একটি ছবির গল্প
সাধারণ ফটোগ্রাফির চাইতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি অনেকটাই ভিন্নধর্মী কাজ। এটিকে এক বিশেষ নেশা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না; যা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং উত্তেজনাকর। শুধু একটি ছবির জন্য একজন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধা বোধ করেন না। কোনো বিশেষ, বিরল, দুষ্প্রাপ্য কিংবা বিচিত্র প্রাণীর খবরে তার মন মুহূর্তের মধ্যে চঞ্চল হয়ে ওঠে। পথ যতই দুস্তর—দুর্গম হোক, ঘটনাস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত শান্তি নেই। এমন দুর্দান্ত নেশায় আক্রান্ত সময় কেটেছে কত দিন কত রাত! কত জায়গা থেকে কত খবর আসত। বহু কষ্টের ফলাফল হিসেবে মিলত একটি আলোকচিত্র। আসলে প্রতিটি ছবির পেছনে রয়েছে একটি গল্প, কোথাও রোমাঞ্চ কোথাও শিহরণ কোথাও ভয়। দুর্দান্ত সেই সব দিনের কথা ভাবতে গিয়ে আজও পুলকিত হয়ে ওঠে মন।
সময়টা ২০০২। আমি তখন কিছুকালের জন্য নিয়মিতভাবে ঢাকার বাসিন্দা। তখন একদিন হঠাৎ নরসিংদীর চরসিন্দুর থেকে একটি টেলিফোন আসে। ফোন করেছিল আবু সাঈদ মোল্লা। তার কাছ থেকে জানতে পারি, তাদের বাড়ির বরইগাছে গত কয়েক রাত ধরে অদ্ভুত ধরনের এক প্রাণীর আগমন ঘটতে শুরু করেছে। বরইগাছটা মোল্লাদের থাকার ঘরের পাশেই। একদিন রাতে হঠাৎ করেই অনেকগুলো বরই ঝরে পড়ে টিনের চালে। কিছুক্ষণ পরপর এভাবে বরই পড়তে থাকে তাদের টিনের চালে। সন্দেহ জাগে মোল্লার মনে। টর্চ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বরইগাছের উপরে আলো ফেলতেই সে দেখতে পায় প্রাণীটাকে। আকারে বিড়ালের চাইতে কিছুটা বড়, নাকটা কুচকুচে কালো, নাকের চারদিক সাদা, লেজটা বেশ লম্বা, টর্চের আলোয় চোখগুলো মার্বেলের মতো জ্বলে উঠেছিল। বেশ আরাম করে একের পর এক বরই খেয়ে চলছিল সে। তার খাওয়ায় বাধা না দিয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মোল্লা। রাজ্যের বিস্ময় আর জিজ্ঞাসা এসে ভর করে তার মনে। পরের রাতেও আবার আসে প্রাণীটা। মোল্লা তার পরিচিত কয়েকজনকে এনে জন্তুটাকে দেখায়। কিন্তু কেউ সঠিকভাবে বলতে পারল না এটা কী প্রাণী! কেউ বলল হনুমান, কেউ বলল বড় কাঠবিড়ালি। কিন্তু কেউই সঠিকভাবে তার পরিচয় বলতে পারল না।
এ ধরনের খবর পাওয়ার পর যেকোনো ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারের পক্ষে ঘরে বসে থাকা মুশকিল। সেদিন বিকেলেই বাসে উঠে রওনা দিলাম চরসিন্দুরের উদ্দেশে। সিটে বসে ভাবতে লাগলাম কী প্রাণী হতে পারে ওটা? এটা যে হনুমান কিংবা বৃহৎ কাঠবিড়ালি নয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। চরসিন্দুর কেন, সমস্ত নরসিংদী জেলার কোথাও হনুমান নেই। তবে বানরের একটি বিশাল দলের বিচরণ রয়েছে মনোহরদী থানার রামপুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে। আর কোনো প্রজাতির হনুমানই নিশাচর প্রাণী নয় যে রাতের বেলায় গাছে এসে বরই খাবে। আর কেউ যদি বলে, এটা বড় কাঠবিড়ালি, তাহলে আমি বলব, এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, গ্রামীণ বনে কখনোই বৃহৎ কাঠবিড়ালি দেখা যায়নি। আমাদের দেশে এদের দেখা মেলে শুধু সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে।
সন্ধ্যার একটু পর পৌঁছে গেলাম চরসিন্দুর বাজারে। বাজারের একপাশে মোল্লার স্টেশনারি দোকান। চরসিন্দুরে মোস্তফা নামের এক যুবক রয়েছে, বন্য প্রাণী সম্পর্কে যার আগ্রহের কোনো অন্ত নেই। এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর ছবি সংগ্রহ করতে সে আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। বাজারের পাশেই তাদের বাড়ি। মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে মোল্লার দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মোল্লা আমাকে দেখে দোকান থেকে নেমে এল। কিছুক্ষণ কথা; তারপর দোকানের দায়িত্ব একজন কর্মচারীর উপর দিয়ে সে আমাদের নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি বরইগাছে আসা প্রাণীটা সম্পর্কে মোল্লাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করলাম। আমার কাছে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা। আমি বুঝতে পারলাম ওটা কী প্রাণী। এখন শুধু একনজর দেখার অপেক্ষা।
রাত নয়টার দিকে আমরা মোল্লার বাড়িতে পৌঁছলাম। মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির চারপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখলাম। চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বৃক্ষের সারি। বরইগাছের কাছে এসে মোস্তফাকে গাছের উপর টর্চের আলো ফেলতে বললাম। সে আলোয় বড় বড় সাইজের কাঁচাপাকা বরই চোখে পড়ল। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে বাড়ির আশপাশের আরও কিছু জিনিস দেখে আমরা মোল্লাদের থাকার ঘরের পাশে ছোট ঘরটায় গিয়ে বসলাম। এ বাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ রয়েছে। মোল্লা তড়িঘড়ি করে আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করল। খাওয়াদাওয়ার পর মোল্লাকে বললাম বাড়ির সবগুলো বাতি নিভিয়ে দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির অন্যান্য সদস্য যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি, মোস্তফা আর মোল্লা একটা খাটের উপর বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম। আস্তে আস্তে রাত গভীর হতে লাগল। ঘড়ির কাঁটার দিকে আলো ফেলতেই দেখলাম রাত একটা। মোল্লাদের থাকার ঘরের টিনের চালে মাঝে মাঝে টুপটাপ শব্দে দু-একটা বরই ঝরে পড়ার শব্দ পাচ্ছি। বুঝলাম নিশাচর গেছো ইঁদুরেরা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনে বুঝলাম, চামচিকারা ছো মেরে মেরে একটা একটা করে বরই নিয়ে যাচ্ছে। কাছেই কোথাও গাছে ঝুলে আরাম করে খাবে। গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে রাত। মোল্লা এবং মোস্তফার ঝিমানো দেখে বুঝতে পারলাম গভীর ঘুমে জড়িয়ে আসছে তাদের চোখ। আমি তাদের ঘুমিয়ে পড়তে বললাম কিন্তু ওরা রাজি হলো না। রাত জাগতে আমার কোনো কষ্ট হয় না। রাত যত গভীর হয়, আমি জেগে উঠতে থাকি। এটা আমার পুরোনো আর প্রিয় অভ্যাস।
রাত তখন কত হবে, আমার ঠিক খেয়াল নেই। আমরা সবাই শুনতে পেলাম সেই শব্দ। যে অভাবনীয় শব্দ শোনার অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ ধরে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় বসে রয়েছি। আচমকা ঝরঝর করে অনেকগুলো বরই ঝরে পড়ল মোল্লাদের থাকার ঘরের টিনের চালে। ক্যামেরা, ফ্ল্যাশ আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম। টর্চ হাতে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে ঘরের বাইরে যেতে চাইলে মোস্তফার পিঠে হাত দিয়ে শান্ত করলাম তাকে। আচমকা কেন যেন আমার তখন বিগত শিকারিজীবনের কথা মনে পড়ে গেল। শিকার কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার শিকারসঙ্গীরা এভাবেই উত্তেজিত হয়ে উঠত। আমি তাদের হাতের স্পর্শ কিংবা ইশারায় শান্ত থাকতে বলে, সুযোগ বুঝে শিকারের উদ্দেশ্যে গুলি চালাতাম। এখানেও পরিস্থিতিটা অনেকটা সেই রকম। তবে বন্দুকের বদলে হাতে রয়েছে ক্যামেরা। আগে ট্রিগার টিপে জীবন নিতাম আর এখন শাটার চেপে জীবনের ভেতর থেকে আরও সুন্দর জীবন বের করে আনি; আলোকচিত্র।
ঘন ঘন বরই পড়তে লাগল টিনের চালে। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ভারী দেহের কোনো জন্তুর আগমন ঘটেছে বরইগাছে। পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম বরইগাছের দিকে। আকাশে চাঁদ ছিল না। তারার আবছা আলোয় বরইগাছের ডালে একটা প্রাণীকে দেখলাম। নিজের খাওয়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। নিচু স্বরে মোস্তফা এবং মোল্লাকে বরইগাছে টর্চের আলো ফেলতে বললাম। সেই আলো প্রাণীটার দেহে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল তার দুই চোখ। পিট পিট করে সে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। এই সুযোগে যত দ্রুত সম্ভব ছবি তুলতে লাগলাম। প্রথম দেখাতেই তাকে আমি চিনতে পারলাম। এদের বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক নাম রয়েছে। কেউ এদের বলে নোঙ্গর, কেউ বলে গন্ধগোকুল, কেউ বলে ভোন্দর। দেশের কোনো কোনো স্থানের মানুষ ওদের বোমালেঞ্জি, বাশাকা, চোরকাঁটা, শাইড়েল, গাছ খাটাস নামেও চেনে। ইংরেজিতে এদের কেউ বলে Toddy cat (বিড়ালের সঙ্গে এদের মুখশ্রীর অদ্ভুত মিল রয়েছে), আবার কেউ বলে Palm civet (তাল গাছের মাথায় বসবাস করতে এরা আসলে খুবই পছন্দ করে)। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Paradoxurus Hermaphroditus. এই প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত নাম হচ্ছে নোঙ্গর। এদের দেহকাঠামোর সঙ্গে বড় বাগডাস (Large civet) এবং ছোট বাগডাসের (Small civet) মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও নোঙ্গরদের দেহের রং এবং স্বভাব বাগডাসদের চাইতে ভিন্ন। লেজের রং দেখেই নোঙ্গরদের বাগডাস থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। বাগডাসদের লেজে ক্রমান্বয়ে অনেকগুলো স্পষ্ট সাদাকালো বলয় থাকে। কিন্তু নোঙ্গরদের লেজের কিছুটা অংশ ছাইরঙা, কিছুটা কালো। বাগডাসরা ঝোপঝাড়ে থাকতে পছন্দ করে। পোষা হাঁস, মুরগি, ইঁদুর, বিভিন্ন পোকামাকড় এদের প্রিয় খাদ্য। এদের গর্তজীবী প্রাণীও বলা যায়। অন্যদিকে নোঙ্গর থাকে গাছে গাছে। বিভিন্ন ধরনের ফল এদের প্রিয় খাদ্য, মাঝে মাঝে কৃষকের পোষা কবুতর শিকার করে খায়। খেজুরের রস এদের প্রিয় পানীয়। এরা তাল, সুপারি, নারকেল কিংবা অন্য যেকোনো ঝাকড়া গাছের মাথায় বাসা বানিয়ে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের অনেক স্থানেই নোঙ্গর ছিল একসময়। নরসিংদী জেলায় এদের সংখ্যা খুবই কম। অনেক দিন আগে নরসিংদীর সাধারচর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে একবার নোঙ্গর দেখেছিলাম। আজ দ্বিতীয়বারের মতো দেখলাম একই জেলার চরসিন্দুরে। মানুষের অজ্ঞানতার কারণে অচেনা এক প্রাণী হয়ে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। এভাবেই অতি সাধারণ কিংবা নিরীহ বন্য প্রাণী কখনো কখনো মানুষের ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে এবং লোকজনের আক্রমণ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
আমাদের টর্চের আলোকে তোয়াক্কা না করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পেট পুরে বরই খেল সে। এরপর বরইগাছের ডাল বেয়ে চলে এল বড় এক আমগাছে। আমগাছের মোটা দুটি ডালের সংযোগস্থলে আরাম করে বসল সে—যেন ক্যামেরা সামনে পোজ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। সেই মোহনীয় ভঙ্গিটা সাথে সাথে ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম। এরপর বাসা থেকে উঠে চলতে শুরু করল সে। তখনো ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির বিশেষ নিয়মকানুন আমার জানা নেই। আমি মোস্তফা আর মোল্লাকে নিয়ে তার পিছু নিলাম। টর্চের আলোয় দেখলাম, সে অবলীলায় কাঠবিড়ালির মতো স্বচ্ছন্দে এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলে যেতে লাগল। এমনকি কলাপাতার উপর দিয়ে তার সাবলীল চলাচল আমাকে হতবাক করে দিল। একসময় তার পিছু ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত তিনটা। বুঝলাম নোঙ্গরটা ফিরে চলেছে তার আস্তানায়। সেখানে হয়তো তার কোনো সঙ্গী রয়েছে অথবা বাচ্চা। অতঃপর প্রশান্ত চিত্তে আমরা আবার ফিরে এলাম মোল্লার বাড়িতে।
ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরও আবু সাইদ মোল্লা আমায় মাঝেমধ্যে ফোন করত। জানাত নোঙ্গরটাকে এখনো রাতের বেলা প্রায়ই দেখা যায় মানুষের বাড়ির ফল গাছে। সে আর মোস্তফা নিয়মিত খবর রাখে, যেন কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে। এমনিভাবে ওরা নেহায়েত মনের টানে বন্য প্রাণীদের সুরক্ষায় কাজ করত। সবাই যদি ওদের মতো হতো, তবে দেশের বন্য প্রাণীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হতো। অপঘাতে চিতাবাঘের মৃত্যুর বদলে সোনার বাংলা মুখরিত হয়ে উঠত হাজারো বন্য প্রাণীর পদচারণে।
গত বছর এপ্রিল মাসে আবু সাঈদ মোল্লার মৃত্যু ঘটে। আমি এই বন্য প্রাণীপ্রেমিক মানুষটির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।