এলসা আমার এলসা
বহুকাল আগের সেই শিকারি জীবনের নানা ঘটনা দুর্ঘটনার কাহিনি আজও হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে আছে অমূল্য রত্নের মতো। কত কথা কত স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আহা কত বৈচিত্র্যময় ছিল বন্য প্রাণী আর অরণ্যময় সেই জীবন।
একদিনের কথা ভীষণ মনে পড়ে। হঠাৎ খবর পেলাম কাপাসিয়া থানার কামড়া মাসুক গ্রামে তিনটি মেছোবাঘের বাচ্চা ধরা পড়েছে। মেছোবাঘ কিন্তু আসলে বাঘ নয়, মাছশিকারি এক বন্য বিড়াল, ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ফিশিং ক্যাট। তবে মাছের পাশাপাশি খুদার তাড়নায় এরা মাঝেমধ্যে মানুষের পোষা হাঁস-মুরগি এমনকি ছাগলও শিকার করে থাকে। আকৃতিতে পোষা বিড়ালের চাইতে কছেশ গুণ বড় আর গায়ের ডোরাকাটা দাগের কারণে মানুষের কাছে এরা মেছোবাঘ নামে পরিচিতি পেয়েছে। নিজের নামের সঙ্গে বাঘ নামটি জড়িয়ে থাকার কারণে যুগের পর যুগ ধরে মানুষের হাতে এদের মৃত্যু হয়েছে। যার পেছনে কারণ একটাই: বাঘ-আতঙ্ক।
যাক সে কথা। সেই সময়টাতে ওরা আমার কাছে 'মেছোবাঘ' নামেই পরিচিত ছিল। মনে জেগে ছিল একটি মেছোবাঘের বাচ্চা পোষার শখ। তাই 'মেছোবাঘের বাচ্চা ধরা পড়েছে' এই খবর পাওয়ার পরদিনই এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বাইকে চেপে রওনা হয়ে গেলাম কামড়া মাসুক গ্রামের উদ্দেশে। মোটরবাইক নৌকায় তুলে নদী পেরিয়ে লাল মাটির পথ ধরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা সেই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছলাম দুপুরের দিকে।
তখন একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোন বাড়িতে মেছোবাঘের বাচ্চা ধরা পড়েছে?' তার কাছ থেকে জানা গেল গ্রামের মজিবর মেম্বারের বাড়ির ছোট বউ সকালবেলা বাড়ির পাশের আনারসবাগানে পাকা আনারস আনতে গেলে হঠাৎ মিউ মিউ শব্দ শুনতে পায়। একটু কাছে গিয়ে সে বিড়ালের বাচ্চার মতো ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা দেখতে পায়। বাচ্চাগুলো একনজর দেখার পর সে বুঝতে পারে এগুলো মেছোবাঘের বাচ্চা। কারণ, গতকাল কিছুটা দূরের এক বাগানে গ্রামবাসীর আক্রমণের মুখে একটি মেছোবাঘিনীর মৃত্যু ঘটেছে। তাই সেই মহিলা দ্রুত বাড়িতে এসে সবাইকে খবরটা দেয়। বাড়ির লোকজন সাথে সাথে সেই আনারসবাগানে ছুটে যায় এবং বাচ্চা তিনটিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে।
মেছোবাঘের বাচ্চা পাবার আশায় আমরা সেই মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। জানতে পারলাম বাচ্চা তিনটি মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলের কাছেই আছে। আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে ছেলেটি এসে আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখতে পেলাম একটা ছোট্ট খাঁচার ভেতর বিড়ালের বাচ্চার মতো ছোট ছোট তিনটি বাচ্চা। বাচ্চাগুলো কিছুক্ষণ পিটপিট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল এবং আবার পরক্ষণেই নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় মেতে উঠল। বাচ্চাগুলো দেখতেই বুঝতে পারলাম সবেমাত্র ওদের চোখ ফুটেছে।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চাগুলোকে সে এ পর্যন্ত কোনো কিছু খেতে দিয়েছে কি না? সে জানাল, চামচ দিয়ে গরুর দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে, এখনো ঠিকমতো খাওয়াতে পারছে না।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, তখনকার সময় বন্য প্রাণী সুরক্ষা আইনের তেমন কোনো প্রচলন ছিল না। আর জঙ্গল এলাকার অনেকেই বন্য প্রাণীর বাচ্চা পুষে বড় করে তুলত, আরও অনেক কিছুই ঘটত জঙ্গলে, যা বর্তমান আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
মেম্বারের ছেলের নাম জয়নাল। জানা গেল তারও খুব শখ মেছোবাঘের বাচ্চা পোষার। দীর্ঘদিন ধরে সে নানা জায়গায় বাচ্চা খুঁজে বেড়িয়েছে।
কথাবার্তার একপর্যায়ে আমি তাকে একটি বাচ্চা আমায় দিতে বললাম। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হতে চাইল না। তারপর অনেক বুঝিয়ে তার কাছ থেকে একটি বাচ্চা সংগ্রহ করলাম। খুশি হয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য তার হাতে কিছু টাকা তুলে দিলাম। বাচ্চা তিনটির মধ্যে একটি মর্দা এবং দুটি মাদি। একটি মাদি বাচ্চা সে আমায় দিয়েছিল। বাচ্চাটাকে একটা চটের ব্যাগে ভরে বন্ধুর হাতে দিয়ে বাইকে চেপে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।
সন্ধ্যার কিছু পরে আমরা বাড়িতে পৌঁছলাম। তখন ছিল শীতকাল। প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া চারদিকে। বাড়িতে এসে প্রথমে ছোট্ট একটা বেতের খাঁচা জোগাড় করলাম, সেই খাঁচার ভেতর খর ও চট বিছিয়ে তার মধ্যে মেছোবাঘের বাচ্চাটাকে রাখলাম। রাতের বেলা যাতে খাঁচার ভেতরটা উষ্ণ থাকে তার জন্য এক শ ওয়াটের একটা বাল্ব ঝুলিয়ে দিলাম খাঁচার একটু ওপরে। বাচ্চাসহ খাঁচাটা আমার থাকার ঘরেই রাখলাম। বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর ফিডারে গরুর দুধ গরম করে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই সে খেতে চাইল না। তবুও একটু পরপর আমি তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে গেলাম। এভাবে একসময় সে নাক ও মুখের পাশে লেগে থাকা দুধ চেটে খেতে শুরু করল।
এরপর আস্তে আস্তে ফিডারের নিপল দিয়ে দুধ খেতে শিখল।
তখন প্রায় রাতেই সে মিউ মিউ করে ডাকত। বুঝতাম মাকে খুঁজছে সে। রাতের বেশির ভাগ সময়ই তার দিকে আমার খেয়াল রাখতে হতো। একটু পরপর বিছানা থেকে নেমে বাচ্চাটার কী অবস্থা দেখে নিতাম।
এভাবেই কেটে গেল কয়েকটি সপ্তাহ। মেছোবাঘের বাচ্চাটি তখন বেশ চটপটে হয়ে উঠেছে। দুধভর্তি ফিডার দেখলেই সে দৌড়ে ছুটে আসত।
বাচ্চাটা একটু বড় হতেই আমি চিন্তা করলাম এর একটা নাম রাখা দরকার। অনেক আগে 'বর্ন ফ্রি' নামে একটা ইংরেজি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম, যার মূল কাহিনিটি ছিল এলসা নামের এক সিংহশাবককে ঘিরে। সেই সিংহের বাচ্চার নাম অনুযায়ী মেছোবাঘের বাচ্চাটার নাম রাখলাম 'এলসা'। তখন এলসাকে নিয়েই কাটত আমার দিনরাতের বেশির ভাগ সময়। আর শিকারের নেশাও কমে গিয়েছিল অনেক।
মাসখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর এলসা একটু বড় হয়ে উঠল। তখন আমি তাকে একটু একটু করে মাংস খাওয়াতে লাগলাম। প্রায়ই এয়ারগান দিয়ে ছোট ছোট পাখি মেরে এলসার দিকে দিতাম, সে প্রচণ্ড বিক্রমে মৃত পাখির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। পাশাপাশি বাজার থেকে গরু-খাসির মাংস কিনে এনে আমি তাকে নিয়মিত খাওয়াতে লাগলাম।
এভাবে কেটে গেল দুটি মাস। এর মধ্যে এলসা বেশ কিছুটা বড় হয়ে গেল। সে এখন আর দুধ খায় না। এ সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। তার গায়ের বাঘের মতো ডোরা দাগগুলো আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। আরও কয়েক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম এলসা আসলে মেছোবাঘ নয়, বন বিড়ালের বাচ্চা। এই ঘটনায় মনে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। আশপাশের লোকজন বলতে লাগল, এভাবে একটা বন বিড়ালের বাচ্চাকে লালন-পালন করা অহেতুক কাজ।
এভাবে কেটে গেল আরও তিনটি মাস। এলসা এখন পরিপূর্ণ পাঁচ মাস বয়সী এক বন বিড়াল। আমি কাছে গেলেই সে দৌড়ে এসে আমার হাত-পা কামড় দিয়ে ধরত, পিঠের ওপর লাফিয়ে উঠত। তার দাঁতের কামড়ে কিংবা নখের আঁচড়ে, আমার শরীর থেকে কোনো দিন এক বিন্দু রক্তও ঝরেরনি। আসলে বন্য প্রাণীর বাচ্চারা যেভাবে মায়ের সঙ্গে খেলা করে, ঠিক একইভাবে এলসা আমার সঙ্গে খেলায় মেতে উঠত।
আমি তাকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ট্রেনিং দিতে লাগলাম। প্রায়ই তাকে কোলে করে জঙ্গলে চলে যেতাম। জঙ্গলে ছেড়ে দিলেই এলসা কেমন যেন হয়ে উঠত! সে অস্থির হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করত। আমার কাছ থেকে ছুটে গিয়ে সে ঢুকে যেত কোনো ঝোপে, কিছুক্ষণ অদৃশ্য থাকার পর হঠাৎ অন্য কোনো ঝোপ থেকে সোজা চলে আসত আমার দিকে। এক অস্থির খেলায় মেতে উঠত সে।
এভাবে একসময় এলসা আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। অপর দিকে তখন বন বিড়ালটাকে নিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়ার জন্য পারিবারিকভাবে আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তখন আমি এলসাকে ছাড়া একদিনও থাকার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। সেই ছোটকাল থেকে যাকে আমি বড় করে তুলেছি, তাকে কী করে আমি দূরের জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দিই? সে যে রাতের বেলা আমার সঙ্গেই ঘুমায়।
এলসা মুক্ত অবস্থায়ই থাকত। আর আমাদের বাড়ির হাঁস-মুরগি শেষ করতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। সমস্যা কঠিন আকার ধারণ করল, যখন তার দৃষ্টি পড়ল প্রতিবেশীদের হাঁস মুরগির ওপর। হাঁস-মুরগির আওয়াজ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তেজিত হয়ে ছুটে গিয়ে আক্রমণ করত। এটা অবশ্য বন বিড়ালদের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই এলসাকে নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াল। আমার বাড়ির লোকজন এলসার উপস্থিতি মেনে নিলেও প্রতিবেশীরা তার অত্যাচার মেনে নিবে, এটা ভাবা যায় না। অনেকে আছেন, পোষা হাঁস-মুরগি যাদের আয়ের একটি অংশ।
আমি পড়ে গেলাম ভীষণ বিপাকে। বুঝলাম এলসাকে এখন থেকে বন্দী করে রাখতে হবে। জানালায় স্টিলের নেট দেওয়া, বিশেষ এক কামড়ায় তাকে বন্দী করে রাখলাম। কিন্তু ফলাফল হলো ভয়াবহ। বন্দিত্ব তাকে যেন উন্মাদ করে দিল, নাক-মুখ-দাঁত রক্তাক্ত হয়ে গেল স্টিলের নেট ভাঙতে গিয়ে। বাধ্য হয়ে আবার তাকে বাইরে ছেড়ে দিতে হলো।
তখনই ঘটল বিশেষ ঘটনা। ছাড়া পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ি থেকে একটু দূরের একজনের মোরগের মাথা কামড়ে ধরল। মোরগের মালিক লাঠি নিয়ে এলসাকে মারতে এলে আমি তাকে বন্দুক নিয়ে তাড়া করি। তারপর এলসা কোলে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।
মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝতে পারলাম, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে, সেটা যতই নির্মম হোক।
সেই রাতে এলসাকে একটা বড় চটের ব্যাগে ভরে ব্যাগটা রাখলাম মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ারে। এরপর মোটরসাইকেলসহ নদী পার হয়ে চললাম গজারিবনের উদ্দেশে। ছোট্ট তুলতুলে এলসাকে আমি এমনি করে চটের ব্যাগের ভেতর ভরে একদিন গজারিবন থেকে নিয়ে এসেছিলাম। আজ কিশোর বয়সী সেই এলসাকে তেমনি করে চটের ব্যাগে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি গজারিবনের দিকে। হেডলাইটের আলোয় লাল মাটির চড়াই-উতরাই পথ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম বনের ভেতর দিয়ে। এভাবে চলতে চলতে বেশ ঘন একটা গজারিবনের কাছে এসে পৌঁছলাম। মোটরসাইকেলটা একপাশে রেখে এলসাকে ব্যাগ থেকে বের করে কোলে তুলে নিলাম। বুনো সরুপথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম গজারিবনের গভীর থেকে গভীরে। সে সময় আকাশে ছিল শুক্রপক্ষের পরিষ্কার চাঁদ। বুনো জোছনায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সমস্ত জঙ্গল।
বুনো জোছনার সবুজ অন্ধকারের আরণ্যক পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা জায়গায় এসে থামলাম। এলসাকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলাম জঙ্গলের এই গভীর পরিবেশ তাকে বেশ উত্তেজিত করে তুলেছে। সে চারদিকজুড়ে ছোটছুটি করতে লাগল। আমি গাছের বুকে বসে রইলাম। চাঁদের ফুটফুটে আলোয় চারদিকের সমস্ত দৃশ্য আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।
এলসা দৌড়ে একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ছে আবার কিছুক্ষণ পর ছুটে আসছে আমার কাছে। আমার কাছে এসেই লেজ উঁচিয়ে চারপাশ ঘুরে আমাকে আদর করতে লাগল। আমি মনে মনে ভাবলাম, সে এখনো জানে না কিছুক্ষণের মধ্যে আমি তাকে এই গভীর জঙ্গলে একা রেখে চলে যাব। এরপর তার পরিণতি কী হবে? আমি তাকে শিকার ধরার যেটুকু ট্রেনিং দিয়েছি, সেটুকু দিয়ে কি সে এই জঙ্গলে টিকতে পারবে? জঙ্গলে দুর্বলের কোনো স্থান নেই, একমাত্র অভিজ্ঞ এবং শক্তিমানেরাই এখানে টিকে থাকতে পারে।
এবার এলসা যখন আমাকে আদর করে দৌড়ে গিয়ে একটা ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন হঠাৎ উঠে আমি প্রচণ্ড জোরে দৌড়াতে লাগলাম জঙ্গলের পাশে রাখা মোটরবাইকের উদ্দেশ্যে। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় মোটরসাইকেলের পাশে এসে থামলাম। তারপর দ্রুত বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। বুকে তখন তীব্র কষ্টের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সেই কষ্টের তুলনা করা চলে একমাত্র সন্তানহারা পিতার কষ্টের সাথে। মুখ ফুটে কান্না আসছে কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি না। কেন কাঁদতে পারছি না বুঝলাম না। হয়তো এলসার প্রতি আমার ভালবাসার মধ্যে কোনো খাদ ছিল।
মনজুড়ে তখন শুধুই এলসার ভাবনা। সে যখন ঝোপের ভেতর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে এসে দেখবে আমি নেই, তখন কী ভাববে সে? অজানা অচেনা এই জঙ্গলে এলসা কি টিকে থাকতে পারবে? মনে মনে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এলসা, আমার এলসা, আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও।
অনেকটা পথ চলে আসার পর বাইক থামিয়ে দূরে ফেলে আসা জঙ্গলের দিকে তাকালাম, চাঁদের আলোয় স্নাত সমস্ত গজারিবন যেন পরিণত হয়েছে রূপকথার এক মায়াপুরীতে। এক দৃষ্টিতে মোহান্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম জঙ্গলের দিকে। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কিছু কথা, 'হে অরণ্য, তোমার বুকেই এলসার জন্ম, তুমি তার প্রকৃত রক্ষাকারী। তাই তোমার বুকেই তাকে রেখে গেলাম। আমার এলসাকে তুমি রক্ষা কোরো।'