কাজী আনোয়ার হোসেন-হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কের রহস্যায়ণ
উথুলি কোনদিকে মনে নাই আর। বিশ একুশ বছর আগে একবার গিয়েছিলাম নির্দিষ্ট একজন মানুষকে দেখতে। উথুলি বাজারে চালের আড়ত মানুষটার। আড়ত দেখে আমি স্তম্ভিত, এত বড়! চালের বস্তা আর চালের বস্তা কেবল। আড়তের এক তরুণ শ্রমিককে দেখলাম বস্তার উপর শুয়ে বই পড়ছে।
স্যান্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গি, কোমরে গামছা, কী বই পড়ছে? আলেক্সান্দার দ্যুমার 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স'-এর কিশোর উপযোগী বাংলা অনুবাদ। সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক বই। 'মাসুদ রানা' সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনী। শীতকালের সেই দুপুরে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।
চট্টগ্রাম গেছি একবার কয়েকজনের সঙ্গে। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে গণরোষে পড়েছি। সঙ্গীসাথি পশুপাখিরা হাওয়া। আমি একা, শূন্য মস্তিষ্ক। হাবার মতো গাড়ি থেকে নেমে পড়ে গেছি জনতার জঘন্য জটলায়। 'রেসিডেন্ট এভিল' ছবির জম্বিদের মতো তারা। খুবলে মেরে ফেলবে এখন আমাকে। টিশার্টের কাঁধের কাছে খামচে ধরল একজন। কী যে বলল। বাজে কথা। সব তবে শেষ!
সেই মুহূর্তে খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে বুক দিয়ে আগলাল এক তরুণ, আমাদের মফস্বল শহরের রসুল ভাইয়ের মতো সে দেখতে। রসুল ভাই এখানে থাকলে নিশ্চয় এভাবে বুকে আগলে আমাকে বাঁচাতো। কিন্তু রাউজানের এক তরুণ, সে কেন? আমি দেশজাতির সেরকম চেনা কোনো মুখ না। কোনোভাবে সেই ত্রাতা তরুণ আমাকে চিনে ফেলেছিল- হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রচ্ছদ করি আমি, সে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে।
বইয়ে পড়া দিনের মতো আশ্চর্য সেইসব বই পড়ার দিন। গ্রুপ করে 'আউট বই' পড়ত স্কুল গোয়িং কলেজ গোয়িং ছেলেমেয়েরা। রোমেনা আফাজের 'দস্যু বনহুর' সিরিজ দিয়ে শুরু হতো, একটু বড় হয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের 'মাসুদ রানা' সিরিজ, হুমায়ূন আহমেদ এবং অন্যদের বই। সেইসব দিন ফিরবে না আর। না ফিরুক বা কেন ফিরবে? সেইসব যায়দিনের জন্য কেউ আফসোস করে না প্রাণের উজ্জ্বল খোরাক যেসব দিন দিয়ে যায়।
ইংরেজি শার্লক হোমস থেকে বাংলা ফেলুদা, পৃথিবীর সকল বইয়ের গোয়েন্দার দ্য গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার হলেন এডগার এলান পো-র মসিয়ো দুপো। সেই মসিয়ো দুপোর নাতিপুতির নাতিপুতি বেশ কয়েকজন আছেন বাংলায়।
কিন্তু জেমস বন্ড ধাঁচের স্পাই থ্রিলার লেখার ঝুঁকি বাংলা কোনো রহস্য লেখক বিদ্যুৎ মিত্রর আগে নেননি। 'মাসুদ রানা' সিরিজের প্রথম কিছু বই ছাপা হয়েছিল বিদ্যুৎ মিত্র নামে। বিদ্যুৎ মিত্র কাজী আনোয়ার হোসেন, স্রষ্টা প্রবাদপুরুষ বাংলা রহস্য সাহিত্যের। রহস্য সাহিত্য করেছেন হুমায়ূন আহমেদও। যোগাযোগ ঘটেছিল তাঁদের।
কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত 'রহস্য পত্রিকা'য় তাঁর প্রথম থ্রিলার লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ- 'অমানুষ'। বিদেশী কাহিনি অবলম্বনে। 'রহস্য পত্রিকা' প্রকাশনার দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। 'অমানুষ'-এর কয়েক বছর পর আবার একটা থ্রিলার লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ- 'সম্রাট'। রচনা: বিদেশী কাহিনি অবলম্বনে। একমাত্র যে হরর উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদ অনুবাদ করেছিলেন সেটাও প্রথম ছাপা হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনী থেকে- উইলিয়াম পিটার ব্লেটির 'দ্য এক্সরসিস্ট'।
রহস্য ধরনের রচনার প্রতি আলাদা আকর্ষণ ছিল হুমায়ূন আহমেদের। বিভিন্ন ধরনের রহস্য গল্প লিখেছেন। তাঁর সম্ভবত শেষ লেখাটাও রহস্য গল্পই। ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থায় লিখেছিলেন। মিসির আলি সিরিজের বই, 'যখন নামিবে আঁধার'। আঁধার নেমে গেছে।
'অমানুষ' বইটা হুমায়ূন আহমেদ উৎসর্গ করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনকে। সম্পর্কের রহস্যায়ণ। কাজী আনোয়ার হোসেন, জন্ম ১৯ জুলাই। হুমায়ূন আহমেদ, মৃত্যু ১৯ জুলাই। তাঁরা আর নাই। তাঁরা আছেন। আরো প্রবলভাবে আছেন, থাকবেন।