পদ্মার ঢেউ রে...
'পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয়পদ্ম নিয়ে যা যারে
মোর পরাণও বঁধূ নাই, পদ্মে তাই মধু নাই, নাইরে।'
বাংলা ভাষায় লেখা তিনটি নদী-উপন্যাসের নাম যদি তালিকাভুক্ত করতে হয়, তাহলে পছন্দের শীর্ষে 'পদ্মা নদীর মাঝি', মানিক বন্দোপাধ্যায়ের স্মরণীয় উপন্যাস। পদ্মার নাম নিয়েই রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'পদ্মা নদীর মাঝি'।
তারপর এপার বাংলার পাঠক পছন্দ করবেন ঋত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম', ওপার বাংলার পাঠক বলবেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা'। 'কালিন্দী' নামের কালিন্দী নদীভিত্তিক তারাশঙ্করের আরেকটি উপন্যাস রয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'ইছামতি'-ও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। দেবেশ রায়ের 'তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত' এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, আর মহানন্দা নদীর নামেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নদী-উপন্যাস 'মহানন্দা'। প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন 'পদ্মা' আর সমরেশ বসুর উপন্যাস 'গঙ্গা'। মনোজ বসুর নদী-উপন্যাস 'ময়ূরাক্ষী', আলাউদ্দিন আল আজাদের 'কর্ণফুলী', আবু জাফর শামসুদ্দিনের 'পদ্মা মেঘনা যমুনা'। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'কাঁদো নদী কাঁদো', হুমায়ুন কবীরের 'নদী ও নারী' গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো উপন্যাস নদীর নামে নেই সত্য, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে নদীর উপস্থিতি প্রায় সব কটি উপন্যাসেই রয়েছে। 'নৌকাডুবি' উপন্যাসের নৌকাটা ডুবল প্রমত্ত পদ্মায়, যখন নায়ক রমেশ বিয়ে করে ফিরছিল।
গানের নদী, নদীর গান
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-দুজনেই বাণী ও সুরে নদীবন্দনা করেছেন। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের লেখায় উঠে এসেছে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা ভাগীরথী, কোপাই, ইছামতি, গড়াই, আত্রাই, ময়ূরাক্ষী, ধানসিঁড়ি, কালিন্দী, সবরমতি নদী।
নদী রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সংগীতেও
'কী শোভা কী ছায়া গো,
কী স্নেহ কী মায়া গো
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।'
নদী ও সাহিত্য নিয়ে লিখতে গিয়ে হাত বাড়াই রবীন্দ্রনাথের রেখে যাওয়া বিপুল বৈভবের দিকে।
'নদীর জলে রাখিরে কান পেতে
কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।'
রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে নদী নিয়ে কথা বলা সমীচীন হবে না, তিনিই দিয়েছেন স্মরণীয় গান:
'ওগো নদী আপন বেগে পাগলপারা
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধ ভরে তন্দ্রাহারা...
ওগো নদী চলার বেগে পাগলপারা
পথে পথে বাহির হয়ে আপনহারা
আমার চলা যায় না বলা, আলোর পানে প্রাণের চলা
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা।'
'পদ্মার ঢেউ রে...' শচীন দেববর্মনের কণ্ঠে কাজী নজরুল ইসলামের 'পদ্মার ঢেউ রে' শুনে গত শতকের বাংলার বহু মানুষ নদী ও নারীকে নতুন করে চেনে।
'ও পদ্মা রে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ উঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধূয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।
সে প্রেমেরই ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস তারে এই পদ্ম দিস তার পায়
বলিস কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির অন্ধকারে...'
নজরুলের গানে যমুনা: 'ওরে নীল যমুনার জল/ বলরে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম।'
আমাদের শৈশবের পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরা দ্বিতীয় নদীটির নাম মেঘনা। কবি আহসান হাবীবের ছড়া কবিতা:
আমি মেঘনাপাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে...
পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে
মাথার ওপর মুচকি হাসে বিজলি নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
কিন্তু প্রথম নদীটি নামহীন। রবীন্দ্রনাথের লেখা: আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
তার পরপরই শুনি দামোদর নদীর কথা। মায়ের ভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন কলকাতা থেকে মেদেনীপুরে ফিরছেন। দামোদর নদীতে একটি খেয়ানৗকাও তখন আর চলছে না। আকাশভাঙা ঝড় এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্র তাতে দমে যাওয়ার নন। তিনি সাঁতরাতে শুরু করলেন। যখন ভোর হয় হয়, তখন ওপারে পৌঁছালেন। যখন মাকে দেখা দিলেন, মা বললেন, 'আমি জানতাম, তুই আসবি।' দামোদর নদীর ওপর পাকা সেতু। ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে সেতুর ওপর দিয়ে দামোদর পাড়ি দেওয়ার সময় অন্ধকার ঝোড়ো রাতের নৌকাবিহীন দামোদরের কথা আর সন্তরণরত ঈশ্বরচন্দ্রের কথা ভেবেছি।
স্কুলে পড়েছি বুদ্ধদেব বসুর নদীর স্বপ্ন।
'আমারে চেনো না? আমি যে কানাই
ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াব আমরা
পদ্মা মেঘনা কোণে।'
অল্পকাল পরে রবীন্দ্রনাথের হাঁটুজলের নদী আর আমাকে আকর্ষণ করে না। আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে শুনি ভিন্ন এক নদীর বিবরণ: নদীর কূল নাই কিনার নাই। আমার চাই সাগরের মতো নদী। তাকেই বলি অকূল দরিয়া।
কবি জসীমউদ্দীনের সেই গানের নদীটাই আমার নদী:
'আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাইরে
কূল নাই কিনার নাই অথৈ দইরার পানি
সাবধানে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরীরে
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাইরে...।'
আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ঠিক এমনই নদী:
ও নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে/আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাব/
কাহারে শুধাই রে.../বিষম নদীর পানি, ঢেউ করে হানাহানি/ ভাঙা এ তরণী তবু বাই রে।
আরও একটি গান, সেখানে প্রবল স্রোতে নদীর দুই কূল ভাঙতেই থাকে, এই গানটি যে নজরুলের, জেনেছি অনেক পরে।
'একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা
সকালবেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা...।'
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন:
'ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে/
বলো কোথায় তোমার দেশ/
তোমার নেই কি চলার শেষ...।'
তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে: কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে/ প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া/ সোনার বরণ মেয়ে বল কার পথ চেয়ে/ আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।
ফরিদা পারভীন গেয়েছেন আবু জাফরের গান: এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়..।
লোকসংগীতে নদী: নদীর নাম সই অঞ্জনা/ নাচে তীরে খঞ্জনা/ পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি/ আমি যাব না আর অঞ্জনাতে/ জল নিতে সখীলো/ ওই আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি।
আব্দুল আলীম গেয়েছেন: সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কি রে আর/ কূল কিনারা নাই, কূল কিনারা নাই/
পদ্মারে তোর তুফান দেইখা পরাণ কাঁপে ডরে/ ফেইলা আমায় মারিস না তোর সর্বনাশা ঝড়ে..।'
আব্দুল আলীমের কণ্ঠে আরও একটি গান:
রূপালী নদীরে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল/
ও তোর রূপের সোনার নয়ন কোনায় নামছে রূপের ঢলরে...
কিশোর কুমার গেয়েছেন: এই যে নদী যায় সাগরে/ কত কথা শুধাই তারে/ এত জানে তবু নদী কথা বলে না রে বলে না।
আরতী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের গান: নদীর যেমন ঝরনা আছে/ ঝরনারও নদী আছে/ আমার আছ তুমি/ শুধু তুমি।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান মান্না দের কণ্ঠে:
কত না নদীর জন্ম হয়/ আরেকটা কেন গঙ্গা হয় না/
কত না মানুষ জন্ম লয়/ আরেকটা কেন জাত হয় না।
আরতী ও মান্না দের গাওয়া দুটো গানেরই সুরকার নচিকেতা ঘোষ। মান্না দে আরও গেয়েছেন: এ নদী এমন নদী/ জল চাই একটু যদি/ দুহাত ভরে উষ্ণ বালুই দেয় আমাকে/ এ প্রিয়া এমন প্রিয়া/ সোহাগে ভরল হিয়া/ কেবলই বিদ্রুপ আর বাঁকা কথাই বলতে থাকে।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা আর সত্য সাহার সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন: কত যে ধীরে বহে মেঘনা।
রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া লাল চাঁদ বড়ালের গানে যমুনা নদী:
কাদের কূলের বউ গো তুমি/ কাদের কূলের বউ/
যমুনায় জল আনতে যাচ্ছ/ সঙ্গে নেই তো কেউ/
কলসী তোমার যাবে ভেসে/ ওই লাগলে জলের ঢেউ।
গানের বাঁকে বাঁকে নদী।
ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। এই ট্র্যাজিক গানটিকে বন্দী বগা কোথায়?
উড়িয়া যায় চখুয়ার/ পঙ্খী বগীক বলে ঠারে/
ওরে তোমার বগা বন্দী হইছে/ ধরলা নদীর পারে রে।
কুড়িগ্রামের সেই ধরলা নদী শুকনা মওসুমে হেঁটেই পাড়ি দেওয়া যায়।
আমাদের যৌবন আপ্লুত করে রেখেছে নদীর গান: পুরোনো দিনের সিনেমার গান-গঙ্গা যমুনার মিলনের গান।
তু গঙ্গা কে মুঝমে যমুনা কা ধারা/
হো রাহেগা মিলন ইয়ে হামারা তুমহারা রাহেগা মিলন।
গানের শুরুতে বলা হচ্ছে, রাধা একা একা যমুনার তীরে যেয়ো না-একেলে মাত যাইয়ো রাধে যমুনা কে তীর।
ভূপেন হাজারিকা প্রাণ ঢেলে গেয়েছেন: গঙ্গা আমার মা/ পদ্মা আমার মা/ তার দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা-যমুনা।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী লেখকদের কয়েকটি নদী-উপন্যাস।
নাগিব মাহফুজ: 'এড্রিফ্ট অন দ্য নাইল'
ভিএস নাইপল: 'আ বেন্ড অব দ্য রিভার'
ইভো আদ্রে: 'ব্রিজ অন দ্য রিভার দ্রিনা'
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে: 'অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইন্টু দ্য ট্রি'
মিখাইল শলোকভ: 'অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন'
হাইনরিখ বোল: 'ওমেন ইন আ রিভার ল্যান্ডস্কেপ'
হারমান হেসের 'সিদ্ধার্থ', গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড', উইলিয়াম ফকনারের 'এজ আই লে ডায়িং', টনি মরিসনের 'বিলাভড', মিখাইল শলোকভের 'দ্য ডন ফ্লোজ হোম টু দ্য সি'-সব উপন্যাসেই নদীর ভূমিকা স্মরণীয়।
গার্সিয়া মার্কেস এনেছেন রিও ম্যাগদেলেনা নদীর কাহিনি।
আরও নদীগ্রন্থ
আরও কিছু নদীভিত্তিক বিদেশি উপন্যাস, স্মৃতিকথা, আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
মার্ক টোয়েন: 'লাইফ অন মিসিসিপি'। মিসিসিপি নদী আরও উঠে এসেছে মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার এবং হাকলবেরি ফিনের অভিযানে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে: 'রিভার্স অ্যান্ড রিমেমব্রান্স'
স্টেফান জেরোমস্কি: 'দ্য ফেইথফুল রিভার'
টোমাস ওলফ: 'অব টাইম অ্যান্ড রিভার'
এডিথ ওয়ার্টন: 'হাডসন রিভার ব্র্যাকেটেড'
জেমস নগুই: 'দ্য রিভার বিউটইন'
উইলবার স্মিথ: 'দ্য রিভার গড'
মিখাইল শলোকভ: 'হারভেস্ট অন্য দ্য ডন'
গীতা মেহতা: 'আ রিভার সুত্রা'
নরমান ম্যাকলিন: 'আ রিভার রানস থ্রু ইট'
ডেনিস জনস্টোন: 'দ্য মুন ইন দ্য ইয়েলো রিভার'
ক্রিস্টোফার ইশারউড: 'আ মিটিং বাই দ্য রিভার'
পিয়েরে বৌল: 'দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই'
লিলিয়ান হেলম্যান: 'ওয়াচ অন দ্য রাইন'
পাওলো কোয়েলহো: 'বাই দ্য রিভার পিয়েদ্র আই সেট ডাউন অ্যান্ড ওয়েপ্ট'
জন রাস্কিন: 'দ্য কিং অব দ্য গোল্ডেন রিভার'
পল থেরো: 'ডাউন দ্য ইয়াংজি'
এলি উইজেল: 'অল দ্য রিভার্স রান টু দ্য সি'
আমাজন নদী ও আমাজন অববাহিকা উঠে এসেছে জেমস অ্যাক্সলারের 'এমারেল্ড ফায়ার' উপন্যাসে। হাডসন নদীর দেখা মিলবে টোভ বাকের 'দ্য লাস্ট রিভার', ওয়াশিংটন আরভিংয়ের 'লেজেন্ড অব স্লিপি হলো', রেয়মন্ড বিচারের 'আন্ডার থ্রি ফ্ল্যাগস', স্যালি বিঙ্গহামের 'আপস্টেট' উপন্যাসে।
ওয়াশিংটন আরভিংয়ের রিপ ভ্যান উইঙ্কল বহু বছর ঘুমন্ত থেকে জেগে ওঠে হাডসন নদীর তীরে। নীলনদ জীবন্ত হয়ে উঠেছে উইলবার স্মিথের 'রিভার গড', নরমান মেইলারের 'অ্যানশিয়েন্ট ইভনিং' উপন্যাসে।
রাইন, দানিউব, ভোলগা, মিসিসিপি, কঙ্গো, ওয়াহিও, মিয়ামি, সেইন্ট লরেন্স হোয়াংহো ও টেমস নদী প্রেক্ষাপট রচনা করেছে অনেক উপন্যাস-গল্পের।
জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন এ বোট' (এক নায়ে তিনজন, মেহের কবীর অনূদিত) টেমস নদীভিত্তিক অসাধারণ এক রম্য উপন্যাস। পেনেলোপ ফিটজেরাল্ড-এর 'অফসোর', আয়ান সিঙ্কলেয়ারের 'ডাউন-রিভার', চার্লস ডিকেন্সের 'অলিভার টুইস্ট' এবং 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড', কেনেথ গ্রাহামের 'দ্য উইন্ড অব দ্য উইলোজ', জোসেফ কনরাডের 'দ্য হার্ট অব ডার্কনেস', হেনরি জেমস-এর 'পোট্রেট অব আ লেডি' এবং আর্থার কোনান ডয়েলের কয়েকটি রহস্য গল্প ও উপন্যাসে টেমস নদীর সঙ্গে নিবিড় পরিচিতি ঘটে।
বিশ্বসভ্যতা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশে প্রথমদিকে যে কটি নদীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে রয়েছে:
ইউফ্রেটিস: এটাই তুর্কি ভাষায় ফিরাত নেহরি আর আরবি সাহিত্যের ফোরাত নদী। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের মাঝখানের অংশটুকু মেসোপটেমিয়া। এ নদীর জন্ম তুরস্কে, সিরিয়া ও ইরাক হয়ে বিশাল জলস্রোত নিয়ে নেমে আসে পারস্য উপসাগরে।
টাইগ্রিস: তুরস্কের পার্বত্য অঞ্চল থেকে নেমে এসে বাগদাদে মিলিত হয় ইউফ্রেটিসের সঙ্গে। তারপর এ নদীর নাম হয় শাতিল-আরব। কৃষিসভ্যতার লালনভূমি এ দুই নদীর মধ্যবর্তী মেসোপটেমিয়া।
নীল: আফ্রিকান নদ নীল ভিক্টোরিয়া হ্রদে উৎপত্তি হয়ে বৃষ্টিপ্রবণ ইথিওপিয়ার স্রোতোধারাসহ মিসরকে প্লাবিত করে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। নীলনদে ক্লিউপেট্রার নৌবিহারের বর্ণনা আছে রাইডার হ্যাগার্ডের উপন্যাসে, একালে নীলনদ ফিরে ফিরে এসেছে নাগিব মাহফুজের লেখায়, 'এড্রিফট অন দ্য নাইল' গ্রন্থে। আগাথা ক্রিস্টিও রহস্য উপন্যাস 'ডেথ অন দ্য নাইল', তায়েব সালেহর 'সিজনস অব মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ'-এ।
টাইবার: রোম ও রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে টাইবার নদী ঘিরে। অ্যাপেনাইন পর্বতমালায় জন্ম, শেষে সমর্পিত ভূমধ্যসাগরে।
হোয়াংহো: ইয়েলো রিভার নামেই একালে খ্যাত হোয়াংহো। চীনের জন্য এই নদী যত দুঃখের কারণই হোক না কেন, চৈনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ হোয়াংহোকে নিয়েই।
সিন্ধু নদ তো সভ্যতারই সৃষ্টি করেছে। আমাদের নিকটতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সমবয়সী।
ঋগ্বেদে বর্ণিত হয়েছে সরস্বতী নদীর কথা। পবিত্র এই নদী রাজস্থানের মরুভূতিতে শুকিয়ে যায়। সরস্বতীর স্রোত একদা পতিত হতো আরব সাগরে। সভ্যতাই মানুষের গল্পগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে শিখিয়েছে। প্যাপিরাসও এসেছে নদীর উপকূল থেকে।
নদীর শৈশব, নদীর বার্ধক্য
আপনহারা পাগলপারা এই নদীকে মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে মিলিয়েছেন উইলিয়াম মরিস ডেভিস। তার বিবেচনায় পাগলপারা নদী চার ধরনের।
তরুণ নদী: তারুণ্য অবশ্যই বয়সের, আচরণও তেমনি, খাড়া পাড়, শাখানদীর সংখ্যা কম, জলপ্রবাহ দ্রুতগতির। স্রোতোধারা দুই পাশে যতটা না ভাঙে, তলদেশ খোদাই করে গভীরতা বাড়ায় তার চেয়ে বেশি। তারুণ্য তো গভীরে প্রবেশের জন্যই। যেমন ব্র্যাজোস, ট্রিনিটি আর এবরো নদী।
পূর্ণবয়স্ক নদী: এ সময় উন্মাতাল তারুণ্য মিলিয়ে যায়। খাড়া পাড় ঢালু হয়ে আসে, নদী ভাসে দুই কূলে; স্রোতের তীব্রতা হ্রাস পায়, নদীর সঙ্গে যোগ হয় বহুসংখ্যক শাখানদী, ফলে সমুদ্রের প্রাপ্তি অনেক বেশি। যেমন মিসিসিপি, দানিউব, টেমস, ওয়াহিও কিংবা সেইন্ট লরেন্স নদী।
বুড়ো নদী: তারুণ্য ও প্রাপ্তবয়স্ক পর্যায়ের পর আসে বার্ধক্য। এ নদী বিক্ষুব্ধ নয়। এ নদী ধরে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। উচ্ছ্বসিত স্রোতোধারা নেই, ভাঙন সামান্যই, বুড়ো নদীর বর্ণনায় যোগ হয় দুই পাশের প্লাবন অ ল। যেমন গঙ্গা, ইয়েলো, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, সিন্ধু ও নীল-এসব নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একেকটি সভ্যতা।
উজ্জীবিত নদী: বুড়ো প্রাণহীন নদী কখনো ভূগর্ভের টেকটনিক প্লে¬টের বিচ্যুতিতে ভূকম্পনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। রেনেলের তখনকার মানচিত্রে ছিল না, ভূকম্পন সৃষ্টি করেছে খরস্রোতা নদী।
নদীই জননীর মতো জন্ম দিয়েছে সভ্যতার। সাত হাজার বছর আগে সিন্ধু, শাতিল-আরব, নীল, চিয়াং জিয়াংয়ের কোল ঘেঁষে বিকশিত হয়েছে কৃষিসভ্যতা, গড়ে উঠেছে নগর। নদীর ওপর মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপের কারণে পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই নদীরা ভালো নেই।
নদীনির্ভর হয়েই বুদ্ধিমান ও কুচক্রী মানুষ সৃষ্টি করেছে 'হাইড্রলিক এম্পায়ার'-জলশক্তিভিত্তিক সাম্রাজ্য। এ শক্তি সাম্রাজ্যবাদকে প্ররোচিত করে। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত 'ওরিয়েন্টাল ডেসপিটিজম' গ্রন্থে কার্ল অগাস্ত ভিটফোগেল একে জলশক্তিভিত্তিক স্বৈরাচার হিসেবে দেখেছেন। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে সৃষ্টি করা হয়েছে একচেটিয়াবাদ। প্রাকৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে নদীনির্ভর মানুষকে। এর নজির রয়েছে নীলনদকে ঘিরে প্রাচীন মিসরে, প্রাচীন সোমালিয়ায়, শ্রীলঙ্কা, মেসোপটেমিয়া, চীন, মেক্সিকো কিংবা পেরুতে, সিন্ধু সভ্যতায় জলস্বৈরাচারের উপাদান রয়েছে বলে মনে করা হয়।
নদীকে ঘিরে 'ওয়াটার মাফিয়া' বাংলাদেশে এবং বিশ্বের নদীনির্ভর প্রায় সব দেশেই রয়েছে। এস এম স্টার্লিংয়ের উপন্যাস 'ড্রাকোন'-এ সেই মাফিয়া সমাজের ছবি আঁকা হয়েছে। কার্টুন চলচ্চিত্র 'র্যাঙ্গো'তে খরাপীড়িত ডার্ট শহরের মেয়র বলেছেন, পানি নিয়ন্ত্রণ করুন, সবকিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।
পানির বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় স্বৈরাচারের উদ্ভবের কারণে খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক ও ঐতিহাসিক হেরাক্লিটাস তার পূর্বসূরিদের ব্যর্থতার নিন্দা করেছেন। ল্যাঙ্গস্টোন হিউজেসের কবিতায়: মানুষের শিরায় রক্তের যে প্রবাহ/ তারও আগে আমি প্রাচীন পৃথিবীর নদীগুলোকে চিনি/ আমার আত্মা নদীর মতো গভীর হয়ে গেছে।
এ কথাও সত্য, মানুষের যত অনাচার, যত স্বৈরাচার নদীর স্রোত নিয়ে, সেই মানুষই সভ্যতারও নির্মাতা, নদীকে ঘিরেই। হেরোডোটাস দেড় হাজার বছর আগে জোর দিয়ে বলে গেছেন, মিসর নীলনদেরই দান।