আনপড়ের কুন্ডেরা
১
লুডভিক কুন্ডেরা, প্রভাববিস্তারী সংগীতজ্ঞ ও পিয়ানোবাদক। তার সন্তান মিলান কুন্ডেরা। বাবা ছিলেন জ্যানাচেক একাডেমি অব মিউজিক অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টের প্রথম অধ্যক্ষ। লেওস জ্যানাচেক, পূর্ব ইউরোপীয় লোকসংগীত, স্লাভীয় সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক সুর সৃজনের এক চেক পথিকৃৎ। (লেও ইউজেন জ্যানাচেক, জন্ম ৩ জুলাই ১৮৫৪-মৃত্যু ১২ আগস্ট ১৯২৮)। বাবা লুডভিকের প্রভাব মিলানের সমগ্র অস্তিত্বে সপ্তসুরে বেজেছে—জীবনজুড়ে। কিশোর কুন্ডেরার জীবন কেটেছে সংগীতের প্রণালিবদ্ধ শিক্ষা এবং সাহিত্য পাঠে। তেইশ বছর বয়সে প্রাগের একাডেমি অব মিউজিক অ্যান্ড ড্রামাটিক আর্টসে সাহিত্য পড়াতে শুরু করেন। শিক্ষক হিসেবে ব্যতিক্রমী ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ধ্রুপদি কোনো বই দিয়ে বলতেন, এই লেখকের মতো এক বা একাধিক বাক্য লিখতে। উধাও হয়ে যেতেন ক্লাসঘর থেকে। সাহিত্যমগ্ন উড়ো সেই ক্লাসঘরে শিক্ষার্থীরা শুষে নিচ্ছে সাহিত্যের রস। ঘণ্টা পাঁচেক পর ফিরে কথা বলতেন ওই বইগুলো নিয়ে। তার সরাসরি ছাত্র বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে—পদ্ধতিটি আদিতে বিরক্তিকর ঠেকলেও সাহিত্যের কলকবজা ঘাঁটা এবং রহস্য অনুধাবনে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। কেননা, তিনি তার মতো না চাপিয়ে সবার মতো নির্মাণচেষ্টার দিকে জোর দিতেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে 'ম্যান: আ ওয়াইড গার্ডেন' (১৯৫৩) কাব্যগ্রন্থ দিয়ে সাহিত্যের বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু হলো তার। কাকতাল এই, একই বছর প্রয়াত হন জোসেফ স্তালিন।
চেক প্রজাতন্ত্রের যে প্রজন্ম ১৯৪৮ সালে সোভিয়েতবাহিত সমাজতন্ত্রের আগমনী গানে আনন্দিত হয়েছিল কুন্ডেরা তাদেরই একজন। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ষাট দশকের সংস্কারবাদী আন্দোলনে যুক্ত হবেন তারা আর নেতৃত্ব দেবেন ১৯৬৮ সালের দুনিয়া কাঁপানো প্রাগ বসন্তে—এই ধারাবাহিকতা তো ইতিহাসনির্দিষ্ট। কেবল কুন্ডেরা নন, 'কুঠার' (দ্য অ্যাক্স, ১৯৬৬) উপন্যাসের প্রণেতা লুডভিক ভাচুলিকও প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। কবি পাভেল কোহৌত, প্রকাশ্য সমাবেশে রাজনৈতিক কবিতা পড়তেন। সমাজতন্ত্র শাসিত ব্যবস্থা তাকেও শান্তি দেয়নি। ইরমান ক্লিমা এবং আর্ন্সট লুস্টিগ শুরুতে স্তালিনের সমর্থক ছিলেন। নাৎসি বন্দিশিবিরে ট্রমাকাতর দিনগুলো থেকে আপাতভাবে রক্ষা পাওয়ায় ভাবলেন স্তালিনই বিশ্বত্রাতা। পরে লুস্টিগ স্তালিন নির্দেশিত ব্যবস্থায় হতাশা বাদে কিছুই পান না। অনেক বছর পরে কুন্ডেরা 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং'-এ লিখবেন: 'ইফ আই ওয়্যার টু রাইট আ নভেল অ্যাবাউট দ্যাট গিফটেড অ্যান্ড র্যাডিক্যাল জেনারেশন, আই উড কল ইট ইন পারসুইট অব অ্যান ইর্যান্ট অ্যাক্ট।' না, তিনি উপন্যাসটি লেখেননি। আত্মায় বহন করে গেছেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। তার অক্ষরেরা নানা ধরনে সেই সব দিনের কথা বিবৃত করে গিয়েছে।
কিন্তু, এসব অনেক পরের কথা। ফিরে আসা যাক, চব্বিশ বছর বয়সের তরুণ কবি মিলান কুন্ডেরার প্রথম কবিতার বই 'ম্যান: আ ওয়াইড গার্ডেনে'। 'মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান'—এই নাম হয় যে কবির প্রথম কবিতার বইয়ের—তাকে নিছক কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী ধরে নিলে ইতিহাসের বিভ্রম ঘটবে।
তিপান্নতে প্রকাশিত হলেও বিশ বছর বয়সে লেখা কবিতাও ছিল ওই সংকলনে। কবিতাগুলো তখনকার বিচারে নিম্ন মানের হলেও এখন সমালোচকরা বলছেন তাতে একটা বিদ্রোহের সুর ছিল। কুন্ডেরা মূর্তি ভেঙে ফেলবেন অনেক, তার ইশারা ছিল এই কাব্যপ্রবাহে। তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন প্রথম বইটির দুর্বলতার ব্যাপারে। 'ইগনোর্যান্স' (২০০২) উপন্যাসে জোসেফ, এক কাল্পনিক চরিত্র, চেক প্রজাতন্ত্রে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে নির্বাসন থেকে। ঘরে খুঁজে পেল 'কমিউনিজমের শুরুর দিকে' তারই লেখা দিনপঞ্জি। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে সে নিজের অতীত ভেবে। উপন্যাস থেকে পড়ি: 'জোসেফ বোঝার চেষ্টা করে কোমল বালকটিকে, নিজের ত্বকের মধ্যে তাকে অনুভব করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। এই মর্ষকামমেশানো আবেগ, পুরো ব্যাপারটি তার রুচি ও স্বভাবের বাইরে। সে দিনপঞ্জি থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে নেয়, একটা পেন্সিল তুলে নিল তারপর, বাক্যটি কপি করতে লাগল 'আমি তার বিষাদে নিমজ্জিত হয়েছি।' অনেকক্ষণ ধরে সে দুটি হাতে লেখা বাক্য পর্যবেক্ষণ করে—অনেক আগের বাক্যটি খানিক শিথিল কিন্তু বর্ণসমাবেশ এখনো একই আকৃতির। এই মিলে যাওয়া আশারহিত, এটি তাকে খোঁচায়, বিপর্যস্ত করে। কেমন করে দুজন পরস্পরের কাছে সম্পূর্ণ আগন্তুক বিপ্রতীপ মানুষের হাতের লেখা একই হয়? কোনো নির্দিষ্ট সারবস্তুতে তার একক ব্যক্তিত্ব এবং এই খুদে কফপ্রতিম ঘৃণ্য মাল একাকার হয়ে যায়?'
অতীতের দিকে ফিরে বিব্রত হওয়া কুন্ডেরার উপন্যাস 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং'-এর প্রধান বিষয়। মিরেক প্রথম বান্ধবীর কাছে বিশ বছর আগে লেখা প্রেমপত্র ফেরত চায় ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার জন্য। এইভাবে অতীতকেও মুছে ফেলতে বাসনা করে। কেননা, অতীত যন্ত্রণা দেয়, বিব্রত করে।
কুন্ডেরা নিজের কাব্যিক উদ্দেশ্য কবিতায় যেভাবে লেখেন—তার নমুনা:
'সাধারণভাবে শান্তি সম্পর্কে
সাধারণভাবে কাজ সম্পর্কে
পার্টি সম্পর্কে সাধারণভাবে
কবি, সকল সাধারণীকরণ ছুড়ে ফেলো
মানুষের কথা বলো।' (প্রাইভেট ড্রামা)
আরেক টুকরো—
'তুমি যাকে বিদ্ধ করতে চাও
পুনরাবৃত্তের ক্রুশকাঠে
বলে ওঠো, চিৎকৃত হও: মানুষ
হলো ক্রমপ্রসারিত বাগান।'
কবি গাইবেন নিজের সুরে। যিনি তন্নিষ্ঠ নন, তার কবিতায় পোকা ধরে। তিনি, কুন্ডেরা লিখবেন, নিজের ক্ষয়ের বিবরণও। স্বনির্বাচিত ধরনে। অন্য কোনো আদেশবাহিত ধরনে কবিতা লিখবেন না। তৎকালীন সোভিয়েত শাসিত চেক প্রজাতন্ত্রের সাহিত্যের মাথাদের মাথাগুলো মোটা ছিল, তাই কেবল মানুষের জয়গান দেখেই তারা প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ হলো।
'মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান'—বইতে সমাজের দশা নিয়ে লিখেছেন তিনি। মানুষ আদতে নিষ্কলুষ, সে যে অপরাধ করেনি, তার জন্যেই দণ্ডিত হয়। তৃতীয় কবিতাবই 'মনোলগ' থেকে কবি হিসেবে তাকে সবাই চিনতে শুরু করে। একটু পেছনে যদি যাই, ১৯৪৮ সালে পার্টি অফিশিয়াল খেপিয়ে দুই সেমিস্টার পরেই বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ছাত্র কুন্ডেরা। এই ঘটনা প্রথম উপন্যাস 'দ্য জোক'-এর প্রেরণা। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরের বছরেই চলচ্চিত্রায়িত হয়। তবে ১৯৬২ সালে প্রথম নাটক 'দ্য ওনার অব দ্য কিজ' ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয়। দর্শকধন্য এই নাটক ইতিহাস হয়ে ওঠে যৌথস্মৃতিতে। সার্ত্রে এই নাটকের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬৮ সালের নাটক 'দ্য ব্লান্ডার' কমিউনিজমের অন্ধকার যুগ বিষয়ে বিবৃতি দেয়। প্রথম গল্পের বই 'লাফেবল লাভস' দিয়ে খ্যাতি শুরু কথাসাহিত্যিক হিসেবে। ১৯৬৫ সালের চলচ্চিত্র 'নোবডি উইল লাফ'-এর মূল চরিত্রে আমরা অভিনেতা কুন্ডেরাকে দেখব। আবার দেখুন, শুরুর গল্প সংকলনে 'আই, মোর্নফুল গড' গল্পটি না রাখলেও ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
২
'মানবিক মহত্ত্বে সুন্দর বিভ্রম সরবরাহ করবার সময়, এই বিষাদগাথা আরাম আনে। কৌতুক আরও বেশি নিষ্ঠুর, এটি দ্বিধাহীনভাবে জীবনের অসাড়তা উন্মোচন করে।'—মিলান কুন্ডেরা
'দ্য জোক' ( ১৯৬৭) এবং 'লাইফ ইজ এলজহোয়্যার' (১৯৬৯)—দুটি উপন্যাস লেখকের সহজাত কৌতুকবোধ আমাদের সামনে স্পষ্ট করে, মানুষের অস্তিত্বের গভীরে ডুব দেয়। কুন্ডেরা জানেন, 'আ চিয়ারফুল ম্যান ক্যান বি নিহিলিস্ট।' তিনি মানেন, 'আশাবাদ মানবজাতির আফিম।'—এতেই বুঁদ হয়ে থাকা মানুষের নিয়তি। মানুষ কেমন করে ইতিহাসে অংশগ্রহণ করে, এই ব্যাপারটিই 'দ্য জোক' উপন্যাসে দেখার এবং একই সাথে এটিও দেখবার, ইতিহাসে ব্যক্তির প্রতিটি পা ফেলা তার আদত উদ্দেশ্য থেকে কতখানি আলাদা। আমাদের মনোবাসনা ইতিহাস শল্যচিকিৎসকের মতো আপাদমাথা উন্মোচিত করে দেয়। কালের ছাপচিত্র একজন সংবেদনসম্পন্ন লেখক বুঝতে পারেন। কত নির্মম হতে পারে আবহমান ইতিহাস, আত্মা বিক্রয়ের মূল্যে অনেক সময় তাকে জানতে হয়।
ধ্বংসযজ্ঞ এবং নিষেধাজ্ঞা আলাদা জিনিস, কুন্ডেরা ভালো করে জানতেন। কোনো সংবাদপত্র, টেলিভিশনের সাথে যুক্ত থাকতেন না। এখন যেমন সকলেই কবি ও সাংবাদিক। গণমাধ্যম তাকে ডেকেও পায়নি। ১৯৬৭ সালে রাইটার্স কংগ্রেসে সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে একটা চিন্তাজাগানো, দ্রোহী এবং সময়ের জন্য জরুরি বক্তব্য দেন তিনি। সময়ের তাপে ও চাপে একজন লেখক কতটা নিষ্করুণ, কুঠার হাতে পরশুরাম হতে পারেন, তার নমুনা হয়ে থাকবে এই বক্তৃতা। এমন আলাপের পর অন্তত দশ বছর আর কিছু না বললেও খুব বেশি অসুবিধা হয় না।
ওয়ারশ প্যাক্ট ট্রুপ, গণতন্ত্রের সাড়ে সর্বনাশ করে ছাড়ল। চেকে সোভিয়েত আগ্রাসন নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে চুরমার করে দিল। ভিনচেজলাস স্কয়ার জ্যান পালাখ নিজেকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দিলেন। চৌরাস্তাটা তাদের থিয়েটারের কাছেই। ভেরা কুন্ডেরা, মিলানের স্ত্রী সেদিন চিন্তিত, লক্ষাধিক মানুষ ভিনচেজলাসে জমায়েত হয়েছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একজন সতীর্থ নাট্যকর্মী পরে স্মৃতিচারণা করছেন, 'প্রবল দীর্ণ, রক্তাক্ত এক মানুষপ্রতিম দাঁড়ানো কুন্ডেরা, বিস্বাদ কফির মতো মলিন নতজানু মুখ-শরীর ভাষায় যেন বলছেন—সব ভেঙেচুরে গিয়েছে, তবু আমি এসেছি, এসো ইতিহাসের টুকরোগুলো জড়ো করি।'
৩
চেকে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর অধ্যাপনার কাজ হারালেন কুন্ডেরা। ওই সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক তথ্যচিত্রে বলেন, 'কোনো কাজ নেই, পাসপোর্ট নেই এমনকি ট্যাক্সি চালিয়ে যে খাবার জোগাড় করব, তারা সে উপায়ও রাখেনি।' প্রাগ বসন্তে অংশ নেয়া বাদে আর কীই-বা করবার ছিল তার। সম্পূর্ণ শূন্যতার মধ্যে থাকতে থাকতে ম্লাডি ভেট পত্রিকায় ভাগ্যরেখাবিষয়ক লেখা লিখতে শুরু করেন। পিটার প্রুজা সম্পাদিত এই সকল ছদ্মনামে লেখা অন্য উপায়রহিত, কোনোরকমে বেঁচে থাকার অবলম্বন। বিনোদনমূলক এই সাহিত্য লিখনপদ্ধতিতে মিশে থাকত ছদ্মকৌতুক এবং সমকালীনতার প্রতি একধরনের সজাগ দৃষ্টিভঙ্গী। একদিন প্রধান সম্পাদক চাইলেন, নিজের ভাগ্যরেখা পড়তে এই নতুন লেখকের লেখায়। লেখা দিলেন এবং সম্পাদক বন্ধু পিটারের চাকরি গেল। টানা চার বছর পিটার প্রুজার খারাপ গিয়েছিল। ১৯৬৫-৭৩, আট বছর কুন্ডেরার কাছে জীবনবীক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত কার্যকর। ১৯৬৯ সালেও তিনি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নিরীক্ষাকে ক্রিটিক করে যাচ্ছিলেন। লিখিতভাবে বলছিলেন, সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত আশা ফলানোর এই প্রকল্প ভুয়া। এই দেশ কার্যত সোভিয়েতের বর্ধিত অংশ হয়ে গিয়েছে। এই বছরেই প্রকাশিত হলো, দ্বিতীয় উপন্যাস 'লাইফ ইজ এলসহোয়্যার'। চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করা এই সময়ের ঘটনা। উপন্যাসটির চরিত্র একজন চরিত্র জারোমিল। সে জানে, ওই স্বপ্ন ছিল মায়া। স্বৈরতন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট আইডিয়ার কেন্দ্রীভূত চাপ তাদের অনুগামীদের স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। ইতিহাসে সংকটকাল উপস্থিত হয় এই হার্মাদ বাহিনীর কারণে। জারোমিল জানে, ভুল আদর্শের প্রতি ভালোবাসা, প্রেম মানুষকে আদতে খুনি করে তোলে। ১৯৭২ সালে তৃতীয় উপন্যাস 'আ ফেয়ারওয়েল ওয়াল্টজ', মূল নাম ছিল এপিলোগ। যেন লেখালেখিতে ক্ষান্ত দিতে চাইছেন। এই দেশে নিষিদ্ধই থাকবেন যেহেতু। সাহিত্যিক অস্তিত্ব অস্বীকৃত ও লুপ্ত হয়ে যাবে। 'জ্যাকুয়েস অ্যান্ড হিজ মাস্টার' নাটকটি ছদ্মনামে লেখা হলো। শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক স্পষ্ট, খোলাখুলি দেখান তিনি। কর্তৃপক্ষ জেনেও কোনো ক্ষতি করেনি। তারা জানত, কুন্ডেরার খ্যাতি বাড়ছে। একটি টুকরো দেখি নাটকটির—
'—আমি অপেক্ষা করছি।
—ভালো। তো, আমায় পথ দেখাও—সামনের দিকে।
—বেশ, কিন্তু এটা কোথায়?
—তোমায় একটা বিশাল রহস্যের কথা বলি। মানব ইতিহাসের আদ্যিকালের এক কৌশল। সামনের দিক সর্বত্র থাকে।'
এই নাটকের এক অভিনেতা স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, কুন্ডেরা প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন একদিন প্রদর্শনীতে আসবেন, শুধু এই কারণে অভিনেতারা সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে সফল করে তুলতেন প্রতিটি মঞ্চায়ন। সহযোদ্ধারা তাকে এতখানি ভালোবাসতেন।
৪
এক চেক সম্পাদকের মতে, 'দ্য জোক' খারাপ উপন্যাস। তাই বিশ্বখ্যাত ফরাসি প্রকাশনা গালিমার ছাপতে রাজি হয়নি। গালিমার তো আর চেক পড়তে পারে না। ভেরা কুন্ডেরা, মিলানের যাপনসঙ্গী আমাদের অবগত করেন এই অজানা ইতিহাস। মুশকিল আসান হয়ে এলেন আন্তোনিন লিম। এই অনুভবী অনুবাদক উপন্যাসটির কিছু অংশ ফরাসিতে অনুবাদ করে সর্বজনমান্য ফরাসি কবি লুই আরাগকে পড়তে দেন। কবি সম্পূর্ণ উপন্যাস পাঠের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার অভিমতের গুরুত্ব ছিল। ক্লদ গালিমার, আদি প্রকাশক, অত্যন্ত সম্মান করতেন তাকে। লিমের তৎপরতার সূত্রেই ক্লদের সাথে মিলানের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। কথাসাহিত্যিকের নানা দুর্বিষহ মুহূর্তে প্রকৃত বন্ধুর মতো সঙ্গ, উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন ক্লদ। একটি ছবিতে দেখি, দুই বন্ধু ছোট জলযানে সমুদ্র ভ্রমণ করছেন। চালকের আসনে ক্লদ আর পাশে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসিতে উজ্জ্বল মিলান। এমন হাসি নিশ্চিত নির্ভর বন্ধুর পাশেই পুষ্পপ্রতিম প্রস্ফুটিত হয় একজন মানুষের মুখে, আত্মায়।
আমরা তাদের বেড়াবার ফাঁকে লুই আরাগ লিখিত, 'দ্য জোক' উপন্যাসের ভূমিকার খানিকটা পড়ে নিতে পারি—
'একটা একদম সাধারণ ঘটনা বা শব্দমালা, সাধারণ এক কৌতুক, প্রায়ই আমাদের সামনে একজন মানুষের চরিত্র খুলে দেখায় জীবন বা মৃত্যুর জন্যে তার যুদ্ধবিবৃতির চাইতেও বেশি করে অথবা অতীতের কিছু নায়কোচিত পুরাণ।'
নানা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে জেরবার কুন্ডেরা লিখছেন—
'আমি সব সময়ই ভাবতাম, একটা প্রেমের গল্প লিখেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ঠিকভাবে বললে, দেশের বাইরে, এই বইটাকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। আমার বিচারমতে, এই ধরে নেয়া অসত্য।'
একাত্তরে একজন মানুষের অভিবাসী বাসনার কথা বললেন 'দ্য ফেয়ারওয়েল ওয়াল্টজ' উপন্যাসে। একজন ক্লান্ত মানুষ। দুই বছর পরে নিজেই আর টিকতে না পেরে দেশ ছাড়লেন। গ্রিক লেখক ল্যাকিস প্রোগুইডিস স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, তার দেশের সামরিক জান্তা পাঁচ বছরের জন্য তাকে জেলে পাঠালে সেখানেই দ্য জোক উপন্যাস হাতে পান। লেখাসম্পর্কিত, সর্বোপরি জীবনসম্পর্কিত তার চিন্তা এই উপন্যাস পাঠের পরেই এক নতুন দিশা পায় বলে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।
আটাত্তরে দুটো ঘটনা ঘটে। 'লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং' প্রকাশিত হয়। চেক নাগরিকত্ব বাতিল হয় তার। চুরাশিতে 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং' উপন্যাসের জুলিয়েত বিনোশে অভিনীত চলচ্চিত্ররূপ তাকে সারা দুনিয়ায় অত্যন্ত পরিচিত করে তোলে। কুন্ডেরার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগেনি। এই সিনেমা তাকে এতখানি বিরক্ত করেছিল নিজের রচনার সিনেমা করবার অনুমতি পরবর্তী সময়ে তিনি আর দিতে চাইলেন না। পরের বছর, পঁচাশিতে সিদ্ধান্ত নেন, সাক্ষাৎকার দেবেন না আর। নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনতে থাকেন। এই সময়ে একটা কৌতুহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটে, যা আগে বা পরে ঘটেনি। নিজের রচনার ফরাসি অনুবাদ দেখে বিরক্ত হয়ে নিজেই ফরাসি শিখে অনুবাদ করতে থাকেন। কুন্ডেরা অনুদিত ফরাসি সংস্করণে লেখা থাকত, সম্পূর্ণ লেখা তিনি দেখে দিয়েছেন। দশ বছর পর প্রকাশ পেল স্লোনেস। নিজের মন্থরগতির জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে ওই উপন্যাসটিতে। দুই হাজার সালকে কেন্দ্র করে দুনিয়া অন্তর্জাল বিপর্যয়, মিলেনিয়াম এ ধরনের শব্দে সরগরম হয়ে ওঠে। আর কুন্ডেরা লিখলেন 'অজ্ঞতা' বা 'ইগনোর্যান্স'। ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়, এই তার এখনকার মনোভাব। তার শেষ দুটো উপন্যাস গালিমার ফ্রান্সে প্রকাশ করেনি। আবারও ফরাসি ক্রিটিক তার সম্পর্কে ভুলভাল বকতে লাগলেন। ইতালি আর কাতালোনিয়ার পাঠক উপন্যাস দুটি পেয়ে ধন্য হলো। তাদের অঞ্চলেই প্রথমবার প্রথম সংস্করণের নতুন বই প্রকাশ পেল।
লা প্লেয়াদা অত্যন্ত অভিজাত প্রকাশনা। তারা সাধারণত জ্যান্ত লেখকদের বই প্রকাশ করে না। কুন্ডেরার জীবদ্দশাতেই দুই খণ্ডে তার রচনা সংকলন তাই দুর্লভ সম্মান। ২০১৩ সালে 'দ্য ফেস্টিভ্যাল অব ইনসিগনিফিক্যান্স' প্রকাশিত হলে, এই বইটিকে ওই সংকলনের সংযোজন অংশে স্থান দেওয়া হয়। আনা কারেনিনোভা, কুন্ডেরার অতি প্রিয় অনুবাদক, তার অনুবাদ করা সব লেখা লেখক নিজে দেখে দিয়েছেন।
উপন্যাস বিষয়ে কুন্ডেরার একটা কথা আমাদের জন্য জরুরি—
'একটি উপন্যাস জন্মবৈশিষ্ট্যের কারণেই, এক আয়রনিক শিল্পশৈলী। এখানে সত্য থাকে লুকানো, অকথিত এবং অনুচ্চার্য। আয়রনি বিব্রত করে, কেবল বিদ্রুপ আর আক্রমণের জন্য নয়। এটি নিশ্চিত দশা থেকে বঞ্চিত করে দুনিয়াটাকে আমাদের সামনে উন্মোচনের মাধ্যমে, শৈলীগত ছদ্মবেশ ধারণ করেই।
৫
আমরা সামান্য রচনাটির শেষ প্রান্তে। কুন্ডেরার মুখেই তার তরুণকালের কথা একবার পড়ে নেওয়া যাক। ফিলিপ রথের সাথে সাক্ষাৎকারে নিজের বিপন্নতার দিনের গল্প করেছিলেন তিনি।
'...তারপর তারা আমায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেদিয়ে দিল। আমি শ্রমিকদের সাথে থাকতাম। এই সময়, ছোট শহরের ক্যাবারেতে একটা জ্যাজ ব্যান্ডে ট্রাম্পেট বাজাতাম। পিয়ানো আর ট্রাম্পেট বাজিয়ে দিন যেত। তার বাদে কবিতা লিখলাম। ছবি আঁকলাম। এই সবকিছুই ছিল বাজে মাল। আমার বলার মতো প্রথম কাজ একটা ছোট গল্প। লাফেবল লাভসের প্রথম গল্প। লেখক হিসেবে যাত্রা ওখান থেকে শুরু হলো। আমি অর্ধেক জীবন কাটিয়েছি প্রায় অচেনা এক চেক বুদ্ধিজীবী হিসেবে।'
আমরা এখন জানি, কুন্ডেরার কথায় সত্যের চেয়ে অভিমান বেশি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি বিবেচিত হচ্ছিলেন চেক পাঠকদের মধ্যে, এক নতুন রুচির কবি হিসেবে যিনি বিদ্রোহে বিশ্বাস করেন।
চলচ্চিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফামুতে সতীর্থরা তাকে ভালোবাসত। শিক্ষাপদ্ধতির অনন্যতা ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় করে তুলেছিল তাকে। পুরো প্রজন্মকেই প্রাণিত করেছিলেন মিলান। অ্যাগনিয়েস্কা হলান্ড এবং মিলোজ ফোরমান—তার সরাসরি ছাত্র। সংক্ষেপে বলা যায়, চেক ফিল্মের নবতরঙ্গ মিলান কুন্ডেরাকে অনিবার্য পথপ্রদর্শক হিসেবে মান্য করে।
প্রথম জীবনে কবি, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রাভিনেতা, চিত্রকর, যন্ত্রসংগীতের নিপুণ শিল্পী, কথাসাহিত্যিক এবং প্রভাববিস্তারী শিক্ষক—একাধিক পরিচয়ের মধ্যে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রিক কুন্ডেরা ও তার জীবনবীক্ষা। হার না মানা মনোভাব। প্রতিষ্ঠানের অন্ধ মতাদর্শভিত্তিক চলমানতার বিপ্রতীপে মূর্তিমান দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ১৯৮১ সালে ফ্রাসোয়া মিতেরা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই দুজন শরণার্থী লেখককে নাগরিকত্ব দেন। কুন্ডেরা,অন্যজন হুলিও কোর্তাসার।
'দ্য জোক' থেকে 'ইনসিগনিফিক্যান্স'—দীর্ঘ যাত্রা কথাসাহিত্যে। 'দ্য জোক'-এ সবচেয়ে পরিচিত বাক্যটি হলো—'সবকিছুই ভুলে যাওয়া হবে অথবা শুদ্ধ করে নেয়া হবে।' আর ইনসিগনিফিক্যান্সে পঞ্চাশ বছর পর লিখলেন—'আমরা এমন এক পৃথিবীতে নিজেদের দেখি, যেখানে সবাই সব ভুলে গেছে। যেখানে কৌতুক করা আর সম্ভব নয়।'
ছোট এক গল্পপুস্তিকা 'বিস্মরণবিরোধী গল্প' প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে, আমার। সীমান্তের ওপার থেকে। তখনো কুন্ডেরা পড়িনি। কেবল বিনোশে ছিলেন বলে সিনেমাটা দেখা। লিখেছিলাম বইতে—'সমাজতন্ত্রের আপাত বিপর্যয়ের পর আমাদের মূল লড়াইটা বিস্মরণের বিরুদ্ধে, যাতে আমরা কিছু ভুলে না যাই।' এইভাবে তৃতীয় বিশ্বের এক আনপড় লেখক এবং কুন্ডেরা একাকার হয়ে যান। তার আলোতে আমাদের আবহমান আত্মামণ্ডলী স্নান করে ওঠে।
[এই রচনাটির জন্য বন্ধুবর এ টি এম গোলাম কিবরিয়া এবং তথ্যচিত্র 'মিলান কুন্ডেরা ফ্রম জোক টু ইনসিগনিফিক্যান্স'-এর কাছে কৃতজ্ঞ।]