঢেকুর তুলতে তুলতে মাঠ ছাড়েন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা। মাঠে এ ঘটনার প্রতিবাদ এতটাই হয় যে ফের খেলোয়াড়দের মাঠে ডাকেন রেফারি। ১-০ গোলেই বিজয় অর্জন করে আর্জেন্টিনা।
গোল বাতিল হওয়ায় এগিয়ে গেল জার্মানি
২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বনাম জার্মানির খেলা যথেষ্ট উত্তেজনাময় ছিল। জার্মানির অবস্থান ভালো ছিল, এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, গোলটা বাতিল না হলে বিজয়ী হতো অন্যপক্ষ।
খেলায় ২-০ শূন্য গোলে পিছিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। স্টিভেন জেরার্ডের অনবদ্য ফ্রি-কিকে একটি গোল হয়। এরপর ফ্র্যাংক ল্যাম্পপার্ড আরেকটি গোল করে সমতা আনেন। কিন্তু লাইনসম্যান গোলটিকে বাতিল করে দেন।
চার্জে মারাত্মক আহত হলেও রেড কার্ড দেখানো হলো না
২০১৪ বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে খেলা হচ্ছিল ফ্রান্স এবং নাইজেরিয়া। ফরাসি খেলোয়াড় ব্লেইস মাতুইদি বিশ্রিভাবে মেরে বসেন নাইজেরিয়ার ওজেনি ওনাজিকে। ফলে ল্যাজিও তারকার টেন্ডন বা পেশিবন্ধনী ছিঁড়ে যায়। এ জন্য তার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছিল। তবে এ মারাত্মক চার্জ করাকে হলুদ কার্ড দেখানোর মতো অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন মার্কিন রেফারি মার্ক গেইগার। লাল কার্ড নয়। কিন্তু ওনাজিকে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় খেলায় নাইজেরিয়ার সফল হওয়ার সম্ভাবনা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫৪ ফাউল, মাত্র ৪ হলুদ কার্ড!
২০১৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিল বনাম কলম্বিয়ার কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল বিতর্কিত ঘটনায় ভরপুর উত্তপ্ত ব্যাপারস্যাপার। ৫৪টি ফাউল করে এ খেলায় গড়া হয়েছিল বিশ্বকাপ রেকর্ড। ফাউলের এ বন্যার পরও দেখানো হয় মাত্র চারটি হলুদ কার্ড।
নেইমারের বিরুদ্ধে হুয়ান ক্যামিলো জুনিগার ফাউল বেশ মনোযোগের কারণ হয়। এই ফাউলের জেরে মেরুদ-ের একটি কশেরুকা ভেঙে যায়। তবে খেলায় কলম্বিয়া অনেক বেশি ফাউলের শিকার হয়েছিল। সাধারণত যে পরিমাণ ফাউল হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী ফাউলের মোকাবিলা করে দলটি।
জেমস রদ্রিগেজের বিরুদ্ধে ফাউলের ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড লুইজ। কিন্তু তাকে লাল তো দূরের কথা হলুদ কার্ডও দেখাননি রেফারি। খেলা শেষে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তিনি টিভি শো ডি জুরাডাতে বলেন, গত দশ বছরের মধ্যে এটাই হলো সবচেয়ে জঘন্য রেফারিগিরি! তিনি আরও বলেন, হাল্ক এবং জুলিও সিজার উভয়কেই মাঠ থেকে বের করে দেওয়া উচিত ছিল।
স্প্যানিশ রেফারি কার্লোস ভেলাসকো কারবালো এবং তার সহযোগীরা কলম্বিয়ার অধিনায়ক মারিও ইয়েপেসের অফসাইড থেকে দেওয়া পুরোপুরি বৈধ গোলকেও বাতিল করে দেন। এ নিয়েও সমালোচনার আরেক দফা কড়া চাবুক তাদের ওপর দাগানো হয়।
'লা মানোদ্য দিওস'
স্প্যানিশ জানা না থাকলে বাক্যটির অর্থ অনেকেই বুঝবেন না। কিন্তু যদি বল 'হ্যান্ড অব গড' বা 'ইশ্বরের হাত?' হ্যাঁ, তাহলে একই সাথে উচ্চারণ করবেন ফুটবলের অন্যতম বরপুত্র ডিয়েগো ম্যারাডোনার নাম। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেওয়া ম্যারাডোনার সে গোলের কথা জানেন না এমন ক্রীড়া অনুরাগী বাজি ধরেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তবে হ্যান্ডবল করে গোল দেওয়ার ঘটনা এটাই শেষ নয়। কথিত সেই 'ইশ্বরের হাত'-এর ব্যবহার এরপরও হয়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপে ফরাসি স্ট্রাইকার থিয়েরি হেনরি নির্লজ্জ হ্যান্ডবল করেন। এই হ্যান্ডবলের কৃপায় সেবারে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করে ফ্রান্স। তবে এর চড়া মূল্য দিতে হয় আয়ারল্যান্ডকে। খেলা শেষে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আয়ারল্যান্ডবাসী। কিন্তু সেই যে কথায় বলে, মরা কপাল কাশিতে গেলেও ফেরে না!
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে হেনরির ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হয়। দ্বিতীয় দফা এ খেলার ব্যবস্থা করার দাবিও উঠেছিলÑকিন্তু না, রেফারির সিদ্ধান্তের নড়চড় হলো না। অন্যদিকে আইরিশদের চোখে চিরকালের জন্য খলনায়ক হয়ে ওঠেন হেনরি। তবে একই সাথে রেফারিরও খলনায়ক হওয়া উচিত ছিল।
রেফারির দায়িত্ব পালন মোটেও সহজ নয়। আদালতের বিচারক সময় নিয়ে পুঁথি ঘেঁটে, নজির দেখে, প্রয়োজনে বিজ্ঞজনের সাথে আলোচনা করে রায় লেখেন। রেফারির সে অবকাশ নেই। বিশ্বকাপের সাবেক ব্রিটিশ রেফারি হাওয়ার্ড ওয়েব তার আত্মজীবনী 'ম্যান ইন দ্য মিডেল'-এ রেফারির দায়িত্ব পালনকালীন নিজ পারিবারিক জীবন বিপন্ন হওয়ার, সামাজিকতা নষ্ট হওয়ার এবং সন্তানকে সঙ্গ দিতে না পারার বেদনা তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তিনি আরও স্বীকার করেন যে অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উঁচুদরের পেশাদার রেফারিও জানেন না, খেলায় শেষ পর্যন্ত কী হবে। আগে বোঝা যায় না, তিনি রেফারি হিসেবে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করবেন নাকি রেফারি-জীবনের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি লিখেছেন, ২০০৬ এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আমি কোনো জুন মাস বাড়িতে কাটাইনি। বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময়ও কাটাইনি বাড়িতে। শুক্র এবং শনিবার আমার সামাজিক দিনপঞ্জি থেকে মুছে ফেলেছিলাম। কারও সহানুভূতির জন্য এসব বলছি না। রেফারির দায়িত্ব পালনের চুক্তি যখন করি, তখন সঠিকভাবেই জানতাম কী ঘটবে। তারপরও স্কুলের কনসার্টে গরহাজির থাকা, বন্ধুদের বিয়েশাদিতে যোগ না দেওয়া বা সন্তানের জন্মদিনে অনুপস্থিত থাকা মোটেও ভালো কাজ হতে পারে না। রেফারির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকে অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। এ জন্য সবচেয়ে ভুগেছে আমার পরিবার।