স্পাই মাসুদ রানার আসল মানুষটি কে?
১
কাজী আনোয়ার হোসেনের বাঙালি পাঠকের মানস গঠনে অসংখ্য অবদানের শ্রেষ্ঠ সৃজন বাংলাদেশি স্পাই মাসুদ রানা।
প্রথমেই এই প্রশ্ন: দার্শনিক, কিংবদন্তি দাবাড়ু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক কাজী মোতাহার হোসেনের মতো ধ্রুপদি চিন্তার একজন বহুমুখী মানুষের সন্তান কেন থ্রিলার তথা রোমা কাহিনি রচনার দিকে গেলেন?
ছেলেবেলা থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন মিশতেন পাড়ার এবং পাড়ার বাইরের ছেলেদের সঙ্গে। নিত্যযাপিত পরিপার্শ্বের দৈনন্দিনতা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পাহাড় বা সমুদ্রে চলে যাওয়া তাকে খুব টানত। অচেনা জায়গায় অ্যাডভেঞ্চারের জন্য বাড়ি থেকে পালিয়েছেন বন্ধু জুটিয়ে একাধিকবার। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য, বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য তাঁকে টানত। ছোট বোন মাহমুদা খাতুনের এক লেখায় পাই, 'গভীর রাতে বড়দা যখন বাঁশি বাজাতেন, তার সুর পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করত।' তাঁর ওই রচনায় আছে, বড় ভাইয়ের কবুতর পালনের শখের কথা। বাড়ির ছাদে থাকা শত শত কবুতরের আবাসের কথা। বিড়াল অথবা বেজিজাতীয় প্রাণীর আক্রমণে সব কবুতর মরে যাওয়ার পর গভীর ব্যথা পেয়ে ওই শখ থেকে ইস্তফা নেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এম এ পাসের পর বন্ধুরা সবাই যখন চাকরি খুঁজছে হন্যে হয়ে, তিনি দিলেন 'বৈশাখী' নামে চা-বিস্কুটের দোকান। বাড়ির বাইরের দিকে এক কোণে পড়ে থাকা এক ঘরে। একদিন বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছেলেকে লেখার উৎসাহ দিলেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়বার সময় তিনি দুটি রহস্যগল্প লিখেছিলেন। বাবার ভালো লেগেছিল। হয়তো পুত্রের রচনায় যুক্তি বিন্যাস মনের মতো হয়েছিল রাশভারী দার্শনিকের। এইভাবেই 'কুয়াশা' সিরিজের জন্ম।
এ সময়ে, পড়াশোনা শেষ করে বেতারেও নিয়মিত গাইতেন তিনি। তাঁর তিন বোন সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে প্রথম সারিতেই আছেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬-এই আট বছর তিনি ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠের একাধিক গান মানুষের মনে স্থায়ী আসন পেয়েছিল। সিনেমার প্লেব্যাক, বেতার ও দূরদর্শনে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন ১৯৬৭-তে। তত দিনে মনে নতুন স্বপ্নের যুবরাজ, যা সমগ্র জনপদে ছড়িয়ে পড়বে-মাসুদ রানা। স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন তো গানেরই মানুষ। ১৯৬৩-এর মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা। আট হাজার টাকায় ট্রেডল মেশিন, বাকি টাকায় টাইপ সরঞ্জাম। যাকে বলে কাজ করতে করতে শেখা। দুজন কর্মচারী নিয়ে সেবার শুরুর বছরে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই বিভিন্ন অঞ্চলে বই নিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম পেপারব্যাক বইয়ের চিন্তাটা অন্য সবার মধ্যে সঞ্চারিত করবার চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে কুয়াশার প্রথম বই বাজারে এল। হলুদ প্রজাপতির লোগোতে আশ্চর্য সুন্দর এক প্রকাশনীর জন্ম হলো বাংলা ভাষায়, যার প্রতিষ্ঠাতা একাধিক প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
২
কাজী আনোয়ার হোসেন একসময় বনজঙ্গলে পাখি শিকারের প্রতি দারুণ আগ্রহী ছিলেন। নানান জলাশয়ের পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপরিসীম সহিষ্ণুতা নিয়ে বসে থেকে ছিপ দিয়ে মাছ ধরাতেও তাঁর কার্পণ্য ছিল না। এ বিষয়ে তিনি বেশ বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তো, শিকার অভিযানের বন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের আর জি এ রেডিও কোম্পানির পূর্ব পাকিস্তান শাখার ম্যানেজার মাহবুব আমিনের সাথে তাঁর সখ্য হয় ১৯৬৫ নাগাদ। তত দিনে কুয়াশার তিনটি বই বের হয়ে গেছে। বন্ধু আগ্রহে প্রকাশ করায় পড়তে দিলেন। পরবর্তী ঘটনা কাজী আনোয়ার হোসেনের মুখেই শোনা যাক: 'বইগুলো পড়ে পরদিনই ফোন করলেন তিনি, "কী করছেন এখন?" আমি যা-ই করি না কেন, তাঁর পরবর্তী বাক্য হবে আমি জানি, আরে, ধুর! চলে আসেন, ম্যান! চায়ের অর্ডার দিচ্ছি।'
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে (তখনকার জিন্নাহ অ্যাভিনিউ) এক মস্ত দালানের দোতলায় ছিল ওর অফিস। মোটাসোটা, হাসিখুশি মানুষ, একের পর এক সিগারেট খেতেন, খুব খাতির-যত্ন করতেন বন্ধুবান্ধবকে। সেদিন গিয়ে পৌঁছতেই খুব প্রশংসা করলেন বই তিনটির, তারপর একটু থেমে বললেন, তবে, একটা কথা আপনাকে না বললে বেইমানি করা হবে, কিছু মনে করবেন না। এর চেয়ে অনেক, অনেক ভালো বই পড়েছি আমি। আজকের দুনিয়ায় রহস্য-রোমা সাহিত্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই।
ভেবে দেখুন, কেমন লাগে! আমাকে কিনা বলে এসব কিছু হয়নি, পাতে তোলার মতো নয়! বারণ করা সত্ত্বেও রেগে গেলাম। মনকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছি: অর্বাচীন লোক, ও কি জানে বাংলা সাহিত্যের, ওর মন্তব্য উপেক্ষা করাই ভালো। 'আজ আর বসব না, একটু কাজ আছে, বলে উঠে পড়লাম। উনিও উঠলেন, বললেন, চলেন, আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।' ছোট একটা ফিয়াট সিক্স হান্ড্রেড চালাতেন। আমায় নিয়ে সোজা এসে থামলেন স্টেডিয়ামের একটি বইয়ের দোকান 'আইডিয়াস'-এর সামনে। বললেন, 'খুব রেগে গেছেন, না? আসেন, আপনাকে একটা বই উপহার দেই।' ইয়ান ফ্লেমিংয়ের 'ডক্টর-নো' কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। 'এটা পড়ে দেখেন, তারপর আমরা আরও আলাপ করব।' সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে বইটা নিয়ে বিছানায় উঠলাম। 'জেমস বন্ড'-এর কাহিনি। প্রথম তিনটে চ্যাপ্টার পড়েই কান গরম হয়ে গেল আমার লজ্জায়। ছি, কী লিখি আমরা! বইটা শেষ করে ছোট হয়ে গেল মনটা। এত উঁচু মানের থ্রিলার দুনিয়ায় আছে, জানতামই না আমি।
প্রিয় পাঠক, উদ্ধৃতি দীর্ঘ হয়ে গেল। কিন্তু একজন রোমা প্রিয় যুবকের লেখার যাত্রার ঘাত-প্রতিঘাত, নিজেকে আমূল বদলে ফেলা-এসব ইতিহাস জানতে আমাদের সামনে উপাদান বলতে সেই সব মানুষের গল্প, যারা একজন লেখককে বদলে দিতে পারেন কেবলমাত্র সঙ্গ আর পরামর্শ দিয়ে। এই রচনা এখন ব্যক্তিগতের দিকে হাঁটবে। সেই কারণে সম্পূর্ণ নাম না করে লিখব কাজীদা; কারণ, আমরা যারা দীর্ঘদিনের মাসুদ রানার পাঠক, তারা ভালোবেসে, আদর করে, শ্রদ্ধা জানিয়ে ডাকতাম-কাজীদা। শুরু হলো একজন লেখকের নিজেকে বদলে ফেলার যুদ্ধ। পড়তে লাগলেন পৃথিবীর বিখ্যাত থ্রিলার উপন্যাস যেমন অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, ডেজমন্ড ব্যাগলি, জেমস হ্যাডলি চেজ, কলিন ফর্বস, জ্যাক হিগিন্স, লেন ডেইটন, কেন ফলেট। ঢাকায় যাদের বই পাওয়া গেল, কারও বই বাদ রাখলেন না তিনি। এসব পড়তে পড়তেই কাজীদার মনে প্রথম মাসুদ রানার পরিকল্পনা কাজ করা শুরু করল। তিনি চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, রাঙামাটি মোটরসাইকেলে করে ঘুরে আসলেন এবং সময় নিলেন সাত মাস। সাত মাস ধরে প্রবল পরিশ্রমে গড়ে উঠল মাসুদ রানার প্রথম বই। ১৯৬৬ সালের জুন মাসে মাসুদ রানার প্রথম বই 'ধ্বংস পাহাড়' প্রকাশিত হলো। প্রথম বইতে কাজী আনোয়ার হোসেন-আমাদের কাজীদা নিজের নাম লেখেননি, লিখতে চাননি অথবা লেখার সাহস করেননি। তিনি হয়তো দেখতে চেয়েছিলেন পাঠক কেমন করে তাঁর এই নতুন চেষ্টাটি গ্রহণ করে! পাঠক কিন্তু গ্রহণ করল, কেননা ওই সময় এই ধরনের কোনো সাহিত্য ছিল না। মানুষের মনে একধরনের ফেইরি টেইলের অনুভূতি জাগিয়ে তোলা এবং মানুষকে একটা অদ্ভুত অথচ যুক্তিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে আবার সেখান থেকে বের করে আনা-এই টানাপোড়েন বাঙালি পাঠক দেখেনি। মনে রাখতে হবে, তখন সদ্য পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তার আঁচ থেকে রেহাই পায়নি। মানুষের মনে তখন একটা বাইপাসের চিন্তা। নিজের প্রতিদিনকার জীবন থেকে পালিয়ে একটা কল্পজগতে আশ্রয় নিয়ে খানিকটা সময় ভালো থাকার চেষ্টা। সামগ্রিক এই শূন্যতাকেই পূর্ণতায় ভরিয়ে দিলেন দিতে চাইলেন আমাদের কাজীদা।
৩
কিন্তু মাসুদ রানা নাম কি করে এল? যতটুকু বিভিন্ন সূত্রে জানা, সত্যিমিথ্যা যাচাই করা কঠিন! তবে বিষয়টা খানিকটা এরকম: স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন এবং কাজীদা দুজনেরই প্রিয় বন্ধু ছিলেন গীতিকার মাসুদ করিম; বন্ধুকে খুব ভালবাসতেন তারা, তাই তার নামের প্রথম অংশ মাসুদ এবং ছেলেবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংয়ের রানা, এই দুইয়ে আমাদের কল্পনার নায়ক মাসুদ রানা। দ্বিতীয় বই 'ভারতনাট্যম' লিখতে সময় লাগল আরও বেশি-দশ মাস। 'ভারতনাট্যম' বইতে ধ্রুপদি শিল্পের যে ব্যবহার ছিল, তাতে পাঠকেরা বুঝতে পারি আমাদের কাজীদার ধ্রুপদি সঙ্গীত, নৃত্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল। অনেকে বলেন মাসুদ রানার বই বিদেশি বই থেকে কপি করা। কিন্তু রাঙ্গার মা চরিত্রটি, যিনি রানার বিপদ-আপদের সম্ভাবনায় চিরন্তন বাঙালি মায়েদের মতোই সব সময় উদ্বিগ্ন থাকেন, তেমন একটি চরিত্র শুধু অ্যাডাপ্টেশনে কি হয়! কিংবা গিল্টি মিয়া চরিত্রটি, যে কিনা ৩২ বছরের চুরির পেশায় যুক্ত ছিল। রানার সঙ্গে থেকে আমূল বদলে যায়। অদ্ভুত এক খিচুড়ি ভাষায় কথা বলে বিপদের মুখে মাসুদ রানার মতোই গভীর সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোগা এই মানুষটি। আমাদের কিশোর বয়সের কত অসংখ্য দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা এলোমেলো করে দিয়েছিল সোহানা। আমরা যখন আস্তে আস্তে নিজেদের শরীর চিনে উঠছিলাম, তখন কাজীদার দু-একটি ইঙ্গিত আমাদের কি আত্মহারা করেনি! ১৯৭৪ সালে 'বিস্মরণ' বইটি অবলম্বনে মাসুদ পারভেজ অর্থাৎ সোহেল রানা 'মাসুদ রানা' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন কাজীদা। এ ছাড়া 'সিনেমা পত্রিকা' এবং 'জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার'। এই ছবিটি তখনকার সময়ের বিচারে দারুণ থ্রিল এনে দিয়েছিল সবার মধ্যে। এমনকি এখনও ইউটিউবে আমরা যখন এই ছবিটা দেখি, আমাদের ভালো লাগে। বিশ বছরের মাথায় বাংলাদেশ প্রথম প্যাকেজ নাটক পেল। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত নাটক প্রথম নাটক হিসেবে আতিকুল হক চৌধুরীর নির্মাণে 'পিশাচদ্বীপ' অবলম্বনে আমরা দেখি 'প্রাচীর পেরিয়ে'। ১৯৯৪ সালে এই নাটকে অভিনয় করেন মডেল নোবেল ও বিপাশা হায়াত। এই নাটকের নির্মাতা মাসুদ রানাকে বুঝতেই পারেননি, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়। কাঠখোট্টা নোবেলের সুন্দর শরীরের প্রদর্শনী এই নাটকের উপজীব্য হয়ে উঠেছিল। নোবেলের মডেলিং এর ফলে প্রাপ্ত খ্যাতি এই নাটকে ব্যবহার করা হয়েছিল, যার ফলে ইতিহাসে স্মরণীয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এটি আমাদের মনে পড়লেই বিরক্ত লাগে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত 'এম আর নাইন' চলচ্চিত্র নিয়ে যত কম কথা হয়, ততই ভালো।
মাসুদ রানা কেন জরুরি? আমরা প্রতিদিন যেভাবে সময় কাটাই, রাষ্ট্রের নানা রকম নিষ্পেষণ আর ঔদ্ধত্যে আমাদের ত্রাহি ত্রাহি দশা। বাজারে জিনিসের দামের কারণে হাত দেয়া যায় না। একজন সৎ লোকের এ দেশে বেঁচে থাকা, পরিবার নিয়ে প্রতিদিন কঠিনতর হয়ে উঠছে। তবে এ পরিস্থিতি শুধু এখনকার না। স্বাধীনতার আগে পরেও এরকম পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম। তখনও কাজী আনোয়ার হোসেন বিশ্ব রাজনীতির সাথে তাল রেখে একের পর এক মাসুদ রানা নির্মাণ করেছেন। তার ফলে আমরা পেয়ে গেছি এক ত্রাতাকে। আমাদের জন্য যে রুখে দাঁড়ায়, প্রাণের ঝুঁকি নেয়, আমাদের ভালোবাসে, যার ওপর নির্ভর করতে পারি আমরা। পাতলা প্রচ্ছদে মুদ্রিত, প্যান্টের পকেটে বহন করবার মতো আকৃতির বইগুলো আমাদের তখন এমন একটা সাহস দেয়-মনে হয় আমরা একা নই। মনে হয় কেউ একজন আমাদের পাশে আছে এবং আমরা দেখি মাসুদ রানা বন্ধুত্বকে খুব গুরুত্ব দেয়, শত্রুর শেষ রাখে না। দেশপ্রেমে নিষ্ঠা তার কাছে শেষ কথা। কাজী আনোয়ার হোসেন একজন 'বিরাট শিশু', সব সময় সূর্যমুখী ফুল যেমন সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে, তেমনি নতুন জানার আগ্রহে সারা জীবন সজীব ছিলেন। ছেলেবেলার রোমা প্রিয়তা স ারিত করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত সমগ্র জনপদে। পুরোনো রানার বইয়ের শেষে 'আলোচনা বিভাগ' পড়লেই আমরা দেখব, কাজীদার উইটি আর হিউমারাস উত্তরগুলো। পাঠকের সাথে লেখকের নিখরচার এই সংযোগ চেষ্টা থেকে আমরা কিছু শিখলাম না। আফসোস থেকে গেল।
মাসুদ রানার একটা আক্ষেপ ছিল বিদেশে কোন স্পাই মারা গেলে রাষ্ট্র স্বীকার করে না। দেশ এমনকি তার লাশটাকেও চিনে উঠতে চায় না। আমরা কি শেষ পর্যন্ত কাজীদার প্রতিও একই আচরণ করিনি? যে মানুষটি অন্তত তিনটি প্রজন্মের মানুষকে ধ্রুপদি বই অনুবাদ করে পড়ানো থেকে শুরু করে মাসুদ রানার মতো কাল্ট চরিত্র উপহার দিয়েছেন, তাকে তথাকথিত মূলধারার সাহিত্য স্বীকার করেছে কি? এখনো কি পশ্চাদ্দেশ ভারী সাহিত্যের অধ্যাপকদের কাছে থ্রিলার ব্রাত্য নয়, এই দেশে! তবে এসব পুরস্কার ছাপিয়ে তিনি আমাদের মনে যে আসন পেয়েছেন, তা পুরস্কারজয়ী অনেক সাহিত্যিকের সাতজন্মের স্বপ্ন। কাজীদা নির্মিত মাসুদ রানার ৪৭০ নম্বর বই 'কালবেলা' লিখেছেন পুত্র কাজী মায়মুর হোসেন। আশা করি, চরিত্রটি আরও কিছুকাল আমাদের দৈনন্দিন যন্ত্রণাকে পাশ কাটাতে বন্ধুর মতো পাশে থাকবে।