কারা বেশি পেঁয়াজ খায়, কারা উৎপাদন করে সবচেয়ে বেশি
পাত্র এমনিতেই ভালো ছেলে, তবে একটু-আধটু পেঁয়াজ খায়। তবে সব সময় খায় না, মাংসটাংস খেলে তবেই খায়। মাংসটাংস সব সময় খায় না, নেশাটেশা করলে তবেই খায়। আর নেশাটেশাও সব সময় করে না, করে কেবল বাইজি বাড়ি গেলে। এখানেই শেষ নয়—ওয়াগান ভাঙে, জেলে থাকে, ছাড়া পেয়ে এমপি-মন্ত্রী হতে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে যায়। অমনি পাত্রের দাম বেড়ে যায়—মন্ত্রী এমপি হলে সব কলঙ্ক ঘুচে যায়। এমনকি পেঁয়াজ সিন্ডিকেটে নেতৃত্বও দিতে পারে। পেঁয়াজখোর এবং আলুখোরের এরকম নেগেটিভ কনোটেশন বাংলা ভাষায় বহু আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই।
পেঁয়াজখোর পাত্র কেবল উপলক্ষ। এই লেখাটি পেঁয়াজখোর সাধারণ নাগরিক ও পেঁয়াজ ব্যাপারীদের নিয়ে। পাত্র যত পেঁয়াজই খাক না কেন, তাতে কিছু এসে-যায় না; জুলিয়া চাইন্ড বলেছেন, পেঁয়াজ ছাড়া সত্যতা কল্পনাও করা যায় না।
এমনকি গুহামানবও পেঁয়াজ খেত। পেঁয়াজ চাষের ইতিহাস ৫ হাজার বছরের। পেঁয়াজ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে একসময় পেঁয়াজ মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে।
মার্কিন সেনাপতি ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস এস গ্র্যান্ট বলেছেন, পেঁয়াজ না পেলে আমি আমার সেনাবাহিনীকে যাত্রা করার আদেশ দেব না। আমেরিকান গণযুদ্ধের সময় তিনি সৈন্যদের জন্য পর্যাপ্ত পেঁয়াজ পাবার পরই তাদের মার্চ ফরোয়ার্ড করার আদেশ দেন। তার বাহিনীর সঙ্গে ট্রেনের তিনটি ওয়াগানভর্তি পেঁয়াজ দেওয়া হয়েছিল।
আমার হাতে পেঁয়াজ খাবার সর্বশেষ তুলনামূলক হিসাবনিকাশটি ২০২১ সালের। সে বছর এবং বহু বছর ধরেই পেঁয়াজ খাবার শীর্ষে রয়েছে তাজিকরা। তাই বলে তাজিকদের সকলেই শীর্ষে নন। ইরানি বংশোদ্ভূত তাজিক যত না তাজিকিস্তানে, তার চেয়ে অনেক বেশি আফগানিস্তানে; কিছুসংখ্যক তাজিক পাকিস্তানেও রয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজ খাবার প্রশ্নে তাজিকিস্তানের তাজিকদের কাছে আর সব জাতিগোষ্ঠী এমনকি আফগানিস্তানের তাজিকরাও মার খেয়ে গেছে। তারা মাথাপিছু বার্ষিক ৬০.৪ কিলোগ্রাম (২০২১ সালের হিসাবে) পেঁয়াজ খেয়েছে। ২০২০-এর তুলনায় পেঁয়াজ ভক্ষণ বেড়েছে ০.৫৩ ভাগ। মাথাপিছু এই পরিমাণটি তাজিকিস্তানের জন্য তেমন রেকর্ড, পৃথিবীর জন্যও মাথাপিছু এত বেশি পেঁয়াজ খাওয়ার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তাজিকিস্তানের মানুষ সবচেয়ে কম পেঁয়াজ খেয়েছে ২০০০ সালে, মাত্র ১৩.৮ কিলোগ্রাম। পেঁয়াজখোর ১৫৬টি দেশে পরিচালিত সমীক্ষায় তাজিকিস্তান অপ্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষ স্থান অধিকার করে আছে। অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দেশ নাইজার তার দেশবাসীকে ২০২১ সালে মাথাপিছু ৪৪.৬ কিলোগ্রাম পেঁয়াজ খেয়েছে, যা তাজিকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু ১৬ কেজি কম। এখন পর্যন্ত ১৬ কেজি ব্যবধানের কারণে তাজিকিস্তানকে অপ্রতিদ্বন্দ্বীই বিবেচনা করা যায়। তাজিকিস্তানের ৯৮ ভাগ অধিবাসীই মুসলমান। আর নাইজারে এই অনুপাত আরও বেশি—৯৮.৩। নাইজার মাথাপিছু সবচেয়ে কম পেঁয়াজ খেয়েছে ১৯৮৫ সালে, মাথাপিছু ৩.০৮ কেজি। ২০২১ সালে ভোক্তার ভাগের ৪৪.৬ কেজি পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ১.৪৬ কেজি কম। ২০১৯ সালে নাইজারের ইতিহাসে মাথাপিছু সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ ভোক্তার ভাগে পড়েছে—৪৬.৬ কেজি। জানা প্রাসঙ্গিক যে পেঁয়াজখোর হিসেবে তৃতীয় স্থানে থাকা সুদানও মুসলমান প্রধান দেশ, ৯১ শতাংশ জনগণ মুসলমান, মাথাপিছু পেঁয়াজ ভোগের পরিমাণ ৪১.০ কিলোগ্রাম। ১৯৬২ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তারা সবচেয়ে কম পেঁয়াজ খাবার রেকর্ড করেছে মাথাপিছু ০.৩৯ কিলোগ্রাম।
পেঁয়াজখোর হিসেবে ৪র্থ শীর্ষ স্থান অবস্থানকারী দেশ আলজেরিয়া। ২০২১ সালে তাদের মাথাপিছু ভোগে লেগেছে ৩৫.৫ কেজি, যা আগের বছরের তুলনায় ১.০৩ শতাংশ বেশি। আলজেরিয়ানরা সবচেয়ে কম পেঁয়াজ খেয়েছে ১৯৬৮ সালে, মাথাপিছু ২.০৩ কিলোগ্রাম। উল্লেখ্য, আলজেরিয়ার ৯৯ শতাংশ নাগরিকই মুলসমান।
শীর্ষ পঞ্চম স্থান আলবেনিয়াতে মাথাপিছু ভোগ ৩৪.৭ কেজি। আগের বছরের তুলনায় ৩.৭৬ ভাগ বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৭ সালে তারা মাথাপিছু সর্বোচ্চ ৩৭.৪ কেজি পেঁয়াজ খেয়েছে, সবচেয়ে কম খেয়েছে ১৯৯০ সালে, মাথাপিছু ৮.৯৯ কেজি। আলবেনিয়ার মুসলমান জনসংখ্যা ৫৯ ভাগ, তবে এই পরিসংখ্যান বিতর্কিত। ইউরোপীয় একদা কমিউনিস্ট এই দেশে মুসলমানের সংখ্যা কম দেখানোর একটি প্রবণতা ছিল, কখনো কেবল সুন্নিদেরই মুসলমান হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সব বিভাজন মিলিয়ে মুসলমানের সংখ্যা ৭০ ভাগের বেশি ছিল বলে মনে করা হয়, সংখ্যার হ্রাস ঘটেছে।
পেঁয়াজখোর শীর্ষ পাঁচটি দেশ এবং নাগরিকদের ধর্মীয় আনুগত্যের বিষয়টি দেখা যাক:
উপাসনালয়ে মুসলমানদের পেঁয়াজ-রসুন খেয়ে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে মুসলমানরাই পেঁয়াজের শীর্ষ ভোক্তা।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে মাথাপিছু পেঁয়াজ ভাগের হিসাবটা দেখা যাক।
সমীক্ষাধীন ১৫৬ দেশের মধ্যে পেঁয়াজখোর হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষ কুড়িতে নেই। বাংলাদেশ তেত্রিশ নম্বরে ঠাঁই পেয়েছে। ২০২১ সালে এখানে মাথাপিছু পেঁয়াজ খাওয়া হয়েছে ১৬.৬ কিলোগ্রাম। একই বছর ভারতীয়দের মাথাপিছু পেঁয়াজ ভক্ষণ ১৬.৩ কিলোগ্রাম করে ৩০তম স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানিদের ৭.৭২ কিলোগ্রাম পেঁয়াজ খাওয়া তাদের ৮১তম স্থানে স্থাপন করেছে। মুসলমানদের পেঁয়াজপ্রিয়তা পাকিস্তানের পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয় না। তাদের তুলনায় বরং ভারতীয় হিন্দুদেরই বেশি পেঁয়াজ খাওয়া হচ্ছে। পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে এটাও জানা আবশ্যক, এই উপাত্ত জাতিসংঘের বিশ^ খাদ্য সংস্থাই সরবরাহ করেছে।
পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধির কারণেই উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের মনোযোগ। ২০১৯ সালের হিসাবে, পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজ ৯৯৯৬৮০১৬ টন। একক দেশ হিসেবে উৎপাদনের শীর্ষে চীন—২৪৯৬৬৩৬৬ টন। দ্বিতীয় স্থান ভারত—২২৮১৯০০০ টন; তৃতীয় স্থান যুক্তরাষ্ট্রের—৩১৭০২৭০ টন। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি পেঁয়াজ ফলিয়ে থাকে। চতুর্থ অবস্থানে মিসর—৩০৮১০৪৭ টন। পঞ্চম স্থানে তুরস্ক—২২০০২০০ টন। ষষ্ঠ স্থানে পাকিস্তান—২০৭৯৫৯৩ টন। সপ্তম অবস্থানে সুদান—২৯১৯৩০৮ টন; দশম স্থান বাংলাদেশ—১৮০২৮৬৮ টন। উৎপাদনের নিম্নক্রম অনুসারে পরবর্তী ১০টি দেশ হচ্ছে: ইরান, রাশিয়া, আলজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, স্পেন, নাইজেরিয়া ও জাপান।
অর্থমূল্যে পৃথিবীর ১২১৭টি বহুল বেচাকেনার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সামগ্রীর মধ্যে ৪৩২তম বাণিজ্যিক পণ্য হচ্ছে পেঁয়াজ। ২০২১ সালে ২.৫৮ বিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ রপ্তানি করে চীন রপ্তানিকারকদের শীর্ষে অবস্থান করছে; ৯১৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পেঁয়াজ আন্তর্জাতিক বাজারে বেঁচে নেদারল্যান্ডসের অবস্থান দ্বিতীয় স্থান; ৪৭৩ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে মেক্সিকো চতুর্থ স্থান এবং ৪৭১ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ে ভারত পঞ্চম স্থানে।
২০২১ সালের শীর্ষ ৫ পেঁয়াজ আমদানিকারক—
যুক্তরাষ্ট্র: ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ
ইন্দোনেশিয়া: ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ
ভিয়েতনাম: ৪৮২ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ
জার্মানি: ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ
মালয়েশিয়া: ৩৩২ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ
২০২২ সালে বাংলাদেশকে ৭২৮০০০ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। আর বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লক্ষ টন।
পেঁয়াজ খাবার ৫ হাজার বছর
এটি রক্ষণশীল হিসেব। পাত্র হিসেবেই হোক কি গুহামানব হিসেবেই হোক, পেঁয়াজ খাওয়া চলে আসছে ৫ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। তখন আনুষ্ঠানিক চাষাবাদ শুরু হয়নি। পেঁয়াজের প্রথম আবিষ্কার কোথায়—এশিয়া না ইউরোপ, আমেরিকা না আফ্রিকা—এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। অধিকাংশ গবেষকই মনে করছেন, সম্ভাব্য উৎস সেন্ট্রাল এশিয়া, ইরান কিংবা এখনকার পাকিস্তান। চাষে আসা প্রাচীনতম পণ্যের একটি যে পেঁয়াজ, এ নিয়ে গবেষকদের কোনো সন্দেহ নেই। যেকোনো ফল কিংবা তরকারির তুলনায় পেঁয়াজ কম পঁচনশীল, উৎপাদন সহজ, বিভিন্ন আবহাওয়ায় জন্ম নিতে ও বেড়ে উঠতে পারে এবং পরিবহনেরও সমস্যা নেই। খরা ও দুর্ভিক্ষের সময় ব্যবহারের জন্য শুকিয়ে রাখা যায়—এটিও প্রাচীনতম আবিষ্কারসমূহের একটি। প্রাচীন লিখিত দলিলে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্নভাবে পেঁয়াজের ব্যবহার উল্লেখ করা হয়েছে—খাবার হিসেবে, ওষুধ হিসেবে, এমনকি মমীকরণেও। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নায় ব্যবহৃত অনিবার্য একটি উপাদান ছিল পেঁয়াজ। ১৬২০ সালে মেফ্লাওয়ার নামক জাহাজে ইংল্যান্ড থেকে যে বৃহৎ তীর্থযাত্রীর দল উত্তর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস প্লাইমাউথ অঞ্চলে পৌঁছেছিল, সেই জাহাজে খাবারের জন্য এবং অপরিচিত নতুন দেশে পেঁয়াজের অভাবে যে কষ্ট পেতে না হয়, সে জন্য তীর্থযাত্রীরা বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ সাথে নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে ১৫ আগস্ট ১৬২০ যাত্রা করলেও উত্তাল সমুদ্র মেফ্লাওয়ার জাহাজকে বেশি দূর এগোতে দেয়নি। জাহাজ আবার ফিরে আসে এবং অপর একটি বন্দর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর যাত্রা করে ৬৬ দিন পর কেইপকড বন্দরে পৌঁছে। এটি এখন ম্যাসাচুসেটসের প্রভিন্স টাউন। তীর্থযাত্রীরা আসলে এসেছেন বসতি স্থাপন করতে, তারাই নিউ সেটেলার। আগতরা জাহাজ থেকে নেমে বিস্মিত হলেন—সেখানকার জমিতে প্রচুর পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে, পেঁয়াজ ইংল্যান্ডের চেয়েও সস্তা।
মেফ্লাওয়ার জাহাজের দুজন বিশিষ্ট যাত্রী ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। একজন উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড ইংল্যান্ডের নব্য উপনিবেশ প্লাইমাউথের গভর্নর হিসেবে তিরিশ বছর রাজত্ব করেন আর ক্যাপ্টেন মাইল স্ট্যান্ডিশ সেখানকার সেনাদল গড়ে তোলেন, নতুন উপনিবেশের ডেপুটি গভর্নর ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োজিত হন। নতুন উপনিবেশে পেঁয়াজ চাষ হয় এবং সস্তায় পেঁয়াজ পাওয়া যায়—এই খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাগেনি।
পেঁয়াজ আকৃষ্ট করে আগামী দিনের বসতি স্থাপনকারীদের। সব ধরনের পেঁয়াজের মধ্যে ইয়েলো অনিয়নকে সবচেয়ে সুস্বাদু মনে করা হয়।
পাত্র একটু-আধটু পেঁয়াজ খাবার পর যদি শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপি কিছু একটা হতে পারে, পাত্রীকে অবশ্যই তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়াই যায়।