দেহেশার ছেলে আর মেয়েটা
[মোহামেদ আলী তাহা: জন্ম ১৯৩১ সাফুরিয়া, গ্যালিলিতে। মৃত্যু ২ অক্টোবর ২০১১, নাযারেথে।
সতের বছর বয়সের সময় পরিবারের সঙ্গে আশ্রয় নেন লেবাননে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় তার গ্রাম বোমাবর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে নাযারেথে ফিরে আসেন। আমৃত্যু এখানেই ছিলেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত খৃষ্টান তীর্থযাত্রীদের কাছে দিনে সুভ্যেনির বিক্রি ও রাতে কবিতা পড়ে শোনতেন। ফোর্থ গ্রেডে ওঠার পর পড়াশোনার ইতি ঘটে। নাযারেথে ক্যাথলিক চার্চের কাছে ছোট এক সুভ্যেনির বিক্রির দোকান ছিল তার। ছেলেকে নিয়ে চালাতেন
তার কবিতা ও গদ্যের অনুবাদ হয়েছে বেশ কটি ভাষায়। আদিনা হফম্যান তাহার জীবন নিয়ে লিখেছেন 'মাই হ্যাপিনেস বিয়ারস নো রিলেশন টু হ্যাপিনেস: আ পোয়েট'স লাইফ ইন দি প্যালেস্টাইন সেঞ্চুরি', ফিলিস্তিন-ইসরাইলি ঔপন্যাসিক আনতন শামাসের অনুবাদে হিব্রু ভাষায় বের হয়েছে তাহার রচনাসংগ্রহ।]
সকালে বাড়ির সবাই নাশতা খেয়ে উঠলে আমি বহু পুরোনো জলপাইগাছের গুঁড়িটার ওপরে বসে থালাবাসন, কাপ-পিরিচ, চামচ-টামচ সব মাজতে শুরু করি। বাড়ির উঠানে এইভাবে বসে থাকা আমার জীবনের অংশ। যে উজ্জ্বল সূর্যের আলো শরৎকালের ওম হয়ে আমার শরীরে ছড়াচ্ছে আদরের মতোন, আমি তার দিকে চেয়ে হাসি। আমার নরম হাত তখনো একটা থালার ওপরে খেলতে থাকে আর আমি মারসেল খলিফার সুর গুনগুনাই। আমার বুকের ওপরের পায়রা দুটার গায়ে ভেজা হাত বুলাতে বুলাতে আলো ঝলমল সূর্যটাকে আরেকবার দেখি। বোতলটা ছেলেটার হাতে দেয়ার সময় সে বলেছিল, 'আমি সূর্য তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে সাজাব।' সবকিছুই তার বশবর্তী, সবচেয়ে পোষ মানা তার অভিব্যক্তি, কাব্যিক সব বাক্য দিয়ে আমাকে এই কঠোর দুনিয়া থেকে আজাদ করে আমার মনে এই জীবনের প্রতি নতুন ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। সে কি জানে আমাদের বাড়ির একমাত্র ফুলদানিটা আমি স্কুলের কারুশিল্প ক্লাসে বানিয়েছিলাম আর ফুলের সাথে যার পরিচয় নাই বুনো নার্সিসি অথবা অ্যানিমোন বাদে?
ক্যাম্পের লোকেরা ফুল কেনে না, জন্মদিন বা বিয়েবার্ষিকীতে কাউকে ফুল উপহারও দেয় না। আমার আব্বা-আম্মার হয়তো তাদের বিয়েবার্ষিকী মনেই নাই। আর আমার কথা বললে, আমিও নিজের জন্মদিন উদ্যাপন করি না, জন্মদিন পালনের মতোন বিলাসিতা করার সামর্থ্য ক্যাম্পের ছেলেমেয়েদের নাই।
আমাদের কবে একটা বাড়ি হবে? যে রকম বাড়ি অন্যদের আছে, যে রকম বাড়ি দেখি শহরে, যেসব বাড়ির কথা বইয়ে পড়ি। কেন আমার নিজের একটা ঘর আর সেই ঘরে একটা খাট, একটা বালিশ আর একটা পর্দাওয়ালা জানালা থাকবে না, সন্ধ্যায় যে পর্দা সরিয়ে আমি রুপালি রঙের চাঁদের সাথে মনের কথা বলব? কেন আমাদের নিজস্ব রান্নাঘরসহ একটা বাড়ি হতে পারে না, একটা গরম পানির ট্যাপ আর একটা মার্বেল এর সিঙ্ক, যেখানে আমি থালাবাটি ধুয়ে ধুয়ে সাজিয়ে রাখতে পারি?
সে আমাকে বলেছিল, 'আমি সূর্য তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে সাজাব!'
সে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, 'তোমার আব্বা কী করে?'
'আব্বা ওদের জন্য বাড়ি আর ছাউনি বানায়।'
'কেফার সাবা নাকি তেল আবিব?'
'দুইটাই। কিরইয়াত আরবাতেও।'
সে আমার দিকে তাকায়। আমার লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছা করে। আব্বা, কেন তোমার তাদের জন্য বাড়ি বানাতে হয়? তারা আমার বন্ধু নাগোয়ার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে আর রুটিওয়ালা হাসান-আলা-ফারানেরও। কিন্তু সে আমার মুখ রাখার জন্য বলে, 'আমার আব্বা ওদের জন্য সবজি ফলায়, ওদের জমি দেখে। ওদের ফসল তোলে।'
ক্লাস শেষ হলে আমরা বিভিন্ন রকম হাসির আর মজার খেলা খেলতাম, তার একটা ছিল 'ছেলেরা আর মেয়েরা'।
এই ছেলেটা সবই জানে। কীভাবে আমাদের নেতৃত্ব দিবে আর কীভাবে আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস জিতবে।
সে বলল, 'আজকে চলো খেলি সেনাবাহিনী আর স্বদেশি।'
নতুন একটা খেলা ছিল সেটা। আগে এর নামও শুনি নাই কেউ আর জানতামও না কীভাবে খেলে। কেউ আপত্তি করল না। সে আমাদের দুই দলে ভাগ করল, একভাগে 'সেনাবাহিনী' আরেক ভাগে 'স্বদেশি'। সে হলো স্বদেশিদের নেতা আর আমাকে বানাল সেনাবাহিনীর নেতা।
আমি গলা ভারী করে তারস্বরে চিল্লায়ে বললাম, 'রাস্তা থেকে হটো!' তারপরে মিলিটারিদের গাড়ির মতোন গর্জন করলাম। সরি, ঠিকমতো বলতে গেলে ওদের ছয়মাথা তারাওয়ালা গাড়ির মতোন হিশহিশ শব্দ করলাম।
আমি হাঁটা শুরু করলাম। পিছনে আমার দল। আমরা গান গাইতে গাইতে কল্পিত গুলি ছুড়তে থাকলাম। তারপরে আমি চিৎকার করে বললাম
'জেরুজালেম?'
'আমাদের'
'বেথেলহেম?'
'আমাদের'
'হেবরন?'
'আমাদের'
'জেরিকো?'
'আমাদের'
'আরবদের জন্য?'
'মরুভূমি!'
আমাদের মাথায় পাথর ঝরল বৃষ্টির মতো। আমরা তাড়াতাড়ি যে যেদিকে পারি ছড়িয়ে গেলাম। আমি কাছেই একটা বাড়ির বেড়ার পেছনে লুকালাম। আমাদের বন্ধু সামিকে দেখলাম এক বাড়ির দেয়ালের পিছনে আশ্রয় নিতে। 'সাবধান লিডার! পাথরেরা অন্ধ', আমি ঠাট্টা করে বললাম তারে।
'আমি! আমি ভয় পাই না!' সে উত্তর দিল।
ভীতুর ডিম সামিও দেখি খেলা শিখে যাচ্ছে। হঠাৎ সে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল—'আমার মাথা, আমার মাথা!'
বুঝলাম সে আহত হয়েছে, তার দিকে ছুটে গেলাম। তার মুখ বেয়ে আঁকাবাঁকা ধারায় লাল রক্ত ঝরছিল। আমাকে দেখে সে বলল, 'আমরা তো বলছিলাম খেলব, কিন্তু তাবিত সেটা সত্যি বানায়ে দিল!'
এখন যখনই সামির সাথে দেখা হয়, আমি এটা বলেই তারে খ্যাপাই, 'আমরা তো বলছিলাম খেলব, কিন্তু তাবিত সেটা সত্যি বানায়ে দিল!' আর সে রাগত চোখে তাকায় আমার দিকে।
আমি হাসতে হাসতে বলি, 'একদম উচিত শিক্ষা হইছে, ব্যাটা হানাদারের আর্মি!'
সে রাগের চোটে আমাকে মারতে আসে। আমি দৌড়াই আর সে আমার পিছে পিছে দৌড়ায়।
'কবে?' আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
'যেদিন বুদ্ধিমান আল-সাত্তার হাসান পিশাচ বধ করবে', ছেলেটা জবাবে বলেছিল।
বাড়ি ফিরে তার চুল, তার চোখ, তার নাক মনে করলাম আর ছবি আঁকলাম বুদ্ধিমান আল-সাত্তার হাসান পিশাচিনীর বুকে ছুরি মারছে। ছবির এক কোনায় আঁকলাম ঝলমল করা সূর্য আর একটা বাড়ি...আর...আর...না থাক বলব না। তোমরা বল তো কী?
'যদি ওরা তোমার পা বেঁধে দেয়?'
'আমি কবুল করব না'
'যদি তোমাকে ঠান্ডা পানির নিচে ডুবিয়ে রাখে?'
'আমি কবুল করব না'
'যদি ওরা তোমাকে ইলেকট্রিক শক দেয়?'
'আমি কবুল করব না'
'যদি ওরা তোমার চোখের পাঁপড়ি একটা একটা করে তুলে ফেলে?'
'উঃ! আমি কবুল করব না'
'যদি তোমার নখ তুলে দেয়?'
'উঃ! উঃ! আমি কবুল করব না'
'যদি তোমার পিছনে লাঠি ঢুকায়?'
'কখনো, কখনোই আমি কবুল করব না'
'যদি ওরা সমস্ত সাভাক পদ্ধতিতে তোমাকে অত্যাচার করে?'
'আমি কবুল করব না'
'আর কী আছে? ভুলে গেছি! আর কী বাকি?'
সে হেসে উত্তর দিল, 'আর আছে সিআইএ'
আমি বললাম, 'আর সিআইএ?'
সে দৃঢ়প্রত্যয়ে বলল, 'আমি কবুল করব না'
আমি তার চিবুকের দিকে তাকালাম। তাকে চে গুয়েভারার মতো দাড়িতে কল্পনা করলাম। ইচ্ছা করছিল তাকে চুমু খেতে। আমার মন নেচে উঠছিল।
তাবিত একজন পুরুষ।
তাবিত পরাজিত হবে না।
আর এই খেলা, আমার ভালো লাগে না, কারণ এটা দুঃখী আর বিরাণ।
সে দৃঢ়তার সাথে বলল, 'আবলা সামলাবে এক নম্বর এলাকা, মসজিদ থেকে ফালাফেলওয়ালা পর্যন্ত। সামিহা থাকবে বাজারের দিকে। সামি দেখবে আল-সায়াঘ স্ট্রিট। সবকিছু কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে হবে। কারও সাথে তর্কে জড়ানো যাবে না। দশটার সময় আল-ফুকা গলির চত্বরে দেখা হবে। আর সামি, তোমার বলটা সাথে নিয়ে এসো।'
আমরা জলদি দৌড়ালাম।
আমার মনে হচ্ছিল যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছি। আমি সামিহা, আদেলের মেয়ে, জঙ্গি ফেদাই হয়ে গেছি, রুখে দাড়াচ্ছি হানাদার বাহিনী আর তাদের অফিসার, সৈন্য, ট্যাঙ্ক, প্লেন আর রকেটের বিরুদ্ধে একটা নতুন সকাল নিয়ে আসার জন্য। এত রকম নিয়ম আর বাধ্যবাধকতা না থাকলে আমি রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে বলতাম, 'হানাদার নিপাত যাও!' কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম চাররং নিশানের আবছায়া, আর স্কুলের মাঠে আমার সহপাঠীরা জপ করছে—'জন্মভূমি আমার জন্মভূমি'!
প্রথম দোকানটায় ঢুকলাম। আমিসহ তিনজন গ্রাহক ছিল সেখানে। দোকানদার প্রায় আমার আব্বার বয়সী। (আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য আমার আব্বা ওদের বাড়িঘর আর ছাউনি বানায়)। দোকানদারের সাদা মুখ লাল হয়ে ছিল, কপালে সাজানো সাদা চুল। পোশাক-আশাক সম্ভ্রান্ত, তার জুতা তার চুলের মতোনই চকচকে। প্রথম গ্রাহক বের হলো। 'ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াদের রেশম ও পশমের তৈরি পোশাক। কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ এবং অভিযোগ গ্রহণীয় নয়। সততাই আমাদের আদর্শ।' আমি হাসলাম। সে নিশ্চয়ই ভালোই লাভ করে। সবকিছুর একদাম, গ্রাহকরা দামাদামিও করে না তার সাথে। দ্বিতীয় গ্রাহকও বের হলো। এবার সে আমার দিকে চেয়ে হাসল, যেন এইমাত্রই দেখেছে আমাকে। আমাকে দেখে কি মনে হয় যে অত দামি জামা কিনব? কিন্তু কেন কিনব না? বারগান্ডি রঙের ভেলভেটের জামা। আমাকে খুব মানাবে। তাবিত! ওহ তাবিত! কেন ওই জামাটা কিনব না আমি? কিনব? আমি...হুম।...কেন আমার সামর্থ্য হবে না জামাটা কেনার?
'ইয়ং লেডি, আপনার কী পছন্দ?'
তার কথায় সম্বিত ফিরল। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রায় ফিসফিস করে আমার কথাগুলি বললাম। সে আমাকে চাইল, উৎকণ্ঠা এবং হয়তো আনন্দের সাথে দেখল আমাকে। কিন্তু তারপরে বলল, 'জন্মভূমি এবং বিপ্লবের জন্য আমরা এমনকি নিজেদেরও বাজিতে লাগাতে পারি।'
আমি দ্রুত দোকান থেকে বের হয়ে পাশেরটাতে ঢুকলাম। কোনো রকম অপেক্ষা না করে দোকানদারের কানে ফিসফিস করে বললাম একই কথা এবং তার জবাব শোনার আগেই দোকান ছাড়লাম। তারপরে আরও বহু দোকানে ঢুকলাম, বের হলাম, ঢুকলাম, বের হলাম।
লোহার দরজাগুলিতে আবার তালা ঝুলল।
আর আমার মনে হলো যেন দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।
তার জন্য আমরা স্কুলের দরজায় অপেক্ষা করছিলাম। সে একটা ভরা ব্যাগ হাতে পৌঁছাল আর সবাইকে পেঁয়াজ বিলি করল। প্রত্যেকের জন্য একটা করে পেঁয়াজ, আর সামিহা, এইটা তোমার জন্য। ঘরে ফলানো পেঁয়াজ। টায়ারগুলিও রেডি, সামির কাজ সেগুলি পোড়ানো। আর বুলেট? তার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে এই উপত্যকাকে। এর পাথরেরা নিরেট এবং শক্ত। 'নিশানা কিন্তু ঠিক রেখো, ভাই।' সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো চোখ আর কানের পাশে। আর নাক? আমি একবার এক সেনার নাকে মেরেছিলাম আর সে নিজেই নিজেই লাটিমের মতোন ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখনই মনে পড়ল একবার আমাদের জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষক তাহসিনকে প্রশ্ন করেছিলেন পৃথিবী কেন নিজ অক্ষের চারপাশে ঘোরে? উত্তরে তাহসিন বলেছে, 'কারণ, সে বেকুব!'
হানাদারেরা বেকুব। নিজেই নিজেকে ঘিরে ঘোরে। একদিন অজ্ঞান হবে। পড়ে যাবে। তারপরে বৃষ্টি নেমে রাস্তাঘাট ধুয়ে দেবে। আর সূর্য উঠবে আর তাবিত সেই সূর্য তুলে আমার ফুলদানিতে সাজাবে। আর আমরা একটা বাড়ি বানাব, তাতে মার্বেলের সিংক থাকবে আর একটা ঘরে বিছানা থাকবে আর একটা জানালা আর পর্দা আর রুপালি চাঁদ।
সে তার শার্ট খুলল।
আহা কী একটা ছেলে! দুর্দান্ত! সে চাররং পতাকা জড়াল তার শরীরে। তার ওপরে শার্ট গায়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উঠল। পতাকা এখন স্কুলের দালানের ওপরে ঝটপট করছে।
শান্তি বর্ষিত হোক তোমার ওপর।
আমাদের সবার সমস্ত সত্তা ছিল তার সাথে।
পাঁচজন সেনাসহ একটা গাড়ি এগিয়ে এল।
...সামিহার ভাষ্য, তাবিতের ভাষ্য, দেহেশা ক্যাম্প প্রাইমারি স্কুলের ইতিহাস শিক্ষকের ভাষ্যমতে, 'আর ইন গালুত ছিল হালাকুর সমাপ্তি...'
আর ব্যারিকেড হয়েছিল জ্বলন্ত টায়ার।
একবার বাড়ির উঠানে একটা চক্রাবক্রা সাপ দেখে লুকিয়েছিলাম। আব্বা সারা বাড়ি খুঁজেও সেটাকে পেল না, তখন একটা রাবারের টায়ার পোড়াল। জ্বলন্ত টায়ার সাপ তাড়ায়।
মিলিটারি গাড়িটা থামল। দুইজন সৈন্য নামল রাস্তা খালি করতে। পাথর ঝরানো হলো বৃষ্টির মতো।
বৃষ্টি দাও, হে দুনিয়া। বৃষ্টি হতে দাও।
বুলেট গর্জন করল।
দেয়াল ভেদ করে গেল।
গ্যাস স্প্রে করল।
আমার পকেটে বাড়িতে ফলানো পেঁয়াজটা ছুঁয়ে দেখলাম।
ওরা একটা স্কুল বন্ধ করল।
আর একটা জেলখানা খুলল।
প্রিয়তম, ফিলিস্তিন আমার প্রিয়তম। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমার জন্য বাঁচি। আমি রাবারের টায়ার পোড়াই, পাথর ছুড়ে দেই সৈন্যদের দিকে, যাতে তুমি আমার হও, শুধু আমার, শুধু। আমি তোমার, আর তুমি আমার। সবকিছুতে আমি তোমায় দেখি। আমন্ডের সাদা ফুলে আর লাল আনেমন আর সকালের শিশির ভেজা ঘাসে, আর রাখালের অন্ধকার মুখে...আর সকালের তারায়।
'সামিহা, তুমি আমার জন্মভূমি!'
'কি বলো ছেলে? আমি? আমি কে তুমি জানো? আমার আব্বা ওদের ছাউনি বানায় হেবরনের ভূমি কিরইয়াত আরবাতে, আল-খলিল, আল্লাহর প্রিয়তম।' ইব্রাহিম, হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, এটা কি সত্যি যে তুমি আমাদের আদি পিতা এবং ওদেরও? আর আমি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখি কংক্রিটের ছাদ আর একটা সিঙ্ক আর একটা ট্যাপ আর একটা ঘর আর একটা খাট আর একটা জানালা আর পর্দা...আর একটা চাঁদ।
আমার প্রিয়র চেহারা, ও চাঁদ, তোমার চেয়েও সুন্দর।
আমার প্রিয় ঝকঝকে আর তুমি বোকা
আমার প্রিয় সাহসী আর তুমি ভীতু।
আমার প্রিয় হানাদারদের বিরূদ্ধে লড়াই করে আর তুমি সবাইকে আলো দাও।
আমার প্রিয় পতাকা ওঠায়, টায়ার পোড়ায়, সেনাদের দিকে পাথর ছোড়ে, সবার হাতে বাড়িতে ফলানো পেঁয়াজ দেয় টিয়ার গ্যাসকে বাধা দেয়ার জন্য।
আর আমার প্রিয় আজ রাতে মাসকুবিয়া জেলে ঘুমাবে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, ও ফিলিস্তিন, আর তাবিত তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে আমি দেখতে পাই বিশাল একটা হৃদয়চিহ্নের মতো, যা আল-নাকেবে শুরু হয়ে আল-মাতালা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে; আর তার ভেতর জড়াজড়ি করে থাকে দুটি নাম...তাবিত।
তোমার জন্য আমাদের ভালোবাসা, তাবিত—অবিচল।
তাবিত শহরের কেন্দ্রে পতাকা উত্তোলন করে। আমার আম্মা উলুধ্বনি করে। ছেলেরা আর মেয়েরা গান গেয়ে ওঠে।
তোমার ভালোবাসার জন্য আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়।
তোমার ভালোবাসার জন্য আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়।
ডি মানে ডেসট্রয়—ধ্বংস
এইচ মানে হোম
সি মানে ক্যাম্প
ডি মানে দেহেশা
তো তোমরা এ বিষয়ে কি করেছ? তুমি কি করেছ মোনা, আর তুমি, সামিরা, আর তুমি খাদিজা, আর তুমি আতিফ? তোমরা কি করেছ, আহমেদ, আর তুমি, সামেহ, আর তুমি, হানাহ, আর তুমি আলী?
আমার আব্বা আর তোমার আব্বা ওদের বাড়ি বানায় আর ওরা আমাদের ভিটা গুঁড়িয়ে দেয়।
আমার ফুলগাছ রোপণ করি আর ওরা বুলেট ছোড়ে।
আর তাবিত দৃঢ়প্রত্যয়ী, সে কিছুতেই হার মানবে না।
আর আমরা তোমাদের ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি।
তোমাদের মায়েরা অভিশপ্ত।
এখন আমি জানি একটা বোতলকে কী করে বিস্ফোরকে রূপান্তরিত করতে হয়।
বুলেটের সাথে ফুলের দেখা হবে না।
যেভাবে একটা ট্যাঙ্কের সাথে লিলি মিলবে না।
আমি বহু পুরোনো জলপাইগাছের গুঁড়িটার ওপরে বসে থালাবাসন, চামচ আর কাপগুলি মাজতে শুরু করেছিলাম।
একটা পাখি ডেকেছিল আর সূর্য আমার গলায় আদর বুলাচ্ছিল।
সে আমাকে বলেছিল, 'আমি সূর্যকে তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে সাজাব।'
একটা মিলিটারির গাড়ি এসে থামল। ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে, আমার চুলের মুঠি ধরে গাড়িতে নিতে নিতে বলল—
বদমাশ
ফাতাহ
বেশ্যা!
তোর এত বড় সাহস গাড়িতে ককটেল ছুড়িস?
ভয়ানক এক আলো জ্বলে উঠল ঘরের ভেতর। নিজের অজান্তেই সামিহার আম্মা তার হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। সে দেখল হলুদ কমলালেবুর মতো সূর্যটা তার মেয়ের ফুলদানিতে এসে পড়ে তার দরজায় অস্ত গেল।
(ইংরেজি অনুবাদ: হালা হালিম)