দ্য লাস্ট ফ্লাইট অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান
এটাই ছিল পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের আগে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে আকাশে ওড়া শেষ যন্ত্রযান। একটি এলুয়েট হেলিকপ্টার। আর্মি এভিয়েশনের তরুণ কর্মকর্তা শের খান ছিলেন এই হেলিকপ্টারে। ব্রিগেডিয়ার (অব.) শের খান তার পালাবার সেই বিবরণীই এই 'দ্য লাস্ট ফ্লাইট':
পাকিস্তানের ইতিহাসে সেই বেদনাদায়ক দিনে, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক দিনে, ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে লেখা লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিনের বইয়ের ভাষায়, 'লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের তিক্ততম শত্রুর হাতে অর্পণ করলেন।'
সেই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বেলা ১টা ৫ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলুয়েট-৩ হেলিকপ্টার ঢাকা এয়ারপোর্টের কাছ থেকে উড়ে এয়ারফিল্ড অতিক্রম করে চলে গেল। সেখানে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের নিচ দিকটাতে ভিআইপি হেলিপ্যাড প্রস্তুত রাখার কাজ এগিয়ে চলছে। ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরা এখানে অবতরণ করবেন।
মেজর মোহাম্মদ জারিফ বাঙ্গাশ হেলিকপ্টারটি স্বাভাবিক উচ্চতার নিচ দিয়ে উড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণে এবং বার্মার উত্তর প্রান্তে আকিয়াব শহরের দিকে এগোচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে আছেন আরও একজন এলুয়েট পাইলট মেজর তৌহিদ উল হক, এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার মেজর ইজাজ মিনহাজ ও পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন স্কোয়াড্রন লিডার আর পথে রিফুয়েলিংয়ের জন্য ১০ জেরিক্যান অতিরিক্ত জেট ফুয়েল। এ ধরনের হেলিকপ্টারে ট্যাংকে যে পরিমাণ জ্বালানি ধরে, তাতে এত দূরের গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব নয়।
বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে এবং বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া ভারতীয় নৌবাহিনীর রাডারের আওতা এড়িয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে আরাকানের জঙ্গলে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে রিফুয়েলিং করে এবং সাড়ে ৪ ঘণ্টা আকাশপথে উড়ে হেলিকপ্টারটি সন্ধ্যার দিকে আকিয়াব অবতরণ করল।
অক্টোবরের ১ তারিখে আমাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তত দিনে পূর্ণ শক্তি নিয়ে আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড এসে যোগ দিয়েছে। তখন ইস্টার্ন কমান্ডের অধীন ছয়টি এমআই ৮ হেলিকপ্টার এবং তিনটি এলুয়েট হেলিকপ্টার সক্রিয় রয়েছে। প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন আন্তর্জাতিক সীমান্ত লঙ্ঘন করছিল, তখন এভিয়েশন স্কোয়াডকে বিভিন্ন মিশনে ব্যস্ত থাকতে হয়। মুক্তিবাহিনীর দখল করা জায়গা পুনরুদ্ধার করার জন্য নিয়মিত বাহিনী ও কমান্ডোদের পৌঁছানো ছাড়াও অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑঅস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ, জেনারেল নিয়াজি ও তার স্টাফদের বিভিন্ন কমান্ড এলাকা ও সদর দপ্তরে আনা-নেওয়া করা।
নিয়মিত কাজের একটি ছিল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গণমাধ্যমের কর্মীদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় এজেন্টদের তৎপরতা ও সহিংসতার জায়গাগুলোয় নিয়ে যাওয়া। নোমান মাহমুদ সাগিরের মতো সিনিয়র ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে এলুয়েট চালনা ছাড়াও আমি মাঝেমধ্যে এমআই ৮-এর কো-পাইলট হিসেবে বসতাম। তা ছাড়া যখন ককপিট ক্রুর সংকট দেখা দিত, তখন তো বসতেই হতো। নভেম্বরে ঈদের দিন জেনারেল নিয়াজি হেলিকপ্টারে বিভিন্ন হেডকোয়ার্টার্সে গেলেন এবং সৈন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
সেদিন আমরা জানতে পারি, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একটি জাহাজ ভারতীয় সীমানায় ঢুকে পড়লে তা গুলিবিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হয়। তারা পাইলটকে ছেড়ে দিয়েছে। যদি ঠিকভাবে স্মরণ করতে পারি, অন্য একটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ পি কিউ মেহেদি চালিয়ে ঢাকায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। মেহেদি কদিন আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তত দিনে বৈরিতা অনেক দূর গড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সেক্টরে মোতায়েন আমাদের বাহিনী আসন্ন ভারতীয় আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে আছে, আক্রমণ সত্যিই অতি আসন্ন। মুক্তিদের তৎপরতার কারণে সড়ক ও নদীপথের যানবাহনে চলাচল ঝুঁকিবহুল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে কারণে হেলিকপ্টার এবং ক্রুদের ওপর সার্বক্ষণিক চাপ পড়ছে।
আমাদের একটি অন্যতম মিশন আহত ও নিহতদের সরিয়ে নিয়ে আসা, প্রায়ই তা করতে হয়েছে সীমান্তের ওপার থেকে আমাদের সৈন্যবেষ্টিত লক্ষ্যগুলোয় গোলন্দাজ আক্রমণের কারণে। আমার জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মিশনটি ছিল আমার নিজের ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা; আমি ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার চাকরিজীবনের প্রথম চার বছর কাটিয়েছি। এখান থেকেই কমিশন লাভ করেছি কিন্তু ভৈরব মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করতে আমাদের এ লড়াই করতে হয়েছে। আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আমাদের ইএমই রক্ষণাবেক্ষণ ক্রুরা তাদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার মধ্যেও স্মরণ রাখার মতো সেবা দিয়ে হেলিকপ্টারগুলোকে চালু রেখেছেন। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের সরঞ্জাম ও রক্ষণাবেক্ষণ ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও তারা এ কাজটি করেছেন। ব্যাপারটি একটু লঘু হাস্যকর মনে হতে পারে। আমাদের আরেকটি মিশন লুট হয়ে যাওয়া সরকারি তোশাখানা অর্থ পুনরায় সরবরাহ করা। মাসে যাদের বেতন সামান্য কয়েক শ টাকা, তাদের হাত দিয়ে হেলিকপ্টারে কোটি টাকা পাঠানোয় জিবে পানি আসার অভিজ্ঞতা হয়ে যায়।
ডিসেম্বরে যুদ্ধ বাধতেই হেলিকপ্টারগুলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন জায়গায় রাখা হলো। ভারতীয়রা একেবারে শুরুতেই ঢাকা এয়ারফিল্ডে বোমাবর্ষণ করে এটিকে অকেজো করে দেয়। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের কোনো জাহাজ আর উড়তে পারল না। তার পরই পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ ভারতীয়দের দখলে চলে গেল। আমাদের আকাশপথে অধিকাংশ চলাচল কেবল রাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। উড়াউড়ির যত কাজ, আমাদের স্কোয়াড্রন তা রাতেই প্রায় অন্ধের মতো চালিয়ে যেতে লাগল। কারণ, উড়োজাহাজের আলো দেখা গেলে ভূমি থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যাবে। সৌভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তানে আমার চার বছরের চাকরি খুব কাজে লেগেছে। এখানকার ভূপ্রকৃতি আমার ভালো চেনা ছিল। আত্মসমর্পণের কয়েক দিন আগে ইস্টার্ন কমান্ডের এক কর্মকর্তাকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন কয়েকটি অধঃস্তন হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। আমরা যেখানেই অবতরণ করছি, তিনি স্থানীয় কমান্ডারের কাছে একটি খাম হস্তান্তর করছেন, খাম খুলে পত্রপ্রাপকের যে অভিব্যক্তি, তা ক্রোধের। খামের ভেতর আসন্ন আত্মসমর্পণের কথা লেখা আছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম গ্যারিসনের কমান্ডিং অফিসার। ভারতীয় নৌবাহিনী অবরোধ সৃষ্টি করে গোড়াতেই চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তিনি আমাদের মুখের ওপর আদেশটি ছুড়ে মারলেন। বললেন, এ ধরনের অপমানজনক আত্মসমর্পণের আদেশ তিনি মানতে রাজি নন। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে তার ট্রুপসের আদৌ কোনো রক্তপাতও ঘটেনি, সেখানে কেন আত্মসমর্পণ। যাক, তারপরও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি কমিশনার ও পুলিশের ডিআইজিকে আমার হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম ত্যাগ করতে দিলেন।
১৫ ডিসেম্বর স্কোয়াড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লিয়াকত আসরার বুখারি অফিসারদের নিয়ে একটি সম্মেলন করলেন এবং বললেন, ইস্টার্ন কমান্ড তাকে নির্দেশ দিয়েছে, উড্ডয়ন উপযোগী সব উড়োজাহাজ সে রাতেই বার্মার আকিয়াব নিয়ে যেতে হবে, সঙ্গে যত বেশিসংখ্যক নারী ও শিশু। একটি এলুয়েট এবং এর ক্রুদের যদি জেনারেল নিয়াজির প্রয়োজন হয়, সে জন্য রয়ে যেতে হলো। যেহেতু আমি ও তৌহিদুল হক ব্যাচেলর, ক্রু হিসেবে আমাদেরই নির্বাচন করা হলো।
জেনারেল মতিনউদ্দিনের কথায়, ১৫ ডিসেম্বর (১৯৭১) জেনারেল নিয়াজি (ফিল্ড মার্শাল) মানেকশর কাছে সিগন্যাল পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শর্তযুক্ত অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব মেনে নিলেন। জেনারেলের চার আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াডের কমান্ডিং অফিসার লিয়াকত আসরার বুখারি প্রস্তুত, অনুমতি পেলেই রাতের অন্ধকারে তার দলবল ও হেলিকপ্টার নিয়ে বার্মা চলে যাবেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর তুলনামূলক অধিক শক্তি ও আকার বিবেচনা করে রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ মতামত দিলেন, লিয়াকতকে একটা সুযোগ দেওয়া যায়। উড়োজাহাজ যেন শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে, সে জন্য লিয়াকতকে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। জেনারেল নিয়াজি রাজি হলেন এবং লিয়াকতকে আদেশ দিলেন, আহত মেজর জেনারেল রহিমকে সঙ্গে নিয়ে যাক, মেজর জেনারেল রহিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও থাকবে। তিনি আরও বললেন, আহত জেনারেলের সঙ্গে নার্সও নিতে হবে। সে রাতে সবাই চাইছেন সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাবেন, তাতে সম্পূর্ণ অরাজকতার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি পাইলটদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, ঠেলাঠেলি চলতে থাকে। হেলিকপ্টারের ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ ওজনের মানুষের ঠাসাঠাসি চলতে থাকে। জেনারেল মতিন বললেন, সে রাতে ১৩৯ জন নারী ও শিশুকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হেলিকপ্টারে, অনুমোদিত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। হেলিকপ্টারের টেইক অফ পয়েন্টে কোনো নার্সের দেখা মিলল না। ভোরের আগে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশসীমা পেরোতে হলে ঢাকা ছেড়ে যেতে আর নষ্ট করার মতো সময় নেই।
১৬ ডিসেম্বর ভোর ৩টার দিকে চারটি এমআই ৮ এবং দুটি এলুয়েট দক্ষিণমুখী হয়ে উড়ে গেল। আমাকে জানানো হলো, চট্টগ্রামের 'কিন্ডার' রাডার এখনো ঢাকায় কাজ করছে। পাকিস্তÍান এয়ারফোর্সের লোকজন তা কিছু সময় সচল রাখার পর ধ্বংস করে দেয়। এয়ারফিল্ডে অবস্থানরত এফ-৮৬ জেট শত্রুর হাতে পড়া এড়াতে তারা এ কাজটি করে। পরদিন সকালে আমাকে বিস্মিত করে মেজর সগির ও মাহমুদ আনোয়ার স্কোয়াড্রন কমান্ডপোস্টে এসে হাজির, এটা আমি চালাচ্ছি। তাদের তো অন্যান্য উড়োজাহাজের সঙ্গে আগেই আকিয়াব চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের এলুয়েট স্টার্ট না নেওয়ায় তারা যেতে সক্ষম হননি। তারা আমাকে অনেক তোষামোদ করে বোঝাতে চেষ্টা করল, আমি যেন ইস্টার্ন কমান্ডকে রাজি করিয়ে দিনের আলোতেই তাদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করি। হেড কোয়ার্টার্সের অবস্থা খুবই গোলমেলে, আত্মসমর্পণের সময় ঘনিয়ে আসছে। আমার যদ্দুর মনে হয়, এয়ার কমডোর ইনাম, আমরা কেন যাইনি সে জন্য বকাঝকা করলেন এবং হেলিকপ্টার দ্রুত স্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন অফিসারকে আমাদের সঙ্গে নিতে বললেন। কারণ, এখানে তার আর কোনো কাজ নেই।
হেলিকপ্টারগুলো যেখান পার্ক করা, আমরা গাড়ি চালিয়ে সেখানে এলাম। মেজর সগির আমার চেয়ে খানিকটা দূরে ছিলেন। একসময় তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আমাদের আকিয়াবে দেখা হয়। আমরা যার যার মতো করে বোঝা নিয়েছি। সঙ্গে বাড়তি জ্বালানি। কারণ, এলুয়েটের উড্ডয়নক্ষমতা অনেক কম। আকিয়াবে পৌঁছতে আরও বেশি সময় আকাশে থাকতে হবে (এমআই ৮ বহু দূরবর্তী সফরের জন্য বাড়তি ট্যাংক সংযোজন করা আছে), আমাদের জাহাজ চালু হলো, টেইক অফ করল, এয়ারপোর্টে যেখানে জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, সেই রিসেপশন লাইনের ওপর দিয়ে আমরা উড়ে গেলাম। গাছগাছালি পাশ কাটিয়ে আমরা দক্ষিণে চলেছি। চট্টগ্রাম থেকে খানিকটা দূরে থাকতেই ফুয়েল ফিল্টারের সতর্কতা বাতি জ্বলে উঠল। মানে পাইপে জ্বালানি আটকে গেছে। এটা পরিষ্কার করতে হবে অথবা পাল্টাতে হবে নতুবা কয়েক মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন তেলশূন্য হয়ে পড়বে। আমরা তখনো শত্রুর সীমানার ভেতর, কাজেই বেপরোয়া হয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে আরাকান অরণ্যে খানিকটা খালি জায়গা পেয়ে সেখানে অবতরণ করি।
মেজর ইজাজ মিনহাস ফুয়েল ফিল্টার বদলানোর আয়োজন করলেন। ফিল্টার না করেই আমরা জেরিক্যান থেকে জ্বালানি সরাসরি ট্যাংকে ঢাললাম। স্বাভাবিক অবস্থায় এমনটি কখনো করা হয় না। উপজাতিদের কেউ কেউ কী হচ্ছে, দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিলে আমরা তাদের দিকে সাব-মেশিনগান তাক করে রইলাম। আমরা যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করার পরও ইঞ্জিনের আলো জ্বলল না। আরও কয়েকটি প্রচেষ্টা একইভাবে ব্যর্থ হলো। ইঞ্জিনে জ্বালানি প্রবেশ করছে না। ততক্ষণে ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার পর বার্মার অরণ্যে এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, গন্তব্য থেকে শত মাইল দূরে। ব্যাটারিকে স্বয়ংক্রিয় শক্তি অর্জনের জন্য কিছুটা সময় দেওয়া হলো। আমাদের ঠোঁটে প্রার্থনা, হৃদপিণ্ড যেন চলে এসেছে মুখের কাছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি আরেকবার ইঞ্জিন ক্র্যাংক করলাম। ধীরে, অলসভাবে, মনে হলো অনন্তকাল পর শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনে আলো জ্বলল, গতিসঞ্চার হলো, আমরা উড়তে সক্ষম হলাম। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আমরা আকিয়াব অবতরণ করতে সমর্থ হলাম।
বার্মার কর্তৃপক্ষ আমাদের অন্তরীণ করল, আগে যারা পৌঁছেছে, সেই ক্রু ও যাত্রীদের কাছে তারা জানতে চাইছে, বিনা অনুমতিতে আমরা কেন বার্মার আকাশপথে প্রবেশ করলাম। সব ক্রু ও হেলিকপ্টার বেসামরিক আমাদের এ কথা তারা গ্রহণ করল না। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সত্যিকার পরিচয় বেরিয়ে এল, যদিও আমরা বেসামরিক পোশাকে ছিলাম এবং উড়োজাহাজের সামরিক চিহ্নও মুছে ফেলেছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের আগে যারা এসেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের রেঙ্গুন পাঠিয়ে দেয়া হলো, কাউকে উড়োজাহাজে, কাউকে সড়কপথে। তারপর পুনর্বাসনের জন্য পাকিস্তান দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করা হলো। কয়েক সপ্তাহ পর আমরা সবাই কলম্বো হয়ে করাচি পৌঁছালাম। সেখানে আর্মি এভিয়েশন ঘাঁটি ধামাইলের (পরে কাসিম ঘাঁটি) কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জব্বার আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
কয়েক সপ্তাহ পর হেলিকপ্টারগুলো ব্যাংকক নিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি ক্রুদের অনুমতি দেওয়া হয়, ব্যাংকক থেকে জাহাজে এগুলো করাচি আনা হয়।
এয়ার কমোডর (পরে এয়ার মার্শাল) ইনাম উল হক পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র এয়ারফোর্স অফিসার। ঢাকা এয়ারফিল্ড স্থায়ীভাবে অকেজো করে দেওয়ার পর তিনিই হেলিকপ্টার ও প্লান্ট প্রটেকশন ডিপার্টমেন্টের এয়ারক্রাফট দিয়ে পাইলটদের আকিয়াব পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। তিনিও সবার সঙ্গে পালাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি যুদ্ধবন্দী হওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন। শের খান ব্রিগেডিয়ার পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করে স্বাভাবিকভাবে অবসরে যান।