বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস
বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস
সাগুফতা শারমীন তানিয়া
আজ এক অদ্ভুত ঋতুর গীত গাইব বলে লিখতে বসেছি। যাকে নিয়ে বলতে গেলেই লোকে নস্টালজিক গলায় বলে—সে ছিল আমাদের কালে! এখন কি আর তেমন আছে! সত্যিই তো, একদিন শীতকাল মানে ছিল মাটির ঠিলা ভরা টলমলে খেজুরের রস, নতুন জলপাই দিয়ে মাছের চচ্চড়ি, ফুলহাতা ফ্লানেলের জামা-উলের ব্লাউজ-পাড় সেলাই করা চাদর, দুপুরের ছাদে রোদে দেয়া লেপ আর সবুজ কাচের শিশিতে নারকেল তেল, অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরের ছুটি। তখন মাঠ কাঁপিয়ে, মুলি বাঁশ পচা খালপাড় কাঁপিয়ে ছুটে আসত দুদ্দাড় পাড়াগেঁয়ে বায়ে—আমাদের এই শহরে। আমরা শুনতাম পৌষের শীত মোষের গায়ে আর মাঘের শীত বাঘের গায়ে, মোষ আর বাঘের অভেদ্য চামড়ায় গিয়ে লাগে যে শীত। এখন সেই ঋতু কেমন? খেজুরগাছগুলো চলে গেছে ইটভাঁটায় ইন্ধন জোগাতে। নিউমার্কেট খুঁজে এনে ভ্যালিকা উল আর আজ কয়জন বোনে জানি না, সেই বিলিতি প্রসাধনসামগ্রী আর কোল্ড ক্রিম বেচা আলো ঝলমলে দোকানগুলো কি আর আছে ওখানে? এ শহরে কমলা হয়ে পেকে আসা পাতাবোঝাই ছিমছাম জলপাইগাছ আমি আর দেখি না। শহরের খাল-বিল-মাঠ-মেঠো পথ নয়ানজুলি কবে চলে গেছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের হাতে। মোষ আর বাঘ কোথায় গেছে, তা আমরা জানতে পারব অতি শিগগির, যখন বাস্তু ফিরিয়ে দিতে না পেরে আমরাও প্রাকৃতিক দুর্যোগের রসাতলে যাব। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের শীতকাল কেমন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে, কোনো কোনো বছর শাল পরতে হয় কেবল হাতে গোনা কয়টি দিন—শালকররা আর ব্যস্ত হয় না, লেপের তুলো ধুনারিদের দেখি না পথে পথে, কোনো বছর আবার শীত আসে কয়েকটি দুরন্ত শৈত্যপ্রবাহের দিনজুড়ে; যেন গোটা শীতকালটা একটি অপরিণত ব্যাঙাচির আকার, মুণ্ডুটা মস্ত, আর বাকিটা লেজমাত্র, লেশমাত্র।
রঞ্জনা গাছে কোন মাসে গুটি ধরে? লাল লাল পাকা পাকা গুটি, লাল কার্ডিগ্যান পরে আর লাল ফিতের ফুল চুলে বেঁধে আমরা যে লাল গুটি কুড়াতাম। রাতে ভিজিয়ে রেখে ডুমো ডুমো করে নিয়ে সকালে সুচ বিঁধিয়ে আমরা যার মালা গাঁথতাম, যাকে ভুল নামে ডাকতাম কুঁচফল? সে কি শীতকালে? সে জন্যই বোধ হয় আমার শীতকালীন স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে আছে লালচে আভা, লালচে রোদ, লালচে গুড়ের সিরা, শিশির লাল আরক, বাজারে এসেছে রক্তগোলাপ—তার গন্ধেই ফিনকি দিয়ে ওঠে প্রেম, ফেরিঘাটে লাল ধুলোয় খাবি খেতে খেতে শিরীষগাছের ছায়ায় তক্তার বেঞ্চে বসে চুমুক দেয়া সরভাসা চা আর পিঠাওয়ালীর তৎপর হাতে খোলাজালি পিঠা, জলশীর্ণ গড়াই নদীর রেখা ধরে খালারা গায়ে মেরুন শাল জড়িয়ে ফিরে আসছে সেসব শীতকালীন ঝাপসা ফটো রয়ে গেছে আমাদের পুরোনো অ্যালবামে। শীতে রোদে দেবার জন্য বের হতো দামি শাড়ি। বেনারসির ভাঁজে কবেকার ফোঁটা ফোঁটা আতর, কাতানের গায়ে কোনো এক ভোজসভার স্মৃতিময় তেলের দাগ, কাঞ্জিভরমের আঁচল ফেঁসে গেলে ওটা আলাদা করে রাখা হতো চীনা ড্রাইক্লিনার্সে (লী ফা) কিংবা নিউমার্কেটের 'নদীয়া'তে রিপু করতে দেয়া হবে বলে। কার্তিক মাস থেকেই পথে পথে শোনা যেত ধুনারিদের 'ল্যাপতুষ্যক' ডাক, লেপের তুলো ধুনে দেবে। এসবই দারুণ ভালো! এই পুরাতনকে রোদে সেঁকে আরও কিছুদিন চলনসই রাখা, এই অনুপযোগীকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা। আমি এখন জানি, এসব কাজ পৃথিবীর বন্ধুরা করে, রিপেয়ার আর রিসাইক্লিং। তখন ওসব শব্দ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতাম না, আমাদের দেশে প্রবৃত্তিবশেই ওসব করা হতো।
শীত মানে রবিশস্য। শীত মানে কৃষ্ণদামপুর গ্রামে কলাই শাকের খেত—শিশিরস্নাত, মরে আসা ইছামতীর নিঃস্রোত তীরে বুকভাঙানিয়া 'ব্রজবাবুর ঘাট' আর পেছনে ভাঙাচোরা প্রাসাদোপম বাড়িতে আনসারদের নেড়ে দেয়া লুঙ্গি। চষা খেতে বসে থাকা যুবকের সংঘ, আর নাড়াপোড়া মাঠের ওপর দিয়ে বোঁ বোঁ শব্দ করে ওড়া ঢাউস ঘুড়ি। কে জানত লাটাইবাঁধা হয়েও ঘুড়ি এমন শারীরিক শব্দ করতে পারে। সন্ধ্যাবেলার টিমটিমে আলো জ্বলা বাজারে পাটের বস্তাগন্ধী চালের দোকান, অপর্যাপ্ত আলোয় ঝিলমিল করছে রাতের বাজারে ঢালাই লোহারঙা মাছ, ডাঁই করা আছে শীতের স্যাপগ্রিন নলডোগ শিম, সুরকি-লাল বিলিতি বেগুন আর ডার্ক পার্পল 'সিন্দুরকোটা' আলু। শীতের সন্ধ্যা মানে শ্রীকুণ্ডেশ্বরীর সামনে অলস সিগ্রেটের নীলচে ধোঁয়ায় পেকে ওঠা বুড়োদের সভা। আমার শীতের বেলা মানে মনকেমনিয়া মিহি রোদ, কুয়াশার ভিতরে চনমনিয়া আলোর ঝালর, শুকনো ধুলো উড়ানিয়া বাতাস।
আমাদের নানাবাড়িতে ছাদে ছিল শীতের সবজিবাগান, ছাদে মাটির চুলা গড়ে আমার নানি পিঠা বানাত, বিবিখানা বিক্রমপুরের দিককার পিঠা হওয়া সত্ত্বেও আমার মনে পড়ে না বিবিখানা পিঠা খাওয়ার কথা। বরং প্রায়ই হতো ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি, সারারাত দুধে-গুড়ে ভিজে মীমাংসায় আসতে চাওয়া নরম দুধচিতই পিঠা। নানির পাশে বসে থাকলে পাওয়া যেত সিন্দুকে তোলা চাদর-হেজলীন স্নো-জাম্বাক আর খেজুরগুড়ের সম্মিলিত গন্ধ। আকাশ ভরে উঠত নয়নতারারঙা সন্ধ্যার আলোয়, তারপর পুব দিকের আকাশে ফিরোজা অন্ধকারের ছোপ ধরলে চাঁদ উঠত, উজ্জ্বল হয়ে উঠত শুক্র গ্রহও। নির্মেঘ আকাশে তারার প্রদীপমালিকা। ফুটফুটে জোছনা-মিটমিটে জোনাকি আর গভীর কুয়াশা সাঁতরে নানা-নানির বাড়িতে পৌঁছলেই চাল সেদ্ধ করার-গুড় পাক দেয়ার-খড় পুড়বার নিবিড় সুগন্ধে অবগাহন। সরস্বতীপূজার পরের নতুন জোড়া-ইলিশ ভাজা আর কাঁচকলায় রাঁধুনি-ফোড়নের পাতলা ঝোল। আর শীতের আনাজ? সবুজ শিমের ঝোল-তরকারি প্রগাঢ় বর্ষাদিনের মতো তার রং, লাউয়ের শাদা তরকারির রং শারদীয় আকাশের তলাকার টইটুম্বুর বিলের মতো শুভ্র...বাটি বোঝাই ঋতু সে বাড়িতে। সন্ধ্যার মশার কয়েল জ্বলে জ্বলে ঘরের বাতাস বিষাক্ত, রেডিওতে 'ঢাকা ৮৬'-এর গান-'পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়', টিভিতে 'হীরামন' আর 'মাটি ও মানুষ'-এর নিয়মিত দর্শক দুই বুড়ো-বুড়ি, নানির এনামেলের ফিকে হলুদ মগে গাঢ় লিকারের চা আর মুড়ি, নানার টার্টান চেক মাফলারে বিঁধে থাকা টাইগারবামের গন্ধ। শীতকাল স্থির হয়ে থাকত বাসাবোতে! নিচু এলাকা, গাছপালাঘন, ঝিল-বিলে সজল। আর সে কী মশা, বাদুড়ের মতো বড় বড় মশা! নাগরিক শিশু চারপাশে তাকিয়ে কিছু রিক্তমনা আত্মীয়-অনাত্মীয় দেখত, যারা কেবল পিঠে খাওয়ার গল্প-হাঁস খাওয়ার গল্প-রস জ্বাল দেবার গল্প করত, আখকে ওরা ইক্ষু বলত কখনো।
পিঠাপুলির ওস্তাদ ছিল আমার দাদিও। দেশগেরামে ভেজে আনা মালপোয়া বেশি দিন টিকত না, গাঢ় খয়েরি জন্মদাগরঙা এ পিঠা এ আমার পছন্দ ছিল না একদম, বারাসাতের একটা দোকানে কয়েক বছর আগে সারা রাত কসরত করে ঢিমে আঁচে ভেজে রসে ভিজিয়ে বানানো মালপোয়া খেয়েছিলাম—মালপোয়াতে যে গোলমরিচ, মৌরি, শুকনো আদা ইত্যাদি দেয়া যায়, সেটাও জেনেছি তখন। অন্যান্য শীতের পিঠা বছরভর ভালো থাকত, রৌদ্রদগ্ধ বস্তুর গুণই এমন। ডুবোতেলে ভেজে চিনিগুঁড়ো বা ঝোলাগুড় ছড়িয়ে খাওয়া হতো। চুলার আশপাশে শাড়ির ওপর ফ্লানেলের জামা পরে ফুল পিঠা বা নকশি পিঠা তৈরি করত নুরেজাহার মা-সাইফুল্লার মা-বাচ্চুচাচি-ফুপ্পি-দাদুমণি-খুদু (খোদেজা)-বেদু (বেদানা) সবাই মিলে বসে। পিঠার কাঁইয়ে তেল লাগিয়ে চ্যাটালো রুটি গড়ে তা খেজুরকাঁটায় উসকে দিয়ে দারুণ দ্রুতিতে বানাত সেই পিঠার নকশা, ওরা হেসে হেসে আমাকে ডাকত—'আহো, আটিন করবার পারো হুনছি, কইরা দেহাও!' একবার বসে কী নাকাল হয়েছি...ওসব হচ্ছে হাতখোঁপা বাঁধবার বা চন্দ্রপুলির ধার মুড়বার দৃশ্য দেখবার মতো, ছদ্মসরল। অত কারিকুরি করে পরে পিঠাটা রোদে শুকিয়ে বা হালকা ভেজে কৌটোবন্দী করা হতো, যেন রাক্ষুসির প্রাণভোমরা। যত কারুকাজ তত খাস্তা, ভেজে তুলে গুড়ের সিরায় ডুবিয়ে পরিবেশিত হতো। কার্বোহাইড্রেটের বন্যা। সেকালে এসব চিন্তা ছিল না, না আমাদের, না বড়দের। 'ম্যাড়াপিঠা' নামের সেদ্ধ চালের আটার ডেলা দুহাতের তেলোয় করে ঘুরিয়ে বানানো যে 'ননা-ডেকাগনাল ডাইপিরামিড'(?) আকারের পিঠাটা থালায় করে আসত, সেটা ভাপে দিয়ে নরম করে বা কাটখোলায় শুকনো করে টেলে নিয়ে মাংসের ঝোল বা ঝাল কোনো ভর্তার সাথে খেতে হতো, দাস্ত হলে একখানা ম্যাড়াপিঠাই একবেলায় সারিয়ে দিত পেট ছুটবার ব্যারাম। কত রকমের শীতের পিঠা হতো আমাদের গ্রামে? কেউ উঠানের রোদে শুকিয়ে নেয়া, কেউ গতবারের কৌটো থেকে বেরিয়ে আসা, কেউ ভাপে গড়া, কেউ শিলনোড়ার নিচ থেকে-কেউ ঢেঁকির তলা থেকে-কেউ কাহাল আর ছিয়ায় পিষে আসা, কেউ বা বাঁশের চাঁচে খুঁচিয়ে বা কেঁচে নেয়া, কেউ গুড়ের সিরায় এক ডুব দিয়ে আসা, কেউ সারা রাত দুধ-নারকেল-খেজুররসের সান্দ্র দ্রবণে ভেজা। আরও কত পিঠাপুলির নাম জেনেছি বই পড়ে—হংসকেলি, শোভারিকা, চন্দ্রকান্তি, ললিতা, কর্পুরকেলি, অমৃতকেলি, রসকরা। চেহারাও চিনি না তাদের, কে জানে তারা কোথায় হারিয়েছে। কোথায় হারিয়েছে সেই রাখাল, যে পিঠাগাছে উঠে ছড়া কাটত,
পুলিপিঠে সাদাসিধে/ ভাজা পিঠে ভালো,
রসের পিঠে ভারী মিঠে/ বেজায় রসাল...
বুদ্ধদেব বসু শীতকাল বিষয়ে তাঁর 'হঠাৎ-আলোর ঝলকানি'তে প্রায় কঁকিয়ে উঠেছিলেন: '...সবচেয়ে আমি ভয় করি এই শীতকে-যখন তিনটে বাজতেই ঘরের মধ্যে অন্ধকার হয়ে আসে...এই ধোঁয়া, আকাশের এই অনস্তিত্ব, বিষাক্ত সর্পিল এই পরিমণ্ডল। সবচেয়ে বিশ্রী লাগে বিকেল থেকে হঠাৎ যখন রাত্রি হয়ে যায়। ইংরেজিতে হলে বলতুম "রাত্রি পড়ে"...রাত্রি পড়ে, কলকাতায় এই শীতে, আকাশ থেকে যেন ঝুপ করে কিছু খসে পড়ে, একটা নোংরা স্যাঁৎস্যাঁতে কম্বল, যার নিচে সমস্ত সৃষ্টি চাপা পড়ে যায়। সব রেখা মিশে যায়, হারিয়ে যায় সব সূক্ষ্ম কোণ, রঙের আভা যায় মিলিয়ে।' সত্যি কিন্তু শীতের 'শাদা' শরতের মতো অমল-ধবল নয়, এর 'কালো'ও বর্ষার নিবিড় অন্ধকারের পুঞ্জ নয়, যার ছায়ায় দিব্যি মন মেলে দেয়া যায়—এ হলো রিক্ততার দৃশ্যমান ইঙ্গিত-'কোনো আদিম সরীসৃপ অস্পষ্টভাবে, অন্তহীনভাবে কেবলই নিজেকে প্রসারিত করে চলেছে...বেরিয়ে এসেছে প্রেতের দল, আমারই কল্পনার সৃষ্টি-পৌষ তাদের ডাক দিয়েছে...কোনোকালে অর্ধ-অনুভূত কোনো আতঙ্ক, দু-বছর আগেকার চাপা-পড়া হতাশা, কোনো দিবানিদ্রার দুঃস্বপ্ন, শৈশবের কোনো অবচেতন ভীতি। এরা সবাই সম্পূর্ণীকৃত, পুনরুজ্জীবিত এই পৌষের স্পর্শে।' তবে অত মনোজাগতিক প্রেতের উস্কানি ছিল না আমার শীতকালে, আমারটি ছিল নিবিড়-বিধুর-মনোরম, লিনেন শাড়ির মতো। বর্ষার যেমন গন্ধ ছিল, শীতেরও ছিল—কাঠখড় পোড়া গন্ধ, নীহার ভেজা গাছের গন্ধ, শেষ কুন্দ-শেফালির আর্ত সুবাস।
'শীতকাল আমার প্রিয় ছিল' বাক্যটা লিখতেও এখন গায়ে কাঁটা দেয়; শীতপ্রধান দেশে স্যাঁতসেঁতে বৃষ্টিভেজা শহরের হাড়কাঁপানিয়া জলবায়ুতে 'প্রিয়' শব্দটা মনে পড়লেও কান্না পায়। প্রিয়বিরহীর কোনো ঋতু নেই শীতের দেশে, বারো মাসের আট মাসই নানান মাত্রার শীত, আবহাওয়ার গল্পই সেখানে খোশগল্পের কিংবা কুশলজিজ্ঞাসার পন্থা। প্রথমবার আমি শীতের দেশে গেছিলাম শেষ শরতে, হেমন্ত সেবার বেশ ছোট্ট করে সারল মনে আছে, কিছুদিনের ভেতরেই দেখতে পেলাম, বেলা তিনটের আকাশে লোহার বালতির মতো অন্ধকার আর তাতে ভাসছে ডুবছে একরকম ফোলা ফোলা বনরুটি চাঁদ। সেই চাঁদ ঢেকে দেয় বৃষ্টির মেঘ, ছরছরে বৃষ্টি। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, 'এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে'; তাঁর কবিতা পড়ে পড়ে আমি বিলাইতি শীত সইতে চেষ্টা করতাম। গড়াগড়ি দিয়ে ডাকতে ইচ্ছে হতো-'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব'... প্রতি সন্ধ্যায় সত্যিই কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দিত আমার শরীরে। ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে নামা হাঁস দেখতাম ধূসর আকাশে, সিকামোরের পচা পাতা বাতাসে উড়ে এসে জমছে ঘোড়ার জল খাওয়ার পরিত্যক্ত আয়তাকার পাথরের চৌবাচ্চাগুলিতে—প্লেনট্রিগুলোর পাতা দেখতে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা'র মতো। শুরু হয়ে গেছে সূর্যহীন ঋতু। সারা শীতকাল ঝড়বৃষ্টি হয় এ মুলুকে। যেন শুধু পাঁজরের তলায় তলায় নিজের শীর্ণ আঙুল চালিয়ে দিয়েই শান্ত হয়নি এই ডাইনি, সেই আঙুলগুলো দিয়ে ক্রমাগত টেনে ছিঁড়ছে আমার বুকের পালক, ডানার রেশম। শীত নিয়ে কত কাব্য করেছেন কোলরিজ-কিটস-হুইটম্যান-ইয়েটস, শীতের তেরচা আলো নিয়ে কবিতা লিখেছেন এমিলি ডিকিন্সন, কিন্তু ওসব কবিতা আমার ডানার তলায় এতটুকু নুন-হলুদের প্রলেপ দিতে পারল না বিলেতে প্রথম শীতসংকাশে। কোথায় গেল 'সুয্যিমামার বিয়েটা'? কোথায় গেল বৃষ্টিসন্নিধানে আমার 'অঙ্গে হর্ষের পড়ুক ধুম'? শীতপ্রধান দেশে শীতেই মানুষের ভিতরে অস্থিরতা বাড়ে, বিষণ্নতা বাড়ে, অভিবাসী এশীয়দের বাড়ে ভিটামিন-ডির অভাবজনিত ব্যাধি বা ব্যাধির উপসর্গ...ওসব কিছুই না জেনে ধূসর বাড়িঘর, ইঁদুররঙা পিচঢালা রাস্তা, মেঘ চোঁয়ানো জোছনা আর ফ্যাকাশে শাদা আকাশের নিচে আমি যা অনুভব করতে লাগলাম লাগাতার, তার ভালো নাম 'আত্মহত্যার প্রয়াস'। ঐ ভেজা বৃষ্টির শীতকাল মনে পড়িয়ে দেবে ডিলান থমাসের লাইন,
Dust the china, feed the canary, sweep the drawing-room floor;
And before you let the sun in, mind he wipes his shoes.
(চীনেমাটির বাসন পুঁছিও, আঙন মুছিও বসার ঘরের, পিঞ্জিরার পাখিরে দিও আহার,
মনে রেখ যেন অঝোর বেলায় জানালা গলায়ে রৌদ্র আসিলে মুছাইও জুতা তাহার।)
ভুলে জানালা গলে রৌদ্র এলে আমিও ভেবেছি আকুল কেশে তার উজ্জ্বল পা মুছিয়ে দেব...আহা রৌদ্র। এই রৌদ্র যে আমার কী, সূর্য যে আমার কত বড় সখা, সেসব এমন করে বুঝব কে জানত! কোথায় ফেলে এসেছি সূর্যকরোজ্জ্বল সকাল আর মাঘসংক্রান্তির রাত, তারায় নির্মিত অনন্ত আকাশগ্রন্থি, মুনিয়ার বাসায় শীত আর শিশিরের জল, সার্কাসের ব্যথিত সিংহের ভেসে আসা হুংকার, মেঠো ইঁদুরের গর্তের খুদ শীতের আর্তি মাখা যত কিছু পশ্চিমের বারান্দায় কালো আলোয়ান গায়ে দিয়ে আমি ভাবতাম...পাশের দালানের পেছনে ঝিনুক আকারের টিনের ঢাকনির নিচে টিমটিমে একটা বাতি, সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে।
কেমন হতো যদি শীতকাল না থাকত? ছোট্টবেলার শীত যতই লালচে লোভনীয় লাগুক না কেন, এখন ওসব শুনলে রাজেশ খান্নার ঢঙে গেয়ে ফেলব—ইয়ে লাল রং কব মুঝে ছোড়ে গাআ! মাঝে মাঝে ভাবি, খুব খুশি হতাম শীতের দেশে প্রায় বারোমাস্যা এই শীত না থাকলে...কিন্তু আসলেই কি তা-ই? বেচারা মেরুভাল্লুক তখন কেবল সাঁতরেই বেড়াত মেরুসমুদ্রে, কোথাও বরফের চাঙর পেত না জিরাবার, বরফে চেপে শিকার করবার। শীতঘুমে যেতে পারবে না হামিংবার্ড, সজারু, ব্যাঙ, কচ্ছপ, কাঠবেড়ালি, বাদুড়, গিরগিটি, ভালুক। আহা, শীতের ছোঁয়াচ ছাড়া নাকি গাছের ছুটি মেলে না, ওদেরও নাকি অ্যানুয়াল লিভ চাই—শীতকাল সেই ছুটির দিন, তখন গাছ বছরের আবর্জনা ঝরিয়ে ফেলে, ব্যাধি মোচন করতে চেষ্টা করে। আমাদের খরিফ মন, ছোটবেলার রেডিও-টিভিতে কারা গাইত, 'ছয়টি ঋতু দাও ফিরিয়ে ওগো নিয়তি, অনন্ত গ্রীষ্ম হেমন্ত বর্ষা শরত শীত দাও কমিয়ে, বসন্ত দাও অফুরন্ত'। রবীন্দ্রনাথ শীত ঋতুর বর্ণনায় লিখেছিলেন—সাজ খসাবার লীলা। হায়, কোন সংসারী না জানে, সাজ না খসলে ফুল-ফল-ফসলের মৌসুম আসে না! ওসব আমি জেনেছি ধীরে ধীরে। জেনেছি বাসন্তী প্রস্তুতি নেবার জন্য শীত ছাড়া চলবেই না গোলাপের কিংবা টিউলিপের। শীতের দেশের বাঘা বাঘা ফলের গাছের বীজের কখনো অঙ্কুরোদ্গম হবে না (আপেল, নাশপাতি, চেরি, এপ্রিকট, প্লাম, পিচ, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি, আঙুর), ফসলের ঘুম ভাঙবে না, যদি না তাদের শীতের ছোবল খাওয়ানো হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতে যেমন বলা হয়—'আম-কাঁঠালপাকা গরম'...গরমের আঁটোসাঁটো আলিঙ্গন বিনে তাদের ফল ফলবে না, তার উলটো রকমের ব্যবস্থা শীতের দেশে। শীত যেন অস্কার ওয়াইল্ডের সেই গোলাপকাঁটা, যাকে বুকে বিঁধিয়ে নাইটিংগেল গান গেয়েছিল বলে রিক্ত শাখায় রক্তগোলাপ ফুটেছিল।
পশ্চিমে যাঁরা বাগান করেন, তাঁরা হিসেব করেন—শীতকালেও শোভা দেয়, গুটি পাকে, ফুল ধরে এমন গাছ যেন বাগানে থাকে, নইলে ছোট ছোট পতঙ্গ আর প্রাণী অনাহারে মরবে (আমি নিজ চোখে দেখেছি শীতের হেলিবোর ফুলের কেশরে লুটিয়ে পড়ে ভোমরা শীতের শেষ সঞ্চয় জুটিয়ে নিচ্ছে, এরপর শীতঘুমে যাবে সে)। বাগানের শোভা বারোমেসে হতে হবে, মধুর মৌমাছি ছাড়াও কত রকমের মৌমাছি আছে—সব্বার খানা চাই এ দস্তরখানে। এখন বলা হয়, শীতকালের ঝরা পাতা সাফ করে পুড়িয়ে দেয়াটা পরিবেশবিরোধী। যত আগুন তত কার্বন ডাই-অক্সাইড। অথচ ঝরা পাতা ভঙ্গুর, পচনশীল, লিফ মোল্ড তথা পাতাপচা সারের উৎস; এই ঝরা পাতা পদতলে ঝরিয়ে গাছ ফাঙ্গাসের আহার জোগায়, পরিণামে গাছ তার আগামী বছরের পুষ্টির ব্যবস্থা করে নেয়। ঝরা পাতার আড়ালে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে বহু ক্ষুদ্র প্রাণী আশ্রয় নেয়, সেসব প্রাণী নিজে মাটি ভেঙে সার তৈরি করে, অন্যান্য প্রাণীর আহার হয়, বাস্তুসংস্থানের জন্য যারা অপরিহার্য। মাঝে মাঝে বাগানে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ভাবি, আমার কান যদি পোকামাকড়-ছত্রাক-কীটাণুর সেই অসামান্য খরোজ সংগীত শুনতে পেত, মাটির তলায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে এরা অগণন জীবনকে ফুলেল করে তুলছে, অক্লান্ত বেগে কুটো করছে সমস্ত পাতা-পত্তর, কথা বলিয়ে দিচ্ছে এক গাছের শেকড়ের সঙ্গে অন্য গাছের শেকড়কে, যারা জীবজগতের সবচেয়ে ব্যস্ত কারিগর।
ইস্কুলে শীতের ছুটি শেষে ফিরে দেখতাম, আমাদের অবর্তমানে হলঘরে ওয়াইএমসিএর অনুষ্ঠানগুলো হয়ে গেছে। শীতে খড়ের আগুন করে তাপ পোহাতে গিয়ে কেয়ারটেকার পরিমলদার হাতে-পায়ে-গালে আগুনের লেলিহান দাগ। দুর্গত মানুষদের জন্য শীতবস্ত্র জোগাড় করা হতো, আর টাকা। প্রদীপ হাতে ইস্কুলের মেয়েরা নাচত—হিমের রাতে ঐ গগনের দীপগুলিরে। গাইতাম—শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর ঐ ডালে ডালে, শীতের গানে অত আনন্দাতুর উচ্ছ্বল সুর! নজরুল লিখেছেন—পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে...ওটাও খুব গলা খেলিয়ে আবৃত্তি করা হতো। রচনা লিখতাম বেশ আশাপ্রদ উদ্ধৃতি দিয়ে, পার্সি বি শেলির বাণী—ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড। শীত এসেছে তাতেই মনে কোরো যেন বসন্ত সমাগত, দূরে নেই সে। আশা এই কবির প্রিয়, মৃত্যুকাল অবধি তাঁর আংটিতে খোদাই করা ছিল—ইল বুওন তেমপো ভেররা, শুভদিন আসবেই। বসন্তের আশায় শীত কাটিয়ে দেয়াটা তেমন কঠিন তো নয়। মিথলজি পড়তাম লাইব্রেরির বইয়ে, সেই যে শীতকালের গল্প—ডিমিটারের কন্যা পার্সিফোনিকে চুরি করে পাতালে নিয়ে গেলেন পাতালের রাজা হেডিস। কন্যাকে খুঁজে না পেয়ে ফসললক্ষ্মী ডিমিটার উন্মাদিনী হয়ে পড়লেন, জীবজগতের সবার প্রাণ যায় যায়। দেবাদিদেবের আদেশে হেডিস পার্সিফোনিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেন, শুধু ছেড়ে দেবার আগে ছল করে খাইয়ে দিলেন একটি ডালিমদানা। মরজগতের কেউ পাতালের ফল খেলে তাকে ফিরে আসতেই হয়, পার্সিফোনিকেও ফিরে আসতে হয় ছয় মাসের জন্য পাতালে—সেটা শীতকাল, তার ধরিত্রী মা অস্থির হয়ে ওঠেন কন্যাবিয়োগে। বাকিটা সময় ফুলে-ফসলে মাতা ডিমিটার ভরে তোলেন পৃথিবী, কন্যা যখন তাঁর কাছে।
জীবনানন্দ দাশ যেমন শীতের কবি, বিমল কর শীতের গল্পকার—ওঁর 'সুখ', 'হেমন্তের সাপ', 'মোহনা'...এমন অনেক গল্পের পটভূমি আমাদের মেদুর শীতকাল। 'আ ক্রিসমাস ক্যারল'—শীত ঋতুর উপন্যাস। 'লিটল উইমেন'-এর শুরুতেই লুইসা মে অ্যালকট চিনিয়ে দিচ্ছেন শীতের দাপট। ছোট্টবেলার সেই সুইস আল্পসের মেয়ে 'হাইডি'কে মনে পড়ে। মনে পড়ে অরহান পামুকের 'স্নো' উপন্যাস। 'সামান্য ক্ষতি' কবিতার সেই কাশীর মহিষী করুণাকে শীতকালে ভোলা অসম্ভব। 'পৌষের কাছাকাছি, রোদমাখা সেই দিন ফিরে আর আসবে কি কখনো'—মান্না দের এই গান কত গুনগুন করতে শুনেছি মামাদের। শীতের পাখি-হাঁস খাওয়ার হিড়িক দেখলে আমার মনে পড়ে অতিথি পাখির বেঁচে থাকবার প্রগাঢ় আর্তি, হাঁসের ভোজ আমাকে মনে করিয়ে দেয় জ্যান্ত হাঁসী ধরে মুসলমান মেয়েটির খাওয়ার উৎকট গল্প—'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' উপন্যাসে। মনে আছে বিনয়ের সেই লাইন 'সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে' শুনে কেমন মুখ বাঁকিয়ে আমি বলেছিলাম—এই কবি বকুল চেনেন না।
এখনো যখন বাড়ি ফিরি, শুনি রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশে কারা কুয়াশাময় পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হোহো করে হেসে ওঠে? শহরে কিংবা মফস্বলে? আকাশে ইঁদুরে কাটা চাঁদ, বাদামগাছের ফাঁকে। দুই যুগ আগে তাদেরই বাপসকল এমন পথে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে আর শাদার ওপর বরফিছাপ মাফলার গলায় শীতরাতে হেঁটে যেত? ভোররাতে এখনো শহরের শেষ মোরগরা বাঁক দেয়, আলোর অনুভূতি জানায়। 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা' শব্দগুচ্ছকে যেন আকার দেয় ফড়িংয়ের ডানারঙা সকালের আকাশ।