ভালোবাসার আহার
পুত্র: আমি বাড়ি ফিরে এসেছি অনেক দিন পর। কত দিন আগে চলে গিয়েছিলাম, সেটা বলতে পারব না। ভালো লাগত না বাসায় থাকতে। নেশা করতাম। বাড়িতে ওটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হতো। একদিন গেলাম নেশার আসরে। প্রতিদিন যেভাবে যাই। কিন্তু আর ফিরলাম না। মনে নেই সেটা কবে ছিল।
বাবা: আমার ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল চার বছর আগে। ও নেশা করত। কবে নেশা ধরল জানি না। একদিন বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিলাম। পরে বুঝলাম ও নেশার ঘোরে পড়ে আছে।
মা: বড় সাধ করে ছেলেটাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দিয়েছিলাম। ওর বাবা অনেক তদবির করে ওকে ভর্তি করেছিল। আমার বাবা এমএ পাস করতে পারেনি। ওর বাবাও বিএ পাস। বড় সাধ ছিল ছেলেটা পাস করে বড় কেউ হবে—আসলে তা না, চেয়েছিলাম পাস করুক। ওইটুকুই।
বাবা: ছেলেটা কবে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল, জানি না। তবে একদিন বাসে ওর এক বন্ধুই যখন জিজ্ঞাসা করল, ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে কেন যায় না, তখন কী হয়েছে, কিচ্ছু বুঝলাম না। বাড়ি ফিরে রাতের বেলা ওকে পেলাম। চিৎকার-ঝগড়াঝাঁটি সব হলো। ওর মা বসে কাঁদতে লাগল। কী করব? কী বলব?
মা: এরপর আমি প্রথম কাঁদতে শিখলাম। আগে এটা এতটা জানতাম না। কিন্তু শেষে কান্নাও থেমে গেল। একদিন ছেলেটা রাতে ফিরল না। তারপরের রাতেও ফিরল না। তারপরের রাতেও ফিরল না। তারপরের রাতেও ফিরল না...
বাবা: ও চলে যাওয়ার পর এই চার বছরে দরজায় ছিটকানি লাগাইনি। ভেবেছি যদি কোনো দিন বাড়ি ফিরে আসে। তারপরে দরজা বন্ধ দেখে আবার চলে যায়। পায়ের শব্দের জন্য অপেক্ষা করি প্রতি রাত। ওর পায়ের শব্দ পাইনি কোনো দিন এই চার বছরে।
পুত্র: নেশাই নেশাকে খাওয়ায়। কিনে আনো, বিক্রি করো, লাভ করো, কিনে আনো, নেশা করো... এই ট্রেন চলতেই থাকে। কিন্তু কদিন আগে নেশার আসরে অজ্ঞান হয়ে যাই। বন্ধুরা ভয় পেয়ে হাসপাতালে নেয়। যেটা কদিন ধরে সামান্য পেটব্যথা ছিল, সেটাই পরীক্ষায় ক্যান্সার হয়ে গেল। ডাক্তার বেশ শক্তমক্ত করে বলল, বেশি দিন না-ও বাঁচতে পারি; স্টেজ ৪, বাড়ি চলে যেতে বলল, একগাদা সস্তা ব্যথার ওষুধ হাতে দিয়ে।
মা: চার বছর ছিল না। প্রথম প্রথম বাড়িতে একটু শান্তি ছিল। ওর বাবার সাথে ঝগড়াঝাঁটি নেই। ওর সাথে ঝামেলা নেই। কিন্তু তারপর আমিও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলাম। চার বছর ধরে দুজনে একসাথে একা থাকি। ও নেই তাই আমরাও নেই।
পুত্র: হাসপাতাল থেকে বের হয়ে প্রাণ ভরে নেশা করলাম। নেশা চলে গেলে আবার পেটে ভীষণ ব্যথা ফিরে এল। আবার নেশা করলাম। আবার ব্যথা হলো। খেতে পারতাম না। একদিন যখন আর পারছি না, বাসায় ফিরে এলাম।
বাবা: ও বলেছে ওর ক্যান্সার হয়েছে। ওর মাকে বলতে নিষেধ করেছিল। আমি পারিনি। ওর মা কান্নাকাটি কিছুই করল না। বিছানায় বসে শুধু জিজ্ঞাসা করল, আর কত দিন আছে? একসাথে এত কথা দুজনের মধ্যে এই চার বছরে হয়নি। আমি বললাম, জানি না। ওর মা বলল, বুঝেছি।
পুত্র: এই প্রথম ঘরে বসে নেশা করছি। বাবা পয়সা দেয়, লোকটা বাড়িতে নেশা পৌঁছে দেয়। যখন পেটের ব্যথা বাড়ে, আমি নেশাও বাড়িয়ে দেই। ব্যথা চলে যায়, আবার ফিরে আসে। যেমন আমি চলে গিয়েছিলাম আবার ফেরত এলাম। ব্যথা আমার শরীরে বাস করে। আর আমি বাস করি আমার বাবা-মার বাসায়। যদি কোনো দিন এমন হতো, এখান থেকে আর কোনো দিন যেতে হতো না।
মা: ছোটবেলায় ও যা যা খেতে পছন্দ করত, ওকে সব রেঁধে দেই। ও খেতে পারে না । বমি করে দেয়। আমি বমি পরিষ্কার করি। আবার রাঁধি। ও খেতে পারে না। বমি করে দেয়।
বাবা: রাতের বেলা আমি ওর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওকে দেখি। ও নেশার ঘোরে ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে। ভালো লাগে।
মা: গতরাতে ছেলের ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে উঠে গেলাম। দেখি, ওর বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখছে। আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। এমনভাবে দুজন একসাথে দাঁড়িয়ে থাকিনি অনেক দিন।
বাবা: ওর যখন ব্যথা বাড়ে, তখন ও ড্রাগ নেয়। তখন আমার মনে একটু শান্তি হয়। ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে না। যেই ড্রাগের জন্য চলে যাওয়া, সেই ড্রাগের কাছেই কৃতজ্ঞতা হয়। যখন সময় হলো চলে যাওয়ার, তখন ছেলেটা ফেরত এল। ওকে যেতে দিতে ইচ্ছা করে না।
মা: ও চলে গেলে আমরাও থাকব না। ওর কিছুই থাকবে না আমাদের সাথে। আমি কী নিয়ে থাকব। ওর একটা আঙুল যদি রেখে দিতে পারতাম। ও যখন থাকবে না, তখন ওই আঙুলটাকে আদর করতাম। শিশির মধ্যে যত্ন করে তুলে রাখতাম। যখন আদর করতে ইচ্ছা হতো, ওটা বের করে তাতে চুমু খেতাম।
বাবা: যদি ওর হাতটা কোনোভাবে রেখে দিতে পারতাম। ও চলে যাবার পরে ওই হাতটাকে বুকে নিয়ে প্রতি রাতে শুতে যেতাম।
মা: এমন হয় না, ওকে আমরা কবরই দিলাম না। আমাদের কাছে রেখে দিলাম। যেমন করে আমার মা জলপাই তেলে ডুবিয়ে অনেক দিন ধরে মরা জলপাই রেখে দিতেন।
বাবা: অন্য পথও তো আছে? ছোটবেলায় দেখেছি, কোরবানির মাংস জাল দিয়ে অনেক দিন ধরে রেখে দিতে।
মা: তাহলে তো একটা বড় ডেগ লাগবে। অনেক তেল লাগবে। কাঠ লাগবে। কয়েক দিন ধরে জ্বাল দিতে হবে।
বাবা: আমাদের শরীরে সে চলে যাবে। যত দিন আমরা আছি ও ছেড়ে যাবে না কোথাও। কোথাও যাবে না।
মা: আমরা সবাই আবার একসাথে হয়ে যাব।