ঈদ স্পেশাল | পানির কল সারাই হয়ে গিয়েছে
প্লাস্টিকের বালতিতে টকাস টকাস করে শব্দ হচ্ছে এখন। হঠাৎ কানে এল।
প্রথমবার এত গাঢ় শব্দ হয়নি। একটা টকাস করে শব্দ। পানির শব্দে আমার মনে হলো আমার পানি তেষ্টা পেয়েছে। আমি অনন্যাকে পাশে ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে পানি খেতে খাবার টেবিলের দিকে যাই। যেতে যেতে অনন্যার দিকে চোখ পড়াতে মনে হলো ঠেলে সরানোটা সুবিধার হয়নি। আমার আগে বলা দরকার ছিল, 'এই স্যরি, আমার না পানি পিপাসা পেয়েছে।' বা এ রকম কিছু। কিন্তু তা তো করা হয়নি। এখন কী করা যায় ভাবতে-ভাবতে গেলাসে পানি ঢালি। তারপর হুড়াহুড়ি করে পানি খেতে গিয়ে বিষম খাই। আমার গায়ে পানি পড়ে। অনন্যার দিকে তাকিয়ে দেখি যে সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই একই রকমভাবে তাকিয়ে আছে। তখন আমি বলি, 'সরি।' ফলে অনন্যা আর বুঝতে পারে না যে আমি সরি বলেছি বিষম খাবার কারণে, গায়ে পানি ফেলার কারণে, নাকি আচমকা তাকে ঠেলে উঠে পড়ার কারণে। গোলমাল আরও বাধিয়ে আমি কঁত কঁত করে বাকি পানিটা খেয়ে আবার মেঝেতে পাতা শতরঞ্জিটার উপরে আসি।
যখন আমার রিকশা ঠিক করার কথা তখন আমার বেজায় চা তেষ্টা পেল। চুপসে যাওয়া চারচাকার ভ্যানে চায়ের দোকানটা পাশেই থাকাতে আমার কোনো খোঁজাখুঁজি করতে হয় না। অনন্যা তখন বেশ খানিক দূরে। ওর ফোনটা আমার সামনে ঠিক লালমাথা একটা বয়ামের উপর রাখা। বয়ামের লাল প্লাস্টিকের মাথাখানা কী কী সব অব্যাখ্যাত কারণে কালচে হয়ে আছে। আর তার উপরে ফোনখানা অনন্যা কেন রেখেছিল তার সঠিক কারণ বোঝাও কঠিন। হতে পারে হাত দুটোকে পর্যাপ্ত খালি রাখতে সে ফোনমুক্ত হয়েছে। বেশ খানিক দূরে বলতে সে তখন রাস্তার অন্যপাশে ত্যারছাভাবে একটা মুড়িভাজার দোকানে আছে। সেখান থেকে ঝালমুড়ি বা বারোভাজা কিছু একটা সে কিনবে এবং এসে এই চায়ের দোকানে আসবে। সেখানে সে এক ঠোঙা মুড়ি আমার হাতে ধরিয়ে দেবার পর আবারও ফোনখানা নিজের হাতে নিতে পারবে বলে ধারণা করা যায়। আসলে এই দোকানের কাছে এসে কোনো কারণ ছাড়াই সে দোকানিকে ঝালমুড়ি আছে কি না জানতে চায়। দোকানি চাইলে রাগ করতে পারত। কারণ, এটাকে দেখেই বোঝা যায় যে এটা চা-কলা-বিস্কুটের দোকান। আর এসব দোকানের পাশেই রিকশা থাকে। ফলে সে আমাকে রিকশা ঠিক করতে বলেই রাস্তার ওপারের মুড়িওয়ালার কাছে যায়। আর ফোনটা বয়ামের মাথার উপর রাখে। সম্ভবত আমার জিম্মায় রেখে গেছে। কিন্তু আমার জিম্মাতেই রেখেছে তা অতটা বুঝিনি তখন। আমি তখন দোকানিকে চা দিতে বলি।
এর মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল। বয়ামের মাথার ফোনটা শব্দ তেমন করছে না। কিন্তু একটা ভোঁতভোঁতানি ধরনের শব্দ। তবে ফোনটা নড়তে নড়তে বয়ামের মাথা থেকে পড়ে যাবার চেষ্টা করছে। আমার সম্ভবত কর্তব্য ছিল ফোনটা যাতে লালমাথা বয়াম থেকে কাঁপতে কাঁপতে না পড়ে যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। কিন্তু আমার মনোযোগ গেল কে ফোন করেছে সেদিকে। আমি দেখতেও পারলাম। কিন্তু নাম দেখে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারলাম না ফোনটা ওর বাসার কারো নাকি অন্য কারো। সেই অশান্তিসমেত আমি কাঁপতে থাকা ফোনটার দিকে নজর দিয়েই রাখলাম। ঠিক যখন বয়ামের মাথা থেকে পড়ে যাবে তখনই খপ করে ধরে ফেলতে পারলাম ফোনটা। ধরে ফোনটা হাতে নিয়ে রাখলাম। ভোঁতভোঁতানি থামলে আমি আরেকবার ফোনটার দিকে তখন তাকাই। আমার বাম হাতে ধরা আছে। কিন্তু ততক্ষণে অনন্যার স্ক্রিনলক চলে এসেছে। চা-ওয়ালা চা ঘোঁটা শেষ করে দু-কাপই এগিয়ে দিল। আর অনন্যাও রাস্তা পার হয়ে দুহাতে মুড়িমাখা বা ঘটিভাজা না কিছু একটা নিয়ে এসেছে।
ফলে আমি আর তাকে জিজ্ঞাসা করি না, 'কে ফোন দিয়েছে?' বলি 'তোমার ফোন এসেছিল।'
তাই সে-ও বলে না, 'তোমার এত কৌতূহল কেন?' বলে 'ও তাই নাকি?'
আমি বলি, 'চা খাব, খাবা?'
অনন্যা বলে, 'সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমার না রিকশা ঠিক করার কথা!'
তারপর ফোন নেয় হাতে। ততক্ষণে আমার হাতে একটা মুড়িঠোঙা চালান দিয়ে দিয়েছে। আর একহাতে ঠুসঠাস করে কোনো একটা এসএমএস পাঠায়। আমি বেশিক্ষণ আড়চোখে দেখি না। কিন্তু আমি খুবই বুঝতে পারি যে ফোন করেছিল তাকেই সে এসএমএস-এ নিরস্ত করে। যাকেই করুক। যা বলেই করুক। মুড়ি আর চাসমেত আমি বেশিক্ষণ এই অশান্তি নিয়ে থাকি না। থাকলেও আমাদের চা-ওয়ালা বুঝত কি না সন্দেহ। তবে তার এখন ক্রেতা নেই। তাই সে আমাদের দিকে খানিক বেশি মনোযোগ দিয়ে আছে। অথবা খামোকাই তাকিয়ে আছে, কাজ নেই বলে। তবে সে যদি খামোকা না তাকিয়ে থেকে আমাদের সম্পর্ক-প্রণালি বিষয়ে আগ্রহ নিয়েও তাকিয়ে থাকে তাতেও বিশেষ কোনো অসুবিধা নাই। বস্তুত, এই ধরনের জুটিদের লাগাতার চা খাইয়ে সে অভ্যস্ত হবার কথা। বরং অনন্যা রাস্তার ওপার থেকে নিজ হাতে মুড়িমাখা বা কিছু একটা নিয়ে আসার কারণে সে অপেক্ষাকৃত সক্ষম নারী দেখবার আনন্দে তাকিয়ে থাকতে পারে। আমি বললাম অনন্যাকে সেই কথা।
'তোমার মুড়ি আনা অতিশয় সাবলম্বী কর্মকাণ্ড। দেখো, উনি তোমাকে কদর করে দেখতেছেন। ওনার জন্য মুড়ি আনো নাই ক্যান?'
আমার এই কথা চায়ের দোকানি আর অনন্যা কারো মধ্যেই কোনো বিব্রতি আনে নাই। দোকানি বলল: 'না না মুড়ি খামু না। আমি এ্যামনে দেখতেছি।'
অনন্যা বলল: 'খান না এইখান থেকে। নেন, মেলা আছে।'
দোকানি বলল: 'আমার কি এখন মুড়ি খাওয়ার সময়?'
অনন্যা বলল: 'মুড়ি খাবার আবার সময় কোনটা?'
দোকানি বলল: 'আপনাদের যেমন এখন মুড়ি খাওয়ার সময়।'
একটা প্রায় নিরুপদ্রব পরিস্থিতি কীভাবে কীভাবে নিদারুণ পরিস্থিতি হয়ে পড়ছিল। অন্তত আমার তাই মনে হলো। দোকানি মুড়ি খাবার সময়কাল বোঝাতে আর কোনো দৃশ্যপ্রস্তাব করে নাই, ব্যাখ্যাও দেয় নাই। তার বলার মধ্যেও এমন কিছু নাই যে মুড়ি খাবার সাধারণ কাজটা নিয়ে আমার বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তা করার কারণ ছিল। কিন্তু আমি খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। দোকানি আর কিছু বলত কি না, সে-ই জানে। আমি বলে বসলাম, 'আমাদের মুড়ি খাওয়ার সময় মানে?' অনন্যা আমার চা-খাওয়ার বেগ চাপাতে সম্ভবত খুশি হয় নাই। কিন্তু ওর কিছু ম্যাজিক আছে। কথায় না আগিয়ে সে ঠোঙা বাড়িয়ে দিল দোকানির দিকে। সে ঠিকই দোকানিকে মুড়ি দিতে পারল। মুড়ি দোকানির হাতের তালুতে যাবার পরই আমার মনে হলো আমার আলাপে কোনো রকম খারাপ কিছু ছিল কি না। থাকলে সেইটা পরে অনন্যা ঠিকই বলবে। যখন এইখান থেকে চলে যাব, আর সামনে এই দোকানি থাকবে না। কিন্তু খারাপ কিছু থাকলেও অনন্যা সেই অধ্যায়ের নিষ্পত্তি করে ফেলেছে। দোকানি এক দফা মুড়ি নিয়ে মনস্থির করে ফেলেছে আর নেবে না মুড়ি। তারপর সে নতুন খদ্দের পেয়ে গেল। আমার কথাতে বিরক্ত বা কিছুই বলে মনে হলো না। বা হয়ে থাকলেও সে অনন্যার আপ্যায়নে নিষ্পত্তি করে ফেলেছে।
দোকানিরা এ রকম জুটিদের নিয়ে কী ভাবে তা নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল হয়। সব সময়েই হয়। আজকেও হলো। হয়তো হবু বর-বউ ভাবে। নাকি মাথাব্যথা করে না! ভাবে- 'যা খুশি কর গিয়া। যা খুশি হ গিয়া!' আমি ভাবি এদের কৌতূহল হয় কি না। কিংবা কীভাবে বড়লোক সক্ষম খরিদ্দারদের জীবন নিয়ে কৌতূহল হজম করে দাঁড়িয়ে থাকে এরা। যেন কোনো কৌতূহলই নাই তাদের। কই আমি তো পারি না। আমি তো পাশে একটা তিন বছরের বা তেরো বছরের ছেলে বা মেয়ে থাকলেও না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারব না 'আপনার মেয়ে?' দোকানি যদি জিজ্ঞাসা করত, 'আপনার কী লাগে?' তাহলে কী বলা যেত! নিশ্চয়ই বলতাম 'বন্ধু'। এমনও হতে পারে যে আমাদের ফ্লাট উত্তর 'বন্ধু' হয় বলেই এসব দোকানিরা এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে না। আমার চায়ের শেষ চুমুক দেবার আগেই অনন্যা মুড়িসমেত রিকশা ঠিক করে বসে পড়েছে। ওর হাতে তখন বাকি মুড়ি আর মোবাইল আর ব্যাগ সবই আছে। সম্ভবত ব্যাগের মধ্যে তখন মোবাইল। আমি দোকানিকে চায়ের দাম দিয়ে মুড়ির আরেক ঠোঙাসমেত ওর পাশে এসে বসলাম। রিকশাওয়ালা চালাতে শুরু করার আগেই অনন্যা বলল:
'তোমার চায়ের নেশার সময়-অসময় জ্ঞান নাই, না?'
আস্তে করেই বলেছে। হয়তো রিকশাওয়ালা শুনতে পেলেও পেতে পারে। তবে চায়ের দোকানদার শোনে নাই। আমি বললাম: 'আরে তুমিও তো মুড়ি কিনতে গেলা।'
অনন্যা বলল: 'মুড়ি আর চা এক জিনিস হলো? মুড়ি তো রিকশায় করে খেতে খেতে যেতাম।'
আমি বললাম: 'ওহো তাই তো!'
অনন্যা বলল: 'তুমি আসলে মুডের কোনো পরোয়া করো না।'
ফলে বাকি রাস্তা আমি মুডের পরোয়া করার চেষ্টা করলাম। আমি মুড়ির ঠোঙাটা দুই হাতে আমার কোলের কাছে ধরে রেখে দিলাম। অনন্যা মুড়ি খেতে থাকল, তেমন কথা বলল না। সম্ভবত আমি মুডের পরোয়া করি না বলে। আমি হাওয়া খেতে থাকলাম, তেমন কথা বললাম না। সম্ভবত মুডের পরোয়ার কিছু নমুনা রাখতে। কয়বার ভাবলাম কথা না বললেও মুড়ি ঠোঙাখানা খুলে মুড়ি খেতে থাকাই ভাল আচরণ হবে, ঠিক যেমনটা অনন্যা করছে। কিন্তু অভিযোগটা যেহেতু আমার প্রতি, তাই আমার মুড়ি খাওয়া আর তার মুড়ি খাওয়া এক না-ও হতে পারে। এইসব ভাবতে ভাবতে আমাদের গলির মুখ দেখা যাচ্ছে। মুড়িটা নিয়ে আর যখন নতুন কোনো ভাবনা নাই তখনই অনন্যা বলে উঠল:
'মুড়িটারে জমাই রাখছ ক্যান?'
আমি তাড়াতাড়ি কোলের কাছে জড়ো করে রাখা মুড়ির পোঁটলার দিকে তাকালাম। যেন আমি জানতাম না যে ওর ভিতরে মুড়ি। আমি বললাম:
'ওহো, হ্যাঁ ভুলেই গেছিলাম।'
অনন্যা বলল: 'মুড়ির কথা ভুলে গেছিলা?'
আমি বললাম: 'না মানে ভাবছিলাম, বাসায় গিয়ে আরাম করে খাব।'
অনন্যা বলল: 'ভাবছিলা বাসায় গিয়া আরাম কইরা মুড়ি খাবা?
আমরা বাসায় মুড়ি খাইতে যাইতেছি বাদল?' আমি বলি: 'ওহো তাই তো মুড়ি খাইতে তো যাই না।'
তারপর বেশ তাড়াহুড়া করে মুড়ি খেতে শুরু করি। আমি আর দেখি না যে অনন্যা আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। হয়তো তাকিয়ে নাই। অবশ্য তাকিয়ে থাকার কথা। আমি সেসব না দেখে মুড়ি খাওয়া শুরু করি। আমার মনে হলো বাসায় গিয়ে আরাম করে মুড়ি খাবার ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি খারাপ করে ফেলেছি। এমনকি মুডের পরোয়া না করে চা খাওয়া শুরু করার থেকেও খারাপ হয়েছে এটা। মানে আমি মুডের পরোয়া করার চেষ্টা করে মুড়ি পাহারা দিয়ে বসে থেকে আরও ভুল করেছি। বরং রিকশাতে বসে মুড়িটা খেয়ে ফেলাই যে জরুরি ছিল তা ততক্ষণে আমি বুঝতে পারি। ফলে আমি বাকি রাস্তার মধ্যেই মুড়িটা খেয়ে ফেলার জন্য তাড়াতাড়ি মুড়ি খাই। আমার গায়ে, পাঞ্জাবিতে মুড়ি পড়ে। আমি তাও খেয়ে যাই। অনন্যার দিকে আর তাকাই না।
এর মধ্যেই দেখি মুড়ি শেষ হবার আগেই বাসার সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে পড়ে। রিকশাতে বসেই মুড়ি খাওয়া শেষ করার তাগিদ ছিল আমার। ফলে রিকশাওয়ালাকে আমার বাসার ডিরেকশন অনন্যাই দিচ্ছিল। তাই হবে। মুড়ি শেষ করতে গিয়ে অত কিছু খেয়াল করিনি। যেহেতু রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে গেছে, তাই বুঝলাম অনন্যাই ঠিকঠাক মতো রিকশা দাঁড় করিয়েছে। আচমকা রিকশা দাঁড়ানোতে আমি নেমে পড়তে যাই। রিকশার চৌকাঠে পা বেধে গেল। হয়তো মুড়ি শেষ না করা আর আচমকা রিকশা দাঁড়ানোর কারণে মনোযোগের ঝামেলা হয়েছে। কিংবা দুই হাতে কাঁধের ব্যাগ, মুড়ির ঠোঙা আর পকেট সামলাতে গিয়ে তাল মেলাতে না পেরে হোঁচট খেয়েছি। হোঁচট খেয়ে হাত থেকে মুড়ির ঠোঙা আধখাওয়া অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেল। প্রথমে আমি মুড়িগুলোর দিকে তাকালাম। তারপর ভাবলাম অনন্যার দিকে একবার তাকাই। এরই মধ্যে দেখি রিকশাওয়ালা রাস্তায় পড়ে থাকা মুড়িগুলোর দিকে দুখীভাবে তাকাল। তখন মনে পড়ল আমার ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া দিতে গিয়ে বুঝলাম মুড়ির ঠোঙাটা হাত থেকে পড়ে যাওয়াতে সুবিধাই হলো। ভাড়া দিয়ে আমি অনন্যার দিকে তাকাই, ভিতরে হনহন করে হাঁটি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার কাছে চাবি। আমার দুই সিঁড়ি নিচে অনন্যা। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে অনন্যার দিকে তাকালাম। তারপর বললাম, 'স্যরি।' অনন্যার তখন জানতে চাইবার কথা যে কোনটার জন্য স্যরি আমি। চা খেতে চাওয়া হতে পারে। রিকশাতে মুড়ি না খাওয়া হতে পারে। তারপর তড়িঘড়ি করে মুড়ি খাওয়া হতে পারে। মুড়ি শেষ করতে চেয়ে গা-ময় মুড়ি মাখানো হতে পারে। রিকশায় হোঁচট খাওয়া হতে পারে। মুড়িগুলো রাস্তায় ফেলে দেবার কারণে হতে পারে। অনন্যার দিকে না তাকিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়াতে হতে পারে। কিন্তু অনন্যা সেসব কিছু করল না। অনন্যা হাসল। এক মুখ আলো করে অনন্যা হাসে। তারপর আমার পাঞ্জাবির কোনা ধরে টান দেয়। ছোট্ট টান। আমাকে ফেলে দেবার জন্য নয়। হয়তো নিজে আরও দুই সিঁড়ি উঠবার উছিলায়। তারপর আমার পাঞ্জাবির তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পেটে হাত রাখে। আমি যখন দরজার তালা খুলি, তখন অনন্যার হাতের তালু আমার পেটের উপর রাখা।
মুড়ি খেতে হুড়াহুড়ি করলেও এখন আমি ঠিক হুড়াহুড়ি করার লোক নই। ওগুলো ইংরাজি ফিল্মেই মানায়। মেঝেতে শতরঞ্জি পাতাই থাকে। ঘাড়ের ব্যাগখানা রাখলাম মেঝেতে। অনন্যার ব্যাগটাও আমি নিয়ে রাখলাম। তারপর আমরা শতরঞ্জিতে লেপ্টালেপ্টি করে শুয়েছি। ঠিক তখনই প্লাস্টিকের বালতিতে একটা টকাস করে শব্দ হয়। আর আমি উঠে গিয়ে পানি খাই। অনন্যাকে সরি করি। তারপর আবার লেপ্টালেপ্টি শুরু করি।
কিন্তু এখন শব্দটা অনেক জোরালো আর দ্রুতগতির। কিন্তু এতক্ষণ তাহলে শব্দটা হয়নি কেন? নাকি হচ্ছিল, আমিই অন্যান্য মনোযোগের কারণে ঠাহর করতে পারিনি? কী অশান্তি! অনন্যার খোলা নাভিতে যখন নাক ঘষতে যাব, তখন মনে হলো টকাস টকাস শব্দটা ক্রমশ ছলকানো শুরু করেছে। নিশ্চয়ই বালতিতে কিছু পানি জমেছে। আমি আবারও তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠি। এবারও উঠবার পরই কেবল মনে হলো এভাবে ওঠা ঠিক হয়নি। আমি সরি করব নাকি উঠবার কারণ ব্যাখ্যা করব ভাবতে ভাবতেই দেখি অনন্যা বিদঘুটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ওড়নাটাকে টেনে গায়ের উপর দেবার চেষ্টা করছে। এটা নিশ্চয়ই ঠিক চিন্তিত কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এক সেকেন্ডের জন্য খালি গায়ে ওর ওড়না টানা আর ও রকম চোখে তাকিয়ে থাকা দেখলাম। সরি না করে পাইপটার ছিদ্র বিষয়ে বললাম।
'আর বইলো না, ট্যাপের প্যাঁচে ভেজাল হয়েছে। কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। ঠিক করে আসি।'
অনন্যা কী বলে বা ভাবে তা আর শোনা হয়নি। মানসিক শান্তির জন্য আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। এই টকাস টকাস শব্দটার মধ্যে আমাদের ঠিকমতো শান্তি হচ্ছিল না। মানে আমার হচ্ছিল না। অনন্যা মনে হয় না এই শব্দ নিয়ে আদৌ চিন্তিত। হয়তো ওর কানেই যায়নি। কিন্তু আমার হচ্ছিল। কোনো মুডের পরোয়া আমি করি না তা আসলে ঠিক কথা নয়। বরং, মুডের পরোয়া করি বলেই এখন শান্তিতে ফুর্তিতে সময়টা কাটাতে চাই। একটা পানির ট্যাপের কারণে এই বিকালের আয়োজন মাটি করার মানে হয় না। আমি ওটা সারাই করতে শুরু করলাম। ফোঁটা ফোঁটা পানি আটকানোর জন্য কাপড় আর টেপ দুই-ই বাথরুমে মজুত। যত তাড়াতাড়ি পারি শতরঞ্জিতে ফিরতে হবে আমার।
সারাই করে এসে ঘোষণা দিলাম:
'পানির কল সারাই হয়ে গেছে, আর পড়বে না পানি।'
দেখি অনন্যা জামা-টামা পরে হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছে চেয়ারে। বলল:
'পানি আর পড়বে না তো বটেই বাদল। ভালোই আটকেছো। আমারও পাঠাও গাড়ি চলে এসেছে।'