‘বনলতা সেন’-এর পাণ্ডুলিপি
জীবনানন্দ দাশ প্রথমে পেনসিলে লিখতেন, টুকরো কাগজে, কদাচিৎ খাতায়। খসড়াগুলো সাধারণত অজস্র কাটাকুটিত কণ্টকিত হতো। তার লেখার প্রক্রিয়া ছিল প্রায়ই অতি ধীর। নিরন্তর যত্ন ও চেষ্টা। অধ্যবসায় ও নিরন্তর অভিনিবেশ। কবিতাটি নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত পরিমার্জনা অবিরাম চলত। এতটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন। কখন কীভাবে লেখা আসে, এগোয় বা হয়ে ওঠে, সে প্রসঙ্গে লিখছেন:
'যখনই ভাবাক্রান্ত হই, সমস্ত ভাবটা বিভিন্ন আঙ্গিকের পোষাকে ততটা ভেবে নিতে পারি না, যতটা অনুভব করি...একই এবং বিভিন্ন সময়ে। অন্তঃপ্রেরণা আমি স্বীকার করি।'
অবশ্য তারপরেই লিখছেন: 'কিন্তু ভাব-প্রতিভাজাত এই অন্তঃপ্রেরণাও সব নয়, তাকে সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ তর্কের ইঙ্গিত শুনতে হবে, এ জিনিস ইতিহাস-চেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই। এইসব কারণেই...আমার পক্ষে অন্তত ভালো কবিতা লেখা অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয়, কবিতাটি প্রকৃতিস্থ করে তুলতে সময় লাগে।'
এতটুকু লিখেও শান্তি পাচ্ছেন না কবি। লিখছেন: 'প্রথম লিখবার সময় যেমন ছিল, তার চেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে চারিদিককার প্রতিবেশচেতনা নিয়ে শুদ্ধ প্রতর্কের আবির্ভাবে...কবিতাটি আরো সত্য হয়ে উঠতে চায় পুনরায় ভাব-প্রতিভার আশ্রয়ে, এরকম অঙ্গাঙ্গী যোগে কবিতাটি পরিণতি লাভ করে।'
অর্থাৎ, অন্তঃপ্রেরণা+কল্পনা বা ভাব-প্রতিভা+ইতিহাস-চেতনা+শুদ্ধপ্রতর্ক+পুনঃভাব– প্রতিভাশ্রয়! একটি কবিতা নির্মাণ ও সৃষ্টির পথ ধরে তবে এইভাবে হয়ে ওঠে।
খসড়া থেকে কাঙ্ক্ষিত 'মনোমতো উজ্জ্বল' কবিতা হয়ে উঠলে জীবনানন্দ দাশ তা তারিখ দেওয়া এক্সারসাইজ খাতায় কালো কালি দিয়ে কপি করে রাখতেন। এমনকি এই সময় চা দিলে চা পড়ে থাকত। ইজিচেয়ারে বসে লিখতে পছন্দ করতেন জীবনানন্দ। তবে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। কখনো বিছানায় শুয়ে বা বসেও লিখতেন। তাঁর 'শেষ ছোঁয়া'য় কবিতার শব্দ তো পালটে যেত-ই! 'নক্ষত্র নিবে' হয়ে গেল 'নক্ষত্র মুছে'! 'শালিখ'-এর বিকল্প 'দাঁড়কাকগুলো', 'কার্তিক'-এর বিকল্প 'পৌউষ', 'কেঁপে'-র বিকল্প 'কেঁদে'! 'হারালো' আর 'ফুরালো'তে এক নয় অথচ জীবনানন্দ এক দুঃসাহসিক পথে পা রেখেছেন।
অথচ জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন'-এর যে পাণ্ডুলিপি আমি উদ্ধার করেছি, তাকে কোনোভাবেই প্রথম খসড়া বলা যায় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস 'বনলতা সেন' তিনি অজস্রবার কাটাকুটি করেছিলেন। দুঃখের বিষয় সেই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা যায়নি। অবশ্য 'বনলতা সেন'-এর উল্লেখ আছে এমন খসড়া কবিতা অন্ততপক্ষে ৫টি পাই। এবং মূল পাণ্ডুলিপির খাতাতে 'বনলতা সেন' কবিতাটি ব্লেড দিয়ে সুচারুভাবে কাটা।
যদি প্রশ্ন করা হয়, সবচেয়ে বেশি পঠিত বাংলা কবিতা কোনটি, উত্তরটি বোধ হয় এক নিমেষে সবাই বলবে, বনলতা সেন। 'কবিতা' পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা পৌষ ১৩৪২-এ (১৯৩৫) প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি এই ৮৭ বছরে 'বনলতা সেন' পড়েননি, এমন বাঙালি সাহিত্য পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
যেন এমন একটা মিথ তৈরি হয়ে গেছে, জীবনানন্দ দাশ=বনলতা সেন। 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম ৪০ বছরে ১৫টি পুনর্মুদ্রণে প্রায় ৭৫০০০ কপি বিক্রি হয়েছে। আজ অবধি সেই সংখ্যাটি যে কত হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। হয়তো পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি কোনো সংখ্যা।
১৯৩০-৩১ থেকে ১৯৩৪ অবধি এই পাঁচ বছর জীবনানন্দ দাশ খুব সচেতনভাবে একটি প্রজেক্ট গড়ে তুলেছিলেন। নিষ্ফলতার প্রজেক্ট, বোরডোমের প্রজেক্ট ও মন্থরতার প্রজেক্ট। চাকরি করবেন না, কোথাও লেখা পাঠাবেন না, কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করবেন না। শুধু পড়বেন, কলকাতা বরিশালের পথে পথে পথে ঘুরে বেড়াবেন আর দিস্তা দিস্তা লিখবেন।
একটি চাকরি তিনি পাননি ঠিক বিশ্বাস হয় না, চাইলে যে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হতে পারতেন না, ঠিক মানতে পারি না; কিংবা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপানো ও গ্রন্থপ্রকাশ খুব কঠিন যে ছিল, তা-ও তো নয়! মা-বাবা-স্ত্রীর গঞ্জনা সয়েছেন, ভাইয়ের কাছে হাত পেতেছেন, বিভিন্নজনের কাছে অপমানিত-লাঞ্ছিত-উপেক্ষিত হয়েছেন, তবু তিনি লেখার টেবিল কামড়ে বসে ছিলেন, একতিলও জমি ছাড়েননি বা সমঝোতা করেননি। এবং সবটাই লেখার স্বার্থে। নিজস্ব ভাষায় 'সিগারের আগুনে চামড়া পুড়িয়ে' লিখেছেন।
ঠিক এমন একটা কালপর্ব যখন শেষ হলো, ঠিক তখনই 'বনলতা সেন'-এর প্রকাশ। এরপর আর পেছন ফিরে চাইতে হয়নি জীবনানন্দ দাশকে। পরপর 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' ও 'বনলতা সেন' প্রকাশিত। 'কবিতা' পত্রিকায় সব থেকে বেশি প্রকাশিত কবিতা জীবনানন্দ দাশের। ইংরেজিতে অনূদিত হচ্ছে 'বনলতা সেন'! হ্যারল্ড অ্যাকটনের অ্যানথ্রোলজির জন্য 'বনলতা সেন' অনুবাদ করছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মার্টিন করকম্যানের তরজমাই অনুমোদন পায়। স্টিফেন স্পেন্ডারের 'এনকাউন্টার' পত্রিকায় চিদানন্দ দাশগুপ্তসহ বিভিন্ন অনুবাদকের কলমে জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনূদিত হয়। পরবর্তীকালে হিন্দি, তেলুগু, তামিল, মালয়ালাম ও কন্নড়ে অনুবাদ হবে। ইংরেজিতে 'বনলতা সেন'-এর অনুবাদ সংখ্যা আজ প্রায় ২০টি। এইসব কারণে এই পাণ্ডুলিপিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম!
অথচ বুদ্ধদেব বসুকে 'বনলতা সেন'-এর 'ম্যানুস্ক্রিপ্ট' পাঠাতে ক্রমাগত দেরি করে ফেলছেন। যাকে তিনি 'সুপ্রিম পোয়েট্রি' বা 'ঐকান্তিক' কবিতা বলতেন, তা লিখবার সাধ যেন পূরণ হচ্ছে না। আর এখানেই জীবনানন্দ দাশ সবার থেকে আলাদা, শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখেও তৃপ্ত হচ্ছেন না।
লেখক: জীবনানন্দ গবেষক