আইয়ুব খানের ডিসেম্বর ১৯৭১
সন্দিহান হলেও ১৯৭১-এ ক্ষমতাহীন একজন সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান প্রত্যাশা করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর এসে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আমূল পাল্টে দিক, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান আবার হাতের মুঠোতে চলে আসবে। কিন্তু চরম দুঃসংবাদটি তিনি ততক্ষণে পেয়ে গেছেন। নিক্সনপ্রীতি ইয়াহিয়ার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সপ্তম নৌবহর কাছাকাছিও আসেনি। জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার ধূলিতে মাথা নুইয়ে অস্ত্র রেখে আত্মসমর্পণ করেছেন।
৭ অক্টোবর ১৯৫৮ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করানো হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্টকে বিদায় দিয়ে নিজেই সর্বময় ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে ওঠেন। বিচারপতি কায়ানি বললেন, পাকিস্তানের বীর সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত নিজের দেশ জয় করেছে। ১৯৬২ থেকে আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৬৯-এ সেই আন্দোলন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে তুঙ্গে ওঠে। ২৪ মার্চ ১৯৬৯ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয় সামরিক শাসন। গোটা একাত্তরই পাকিস্তান ছিল অশান্ত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খান প্রায় নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। আইয়ুব খানের ডায়েরি থেকে একাত্তরের ডিসেম্বরের কয়েকটি দিনের বিবরণী অনূদিত হল। পুনরায় স্মর্তব্য—এটি আইয়ুব খানের ডায়েরি, বাংলাদেশের কারও নয়।
২ মার্চ, মঙ্গলবার তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন:
পাকিস্তান ভয়াবহ দ্বৈধতার মুখোমুখি। পাকিস্তান চায় দুই অংশের একীভূতকরণ এবং গণতন্ত্র, কিন্তু বাস্তবতা আবার এই সমন্বয়ের বিরোধী। পূর্ব পাকিস্তান এই একীভূতকরণের বিরুদ্ধে, আর গণতন্ত্র যদি কবুল করতে হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে তার পছন্দের স্বাধীনতা দিতে হবেই—তার মানেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা। সেনাবাহিনী দেশের দুই অংশকে ধরে রাখতে পারবে—কিন্তু তা কত সময়ের জন্য? এটা বড়জোর একটি সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা যদি এড়াবার পথ না থাকে, তাহলে যৌক্তিক কাজ হবে সামরিক আইনের আওতায় এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটি যতটা গোছালো অপারেশনের মাধ্যমে সম্ভব সম্পন্ন করা। কিন্তু তা করতে ইয়াহিয়ার প্রচণ্ড নৈতিক সাহসের প্রয়োজন হবে—যার স্বাক্ষর এখন পর্যন্ত তিনি রাখতে পারেননি।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা এখন দেখার বিষয়। এখন সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া এবং এমনকি এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার সম্ভাবনাই বেশি—সে ক্ষেত্রে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বারোটা বাজিয়ে দেশ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে। যা-ই ঘটুক, দুর্ভাগ্যবশত বিচ্ছেদই বরং ঘনিয়ে আসছে। দেশ ভেঙে ফেলার জন্য যা যা করা দরকার, বাঙালিরা তার সবই করছে। আর এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত ও জোরদার করতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে যা করা দরকার, ভুট্টো তা-ই করছে।
আইয়ুব খানের ডায়েরি
২০ মার্চ ১৯৭১ শনিবার লিখেছেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে' মুজিবের সমান্তরাল সরকার চলছে।
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুধবার
ভুট্টো যত দিন বেঁচে আছে এবং পাকিস্তানে অবস্থান করছে—শান্তি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। নুরুল আমিন, এমনকি ইয়াহিয়ারও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করতে ভুট্টোকে জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছে। ভুট্টো প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, কিন্তু সে তা করবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, রাত এবং এমনকি দিনও বিমান আক্রমণের কারণে প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাটছে, কিন্তু গত রাত বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। একটি-দুটি করে উড়োজাহাজ আসছে এবং লক্ষ্যহীনভাবে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ এতে নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া সংবাদ মোটেও ভালো নয়। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের বাহিনীকে পশ্চাৎপসারণ করতে হয়েছে, তবে আমাদের সৈন্যরা সাহসের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জাতিসংঘ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং অপর দেশ থেকে নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস করেছে। এর পরে কী হয় দেখা যাক। সম্ভবত তেমন কিছুই হবে না, কারণ যুক্তি শোনার মতো মনোভাব ভারতের নেই।
১০ ডিসেম্বর, শুক্রবার
নুরুল আমিনের নিয়োগটা কৃত্রিম মনে হচ্ছে। তিনি কার প্রতিনিধিত্ব করছেন? আমি মনে করি না, তিনি বাংলার ব্যাপারে নাক গলাতে সক্ষম হবেন, যেমন সক্ষম হবেন না ইয়াহিয়া কিংবা ভুট্টো। তবে নুরুল আমিন ভালো প্রশাসক, কিন্তু এখন অনেক বুড়ো, বয়স ৭৪ বছর। কোনো ভালো অবদান রাখার সুযোগ নেই। আমার বিশ্বাস, নুরুল আমিন ও তার আত্মীয়রা বাংলা ছেড়েছে, কারণ সেখানে তারা আর বসবাস করতে পারছে না।
পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ট্রুপস সাহসের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে, কিন্তু শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি এবং অস্ত্রেও অনেক এগিয়ে। তার ওপর ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের ঘিরে আছে, তার মানে সৈন্য ও রসদ পাঠিয়ে তাদের পুনর্বলীয়ান ও ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। আক্ষরিক অর্থে শত্রুভাবাপন্ন মানুষের মাঝে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে, ভারতের এই আগ্রাসন সত্ত্বেও বাঙালিদের মনোভাবে সামান্য পরিবর্তনও ঘটেনি।
আশা করা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের দিক থেকে যে আক্রমণ পরিচালনা করা হচ্ছে, তা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপ কমিয়ে দিতে সক্ষম হবে; কিন্তু তা ঘটেনি। কেবল বিমানবাহিনীর কয়েকটি স্কোয়াড্রন প্রত্যাহার করেছে, পশ্চিমে পাঠিয়েছে—যেখানে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের কাছে বেদম মার খাচ্ছে। চমৎকার কাজ করছে পাকিস্তান বিমানবাহিনী। যদি-না অলৌকিক কিছু ঘটে, বাংলা এবং সেখানে অবস্থানরত সুদক্ষ সেনাবাহিনী রক্ষার আর কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
খোদা না-করুন, যদি বাংলার পতন ঘটে—পশ্চিমে তার ভয়াবহ আঘাত লাগবে। আমি মনে করি, সামরিক আইন সত্ত্বেও এই সরকার টিকতে পারবে না। সেনাবাহিনী নিজে থেকেই কিছু করতে বাধ্য হবে। তার পরিণতি হবে ভয়াবহ এবং ভারতীয় সামরিক চাপের মুখে পশ্চিমে পাকিস্তানের বিপন্নতা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে।
কেউ একজন বলেছেন, নুরুল আমিন ও ভুট্টোর নিয়োগের মানে ক্ষমতার ভাগাভাগি নয়, দোষের ভাগীদার হওয়ার জন্য বলির পাঁঠা খুঁজে বের করা। তবে তারা যথেষ্ট চালাক, সব সময় সেই খেয়ালই রাখবেন যেন যার দোষ তার ওপরই পড়ে। আমাদের দেশের জনগণের নেতাদের রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা না থাকুক, তারা রাজনীতিবিদও নন, উত্তেজনা সৃষ্টিতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা যেকোনো কিছুকে নিজের মতো করে বিবৃত করে নিতে পারেন। দেখুন, তারা কেমন করে লোকজনকে বোকা বানিয়ে এই দেশের মূলটাই আলগা করে ফেলেছে, তারপরও কেউই তাদের দোষারোপ করছে না। আমাদের দেশের মানুষের মূর্খতা সেই পর্যায়ের। আমি বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষগুলোকে দোষারোপ করি, এসব দুর্বৃত্তের মুখোশ খুলে দেওয়ার মতো নৈতিক সাহস তাদের নেই।
১২ ডিসেম্বর, রোববার
কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে—আমাদের ছোট্ট সেনাবাহিনীকে বাংলায় কী ভয়াবহ অবস্থার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জনবল ও অস্ত্রবলে শত্রুরা আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। শেষ দিকে তিনি (ইয়াহিয়া) সৈন্য পরিবহনের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। ঢাকার ৬০ মাইল উত্তরে একটি প্যারা-ব্রিগেড নামানো হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে, তারা জনগণকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্য প্রস্তুত করছে। এটা ট্র্যাজিক এবং হৃদয়বিদারক। বাঙালিরা নিজেরাই ভারতীয়দের সঙ্গে যোগসাজশে এ দুর্যোগ ডেকে এনেছে। অবাঙালিদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা, বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা এই তিক্ত ফল বহন করতে চলেছে। তাদের দুর্ভাগ্য, তারা বন্ধু ও শত্রুর মধ্যে তফাৎ করতে জানে না। এই বিচ্যুতির কারণে তাদের শতকের পর শতক মূল্য পরিশোধ করে যেতে হবে। এর মধ্যে দেশের অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হবে, সম্ভবত তা মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
গতকাল একটি দুঃখজনক সংবাদ শুনলাম। আমাদের অসমসাহসী অফিসারদের একজন মেজর জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি চাম্ব সেক্টরে তার ডিভিশনকে অপারেশনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধেও ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে কম্পানি ও ব্যাটালিয়নের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করেছেন।
১৩ ডিসেম্বর, সোমবার
যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ইন্দিরা গান্ধীকে একটি কড়া চিঠি পাঠানোর কথা। এমন ইঙ্গিতও রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত সেন্টো ও সিয়াটো চুক্তির দায়িত্ব হিসেবে এমনকি হস্তক্ষেপও করতে পারে। কেউ এমনও বলেছেন, কেমন করে পাকিস্তানকে সাহায্য করা যায় এ নিয়ে আমেরিকান ও চায়নিজরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ার একটি শক্তিশালী মিশন নয়াদিল্লিতে উপস্থিত হয়েছে, একইভাবে ভারতের একটি মিশন গেছে মস্কোতে। ভারত যে গতিতে পূর্ব পাকিস্তানে এগোচ্ছে, এতে রাশিয়ানরা বাহ্যত অসন্তুষ্ট বলেই মনে হচ্ছে। রাশিয়ানরা চায় ঢাকা দখলে চলে আসুক এবং এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সেখানে একটি সরকারকে বসিয়ে দেওয়া হোক, যাতে আরও একবার নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভেটো প্রয়োগ করতে না হয়। দিল্লিতে জনসমাবেশে ইন্দিরা শোকার্ত হয়ে জানাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে না—এই সম্প্রদায় ভারতকে আগ্রাসী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তারা সতর্ক করে দিয়েছে, ভারতের সামনে দুর্দিন আসছে। তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) অবশ্য প্রকাশ করেছেন যে যুদ্ধে ভারতের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আমি ভাবছি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কথা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া যায়। হতে পারে ভারতের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে তারা উদ্বিগ্ন এবং পাকিস্তান খণ্ডিত হয়ে যাক তা চায় না, কিন্তু আমেরিকানরা মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, শারীরিক, আর্থিকভাবে ক্লান্ত এবং নিঃস্ব একটি জাতি। এ সময় এ পর্যায়ে তারা আদৌ কোনো সামরিক প্রতিশ্রুতি দেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সর্বোত্তম তারা যা করতে পারত, সপ্তম নৌবহরের একটা অংশ বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দিতে পারত এবং তা-ও চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতার পর যে চীন ফরমোজাতে কোনো আক্রমণ পরিকল্পনা করবে না।
১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
যুদ্ধবিরতির জন্য নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার প্রস্তাবে রাশিয়ানরা আবার ভেটো দিল। আমার ভয় হচ্ছে, এরপর আমেরিকানরা ঠান্ডা হয়ে যাবে। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে যদিও-বা এগোয়, তা ব্যবহার করা হবে না— এটাই ভারতীয়দের ধারণা। তারা মনে করছে, আমেরিকানরা কেবল তাদের রাগ দেখাচ্ছে। আমি এর সঙ্গে একমত। ভারতীয়রা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে, তারা আজাদ কাশ্মীর কিংবা পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে কি না, আমেরিকার এ প্রশ্নের জবাব দিতেও অস্বীকার করেছে। আমেরিকান প্রশাসনের সমস্যা হচ্ছে, পূর্ববর্ণিত প্রতিনিবৃত্তকরণ প্রবণতা ছাড়াও তাদের শত্রুভাবাপন্ন এবং যুদ্ধবিরোধী কংগ্রেসকে মোকাবিলা করতে হয়, জোটের ব্যাপারে যাদের সামান্য আগ্রহও নেই। তারা মনে করে বিশেষ করে সেন্টো ও সিয়াটো অপ্রয়োজনীয় বোঝা ও অস্বস্তিকর একটি অধ্যায়।
গত কয়টা দিন ছিল অত্যন্ত বিমর্ষতার, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া খবর খুব খারাপ। শত্রুরা ঢাকার বাইরের প্রধান শহরগুলোতে আক্রমণ চালাচ্ছে, ঢাকা থেকে ৪০ মাইল উত্তরে টাঙ্গাইলে প্যারাসুট ব্রিগেড নামিয়েছে। আরও একটি ব্রিগেড হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য প্রস্তুত, গুজব রটেছে, পূর্ব দিক থেকে শত্রুসেনার বহর ক্রমেই এগিয়ে আসছে। (পূর্বাঞ্চলের) আকাশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা যেকোনো ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে নির্বিচারে সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনার ওপর আকাশ থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। গভর্নমেন্ট হাউসে (গভর্নরের বাসভবন) আক্রমণ হয়েছে এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের রেডিও ও সংবাদপত্র আশ্বাসসূচক সংবাদ দিয়ে বলছে, শত্রুদের মোকাবিলা করে তাদের রুখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ঢাকার চারদিকে ফাঁসের দড়ি ক্রমেই আঁটসাঁট হয়ে আসছে, লড়াই চলছে উপশহরগুলোতে। তারা টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করছে এবং অন্যান্য অস্ত্রের শব্দ শুনতে পাচ্ছে বলে দাবি করছে।
১৫ ডিসেম্বর, বুধবার
সিঙ্গাপুর থেকে পাওয়া একটি বার্তায় আভাস দেওয়া হয়েছে, বোমারু বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ আরও সাতটি জাহাজসহ মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করেছে এবং বঙ্গোপসাগরের দিকে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত সংবাদ এটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে এবং বলেছে যে বহর সম্ভবত চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছে। এ বহরের কী উদ্দেশ্য, তা জানা যায়নি। এ বহরের পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকলেও আমি সন্দিহান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পাল্টে দিতে তা আদৌ ব্যবহার করা হবে কি না।
দুপুরের খবরে জানা গেল, ঢাকার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় খোলামেলাভাবেই স্বীকার করা হলো, ঢাকার চারপাশে চারদিক থেকে আক্রমণ চলছে এবং বৃত্তটি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বেশ কয়টি শত্রু সৈন্যের কামান এই বৃত্তে এসে মিশেছে। এটি খুবই হৃদয়বিদারক সংবাদ। মনে হচ্ছে, এটাই পূর্ব পাকিস্তানের শেষ হয়ে যাওয়ার সূচনা, পরিণতি কী হবে, তা বিবেচনা না করে সংকীর্ণ অনুভূতিতে অন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু বোকা লোকের কারণেই এ অবস্থা। তারা যদি বিচ্ছিন্নই হতে চাইত, এটা খুব সহজে শান্তিপূর্ণ উপায়েই অর্জন করা যেত।
১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭১
এইমাত্র শুনলাম, নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছে।
তিনি ঠিকই শুনেছেন। বিভাজনের বীজ নিয়ে সৃষ্ট অখণ্ড ও পেয়ারা পাকিস্তানের স্বপ্ন চিরতরে সমাহিত হয়েছে।
১৯ এপ্রিল ১৯৭৪ আইয়ুব খানও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।