রানী চন্দের কলমে অবন ঠাকুর
৮০ বছর আর ৭০ বছর বয়স্ক দুই অবাক শিশু একসঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছে, কোনো সময় শৈশবের কোনো রঙ্গ মনে করে দুইজন একসঙ্গে হেসেই কুপোকাত, কোনো সময় স্বজন হারানোর স্মৃতি মনে করে দুজনেই নিশ্চুপ, কোনো সময় সৃষ্টির সুখের উল্লাসে মেতে তাদের আড্ডা থেকে জন্ম নিচ্ছে নব নব চিন্তাধারা, যে চিন্তা শুধু তাদের দুজনের নয় বরং বাঙালি জাতির আগামী কালের কক্ষপথ।
সম্পর্কে তারা আজীবনের বন্ধু, আত্মীয়তার সূত্রে কাকা-ভাতিজা, আর আমাদের কাছে দুই গল্পবুড়ো, যাদের মেলবন্ধন ছাড়া বাঙালি জাতির আত্মিক পরিচয় অপূর্ণ থেকে যায়। ৮০ বছরের জনের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর ছোটজন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ সমাজ গড়তে তাদের সকল অবদান বাদ দিলেও শুধুমাত্র ছবি আঁকায় তাদের যে অবদান এবং শিশু সাহিত্যে তাদের যে অবদান তার তুলনা করার মতো কোনো কিছুর জন্ম আর কোনোদিন হবে না বলাই ভালো।
রবীন্দ্রনাথ তখন জীবনের সায়াহ্নে, সে সময়ে শান্তিনিকেতনে বলা চলে শিশুকাল থেকে বড় হওয়া চিত্রকর, লেখক, নৃত্যশিল্পী, সেবিকা রানী চন্দ — যিনি প্রথমে নন্দলাল বসু এবং পরবর্তীসময়ে অবনীন্দ্রনাথের সরাসরি ছবি আঁকার ছাত্রী ছিলেন, এবং শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় জন ছিলেন — তিনি অবন ঠাকুরের কাছ থেকে নানা গল্প মুখে মুখে শুনে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেগুলো বলা চলে কোনোরকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই লিখে নোট করে একদিন কয়েকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়তে দিয়েছিলেন।
সেগুলো পড়েই অতি উচ্ছ্বসিত হয়ে রবিঠাকুর বলেছিলেন, 'কী সুন্দর, অবন সেকালের-আমাকে তুলে ধরেছে। আমি কী ছিলুম। সবাই ভাবে আমি চিরকাল বাবুয়ানি করেই কাটিয়েছি, পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে। কিন্তু কিসের ভেতর দিয়ে যে আমাকে আসতে হয়েছে এই লেখাগুলোতে তো স্পষ্ট রূপে ধরা পড়েছে। এটা তুই একটা খুব বড় কাজ করেছিস।' সত্যিই যে তাঁর অতি আপনার জন রবিকাকা এত খুশি হবে সেটা অবন ঠাকুর নিজেও বুঝতে পারেননি, পরবর্তীসময়ে আরও গল্প শুনতে গেলে রানী চন্দকে বলেছিলেন, 'যত পারো নিয়ে নাও; সময় আমারও বড়ো কম। কে জানত রবিকাকা আমার এই-সব গল্প শুনে এত খুশি হবেন।' এভাবেই জন্ম নিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্মৃতিকথার যার প্রথমটারর নাম ঘরোয়া।
নিতান্তই ঘরোয়া স্মৃতিগুলো অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ভালো বলে এই বইটার নাম ঠিক করা হয়েছিল ঘরোয়া এবং লেখক হিসেবে গিয়েছিল যৌথভাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রানী চন্দের নাম। এ বইটি প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তুলে দেওয়া যাতে অসুস্থ অবস্থায় কবিগুরু কিছুটা হলেও আনন্দিত হয়ে ওঠেন।
অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে, এবং ঘরোয়া বইটি ঠিক এর পরের মাসে ১৩৪৮ সালের আশ্বিনে প্রকাশিত হয়েছিল। এই যে অল্প কয়েক দিনের জন্য গুরুদেবের হাতে বইটি দেওয়া গেল না সেজন্য রানী চন্দ আজীবন দুঃখ করেছেন। কিন্তু এভাবেই জন্ম নিল এক শক্তিশালী ধারার স্মৃতিকথা রচনার, সত্যি বলতে মানুষ রবীন্দ্রনাথ, মানুষ অবনীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতনের গোড়ার দিকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব স্মৃতি হয়তো আমরা কোনদিনই জানতে পারতাম না যদি না রানী চন্দ এগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন।
আমাদের আজকের গল্প সেই অমূল্য বইগুলো নিয়েই। এর বছর তিনেক পরেই ১৩৫১ সালের কার্তিক মাসে আবারও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রানী চন্দের যৌথ নামে প্রকাশিত হয় জোড়াসাঁকোর ধারে। এখানে আমরা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করি এক অন্য অবনীন্দ্রনাথকে। সদা কৌতূহলী এক কিশোর যেন, জীবনের প্রতি পলে পলে সবকিছু থেকে রঙ শুষে নিয়ে শিখে গেছেন যতটা পারেন।
বয়স যখন ৭০ পার হয়েছে তখনও বলছেন আমি শিখছি, প্রতিনিয়ত শিখেই যাচ্ছি, এবং নিজে শেখার পাশাপাশি অন্যদের শেখানো — বিশেষ করে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের মনের চোখ খুলে দেওয়ার উপরে যে তিনি কত গুরুত্ব দিয়েছেন এটা স্পষ্ট বোঝা যায় জোড়াসাঁকোর ধারের প্রতি পাতায় পাতায়।
একসময়ে তিনি বিচিত্র সব জিনিস সংগ্রহ করতেন, কখনো হিমালয়ের ওপার থেকে আসা চীনে ব্যবসায়ীর কাছে মুক্তা, কখনো বা কারুকাজ করা মোগলাই পান্না, কখনো আবার প্রায় ফসিলে পরিণত হয়ে যাওয়া কোটি বছর আগের কীটপতঙ্গ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রহ করে গেছেন কিছু না কিছু। বিশেষ করে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি তাঁর 'কুটুম-কাটাম'-এর গল্প তো এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
বাঁশের গুঁড়ি, গাছের ডাল, নারকেলের মালা, সুপারি গাছের খোল, গাছের শেকড় ইত্যাদির প্রাকৃতিক আকারকে সামান্য ঘষে মেজে তিনি নানা প্রাণীতে রূপ দিতেন, এটা ছিল তাঁর কাছে এক খেলা। কিন্তু সৃষ্টিশীল এই খেলা হয়ে উঠেছিল অতি বিখ্যাত, আমরা এই স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি, ওনার সব মিলিয়ে হাজার খানেক কুটুম-কাটাম সম্পূর্ণ হয়েছিল! নিজেকে নিয়ে বলেছিলেন, 'কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনো কিছু করবার, এখনো নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত। তাই করত, আমায় সবাই খাটিয়ে নিত।'
১৩৫৮ সালে তার প্রিয় রবিকাকার তিরোধানের এক দশক পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে, তারও ২০ বছর পর ১৩৭৯ সালে প্রকাশ পায় রাণী চন্দের অসামান্য নৈবেদ্য শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। এই বইটি আর কেবল নিছক স্মৃতিকথা থাকেনি, এখানে বারবার দেখানো হয়েছে কেন শিক্ষক হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় ভাস্বর। কী করে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আগ্রহের দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে পারতেন, তাদের কৌতূহলী করে তুলতে পারতেন এবং কীভাবে তাদেরকে সবসময়ই শিক্ষকের অনুকরণ না করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর হয়ে শিল্পসৃষ্টির প্রণোদনা দিয়ে গিয়েছেন।
রবিঠাকুরের মৃত্যুর পরে যখন শান্তিনিকেতন বলা চলে সকলের বিমর্ষতায় এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছে, ঠিক তখনই নিজের বুকে পাথর চেপে সেখানে এসে প্রাণের ফুলকি ছড়িয়ে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে যাবার পরপরই প্রত্যেকটা শিশু অবু দাদু, অবু দাদু বলে তার মহাভক্ত হয়ে গেল, প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে যেচে নিজের কাজ দেখাতে বলেন এবং গঠনমূলক উৎসাহ দেন।
রানী চন্দের ভাষায়, 'গুরুদেবের পরে অবনীন্দ্রনাথকে না পেলে আমরা বোধহয় উঠে দাঁড়াতে পারতাম না। তাঁর অভাব একমাত্র অবনীন্দ্রনাথই পেরেছিলেন ভালোবাসা দিয়ে ভরে দিতে। তিনি যেন নিজের হাতে আপন দ্বারের বন্ধ আগল খুলে দিলেন এতদিনে।' অবনীন্দ্রনাথের যেমন এ গল্পগুলো নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন, লেখক ঠিক তেমনই তারও এক যুগ পর বাংলা ১৩৯১ সালে প্রকাশিত শান্তিনিকেতন নিয়ে আরেক অমূল্য স্মৃতিকথা সব হতে আপন বইতে তুলে এনেছেন যার কেন্দ্রে ছিল গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ। এ ছাড়া রানী চন্দের আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ এবং গুরুদেব অতি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা যেখান থেকে আমরা শান্তিনিকেতনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে পারি এবং সেই সব মহারথীদের প্রতিদিনকার জীবনের অনেক ক্ষুদে ক্ষুদে অনুল্লেখিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সাক্ষী হতে পারি।