মিলান কুন্ডেরার চিঠি, কার্লোস ফুয়েন্তেসের উত্তর
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের বুক রিভিউ বিভাগে কুন্ডেরার এই খোলা চিঠিটি ছাপা হয় ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল সংখ্যায়; পরে কুন্ডেরা তাঁর গদ্যের বই 'এনকাউন্টার'-এ চিঠিটি অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু ফুয়েন্তেসের চিঠিটি সেখানে তিনি রাখেননি, একটি নোট জুড়ে দিয়েছেন, মূল ফরাসি সংস্করণে নোটটি পড়া যায় কিন্তু ইংরেজি 'এনকাউন্টার'-এ জানি না কেন অনুবাদক সেই নোটটি এড়িয়ে গেছেন! 'লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস বুক রিভিউ' অবশ্য কুন্ডেরার চিঠির সঙ্গে ফুয়েন্তেস-লিখিত উত্তর জুড়ে দিয়েছিলেন একই সংখ্যায়। প্রখ্যাত লাতিন আমেরিকান লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেসের ৭০তম জন্মদিন উদ্যাপনের অংশ হিসেবে কুন্ডেরা এই খোলা চিঠিটি লেখেন ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে, একই বছর কুন্ডেরাও ৭০-এ পা রাখেন। চিঠি দুটি এখানে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত হলো।
১. কার্লোস ফুয়েন্তেসকে মিলান কুন্ডেরা
প্রিয় কার্লোস,
আজ আপনার জন্মদিন এবং এ বছর আমারও বার্ষিকী, ৭০-এ পা রাখার; আপনিও ৭০-এ পা রেখেছেন; আমরা, আজ থেকে ৩০ বছর আগে, প্রাগে, প্রথমবারের মতো দেখা করেছি। প্রাগে আপনি এসেছিলেন রুশ আগ্রাসনের মাত্র কয়েক মাস পর, এসেছিলেন হুলিও কোর্তাসার আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে; এসেছিলেন আমাদের পক্ষে কথা বলতে, চেক লেখকদের জন্য আপনাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে।
তার কয়েক বছর পর, প্রাগ ছেড়ে আমি ফ্রান্সে চলে আসি, তখন আপনি ফ্রান্সে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। এখানেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়, বারবার দেখা হয়, কথা হয়; আমরা বন্ধুর মতো সম্পর্কিত হয়ে পড়ি। আমি ছিলাম মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ এক বিক্ষুব্ধ নির্বাসিত লেখক। তখন আপনি আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাকে সমর্থন করেছেন এবং অন্যান্য চেক বন্ধুকেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। বহু বহু দিন আমার স্ত্রী ভেরা আর আমি মেক্সিকো দূতাবাসে আপনার অতিথি হয়েছি, একসঙ্গে আমরা রাত্রি যাপনও করেছি (তখন আমরা প্যারিসে থাকতাম না)। সকালের নাশতার টেবিলের আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে কার্লোস, সেখানে আমরা রাজনীতি নিয়ে খুব কমই কথা বলেছি আর অবিরাম কথা বলেছি কেবল উপন্যাস নিয়ে, আর আমাদের সেসব কথা কোনো দিনও শেষ হয়নি!
ঠিক তখনই কিন্তু আমি মধ্য ইউরোপ-সংক্রান্ত (সেন্ট্রাল ইউরোপ) ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করি, একটা ঘোর তৈরি হয়; বিষয়টি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত (রাশিয়ার দখলদারিত্ব কিংবা অপহরণ) কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণটি বোধ হয় এটিই যে, মধ্য ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা নির্দিষ্টতা, যা সেই মধ্যযুগ থেকে আজও অস্তিত্বমান। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়, একটা সংস্কৃতি কিংবা নিয়তি। একজন হাঙ্গেরিয়ান কিংবা একজন চেকের কাছে ইউরোপের কী অর্থ? হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটি-সমৃদ্ধ অংশে বাস করেছে। ইতিহাসের প্রতিটি পরতে তাদের অবদান আছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের কাছে একটি আধ্যাত্মিক ধারণা। আর আমরা দিনের পর দিন এই নিয়ে কথা বলেছি, কীভাবে অসাধারণ এক মিল মধ্য ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার ভেতর, উভয়ই বারোকরীতির দ্বারা গভীরভাবে চিহ্নিত, একজন লেখকের জন্য যা ম্যাজিক্যাল এবং কল্পনাবিস্তারি স্বপ্নের জাল। অবশ্য ফরাসিদের কাছে তা বিজাতীয়। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে ফ্রান্সে স্যুররিয়ালিজমের জন্ম কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আসলে স্যুররিয়ালিজম শিল্প হিসেবে নয়, আদর্শ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল ফ্রান্সে। আমরা, আপনি আর আমি—বিশ্বের এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে আরেকটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পেয়েছি: মধ্য ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা বিশ শতকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি বিস্তৃত নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে—প্রুস্ত-পরবর্তী উপন্যাসে এবং সেই উপন্যাসের নতুন নন্দনতাত্ত্বিক আলো-হাওয়ায়। প্রথমত, দশের, বিশের এবং তিরিশের দশকে মধ্য ইউরোপে একটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ এসেছিল—কাফকা, মুসিল, ব্রখ এবং গোমব্রোভিজ; তারপর, ষাটের লাতিন আমেরিকায় আরেকটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ দেখা গিয়েছিল।
শিল্পের আধুনিকতা আর উপন্যাস—আমি এ দুটি বিষয় নিয়েই বেশির ভাগ সময় ভেবেছি, নিজেকে গড়ে নিয়েছি। অনুগত থেকেছি। আভঁ-গার্দ
চিন্তাভাবনা উপন্যাসের শিল্পকে সব সময়ই আধুনিকতার বাইরে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, উপন্যাসকে এমন কিছু বিবেচনা করেছে, যার সময় অতিবাহিত হয়েছে; পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আভঁ-গার্দ যখন তাদের নিজস্ব ঔপন্যাসিক আধুনিকতা তৈরি এবং ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিল, তখন তারা বিশুদ্ধ নেতিবাচকতার পথ অনুসরণ করেই এটি করেছিল: উপন্যাস, চরিত্র, প্লট, গল্প এবং (সম্ভব হলে) বিরাম চিহ্ন ছাড়া। ফলে উপন্যাসগুলো গর্ব করে নিজেদের অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। আধুনিক কবিতা কিন্তু কখনোই নিজেকে কবিতাবিরোধী বলে দাবি করেনি। শার্ল বোদলেয়ারের হাত ধরে কাব্যিক আধুনিকতা (পোয়েটিক মডার্নিজম) আমূলভাবে কবিতার এসেন্সের কাছে যেতে চেয়েছে। কবিতা কেবল কবিতাই হবে।
আমি এই নিয়ে কিছুটা ভেবেওছি। আধুনিক উপন্যাসকে আমি অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে নয় বরং অতি উপন্যাস বা অত্যধিক উপন্যাস (আলট্রা নভেল) হিসেবে কল্পনা করেছি। অতি উপন্যাস সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করে, যা শুধু উপন্যাস করতে পারে। অতি উপন্যাস জীবনের সমস্ত অবহেলিত এবং বিস্মৃত সম্ভাবনাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে, উপন্যাসের শিল্প তার চার শতাব্দীর ইতহাসে যা করে এসেছে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়েছে।
২৫ বছর আগে আপনার 'তেরা নস্ত্রা' পড়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি একটি অতি উপন্যাসই পড়েছিলাম। আপনার বইটি প্রমাণ করেছে যে এই এই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব আছে, এই এই জিনিসগুলো থাকতে পারে।
আর তার ১৫ বছর পর আপনার 'ক্রিস্টোফার এখনো জন্মায়নি' উপন্যাসেও সেই একই জাদু খুঁজে পেয়েছি: সমস্ত আকর্ষণীয় সম্মোহন এবং নতুনত্বসহ উপন্যাসের দুর্দান্ত আধুনিকতা।
উষ্ণ আলিঙ্গন, কার্লোস!
২. কার্লোস ফুয়েন্তেসের উত্তর
প্রিয় মিলান,
অবশেষে আমরা দুজনই সত্তরোর্ধ্ব! ব্যাপারটি কী অদ্ভুত, অলীক আনন্দময় আর বিস্ময়কর আমার কাছে যে শেষ পর্যন্ত আমরা এ রকম একটা তাৎপর্যময় বয়সপর্বে পৌঁছেছি! প্রাগে, ৬৮-তে আমাদের সেই আশ্চর্য সাক্ষাৎ—এ এক অন্য রকম স্মৃতি আমার কাছে, মিলান। সাক্ষাতের সেই মুহূর্ত আমি কোনো দিনই ভুলতে পারিনি, যা একই সঙ্গে ট্র্যাজিক এবং উল্লাসময়, সে মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসকে যেন পরিমাপ করা হচ্ছিল। বাস্তবতা তখন বিভ্রমের জায়গা নিচ্ছিল এবং এত সব সত্ত্বেও, আমরা আশাহীন হয়ে পড়িনি। এটি ছিল প্রাগ, প্যারিস এবং মেক্সিকোর বছর। চেকোস্লোভাকিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রোথিত করার মহৎ প্রয়াসকে ক্রেমলিন কমিউনিজমের নামে নৃশংসভাবে দমন করেছিল।
১৯৬৮ সালে যখন হুলিও কোর্তাসার, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কে এবং আমি আপনার সঙ্গে আপনার দেশের গণতন্ত্রের আশা নিয়ে প্রাগে যাই, তখন আমাদের আড্ডার টেবিলে বিভ্রমের দেবদূত এবং দুর্ভাগ্যের শয়তান উভয়কেই আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছিল। পরবর্তী ৩০ বছরে যা কিছু ঘটবে, তা আমরা কেউই আগে থেকে ভাবতে পারিনি। কিন্তু এর মধ্যেই চেকোস্লোভাকিয়ায় রুশ ট্যাঙ্ক, টেটেলোলকোর যুবকদের লাশ আর লাতিন কোয়ার্টারে পুলিশ নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। আমাদের কথাবিনিময় এমনই ছিল প্রিয় মিলান—ইতিহাসকে সত্যিকারভাবে বোঝার জন্য কল্পনার প্রয়োজনীয়তাকে নিশ্চিত করেছে আমাদের কথাগুলো। হ্যাঁ, আমাদের সেদিনের কথাগুলো এটা নিশ্চিত করেছে যে ভাষা ও সমাজের কল্পনাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহিত্য অপরিহার্য; 'কল্পনা' ছাড়া, ভাষা ছাড়া কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না। আমরা মনে করি, একটি উপন্যাস রাজনীতিকে পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু এটুকু আমরা বিশ্বাস করি যে উপন্যাস ছাড়া নারী-পুরুষের জগৎ শুধু জীর্ণশীর্ণ আর অনুর্বরই হবে না, ক্ষমতার ক্রমাগত আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও মানুষ কম প্রতিরোধী হবে, কেননা রাজনৈতিক ক্ষমতা কেবলই নিরঙ্কুশ হতে চায়।
আপনার দীপ্তিমান উপন্যাস, আমার শ্রেষ্ঠ প্রিয় বন্ধু মিলান কুন্ডেরা, আপনার সমস্ত পাঠককে সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং শক্তিশালী কল্পনাশক্তি এবং ভাষা উপহার দিয়েছে। 'দ্য জোক', 'লাইফ ইজ এলসহোয়ার', 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং', 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং', 'ইমর্টালিটি', 'স্লোনেস' এবং 'আইডেন্টিটি'র নিঃসঙ্গ, নির্জন, দিশাহীন এবং প্রতিরোধী চরিত্রগুলোর মাধ্যমে আপনি সেই স্থান (স্পেস) তৈরি করেছেন, যেখানে সকলের কথা বলার অধিকার রয়েছে এবং সেই সময় নিয়ে পাঠকদের ভাবিয়েছেন—যখন সবকিছুই বিস্ময়করভাবে বর্তমান: এখানেই অতীত, এখানেই ভবিষ্যৎ।
আপনার উপন্যাসগুলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে কাজ করে, কর্তৃত্ববাদী প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিকে শক্তিশালীভাবে বাধা দেয়। আপনি কিছুই ভুলতে দেবেন না। আমাদের দুজনেরই প্রিয় লেখক ফকনারের মতো আপনি শুধু ব্যথাকেই বেছে নেন।
আপনি আর আমি আজ নাচছি প্রিয় বন্ধু মিলান, আর এ জন্য আমি আপনার একটি উপন্যাসের নাম বেছে নিয়েছি—বিদায়ী নৃত্য (ফেয়ারওয়েল ওয়লজ); তবে আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছি না, ক্লান্তি কিংবা সন্তুষ্টি নিয়েও পরস্পরকে বিদায় জানাতে যাচ্ছি না। আমরা প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং সম্পূর্ণ অতৃপ্তি নিয়ে আরও বাঁচতে এবং লিখতে চলেছি। কী আনন্দ—আমরা আমাদের ৭০ বছরের সমস্ত কাজ এবং দিনরাত্রিগুলো পরস্পরকে দেখিয়েছি, শুনিয়েছি, ঠিক যেমনটি আমরা গত তিরিশ বছর ধরে করেছি।
আলিঙ্গন এবং শুভকামনা, মিলান