শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা…
১
শীতকাল এলে তিন মাস ঘুমিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। ব্যক্তিমানুষের অবসাদে, ক্লান্তিতে তাঁর কবিতার প্রোটাগোনিস্ট কোনো এক সুপর্ণার কাছে জানতে চায়, 'শীতকাল, কবে আসবে?' বহু বছর আমি বাক্যটি নিয়ে ভেবেছি, 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব।' ভেবে, শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছি, শীত আসে এবং মাস তিনেক পর চলেও যায়; কিন্তু নিজস্ব বিপন্নতায় জেরবার কবি এই যাওয়া-আসা বুঝতে পারেন না; কেননা তার মনে হয়, 'কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে... ', কবির ধমনিতে প্রবাহমান রক্ত উষ্ণতা হারিয়ে ফেলেছে, সহনাগরিক অনেক মানুষের মতো, তিনি নিশ্চিত নন ব্যাঙের রক্ত হাতে এগিয়ে আসা আততায়ীকে-মানুষকে শীতল নিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়। আমরা হয়তো চিনে উঠি, সে আর কেউ নয়-দিন যাপনের গ্লানি আর উদ্বেগ সেই অকরুণ হত্যাকারী। আমাদের জীবন তো এক ঘুম থেকে অন্য ঘুমের দিকে ছোট ছোট লাফ। শেষ পর্যন্ত নিশ্চল এক ঘুম গ্রাস করার আগেই যত বাসনা, সমর্পণ, প্রতিরোধ বিনা স্থবির থাকা।
শীত, বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া বিপর্যয়ের প্রভাবে প্রতিবার অধিক শৈত্য নিয়ে ফিরে আসে। মনে পড়ে, তিরিশ বছর আগেও এত দাপট ছিল না শীতের। দীর্ঘ সময় কুয়াশার পর্দা ঝুলে না থেকে খানিক বেলা হলেই উঠে যেত নিয়মমাফিক রোদ। ফতেজঙ্গপুরে শরিকি পুকুরঘাটে পাড়াতুতো ভাইবোনেরা খড় জ্বেলে রোদ পোহাতাম। কবি লিখেছিলেন, 'রক্তে শর্করা, প্রিয়তমা-চুম্বন নিষিদ্ধ তাই।' কচি বয়সের রক্তে শর্করার আধিক্য আসেনি, চুম্বন তখন ঈশ্বরের মতোই প্রতীকী ধারণা। কবে কোন সামন্ত রাজা জঙ্গ তথা যুদ্ধ ফতে অর্থাৎ জয় করার স্মারক এই ফতেজঙ্গপুর গ্রামে কয়েকটি বালক-বালিকা ডিসেম্বরজুড়ে বিকল্প পথের পাঁচালী ফলিয়ে তুলত। আমরা সত্যজিৎ নয় বিভূতিভূষণ-সৌজন্যে চিনেছিলাম গ্রামরাস্তার সুন্দর আর বেদনা। 'মেঘমল্লার' গল্পে যেমন নেমে এসেছিলেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী। আর মৃদু শীতে আমরা গ্রামে পড়শীদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতাম ছোট ছোট ঘরোয়া পুজো। পাড়ার সর্বজনীন প্রতিমা। তখন যথার্থই সর্বজনীন ছিল আমাদের বারো মাস তেরো পার্বণ। কোনো কোনো কিশোরী, তরুণী পুরো মাসজুড়ে অতি ভোরে কনকনে ঠাণ্ডা পুকুরে স্নান সারতেন। গ্রাম্য পরিভাষা এটি মাইঘ্যা ব্রত। মাঘ মাসে পালনীয় এই ব্রতে অগ্নিস্পর্শ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভালো বরের আশায় তারা এই স্নান করতেন এবং মাঘ মাসজুড়ে। রুমি তেমন এক নারী, সারা মাস শীতে কেঁপে ব্রত পালন করে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করে তিন মাসের মাথায় কয়লা হয়ে গেল। প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে নিরাশ করলেও অগ্নিদেবতা তাকে নিরাশ করেননি।
২
শীতজাতক কবি জয় গোস্বামী আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেন ক্রিসমাসের সাথে শীতের সম্পর্ক কত অমোচনীয়! সেই কারণেই তাঁর প্রথম কাব্যপুস্তিকার নাম 'ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ'। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এই মিতায়তন গ্রন্থে আছে শীতের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। তরুণ কবির কাব্যসুন্দর ভাষায়-প্রবীণ কেউটে 'অদ্ভুত, শীতল কুণ্ড' ঘিরে শুয়ে থাকে। 'শিশুর প্রসঙ্গে' এলে 'লাজুক ছাত্রীর চোখ নিচু হয়ে' আসে। ক্রিসমাস গাছের সময়ে লাল জাহাজের ভোঁ, সাদা শিশুর প্রসঙ্গেই ছাত্রীর নীরবতা। পরবর্তী জীবনে আমরা দেখেছি, তার রচনাকর্মের বেশির ভাগজুড়ে সম্পর্কের মধ্যকার শৈত্যপ্রবাহ। যেমন একটি উপন্যাসের প্রথম বাক্য-'সে, মানে যৌনশক্তি, চলে গেছে।' মানুষ স্তব্ধ ইচ্ছে হলে রক্তে হিম নেমে আসে। 'গর্ভপাত' কবিতার চারটে বাক্য পাঠককে আজও নির্বাক করে দিতে পারে। 'মাথার উপর অন্ধ দিদির হাত/ ঘুমিয়ে পড়ো, ঘুমিয়ে পড়ো, ছেলে/ লাল চাদরের ঘোমটা মাথায়, পৌষ মাসের রাত/ অন্ধ দিদি, কোথায় আমায় পেলে?' 'নির্বাক' শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'নির্বাক' চলচ্চিত্রের কথা, যেখানে মর্গে ডিপফ্রিজারে রাখা শব, হিম শীতলতার এক অন্য চেহারা নিয়ে এসেছিল।
বাংলা চলচ্চিত্র কবিতার হাত ধরে চলেছে কোনো কোনো সময়। জয় গোস্বামী আর ঋতুপর্ণ ঘোষের যৌথ নির্মাণ 'সব চরিত্র কাল্পনিক' । এই ছবিতে শীতের কুয়াশার একটা মুখ্য ভূমিকা আছে। যৌথ নির্মাণ বললাম, কেননা জয়ের 'নন্দর মা' কবিতা এই চলচ্চিত্রের জন্য লিখে অনেক দিন ফেলে রাখা হয়েছিল। 'সব চরিত্র কাল্পনিক' এক কবির জীবন হৃদয়ের কুয়াশা, দাম্পত্য জটিলতা এবং ধূসর কবিতা ভাষায় এক অনন্য চলচ্চিত্র। বস্তুত ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রায় সব চলচ্চিত্রেই শীত ঋতুর একটা অন্য প্রতিবেদন নথিভুক্ত আছে। চলচ্চিত্রের লেন্সে ধূসর কুয়াশা, শীতের বরফ পড়া, বাংলা ছবিতে নস্টালজিয়া বোঝাতে-প্রণয় রহস্যের আলো-আঁধারি বোঝাতে ফিরে ফিরে আসে। আর বিদেশি ফিল্মে যেমন ফেলিনি 'আমারকর্ড'-এ তুলে আনেন জন্মশহর। ইংমার ব্যারিম্যানের ছবিতে শীতের দৃশ্যমালা ফিরে ফিরে আসে, বিশেষত 'ফারো আইল্যান্ড' পর্বের সিনেমাসমূহে। 'সেভেন্থ সিল'-এর ওই বিখ্যাত দৃশ্যে কি শীতল আবহ ছিল না? তুর্কি পরিচালক নুরি বিলগে সেলানের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র 'অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস' তিন ঘণ্টার বেশিজুড়ে সাদা বরফ ফিরে ফিরে আসছে। আকি কৌরোসমাকির সিনেমার কুশীলবরা ফিনল্যান্ড নামক দেশটির আর্থিক বিপর্যয়ের অগত্যা শিকার, মানুষে মানুষে সম্পর্কও প্রশ্নের মধ্যে পড়ে-শহরের বুড়িয়ে যাওয়া কাঠামো আর স্কাইলাইন আমাদের উপলব্ধি করায় শীতের রকম কত আলাদাই না হতে পারে!
আমার অতি প্রিয় পরিচালক গ্রিসের থিওডোরাস অ্যাঞ্জেলোপোলুসকে অনেকেই চেনেন 'ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট' চলচ্চিত্রের সুবাদে। পৌরাণিক গ্রিসের পর্যটক-পছন্দ আবহকে তিনি মুক্তি দেন দেশটির অতীত আর বর্তমানের রাজনৈতিক ইতিহাসে। ইউরোপকে একত্র করতে চাইতেন সতীর্থ ক্রিস্তফ কিয়েস্লোস্কির মতো। বলেছিলেন একবার-'আমরা ইউরোপের একত্রীকরণ নিয়ে কথা বলছি...তবু এখনো ক্ষয়ে যাওয়া এলাকাজুড়ে আরও বেশি করে সীমান্ত তৈরি করছি। খুব দ্রুত আমার নিজের বাড়ির দরজার সামনে সীমান্ত দেখব আমরা। আমার বাড়ির চারদিকে গজিয়ে উঠবে সীমান্তের কাঁটাতার। আর একদম নগদে-নিজেই হয়ে পড়ব রাষ্ট্র!' রাজনীতি আর ইতিহাসের ধূসর এলাকাকে নিয়ে কথা বলবার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল তার। ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্টের শেষে যেমন দেখি। ঘোর কুয়াশার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভাইবোনকে। হংকংয়ের ওং কার ওয়াইয়ের কাছে শীত হিমজমাট একাকিত্ব নিয়ে আসে। মনে পড়ে, 'মাই ব্লু বেরি নাইটস'-এ শীতের রাতে নোরা জোনসের ঘুমন্ত, ক্লান্ত ঠোঁটে লেগে থাকা ক্রিম আলতো ঠোঁটে তুলে নেন জুড ল। বিশ্ব সিনেমায় এক অভাবিত মুহূর্ত তৈরি হলো। ক্রিস্তফ কিয়েস্লোস্কির কালার্স ট্রিলজির 'হোয়াইট' ছবিজুড়ে শ্বেত বরফ, প্রগাঢ় শীত। ডেকালগের প্রথম চলচ্চিত্রে তো শীতেরই অভিঘাত-জমাট হ্রদে স্কি করতে গিয়ে আত্মজ হারিয়ে গেলে ধর্মবিশ্বাসই নড়বড়ে হয়ে যেতে থাকে-যত দূর মনে পড়ে; আমাদের দেশের চলচ্চিত্র, শিবলী সাদিকের 'অন্তরে অন্তরে', সালমান শাহ আর মৌসুমীর অজর চলচ্চিত্র। শীতের ছুটিতে আসা সালমান আর গৃহ সহকারী মৌসুমীর প্রণয় আখ্যান। একটি দৃশ্যে ঘিয়ের কৌটোয় আঙুল ডুবিয়ে তা নায়কের মুখের সামনে তুলে ধরছেন। কেননা, তার মুখে ঝাল। কাকতাল এই, ক্লাস সিক্সের বালক এই দৃশ্যে যে ইরোটিসিটি পেয়েছিল, পরবর্তী জীবনে তুমুল সিনেবাফ হলেও অমন অভিঘাতক্ষম দৃশ্যের সামনে পড়েনি। ঘটনাচক্রে, শহরে তখন শীতকাল।
৩
শীত এলে মনে পড়ে আমার দুই দিদিমণিকে। একজন আমার মায়ের মা, অন্যজন তাঁর ননদ। ভাইবউ আর ননদে ঘরোয়া ঝামেলার যে ঘটনার পরবর্তী প্রায় ঘরে দেখেছি, তাঁরা ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। আমরা বেড়াতে গেলে অগণিত পিঠেপুলি বানাতেন। আমার দিদিমণি রেনুবালা দূরের দূরের হরিলুটের আয়োজনে যেতেন। গৃহস্থ বাড়িতে উঠোনে শীতের রাতজুড়ে হরিনাম সংকীর্তন হতো। সেখানে বিতরণ করা হতো বাতাসা, খই। খানিক বাদে বাদে রং চা। আমার শিল্পপ্রাণ দাদু, মায়ের আপন ছোট মামা, এই ধরনের জমায়েতে হারমোনিয়াম বাজাতেন। বিনোদবিহারী সত্যই বিনোদ তথা আমুদে ও বিহারী তথা সঞ্চরণশীল ছিলেন। ডিসেম্বর মাসজুড়ে এই হরিলুটের পাশাপাশি হতো রাতব্যাপী যাত্রা। মূলত পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে। রামায়ণে হনুমানের রোলটা খুব ভালোবাসতাম। স্টেজের পেছনে ওরা খড়ের লেজ লাগিয়ে সময় হলে লাফিয়ে নামত মঞ্চে। ভোরে একদিন, মনে আছে, দাদুর বদান্যতায়, সেই ল্যাজ পেছনে লাগিয়ে ভোরবেলা খুব আনন্দ করে ফিরেছিলাম।
এখন গ্রামের অর্থনীতি দুমড়ে গেছে। ঢালাও হরিলুট আর যাত্রার ঔদার্য দেখাবার ক্ষমতা কমেছে একসময়ের বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের। ভূমির চরিত্র বদলানোয় স্বাদ বদলে গেছে চিরাচরিত খেজুরের রসের। বন্ধুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। গ্রামে গাছ কেটে প্রচুর নতুন বসতি হয়েছে। বিশাল উঠোনেরা শরিকি সীমানাপ্রাচীরে বিভক্ত। তবু মনে হয়, আমাদের পুকুরের পূর্ব প্রান্তের শ্মশানঘাট চিরন্তন। কেননা, কত যুদ্ধ, মারি পেরিয়ে ঘাট আজও স্থির। কোনো এক শীতে যদি আমার শরীর কারও উষ্ণতা এনে দেয়, এটিও এক জীবনের অর্জন। জীবনানন্দ পরের জন্মে কমলালেবু হতে চেয়েছিলেন কোনো অসুখক্লান্ত মানুষের মাথার পাশের, আমি না হয় এই জন্মেই শব হতে চাইলাম।