চর কাঁকড়ার ‘যাযাবর’ তরমুজ চাষিরা
একটি কাজের উদ্দেশ্যে কয়েক মাসের জন্য ছোট এক দ্বীপে জড়ো হন কয়েকশো মানুষ। কাজ শেষ হয়ে যাবার পর সেই দ্বীপ ছেড়ে তারা বেরিয়ে পড়েন পরবর্তী গন্তব্যের সন্ধানে।
দ্বীপটির নাম 'চর কাঁকড়া', আর ওই মানুষগুলোর একত্র হওয়ার উদ্দেশ্য হলো তরমুজ উৎপাদন করা।
এই রমজানে আপনার ইফতারের টেবিলে তরমুজগুলো সম্ভবত এই মানুষগুলোই উৎপাদন করেছেন।
লক্ষ্মীপুর ও ভোলার মাঝখানে অবস্থিত, লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং মূল ভূখণ্ড থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের মেঘনা নদীর মাঝ বরাবর একটি দ্বীপ চর কাকঁড়া।
গুগল ম্যাপে এই চর খুঁজে লাভ নেই—কারণ এখনও সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি চরটি।
চলতি বছর স্থায়ী জনবসতিহীন দ্বীপটি ভরে গেছে তরমুজে। চাষিদের একটি দল ৫.৬৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ চরের ১ হাজার একর জমিজুড়ে এই মিষ্টি ফলের চাষ করেছেন।
এই চাষিরা তরমুজ চাষের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান। খুঁজে বের করেন বড় বড় জমি। জমি পছন্দ হলে মালিকদের থেকে কয়েক মাসের জন্য নেন ইজারা। সে জমিতে চাষ করেন তরমুজ।
টানা প্রায় ২৫ বছর ধরে এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তরমুজ চাষ করছেন এই চাষি দল। তাদের চলাফেরায় যাযাবরদের সাথে মিল থাকার কারণে মানুষ তাদের 'যাযাবর চাষি' বলেও ডাকে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে এখন এরকম চাষির সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে।
এ বছর এই চাষিরা তরমুজ চাষের জন্য বেছে নিয়েছেন চর কাঁকড়াকে।
চরের ২০০ জন তরমুজ চাষির সবার বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানার নুরাবাদ গ্রামে। এই চাষিদের অর্ধেকই বিনিয়োগকারী। তারা সবাই নুরাবাদ গ্রামের পাটোয়ারি বংশের বাসিন্দা এবং পেশায় যাযাবর তরমুজ চাষি।
বিনিয়োগকারী চাষিদের একজন দুলাল পাটোয়ারি। ৫০ বছর বয়সি দুলাল ২০০০ সাল থেকে তরমুজ চাষ করছেন। চলতি মৌসুমে মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর জেলার সীমানার চর কাঁকড়ায় একাই ৬৪ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন ১ কোটি টাকা।
তিনি জানান, 'এবার ফলন তেমন ভালো হয়নি। একরপ্রতি গড়ে ১ হাজার ৫০০-র মতো তরমুজের ফলন হয়েছে। আর গড় ওজন ৮-১০ কেজি।'
দুলাল খেত থেকে সরাসরি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে সর্বোচ্চ বড় (১৫ কেজি) সাইজের প্রতি একশো তরমুজ বিক্রি করছেন ৩০ হাজার টাকা। মাঝারি (১০-১২ কেজি) সাইজের একশো তরমুজ বিক্রি করছেন ১৫-২০ হাজার টাকা। আর ছোট (৪-৮ কেজি) সাইজের প্রতি একশো তরমুজ বিক্রি করছেন ৮-১২ হাজার টাকা।
চলতি মৌসুমে প্রায় ৩০ লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন দুলাল।
তরমুজের রাজ্যে পরিণত হয়েছে চর কাঁকড়া
সরেজমিনে চরে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত চরটির বুকের বিশাল তরমুজ খেতে প্রায় ২০০ মানুষ শ্রমিক তরমুজ তুলছেন। কেউ ট্রাক্টর ট্রাকে বোঝাই করছেন। পুরো এলাকা যেন তরমুজের রাজ্য। খেতের মধ্যেই বড় ট্রাক্টর নিয়ে এসে তরমুজ বোঝাই করে নদীপাড়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে ট্রাক্টর থেকে তরমুজ নামিয়ে ট্রলার বোঝাই করছে আরেকদল শ্রমিক।
তরমুজ চাষি দুলাল পাটোয়ারি, রফিক পাটোয়ারি ও হারুন পাটোয়ারি জানান, দলবদ্ধ চাষে অনেক মজা, সুবিধা বেশি। প্রায় ২৫ বছর যাবত তারা এভাবে তরমুজ চাষ করে আসছেন। তাদের ইউনিয়নে প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দার মধ্যে অন্তত ৮-৯ হাজার বাসিন্দা তরমুজ চাষি।
তবে বেশিরভাগ বাসিন্দাই নিজ গ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তরমুজ চাষ করেন। কারণ নিজ এলাকায় এত জমি নেই।
তারা জানান, দলবদ্ধ চাষাবাদে রক্ষণাবেক্ষণে অনেক সুযোগ পাওয়া যায়। নিরাপত্তা থাকে। খরচ কম হয়। সে কারণে দলবদ্ধ হয়ে তারা জেলায় জেলায় ঘুরে তরমুজ চাষ করেন। চার মাস পর বাড়ি ফিরে যান। তরমুজ চাষের উপযোগী জমি পেলে দেশের যেকোনো জেলায় যেতে প্রস্তুত তারা।
তবে ভোলা জেলার বাইরে তাদের সবচেয়ে বেশি যাওয়া হচ্ছে, পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায়। এসব জেলায় প্রচুর খালি জমি রয়েছে। তবে তরমুজ চাষে তাদের পছন্দ নদী তীরবর্তী ও সাগরের দুর্গম চরাঞ্চল।
তরমুজ ব্যবসা
হারুন পাটোয়ারি জানান, তরমুজ চাষের মৌসুম থাকে চার মাস—ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। চলতি মৌসুমে তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় ৪০০ জমি ইজারা নিয়েছেন। পরে এক্সক্যাভেটর মেশিন এনে এই ৪০০ একর জমির চারপাশে উচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছেন, যাতে নদীর লোনাপানি খেতে না আসে।
হারুন জানান, এ বছর তার জমিতে প্রায় ৬ লাখ তরমুজ এসেছে, যার পাইকারি বাজারমূল্য প্রায় ৮-১০ কোটি টাকা।
'মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫০ ভাগ তরমুজ বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি তরমুজ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমরা সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যাব,' বলেন তিনি।
রফিক পাটোয়ারি জানান, প্রতি দেড় একর জমিতে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়। 'ফলন ভালো হলে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়।'
তরমুজ চাষিরা খেত থেকে তরমুজ কেটে ট্রাক্টর দিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে যান। সেখানে ফলগুলো নৌকা ও ট্রলার বোঝাই করেন। এরপর তরমুজ নিয়ে যান মোকামে। ঢাকার যাত্রাবাড়ি, সাভার, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনীতে তরমুজ নিয়ে যান তারা পাইকারি বিক্রির জন্য।
দুলাল, হারুন ও রফিক জানান, আড়ত ও মোকামে তারা সবসময় পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি করেন। তিনটি সাইজে তরমুজ পৃথকরা হয়। প্রতিটি সাইজের দাম ভিন্ন ভিন্ন হয়।
তারা জীবনে কখনও পাইকারি বাজারে কেজি হিসেবে তরমুজ বিক্রি করেননি। তবে মাঝে মাঝে পুরো খেত একসঙ্গে বিক্রি করেন দেন। প্রতি একর সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।
চর কাঁকড়ার জীবন
চাষিরা তরমুজ চাষের জন্য টানা চার মাস তরমুজ খেতেই সংসার পাতেন। এ সময় খেতের বিভিন্ন কোনায় ছোট ছোট ঘর তৈরি করেন তারা। নলকূপও বসান। জমিতে মিষ্টি পানির জন্য ইঁদারা তৈরি করেন। বাসস্থানে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করেন। টয়লেট নিমার্ণ করেন। এমনকি ছোট ছোট ঘরে টেলিভিশনও সংযোগ স্থাপন করেন।
চার মাসের খাবার, নাস্তা, কৃষি যন্ত্রপাতি সবকিছু একসঙ্গে নিয়েই বাড়ি থেকে পাড়ি জমান তারা।
এ যাত্রা শেষ হয় সব তরমুজ বিক্রির পর। বাড়ি ফেরার দিন যেন অন্যরকম আনন্দের দিন।
কোনো কোনো মৌসুমে আবহাওয়া খারাপ হলে লোকসান হয়। তবে বেশিরভাগ সময়েই তাদের ভালো লাভ হয়।
চর কাঁকড়ার 'যাযাবর তরমুজ চাষিরা' বলছেন, তরমুজ যেখানেই চাষ হোক কেন, সারা দেশে তরমুজ চাষিদের মধ্যে প্রথমে রয়েছে দলবদ্ধ তরমুজ চাষিদের গ্রাম নুরাবাদ গ্রাম।
তাদের দাবি, নুরাবাদ গ্রামের চাষিরাই সারা দেশের ৬০ ভাগ তরমুজ উৎপাদন করেন।
আর কোথায় আছে 'যাযাবর চাষি'
শুধু ভোলার নুরাবাদ গ্রামেই নয়, নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় এরকম প্রায় পাঁচ শতাধিক চাষি রয়েছেন। তারাও বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তরমুজ চাষ করেন। বর্তমানে মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর জেলার চর আবদুল্লাহসহ অন্তত ১০টি চর, ভোলার জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর চর এবং নোয়াখালীর অনেকগুলো চরে এভাবেই তরমুজ চাষ করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে তরমুজ চাষের জন্য বিখ্যাত বরিশাল বিভাগ। এ বিভাগের ৬ জেলায় গড়ে প্রতি বছর ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়।
বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়। সারা দেশে তরমুজ উৎপাদনে প্রথম পটুয়াখালী জেলা। এ জেলার উৎপাদন মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩৭.৮ শতাংশ। পটুয়াখালীর গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী, এ দুই উপজেলাতেই প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়ে থাকে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, দলবদ্ধ তরমুজ চাষিদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে চাষাবাদের নতুন বার্তা যাচ্ছে।
'বাজারে ভালো দাম পেলে তরমুজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ভালো মানের তরমুজ বিদেশেও বিক্রি করা সম্ভব,' বলেন তিনি।