তরমুজ কি ভারতবর্ষের আদি ফল!
সুবাসিত, মিষ্টি, রসালো ও শীতল পাকা তরমুজ মানানসই দীর্ঘ ও বিচিত্র স্বাদু ইতিহাস নিয়ে সবচেয়ে মোহনীয় ফলগুলোর একটি হতে পারে। হাজার বছর ধরে মানুষ তরমুজ খাচ্ছে, উপভোগ করছে। কিন্তু কোন মানুষ? কোথাকার মানুষ? কোন তরমুজ? এই বিচিত্র ইতিহাসের জট ছাড়ানো অতিসাম্প্রতিক কাল অবধি বেশ কঠিন ছিল। বছরের পর বছর যেন আফ্রিকা কিংবা ভারত তরমুজ ও মিষ্টি কুমড়োর আদি উৎস হওয়ার ধারণায় বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক মতৈক্য ছিল বলে মনে হয়, কিন্তু ঠিক কোথায় শুরু হয়েছিল, নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ।
উদ্ভিদবিদরা অনেক দিন ধরেই তরমুজের আদি উৎসের বেলায় ধন্ধে ছিলেন। তরমুজের নামের বিপুল বৈচিত্র্যের কারণে সুদূর অতীতে এটির আদি উৎসভূমি থেকে বিস্তৃত হওয়ার কথা অনেকে বিশ্বাস করেন। তরমুজের প্রাচীন মিসরীয় নাম বদদওক—এটি পরে কপ্টিক বেতুক, হিব্রু আভাত্তিহিম এবং আরবি-ফারসি হিন্দেওয়ানি, ইতালীয় কোকোমেরো বা অঙ্গুরিয়া, স্প্যানিশ সান্দিয়া, ফরাসি পাস্তেকে, পর্তুগিজ মেলান্সিয়া ও তুর্কি কারপুযে পরিণত হয়। এই নামগুলো ভিন্ন এবং ভাষাগত বিচারে সম্পর্কহীন মনে হয়, যা বেশ আগেই ইউরোপ ও নিকট প্রাচ্যে তরমুজ ছড়িয়ে পড়ার ধারণার সাথে মেলে। তবে কিছু পরিমাণ অনুসন্ধান থেকে তরমুজের নামের বৈচিত্র্য অনায়াসে ব্যাখ্যার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে: ইতালীয় কোকোমরো শসার লাতিন প্রতিশব্দের একটি রূপ; অঙ্গুুুরিয়া সম্ভবত শসারই গ্রিক-বাইযান্টিয় প্রতিশব্দ থেকে এসেছে। স্প্যানিশ সান্দিয়া এসেছে আরবি বাত্তিখ-আল-সিন্দির শেষাংশ থেকে; অন্যদিকে ফরাসি পাস্তেকে নিশ্চিতভাবে বাত্তিখ থেকে উদ্ভূত। পর্তুগিজ মেলান্সিয়া 'মেলোন' থেকে এসেছে আর তুর্কিরা মিষ্টিকুমড়োর ফারসি নাম থেকে কারপুয নিয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রথম নজরে সুপরিচিত তরমুজের নামের বৈচিত্র্য গোলমেলে ঠেকলেও নিবিড় পর্যবেক্ষণে সেটা আর তত উল্লেখযোগ্য মনে হয় না।
অনেক বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন তরমুজ এসেছে ভারত থেকে। এখানে এটি অবাধে মরুভূমিতে মানিয়ে গেছে। অবশ্য এখানে বুনো প্রজাতির দেখা না মেলায় অবাক হয়েছেন তারা। তবু তরমুজের কিছু নাম এর ভারতীয় উৎসের কথা বলে, যেমন মধ্যযুগীয় আরবি বাত্তিখ-আল-সিন্দি (কিংবা আল-হিন্দি) এবং ফারসি হিন্দেওয়ানি। সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী লিন্নায়াস মনে করেন, তরমুজ দক্ষিণ ইতালি থেকে এসেছে; অন্যদিকে আঠারো শতকের মহান সুইস উদ্ভিদবিজ্ঞানী আলফোন্সে পিরামাস দে খ্যান্দোর ধারণা এটি এশিয়ায় উদ্ভূত। আবার ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোন আফ্রিকান কালাহারি মরুভূমিতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে সহসা বৈজ্ঞানিক ইতিহাস তৈরি করে বসেন। ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন:
'তবে মরুভূমির সবচেয়ে বিস্ময়কর গাছ 'কেঙউই বা কেমে' (কাকুমিস কেফার), মানে তরমুজ। যেসব বছর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়, দেশের বিশাল অংশ আক্ষরিক অর্থেই এইসব তরমুজে ভরে যায়...আর মানুষসহ সব জাতের পশু এই দরাজ জোগান উপভোগ করে...অবশ্য এসব তরমুজের সবই খাদ্য নয়; কিছু আছে মিষ্টি, বাকিগুলো এত তেতো যে কৃষকরা এগুলোর নামই রেখেছে করলা। স্থানীয়রা খুদে কুড়ালের আঘাতে ফাটানোর পর জিভের স্পর্শে এগুলো থেকে বাছাই করে তারা। এভাবে চটপট করলা আর মিষ্টি তরমুজের পার্থক্য ধরতে পারে। করলা ক্ষতিকর, তবে মিষ্টিগুলো সত্যিই স্বাস্থ্যকর।'
লিভিংস্টোনের পর্যবেক্ষণের ফলে বিজ্ঞানীদের নজর তরমুজের জন্মভূমি হিসাবে আফ্রিকার দিকে ফেরে; বেশির ভাগই ফলটির সত্যিকার আদিনিবাস মহাদেশের দক্ষিণে হওয়ার কথা মেনে নেন। কিন্তু ২০১৪ সালে মিউনিখে চালানো এক জেনেটিক গবেষণার পর জানা গেছে, তরমুজ আসলে আফ্রিকার স্থানীয় ফল নয়।
তরমুজ ও এর নিকট আত্মীয় সাম্মা ও তেতো কোলোসিন্থ (রাখাল শসা)—সবই সাইট্রালাস পরিবারের সদস্য—হাজার হাজার বছর ধরে পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার বুনো ভূমিতে ফলে এসেছে। এখানে বুশম্যান ও অন্যান্য গোত্র এই রসালো ফলটি খায় বলে এটি কেবল খাবার নয়, পানীয়র মূল্যবান উৎসেরও কাজ দেয়। এমনকি আজও এটা যাযাবর বুশম্যানদের জীবনের একটা কেন্দ্রীয় অংশ। একসময় তরমুজ বা এর বীজ উত্তর আফ্রিকায় পৌঁছে যায়। এখানে তা অনেকের বিশ্বাস অনুযায়ী মানিয়ে গেছে। তরমুজের সবচেয়ে প্রাচীন ৬,০০০ বছররের পুরোনো বীজ পাওয়া গেছে মিসরে, অন্যদিকে লিবিয়ায় ৫,০০০ বছরের পুরোনো তরমুজের বীজ পাওয়া যায়। আবার ৫,০০০ বছর পুরোনো তরমুজের খোসা পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। মিসরীয় দ্বাদশ রাজবংশের আমলে (২০০০-১৮০০ খ্রি.পূ.) তরমুজের বীজ ও পাতা পাওয়ার কথা বলা হয়। অন্যদিকে রাজা তুতেনখামেনের সমাধিতে (অনু. ১৩২৫ খ্রি.পূ.) তরমুজের বীজ পাওয়া গেছে।
উত্তর আফ্রিকা থেকে তরমুজ ভারত ও এশিয়ায় পৌঁছায়। অনেকে এই নাটকীয় ভৌগোলিক বিস্তারের ঘটনাটি বেশ আগে, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম সহস্রাব্দে ঘটার কথা বিশ্বাস করেন। অন্যদের দাবি, এটা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে ঘটেনি। ইতিহাসবিদ জে আর ম্যাকনিল তার ভাষায় 'মনসুন এক্সচেঞ্জে'র সময় জোয়ার, বাজরা ও তরমুজের মতো ফসল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম সহস্রাব্দ নাগাদ আফ্রিকায় থেকে ভারতে এসেছে বলে মনে করেন। সংস্কৃত এবং ফারসি ভাষার সাম্প্রতিক ভাষাগত প্রমাণ থেকে মনে হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকের দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারত পারস্যের নিয়ন্ত্রণে আসার সময় এই দুটো জাতির ভেতর তরমুজের বিনিময় ঘটে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে মিষ্টিকুমড়ো—অন্যান্য কুকামিস মেলো ফল—শনাক্ত করা তরমুজের তুলনায় কঠিন। মিষ্টিকুমড়োর পাতলা খোসা বলতে গেলে টেকেনি আর জেনেটিকস ল্যাবরেটরির সাহায্য ছাড়া কোনো একটি সি. মেলোর জাতের বীজকে শুধু মিষ্টিকুমড়োর অনান্য জাতের বীজ নয়, শসার বীজ থেকেও আলাদা করা কঠিন। তবু অনেক বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ আফ্রিকাই তরমুজের আদি উৎস হওয়ার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ২০১০ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানী সুসান রেনার এবং অন্যরা তাদের ডিএনএ গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। এই রিপোর্টে সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়, কুকামিস মেলোর—মিষ্টিকুমড়ো—আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ এবং সম্ভবত হিমালয়ের নিম্নভূমিতেই ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ এবং ১৬০০ সালের মাঝামাঝি সিন্ধু উপত্যকায় এবং খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সালের দিকে মধ্য ভারতে প্রাচীনতম মিষ্টিকুমড়ো পাওয়ার কথা জানা যায়। ভারতের আদিবাসীদের—মুন্ডা নামে পরিচিত—ভাষায় বিভিন্ন জাতের সি. মেলোর (তরমুজ ও এর আত্মীয়দের জন্যেও) বহু নাম ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম সহস্রাব্দে সংস্কৃতভাষী ইন্দো-আর্যরা ভারতে পৌঁছানোর সময় কারভাতা বা সিরভিতাসহ—লাতিন কুকারবিতের মূল—তরমুজের কিছু মুন্ডা প্রতিশব্দ গ্রহণ করে। মুন্ডা ভাষায় খরমুজার একটি সংস্কৃত—আয়ূর্বেদিক নামের মূল আছে বলে মনে হয়, ফলে এটি ৪,০০০ বছর পুরোনো শব্দ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তরমুজ নিশ্চয় বেশ আগেই ভারত থেকে ইরানে গিয়ে থাকবে। রহস্যময় 'দগ্ধ নগরে'—দক্ষিণপুব ইরানের মানুষের ইতিহাসে অন্যতম প্রথম নগরী শাহর-ই-শোখতা—খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ বছর আগের বিপুল পরিমাণ তরমুজের বিচি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই বীজগুলো তরমুজ নাকি সবুজ সবজি কুমড়োর সেটা স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা ইরানকে তরমুজের বৈচিত্র্যের অন্যতম কেন্দ্র মনে করলেও সে বিচারে প্রাচীন পারস্যে বিস্ময়করভাবে তরমুজসম্পর্কিত কম তথ্য মেলে। তবে তথ্যের ঘাটতি থাকলেও পারস্য ভাষা এই ফলটির সাথে দীর্ঘ ও স্থায়ী সম্পর্কের কথা বলে। ভাষাটি খোদ তরমুজ বা এগুলোর বর্ণনা দেওয়া বহু শব্দ ধারণ করছে, যেমন তরমুজ, ছোট কিন্তু সুবাসিত তরমুজ, করলা, কাঁচা তরমুজ, নরম/পচা তরমুজ, তরমুজ ফলনের জায়গা, ইত্যাদি। তরমুজের ফারসি শব্দ খারবুয বা খারবুযা (অর্থ 'বড় শসা/কুকারবিত')—খুব সম্ভবত মুন্ডা/সংস্কৃত কারভাতা থেকে ধার করা শব্দ—পরে পারসিরা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে ভারতে আক্রমণ করার সময় একে সংস্কৃত ভাষায় নতুর রূপে গ্রহণ করা হয়। আজও তরমুজের অন্যতম হিন্দি প্রতিশব্দ খারবুয, কিন্তু পারসি খারবুযের বেশির ভাগ উত্তরসূরি—তুর্কি কারপুয, গ্রিক কারপোউযি, রাশিয়ান করপুয এবং সংস্কৃত খারবুজাসহ—মিষ্টিকুমড়োর চেয়ে বরং তরমুজের কথাই বোঝায়।
ভারত থেকে ঠিক কবে মিষ্টিকুমড়া চীনে পৌঁছেছে সেটা স্পষ্ট নয়। য়েঝিংয়াংয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ বছর আগের এবং শানযিতে খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০ বছর আগের তরমুজের বীজ পাওয়া গেছে, যদিও বীজগুলো চালকুমড়ো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সম্ভবত চীনারা তাদের প্রথম দিকের পশ্চিম যাত্রার সময় মিষ্টিকুমড়ো এবং জেডে পাথর ও সোনা সংগ্রহ করে। উদ্ভিদবিজ্ঞানী টেরেন্স ডব্লু ওয়াল্টার্সের মতে, খরমুজা ও ক্ষীরা পশ্চিমের ঝোউ রাজবংশের আমলে (খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০-৭৭১) 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল-সবজি ছিল। চীনে হান রাজবংশের আমলে (খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬—২২০ খ্রিষ্টাব্দ) তরমুজ সাধারণ হয়ে যাওয়ার কথা আমরা জানি। হান আমলে মমীভূত এক নারীর সাম্প্রতিক অটোপসিতে তার পেট তরমুজের বিচিতে ভরা থাকতে দেখা গেছে (তরমুজের বিচি এখনো এশিয়া ও নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যে একটি জনপ্রিয় খাবার)। কথিত আছে, মার্কিস অব ইস্টার্ন মাউন্ড হান আমলে তার সহায়-সম্পদ খোয়ান, কিন্তু অতি ভালো জাতের তরমুজ ফলিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন।
আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তরমুজের ইতিহাস কিছুটা প্যাঁচাল। পুব আরবে ২৯০০ খ্রিষ্টপূর্বের তরমুজের বীজ পাওয়ার কথা জানা যায়, কিন্তু এগুলো মিষ্টিকুমড়ো নাকি সবজি তরমুজের বীজ—নাকি শসার—এখনো অজানা। মেসোপটেমিয়ায় (এখন ইরাক) ছিল এককালে সুমের নামে পরিচিত দেশটির অবস্থান। এখানকার ভাষার সাথে অন্য কোনো ভাষার মিল নেই। ইতিহাসে এটাই প্রথম লিখিত ভাষা ছিল বলে মনে হয়। এখানে মহান সুমেরীয় আইনদাতা উর-নাম্মুর তার কিংবদন্তির উদ্যানে তরমুজ ও শসার চাষ করার কথা বলা হয়েছে। উর-নাম্মু—২০৪৭—২০৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উরে সুমেরিয় তৃতীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা ও উরের বিশাল যিগুরাত তৈরি করেন—কোনো ধরনের কাকুরবিতের সাথে পরিচিত ছিলেন। সেগুলো সম্ভবত কাকুমিস পরিবারের সদস্য। কিন্তু এই প্রাচীন কাকুরবিত মিষ্টিকুমড়ো, সবজি তরমুজ নাকি শসা ছিল? বিতর্ক জটিল এবং চলমান।
তরমুজ হিসাবে উর-নাম্মু কি খাচ্ছিলেন জানার একটা উপায় তার স্থানীয় সুমের ভাষায় নজর চালানো। প্রাচীন সুমেরদের উকুস নামে একটা শব্দ ছিল, যেটি প্রাচীন সেমিটিক আক্কাদিয় কিস্সু-তে রূপান্তরিত হয়েছে। সাধারণত একে 'শসা' হিসাবে তরজমা করা হয়। (চকিত ঐতিহাসিক টীকা: আক্কাদিয়রা ছিল সুমেরীয়দের উত্তরসূরি এবং বাবিলোনিয়া ও অসিরীয়দের পূর্বসূরি। রহস্যময় সুমেরীয় ভাষার বিপরীতে আক্কাদীয় ভাষা হিব্রু ও আরবির সাথে সম্পর্কিত।) 'পাকা', 'মিষ্টি' ও 'তেতো'সহ এই তথাকথিত উকুস বা কিসসু বা 'শসা'র,' গ্রীষ্ম' ও 'শীতকালীন' দুটো জাতই পরিচিত ছিল। আপনি নিজে কখনো শসা চাষ করে থাকলে 'পাকা' বা 'মিষ্টি' শব্দগুলো সাধারণত শসার সাথে সম্পর্কিত না হওয়ার কথা জানেন। আপনি (কিংবা প্রাচীন সুমেরীয়রা) শসার বদলে তরমুজ ফলিয়ে থাকলে, 'পাকা' এবং 'মিষ্টি'র মতো বর্ণনাই বেশি অর্থপূর্ণ হতো না? এ থেকে ধারণা জাগে যে উকুস ও কিসসু আসলে একধরনের তরমুজ ছিল। এগুলো প্রাচীন সুমের ও আক্কাদ এবং পরে বাবিলোনিয়া ও ইসরায়েলে চাষ ও উপভোগ করা হয়েছে। মোসুলের কাছে তেল তায়ায় এক প্রাচীন আক্কাদীয় খনন কেন্দ্রে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০-১৯৫০) একটি অজানা কাকুরবিতের বীজ পাওয়া গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এইসব বীজ শনাক্ত না করা পর্যন্ত আমরা সম্ভবত সুমেরীয়রা ঠিক কী ধরনের তরমুজ খেতো, জানতে পারছি না।
খ্রিষ্টপূর্ব সাত শতকের মেসোপটেমিয়ায় বাবিলোনীয় রাজা দ্বিতীয় মেরোদাখ-বালাদান একজন বিশিষ্ট উদ্যানবিদ ছিলেন। সুস্বাদু তরমুজ ফলানোর জন্যে বিখ্যাত ছিলেন তিনি। মেরোদাখ-বালাদানের গাছের ফর্দ দেখায়, তিনি কোলোসিন্থ (করলা) ফলাতেন, কিন্তু একে কেউ সুস্বাদু তরমুজ বলবেন, এটা মনে হয় না! তার গাছের তালিকার অন্যান্য কাকুরবিতকে তরমুজ, শসা বা লাউ হিসেবে তরজমা করা যায়। অবশ্য একটি উত্তেজনাকর সূত্র মেলে আশুরবানিপালের (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৮৫-আনু. খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৭) আমলে এক আসিরীয় ভোজসভার দৃশ্যের বর্ণনায়। অতিথিদের সামনে টেবিলে তরমুজের চমৎকার টুকরোর মতো ফলসহ নানান ফল ছিল।
মিসরের তরমুজের ব্যাপারে কী? প্রাচীন কাহিনিতে তরমজু বা কোনো ধরনের কাকুরবিত, সাধারণত শসার উল্লেখ মেলে—কিন্তু এইসব উল্লেখ ধন্ধে ফেলার মতো আলোকিতও করতে পারে। ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন 'রবিনসন ক্রুশো' কাহিনি, মিসরীয় 'দ্য টেল অব শিপরেকড সেইলর', খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ সালের পুরোনো। এটা মিসরে ফারাওয়ের খনিতে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার পথে জাহাজডুবির শিকার এক লোকের কাহিনি। শেষতক তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় তীরে পৌঁছানোর পরের ঘটনা বয়ান করছে সে: 'একটা ঝোপের ভেতর শুয়ে পড়লাম...তারপর মুখে দেওয়ার মতো একটা কিছুর খোঁজে হাতড়ানো শুরু করলাম। ডুমুর আর শস্য, তরমুজ, মাছ আর পাখি পেলাম।' হিব্রু বাইবেলের সংখ্যাবলি ১১: ৫ পঙ্ক্তিতেও একই আভাস পাওয়া যায়: প্রাচীন ইসরায়েলিরা মিসরের জীবনের স্মৃতিচারণায় বিলাপ করে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর সময়: 'মিসরে বিনে পয়সায় খাওয়া মাছ, তরমুজ, শসা আর পেঁয়াজের কলি, পেঁয়াজ, আর রসুনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এখন আমাদের আত্মা শুকিয়ে গেছে...' শত শত বছরের তফাতে এই দুটি বর্ণনায় আমরা যেন মিসরীয়দের তরমুজ আর শসা খাওয়ার কথা জানতে পারছি। কিন্তু তাই কি?
কাকুরবিত গবেষক হ্যারি এস প্যারিস বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন যে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সত্যিকারের শসা ছিল না। এবং 'শসা'র উল্লেখ—হিব্রু, মিসরীয়, রোমান, গ্রিক বা সম্ভবত সুমেরীয় ও অসিরীয় হোক—আসলে চ্যাটে বা চিচিঙ্গা। এই গবেষকেরা বেশ কিছু সূত্রের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন: প্রথমত 'শসা'র দৃশ্যমান বর্ণনা—টাইল, ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে—ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বিভিন্ন প্রাচীন স্থানে শসার বদলে যেন কাঁচা চিচিঙ্গা আর ফুটিই তুলে ধরেছে। আসলে মূল জিনিসটা হলো আঁশ। কাঁচা চ্যাটেকে আবৃত করে রাখা সূক্ষ্ম, কোমল আঁশ বা পশম একে শসা থেকে আলাদা করেছে, খাওয়ার আগে এগুলো অবশ্যই ফেলে দিতে হয়। এই আঁশ বা পশম এত স্পষ্ট যে প্রাচীন হিব্রু পাণ্ডুলিপিতে এগুলো ফেলার কায়দা বাতলানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পশমি আবরণ অন্যান্য জাতের তরমুজে দেখা গেলেও শসায় থাকে না—তবু শসার বহু প্রাচীন ছবিতে স্পষ্টভাবে এই আঁশ দেখিয়েছে, লিখিত নথিতেও বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাচীন বিশ্বের 'শসা'র অন্যান্য লিখিত বর্ণনা একটি দীর্ঘ, পাঁকানো, সাপসদৃশ ফলের কথা বলেছে, শুনে চিচিঙ্গাই মনে হয়। এইসব কাঁচা ফুটির প্রাচীন হিব্রু নাম ছিল (অনেক সময় চিচিঙ্গাও) কিশু (বহুবচনে কিশুইম), নিৎসন্দেহে সেমিটিক আক্কাদীয় কিস্সু, সুমেরীয় উকুস থেকে এসেছে। এসবই আধুনিক ইংরেজিতে 'চ্যাটে'-তে রূপান্তরিত পরবর্তীকালের আরবি কিসা বা কাত্তার সাথে সম্পর্কিত। চ্যাটে হাজার হাজার বছর ধরে আফ্রিকা ও নীল নদ অঞ্চলে ফলেছে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব জুইশ ফুড অনুযায়ী ৪,০০০ বছর আগে মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় লবণ মাখিয়ে ফুটি তরমুজ সংরক্ষণ করা হতো।
সুতরাং, প্রাচীন মিসরীয় 'শসা' আসলে ফুটি বা চিচিঙ্গা হলে মিসরীয় নাবিক আর ইসরায়েলিদের বর্ণনা করা 'তরমুজ' তাহলে কী? এখন বেশির ভাগ পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে তরমুজের মতো মিষ্টিকুমড়ো খ্রিষ্টের জন্মের আগে মিসরে দেখা যায়নি। ইসরায়েলিদের বিলাপে ব্যবহৃত হিব্রু শব্দ আকাক্সিক্ষত তরমুজ আসলে মিষ্টিকুমড়ো হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা হিব্রু বাইবেলের সময় নাগাদ মিসরে তরমুজ চালু হওয়ার প্রমাণের সাথে মেলে। জাহাজডুবির শিকার নাবিকের ক্ষেত্রে গল্পে ব্যবহৃত হিরিওগ্লাফ নাবিকের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মেটানো রসালো ফলটি চাষের তরমুজ ছিল বোঝায়—অবশ্যই মিষ্টিকুমড়ো নয়, সম্ভবত ফুটি।
সুইডিশ অভিযাত্রী ও প্রকৃতিবিদ ফ্রেডেরিক হ্যাসেলকুইস্টের মতে, ফুটিকে 'মিসরীয় তরমুজ' বলা হতো। (স্রেফ বিভ্রান্তি অবাহত রাখতে এগুলো আবার 'শসার রানি' হিসেবে পরিচিত ছিল।) আজকের দিনে ফুটিকে প্রায়শই নরম আর স্বাদহীন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু হ্যাসেলকুইস্ট একমত নন। ১৭৪৯ সালে তিনি লিখেছেন:
ফলটা সামান্য রসালো, শাঁসটুকু প্রায় তরমুজের মতো। অনেকটা মিষ্টি ও শীতল এর স্বাদ। তবে তরমুজের মতো শীতল নয়। মিসরের অভিজাত ও ইউরোপীয়রা এটি সবচেয়ে প্রীতিকর ফল হিসেবে খায়... এখন পর্যন্ত যত দূর জানা যায়, এই গোত্রের এটাই সবচেয়ে ভালো ফল। ইউরোপে যুবরাজ ও অভিজাতরা তাদের বাগানে এগুলো ফলানোর কথা ভাবেন, কারণ এগুলো অবশ্যই তাদের টেবিলে জায়গা করে নেওয়ার উপযুক্ত।
- [সিলভিয়া লাভগ্রেনের 'মেলোন: আ গ্লোবাল হিস্ট্রি' থেকে]