ফুটবলের ফাঁপা আনন্দ
[মারিও ভার্গাস ইয়োসা। পেরুর নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী এই সাহিত্যিক তার প্রজন্মের একজন নেতৃস্থানীয় লেখক। অনেক সমালোচকই মনে করেন ষাট ও সত্তরের দশকের ল্যাটিন আমেরিকান বুমের সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও পঠিত ল্যাটিন আমেরিকান লেখক তিনি। ২০১০ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ইয়োসা। এর সাথে জিতেছেন রোমুলো গালেগোস পুরস্কার (১৯৬৭), প্রিন্স অফ আস্তুরিয়া অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৬), মিগুয়েল ডি সারভান্তেস পুরস্কার (১৯৯৪), জেরুজালেম পুরস্কার (১৯৯৫), কার্লোস ফুয়েন্তেস আন্তর্জাতিক পুরস্কার (২০১২) এবং পাবলো নেরুদা অর্ডার অফ আর্টিস্টিক অ্যান্ড কালচারাল মেরিট (২০১৮)।
ষাট ও সত্তরের দশকে 'দ্য টাইম অফ দ্য হিরো (১৯৬৩-৬৬)', 'দ্য গ্রিন হাউজ (১৯৬৫-১৯৬৮)' এবং 'কনভার্সেশন ইন দ্য ক্যাথেড্রাল (১৯৬৯-১৯৭৫)'-এর মতো উপন্যাস লিখে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন ইয়োসা। প্রায় সব ধরনের সাহিত্যেই হাত পাকিয়েছেন তিনি, যার মধ্যে রয়েছে সাহিত্য সমালোচনা, কমেডি, ঐতিহাসিক উপন্যাস, মার্ডার মিস্ট্রি, এমনকি রাজনৈতিক থ্রিলারও। তার লেখা 'ক্যাপ্টেন পান্টোহা অ্যান্ড দ্য স্পেশাল সার্ভিস (১৯৭৩-১৯৭৮)' এবং 'আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার (১৯৭৭-১৯৮২)'-এর ওপর চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে।
অন্যান্য অনেক ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিকের মতো ইয়োসাও রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। প্রথমে তিনি কিউবান বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সরকারকে সমর্থন জানালেও পরে সরে আসেন, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে কিউবার কবি হার্বার্তো পাদিয়াকে কারারুদ্ধ করার পর। ১৯৯০ সালে তিনি পেরুর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে যোগ দেন, যদিও আলবার্তো ফুজিমোরির কাছে হেরে যান। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের চালু করা ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি কমিশনের ২৫ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মধ্যে ইয়োসা একজন।
১৯৮২ সালে মাদ্রিদভিত্তিক পত্রিকা এল পাইস তাকে স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ নিয়ে প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব দেয়। ফুটবল দর্শকদের অনুভূতি ধারণ করা এই নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বিশ্বকাপকে এক শূণ্য পাত্র মনে করেন, যার ওপর যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো অর্থ চাপিয়ে দিতে পারে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা সম্পর্কে তিনি 'মেকিং ওয়েভস' নামের এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, "কোন ফুটবলারের তারিফ করা কোনো কবিতা কিংবা চিত্রকলাকে তারিফ করার মতোই। কোনো শনাক্তযোগ্য বস্তু ছাড়াই কেবল তার গঠনের জন্যই তারিফ করা।"
এল পাইসে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা মূল প্রতিবেদন 'ফুটবল'স এম্পটি প্লেজার' থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন জন কিং। সেখান থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হলো।]
দুয়েক বছর আগে, আমি ব্রাজিলীয় নৃতত্ত্ববিদ রবার্তো দা মাত্তার এক অসাধারণ লেকচার শুনেছিলাম। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন ফুটবলের জনপ্রিয়তা কীভাবে সমতা আর মুক্তির সহজাত আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে।
তার যুক্তি বেশ চতুর এবং আমুদে ছিল। তার মতে, জনগণ ফুটবলকে এক ধরনের আদর্শ সমাজ মনে করে, যে সমাজ একেবারে সহজ ও স্পষ্ট আইন দিয়ে চলে এবং আইনগুলো সবাই বোঝে। একইসাথে এই আইন যদি কেউ ভঙ্গ করে তবে তাকে সাথে সাথে শাস্তি দেওয়া হয়। ফুটবল মাঠ হচ্ছে এমন এক সমতার জায়গা, যেখানে কোনো ধরনের পক্ষপাত কিংবা অবৈধ সুবিধা থাকবে না। এই সবুজ দাগ দেওয়া মাঠে একজন মানুষকে তার যোগ্যতা অনুসারেই মূল্য দেওয়া হবে: তার দক্ষতা, কার্যকরিতা, উদ্ভাবনীশক্তি আর তার পরিশ্রম দেখে। যখন কেউ গোল করবে কিংবা দর্শকসারি থেকে হাততালি আর চিৎকার ভেসে আসার আশা করবে, তখন খ্যাতি, টাকা বা প্রভাব, কোনোকিছুই কাজে আসবে না। ফুটবল খেলোয়াড়েরা সমাজের সেই স্বাধীনতাই চর্চা করে যেখানে সমাজের সকল সদস্য একমত হয়: তুমি যেকোনো কিছু করতে পারো যতক্ষণ না সবার একমত হওয়া আইন সেটিকে বাধা দিচ্ছে।
এই জিনিসটাই শেষমেশ সারাবিশ্বের জনগণকে আবেগে ভাসায়, দর্শকদেরকে মাঠে নিয়ে আসে, টেলিভিশনের ওপর চূড়ান্ত মনোযোগ দিতে বাধ্য করে, নিজেদের ফুটবল আইডলদেরকে নিয়ে দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়: এমন এক পৃথিবীর প্রতি এক গোপন ঈর্ষা, এক ধরনের অবদমিত নস্টালজিয়া কাজ করে তাদের মধ্যে, যে পৃথিবী তাদের অবিচার, দুর্নীতি, অনাচারে ভর্তি বাস্তব পৃথিবীর মতো নয়, সেখানে রয়েছে আইন, সমতা আর সম্প্রীতি।
এই চমৎকার তত্ত্ব কি সত্যি হতে পারে? যদি এটা সত্যি হয়েই থাকে, তবে মানবসমাজের ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য এর চেয়ে ইতিবাচক আর কিছু হতে পারে না, যেটা জনগণের সহজাত প্রবৃত্তির গভীরে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই, বাস্তবতা তত্ত্বের অসম্পূর্ণতাকে দেখিয়ে দেয়। তত্ত্ব সবসময়েই যৌক্তিক, যুক্তিবাদী আর বুদ্ধিবৃত্তিক হয়ে থাকে, (যদিও সেই তত্ত্বগুলো অযৌক্তিক আর পাগলামি প্রস্তাব করে); কিন্তু সমাজে, মানুষের ব্যবহারে, সবসময়েই অবচেতন, অযুক্তি, এবং নির্ভেজাল স্বতঃস্ফূর্ততা কাজ করে। এটা একইসাথে অপরিহার্য এবং অপরিমেয়।
আমি এই কথাগুলো লিখছি ক্যাম্প ন্যুয়ের এক সিটে বসে, ১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা বনাম বেলজিয়াম ম্যাচের কয়েক মিনিট আগে। চিহ্নগুলোও ইতিবাচক দিক নির্দেশ করছে: মাথার ওপর জ্বলজ্বলে সূর্য, স্টেডিয়াম ভর্তি স্প্যানিশ, কাতালান, আর্জেন্টাইন আর সামান্য কিছু বেলজিয়ান পতাকা, আতশবাজির কড়কড় শব্দ, উৎসবমুখর পরিবেশ, আর ম্যাচের আগে ওয়ার্ম-আপ হিসেবে নাচিয়ে আর জিমন্যাস্টদের প্রতি দর্শকদের হাততালি।
এই জগত বাইরের জগতের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। ন্যু ক্যাম্পের ভেতরে মাঠে নাচতে থাকা তরুণদের পারফরম্যান্স দেখে হাততালি দিচ্ছে গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকরা। এটা এমন এক জগত যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই। দক্ষিণ আটলান্টিক (ফকল্যান্ড যুদ্ধ) কিংবা লেবাননের (লেবাননের গৃহযুদ্ধ) মতো এই জগত নয়, যেখানে বিশ্বকাপের উন্মাদনা, বিশ্বকাপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা দর্শকদের চিন্তার অগ্রাধিকার তালিকার দ্বিতীয় সারিতে চলে গিয়েছে। এখানে যারা বসে আছে, ন্যু ক্যাম্পের এই গ্যালারিতে, আগামী দুই ঘণ্টার জন্য তারা কেবল ২২ জন বেলজিয়ান আর আর্জেন্টাইনের মধ্যকার পাস আর শটের মধ্যেই ডুবে থাকবে, যে ম্যাচের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হচ্ছে এই টুর্নামেন্টের।
এই অসাধারণ ঘটনা, ফুটবলকে সুপ্ত ধর্মে পরিণত করা এই আবেগ, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষকে একত্রিত করা এই খেলা আসলে সমাজতত্ত্ববিদ আর মনস্তত্ত্ববিদরা যা ভাবেন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সরল। ফুটবল আসলে এমন জিনিস জনমানুষকে দেয়, যা তারা খুব কম পায়। আর সেটা হচ্ছে মজা করার সুযোগ, আনন্দ নেওয়ার সুযোগ, উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ, কিছু নির্দিষ্ট আবেগ উপভোগ করার সুযোগ, যা তারা তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে পায় না।
মজা করা, উপভোগ করা, একটা ভালো সময় কাটানো, খাওয়া আর কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং মানুষের একটি স্বাভাবিক বাসনা। এবং অনেকের মতেই, ফুটবল জনমানুষের জন্য এই জায়গাটা তৈরি করে দিয়েছে, অন্য যেকোনো খেলার তুলনায়।
যারা আমার মতো ফুটবল থেকে আনন্দ নিতে পারে, তারা কখনোই অবাক হন না যে কেন এটি সাধারণ মানুষের বিনোদন হিসেবে এত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে কীভাবে। কিন্তু এমন অনেকেই আছে যারা এটা বোঝে না এবং সমালোচনাও করে বসে কেউ কেউ। তার একে শোচনীয় বলে মনে করে, কারণ তারা মনে করে ফুটবল জনমানুষকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তাদের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়, তাদেরকে এসকল ইস্যু থেকে আলাদা করে ফেলে। যারা এরকম ভাবে, তারা ভুলে যায়, আনন্দ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তারা এটাও ভুলে যায় যে বিনোদনের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী, এগুলো কতটা তীব্র, কতটা মনোযোগ আকর্ষণকারী (আর একটা ভালো ফুটবল ম্যাচ প্রচণ্ড মাত্রায় তীব্র আর মনোযোগ আকর্ষক), কতটা ক্ষণস্থায়ী আর নির্দোষ। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা যেখানে আবেগ ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই চলে যায়।
খেলাধুলা, যারা উপভোগ করতে পারে, তাদের কাছে এটা এমন এক মুহূর্ত যা ক্ষণিকের আবেগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা কোনো বই বা নাটকের মতো নয়, যার রেশ স্মৃতিতে বহুদিন থেকে যায়, এটা জ্ঞানকে বাড়ায়ও না, আবার কমায়ও না। এটাই ফুটবলের আবেদন, এটা উত্তেজক আর শূণ্য। এই কারণেই, মেধাবী আর নির্বোধ, সংস্কৃতিমনা আর অ-সংস্কৃতিবান, সবাই একইসাথে ফুটবলকে উপভোগ করতে পারে।
তবে আপাতত এটুকুই থাক। দলগুলো বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বকাপ অবশেষে শুরু হয়েই গেল, খেলাও শুরু হয়ে যাচ্ছে। যথেষ্ট লেখা হয়েছে। এবার একটু উপভোগ করা যাক।