ছেষট্টির বিশ্বকাপ কেন সবাই ভালোবাসে, কিন্তু মনে রাখে না!
১.
তেইশে জুলাই, ছেষট্টি-বুয়েনস এইরেসের টিট্রো কোলোনের সবাই একত্র হয়েছিল আইডার পারফরম্যান্স দেখতে। নির্দিষ্ট সময়ে, আলো কমে এল, কথাবার্তা একেবারেই বন্ধ এবং সঞ্চালক বেরিয়ে এসে অর্কেস্ট্রার সামনের আসনে নিজের জায়গায় বসলেন। তাকে দেখবার ফলে গোলমালের শব্দ শোনা গেল, শ্রোতাদের দিক থেকে। সমবেতরা চিল্লাচিল্লি শুরু করলেন, কেউ কেউ আসন থেকে উঠে হট্টগোল শুরু করে দিলেন। এখানে একটি মাত্র ভুল ঘটেছিল, ব্যাটন ধরা হাতটি ছিল জন প্রিচার্ডের, একজন ইংরেজের।
আগের দিন, শেফিল্ড থেকে সাত হাজার মাইল দূরে, ৯ বছরের বাচ্চা জন ব্লাগডেন এবং তার দ্বাদশ বর্ষীয়া দিদি জিন হিলসবরোর ড্রেসিংরুমের বাইরে অপেক্ষায় ছিল অটোগ্রাফের আশায়। উরুগুয়ে এবং পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়েরা ওয়ার্ল্ডকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের পর সবে মাঠ থেকে বেরিয়েছেন। ভাইবোন দুটির কিছু সাফল্য ঘটেছিল। তারা উজ্জ্বল আনন্দে ভরে উঠেছিল; কেননা দুজন সহৃদয় উরুগুয়ের প্লেয়ার অটোগ্রাফের পাশাপাশি খুদে বার্তা লিখে দিলেন এই ভক্তদের।
মনে রাখতে হবে, উরুগুয়ে মাত্রই ৪-০ গোলে হেরে এসেছে। এ জন্যই খেলোয়াড়দের মানসিক বিপন্নতার এমন সময়ে হৃদয়বত্তার প্রদর্শনটুকু স্মরণে রাখবার মতো। সমস্যা একটাই, বাচ্চা দুটো বার্তাগুলোর অর্থ বুঝছিল না। পুরো দুইদিন পর স্প্যানিশ অনুবাদে সক্ষম একজনকে পাওয়া সম্ভব হলো ওদের পক্ষে। একটায় লেখা ছিল-রেফারিটা চোর। আর অন্যটায়-জার্মান হারামজাদারা আমাদের খেলাটা চুরি করেছে।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জয় ইংল্যান্ড রীতিমতো পুরাণে পরিণত করেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, ফুটবলের আনন্দমাখা উৎসব, সাংগঠনিক আর প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক কিছুর শুরু-প্রথম রঙিন বিশ্বকাপ সম্প্রচার, প্রথম ম্যাসকট-অন্যান্য দেশে এবং নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে একটা মহাদেশে এসবের প্রধান প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র রাগ।
তেইশে জুলাই, চারটে কোয়ার্টার ফাইনাল একত্রে হওয়ার সিদ্ধান্তটি সুনির্দিষ্টভাবে কুখ্যাতি অর্জন করে। সেদিন এক ফাইনালিস্ট পশ্চিম জার্মানি, দক্ষিণ আমেরিকান প্রতিপক্ষকে হারায়। তাদের দুজন প্লেয়ারকে ইংরেজ রেফারি মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিল। অন্য ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড, অন্য আরেক দক্ষিণ আমেরিকান প্রতিপক্ষকে হারায়, যাদের একজন খেলোয়াড়কে বহিষ্কৃত করে মাঠের বাইরে পাঠান রেফারি।
ব্রাজিল এর আগেই গ্রুপ পর্বে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের সেরা খেলোয়াড় পেলে বুলগেরিয়ার সাথে প্রথম খেলায় এত আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন যে পরের খেলায় তিনি কিছুই করতে পারেননি। তাদের কোচ বলেছিলেন, 'আমার ধারণা, প্রতি দলই তাকে একই উপায়ে সমাদর করত।' হাঙ্গেরির কাছে ব্রাজিল ৩-১ গোলে হারে। ব্রাজিলের দুটো গোল বাতিল হয়েছিল। পেলে শেষ খেলাটা খেলেছিলেন অনেকটাই ভার্চ্যুয়াল দর্শকের মতো। পর্তুগালের হোয়াও মোরাইস তাকে ফাউল করেন। উঠে দাঁড়িয়ে খেলতে গেলে মোরাইসের কাছেই আবার আরও কুৎসিত ফাউলের শিকার হন। মোরাইসকে সতর্ক করা হয়নি। ব্রাজিলের প্রথম খেলার রেফারি ছিলেন পশ্চিম জার্মানির, পরের দুটোর ইংরেজ।
'ছেষট্টির বিশ্বকাপ থেকে প্রথমবার দেশে ফেরার পর আমার হৃদয় ফুটবলের আনন্দে স্পন্দিত হচ্ছিল না।' পেলে পরে বলেছিলেন, 'খেলাগুলো আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল তাদের অখেলোয়াড়ি আচরণ আর দুর্বল খেলা পরিচালনার জন্য। ইংল্যান্ড সে বছর কাপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু মাঠে তাদের সেরা দল ছিল না।' অন্য আরেক উপলক্ষে তিনি বলেছিলেন, 'ছেষট্টিতে ফুটবল শিল্পত্ব হারায়। দর্শকের মনোযোগ নিজেদের দক্ষতা দিয়ে কাড়তে ভুলে যায়। এটি সত্যকারের যুদ্ধই হয়ে ওঠে।'
২.
যদি সংগঠকদের হাতে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তবে অনেক ঘটনা ঘটানো যায়। এমন একটা সময় যখন অল্প দর্শক আসতেন খেলা দেখতে। বিদেশি প্রেস সংবাদ সরবরাহের ধরনের ওপর কেমন করে প্রতিযোগিতা গ্রহণযোগ্য হলো, তা নির্ধারিত হতো।
ছেষট্টির বিশ্বকাপ সংগঠকেরা, কেউ আসার চার মাস আগেই সব 'ব্যবস্থা' পোক্ত করে ফেলেছিলেন। যখন ব্রাজিলের সংবাদপত্র বুঝতে পারল তাদের মাত্র দুজন আলোকচিত্রী নিজের দেশের একেকটা খেলায় প্রবেশাধিকার পাবে, তারা ক্ষিপ্ত হলো। কেননা ব্রিটিশদের ছিল ১৪ জন আলোকচিত্রী। আশা করা হয়েছিল, সকল আলোকচিত্রী নিজেদের মধ্যে ছবি বিনিময় করবেন। ব্রাজিলের পেশাদার সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। সুরাহা না হলে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির কথাও বলেছিলেন সতর্কবার্তায়।
এই বছরের মার্চ মাসে ব্রাজিলের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লেজলি ফ্রাই ফরেন অফিসের সাথে এ বিষয়ে সংলাপ চালান। 'প্রেসের কথাবার্তা এই সপ্তাহে অত্যন্ত উদ্বেগের ও অসম্মানের।' তিনি লিখেছিলেন, 'সবাইকে নিজেদের জাতীয় পতাকা সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। আমি আশা করি, দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে-এখানকার জনমতকে শান্ত করতে। এই দেশে ব্রিটিশ ভাবমূর্তি এসব উদ্ভট আচরণের জন্য নষ্ট হচ্ছে।'
রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল ব্যবস্থাপক কমিটি এবং ফটোগ্রাফার বাড়ানো অকল্পনীয় বলে রায় দিয়েছিল। পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কমিটি সম্মত হলেও বার্মিংহ্যামে দেখা গেল আর্জেন্টিনা আর হাঙ্গেরির সাথে অন্যায় ঘটেছে। ব্রাজিলিয়ানরা মাঠে ফটোগ্রাফার চেয়েছিল, কমিটি জানাল টিকিটে শর্তাবলি স্পষ্ট মুদ্রিত-প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কেউ প্রবেশের চেষ্টা করলে তাকে মাঠের বাইরে ছুড়ে ফেলা হবে।
ইংরেজরা রেলব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারেনি, সব সময় ট্রেন দেরি করত। খেলা কখনো দেরিতে শুরু হয়েছে। বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য পর্যাপ্ত টিকিট ছিল না, প্রেস সেন্টারের ফোন যথাযথ কার্যকর ছিল না। টেলিগ্রাম অন্য প্রান্তে যেতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় নিচ্ছিল।
লন্ডনে গণমাধ্যমকর্মীদের থাকার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে করা হয়েছিল, 'বোর্ডিং স্কুল'-এর মতো দেখতে। জোরালো সাইরেনের শব্দে সবাইকে ঘুম থেকে উঠতে হতো সকাল আটটায়। বিদেশি সাংবাদিকেরা মেক্সিকান সাংবাদিকের নেতৃত্বে জরুরি সভা ডেকেছিল। এসব অনাচার বন্ধের জন্য চেয়েছিল রানির হস্তক্ষেপ। বিবিসির সাংবাদিকেরা ব্রাজিল ক্যাম্পে তাদের প্রস্তুতির খবর আনতে গেলে স্পাই সন্দেহে তাদের ভ্যানে আক্রমণ করা হয়। ইংরেজ ডাক্তারের নির্দেশনায় ওয়ার্ল্ডকাপ ফাইনালের আগে বাধ্যতামূলক মাদক পরীক্ষার কথা শুনে ব্রাজিলিয়ানদের অবিশ্বাস চরমে ওঠে। এমন সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, ব্রাজিলিয়ানরা কফি খাওয়ার অনুমতি পাবে কি না, সংগঠকদের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল।'আমাদের মতে, চা কফির চেয়ে বেশি উত্তেজক'-ব্রাজিলের টেকনিক্যাল কমিশনের প্রধান বলছিলেন, 'আমরা যদি কফি খাওয়ার অনুমতি না পাই, তবে ইংল্যান্ড দলের জন্যেও তা মুলতবি করা দরকার।'
৩.
ব্রাজিল দল হিথ্রোতে নেমেই দেখে কাকপক্ষী নেই। বল্টনের বার্নডেন পার্কে, ট্রেনিং গ্রাউন্ডে এসে দেখে ইয়া লম্বা ঘাস, কোনো গোলপোস্ট নেই, তাদের বলা হলো অন্য রাস্তা মাপতে। লিভারপুলের মেয়রের ডাকা পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়ে সাধারণ গাড়িতে চড়ে তারা গেল, রাস্তা খুঁজে না পাওয়ায় পার্টিতে পৌঁছাতে হলো এক ঘণ্টা পর।
আর্জেন্টিনারও গোলপোস্ট ছিল না ট্রেনিং গ্রাউন্ডে। এলাকার মানুষজন ডেকে গোলবার ধার করে, ঠিকঠাক করিয়ে নিয়ে তারা প্র্যাকটিসের চেষ্টা করেছিল। লিলেসহলের সেশন ঠিক করার পর দেখা গেল কোচ হারিয়ে গেছেন, ত্রিশ মাইল জার্নি দুই ঘণ্টার বেশি খেয়ে ফেলেছে।
ওয়েম্বলির কোয়ার্টার ফাইনালের আগে বার্মিংহাম হোটেল থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনে নামার বদলে নামানো হয়েছিল ওয়েলুইনে, তাদের হোটেল থেকে আশি মিনিটের দূরত্বে।
শুধু দক্ষিণ আমেরিকানরা নন, ইউরোপিয়ানরাও ভুগেছিলেন। টুর্নামেন্টের মধ্যে প্যারিসকেন্দ্রিক ক্রীড়া লেখক সমিতি একটি সম্মিলিত বার্তা প্রকাশ করে জানায়, টুর্নামেন্টের 'দুঃখজনক অস্বস্তিকর' ব্যবস্থাপনার কথা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত কাগজ ডাগেনস নাইহেটারে সুইডিশ সাংবাদিক টরস্টেন এইরেনমার্ক গুডিসন পার্কের খেলার বিবরণের সংযুক্তি দেন, 'এই প্রথম একটি রিপোর্ট একজন সাংবাদিক লিখছেন এক ইঁদুরের গর্তে বসে। আমি দুই হলুদ সমব্রেরো পরা সিগারখেকো ব্রাজিলিয়ানের চিপায় আরামে বসে আছি।'
রেফারির কারবার সবচেয়ে সমস্যাজনক। কয়েকটা ইউরোপিয়ান দলের যৌক্তিক অভিযোগ ছিল। ইংল্যান্ড ২-০ গোলে যখন ফ্রান্সকে হারাল, প্রথম গোল সম্ভবত ছিল অফসাইড। নবি স্টাইলের ধাক্কা খেয়ে ঘাসে পড়ে গেলেন যখন ইনজুরি আক্রান্ত জাঁক সাইমন, তখন পরের গোল হলো। নবি স্টাইলের কোনো শাস্তি হলো না। রেফারি নির্বিকার রইল।
ইংল্যান্ডের একটি গোল নিশ্চিতভাবেই লাইন অতিক্রম করেনি, এবং দক্ষিণ আমেরিকানরা দ্রুতই অনুভব করেছিলেন, তাদের ভিক্টিম বানানো হচ্ছে। ওয়েম্বলিতে অনুষ্ঠিত আর্জেন্টিনা-ইংল্যন্ডের এ ম্যাচটিও প্রবল বিতর্কের জন্ম দেয়। আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন আন্তনিও রাতিন, ম্যাচের ৩৫ মিনিটের মাথায় বহিষ্কৃত হন, তিনি যেতে অসম্মত হলে ৯ মিনিট দেরি হয় খেলায়। জিওফ হার্স্ট একমাত্র গোল করেন।
রাতিন পরে বলেছিলেন, 'এটি পরিষ্কার, রেফারি ইংল্যান্ডের জার্সি পরে খেলেছে।' আলফ রামজে জর্জ কোহেনকে থামান আর্জেন্টাইন প্লেয়ারের সাথে জার্সি বদলের সময়। চিৎকার করে বলেন, 'জর্জ, তুমি এই জন্তুর সাথে জার্সি বদল করো না।' আর্জেন্টিনার রোবের্তো ফেরেরা আক্রমণ করে বসেন রেফারিকে এবং ফরোয়ার্ড এরমিন্দো ওনেগা ফিফার ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি কাভানের মুখে সপাটে চড় কষেন। দুজনেই টানা তিন আন্তর্জাতিক ম্যাচে নিষিদ্ধ হন। একজন আর্জেন্টাইন প্লেয়ার টানেলে মূত্রত্যাগ করেন। একটা চেয়ার ছোড়া হয় ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুম বরাবর। আর্জেন্টাইন স্কোয়াড এরপর ইংল্যান্ডের বাসে হামলা চালায়। যখন কেউ তাদের থামাতে গিয়েছিল, তার মুখে আধখাওয়া কমলা এসে পড়ে।
'আমি আমাদের প্লেয়ার আর অফিসিয়ালদের আচরণ অনুমোদন করি না।' আর্জেন্টাইন স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রতিনিধি জানান দেন, 'কিন্তু রেফারি তাদের উত্যক্ত করেছিল। তিনি ইংল্যান্ডের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। রেফারি আর রেফারিকে যারা নির্বাচন করেছে, তারাই এসবের জন্যে দায়ী।'
৪.
পতুর্গালের কিংবদন্তি ইউসেবিও বলেন, 'রেফারিকে দেখে মনে হচ্ছিল খুঁটে খুঁটে আর্জেন্টিনার ভুল বের করছেন, ইংল্যান্ডের কারও দোষ দেখছেন না।'
ইল মেসাগগেরো, ইতালিয়ান সংবাদপত্র শিরোনাম দিয়েছিল-'লন্ডনে কেলেঙ্কারি- ইংল্যান্ড দলের জন্যে অতিরিক্ত পক্ষপাত'-এখানে রাতিনের বহিষ্কারাদেশ সমালোচিত হয়। বলা হয়, 'যারা দলান্ধ নন, তারাই দেখবেন ইংল্যান্ডের এইসব নষ্ট কার্যকলাপ।'
'আমি এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্রেফ ভুলে যেতে চাই'Ñক্রেইতলিয়েগ বলেছিলেন, 'আমার রেফারি-জীবনের সবচেয়ে বাজে খেলা ছিল এটা। ভয়ংকর এবং অসম্মানের। আমি রাতিনকে বের করে দিই, কেননা সে আমাকে ধাওয়া করেছিল, গালাগাল দিচ্ছিল। আমার কোনো উপায় ছিল না।'
ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ববি মুর জানান, 'তারা নোংরা কাজ করেছিল, আপনার চুল ধরে টানবে, গালি দেবে, থুতু দেবে, চোখে গুঁতো দেবে। লাথি মারবে এমন সময়ে যখন বল অনেক দূরে। এসব দেখার কেউ নেই। এইসব বেজন্মাদের শায়েস্তার উপায়- মার দিলেই কেবল এরা শান্ত থাকবে।'
অবিচারের দরুন দক্ষিণ আমেরিকায় ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। বুয়েনস এইরেসের ব্রিটিশ দূতাবাস ফরেন অফিসকে জানাচ্ছিল, কোয়ার্টার ফাইনালের আগে 'লাতিন আমেরিকান প্রেস ফিফা আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক আবেগপ্রবণ প্রচারে লিপ্ত।' কোয়ার্টার ফাইনালগুলো হয়ে যাওয়ার পরে আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের দূতাবাস হামলার মুখে পড়ল। আর্জেন্টাইন ক্রীড়া সংস্থা প্রকাশ্যে বলা শুরু করল, সদলবলে ফিফা ত্যাগ করবার কথা। একজন অফিশিয়ালের বরাতে জানা গেছে,'ফিফা ছেড়ে বেরিয়ে নিজেদের প্রতিযোগিতা শুরু করার কথা বলার আমি কেউ নই। তবে এমনটা হলে ভারি ভালো হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিযোগিতা যত সামনের দিকে যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের প্রতি পক্ষপাত টের পাওয়া যাচ্ছে।'
রেডিও কভারেজ নিয়েও ঘটনা ঘটেছিল। বিবিসি দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর জন্য স্প্যানিশ আর ব্রাজিলের জন্য পতুর্গিজ ধারাভাষ্যের ব্যবস্থা করেছিল। তবে চিলির এক ধারাভাষ্যকার নিয়োগ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তিনি ছিলেন লাতিনভক্ত, ইউরোপদ্বেষী। ইচ্ছেকৃতভাবে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনা ম্যাচের ধারাভাষ্য বিকৃত করবার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। লিমায় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া হাচিনসন জানাচ্ছেন এসব তথ্য।
ইংল্যান্ড ত্যাগ করার আগে আর্জেন্টিনা দল ক্লাব ইউনিভার্সিদাদ দে চিলে থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছিল। লেখা ছিল- 'বিশ্বফুটবলের নৈতিক চ্যাম্পিয়নের প্রতি শুভ কামনা।' দেশের বিমানবন্দরে তারা রাজকীয় সংবর্ধনা পায়। প্রেসিডেন্ট নিজ বাসভবনে ডেকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ আয়োজনের সবচেয়ে বড় ক্রিটিক ছিলেন জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ, ব্রাজিলের ক্রীড়া সংস্থার প্রেসিডেন্ট। আট বছর পর তিনি ফিফার চূড়ায় বসবেন। নিজের দলের বিদায়ের পর তিনি মন্তব্য করেন,'ফিফার আমাদের জন্য আরেকটু সম্মান থাকা দরকার ছিল।'
এমন নানা রকম অঘটন আর ব্রিটিশ কূটচালের জন্য খেলার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় একাধিক ক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও ছেষট্টি সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিজয়গাঁথা কেউ স্মরণের অন্তর্গত করে রাখেনি।