ফ্যানি কাপলানের বুলেটই লেনিনের মৃত্যুকে তরান্বিত করেছিল!
আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করা ঘাতক জন উইলকিস বুথের নাম আমেরিকাতে কারও জানার বাকি ছিল না। রয়টার্সের ব্রেকিং নিউজের সুবাদে সে নাম দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে হত্যা করে নাথুরাম গডসে হয়ে ওঠেন বিশ্বনিন্দিত এক নামে, অবশ্য মোদির বিজেপির কল্যাণে নাথুরাম এখন ন্যাশনাল সেলিব্রিটি। নাথুরাম গুলি করেছিল।
জন এফ কেনেডিকে ২২ নভেম্বর ১৯৬৩ গুলি করে হত্যা করে সুপরিচিত মানুষের তালিকায় নাম উঠিয়েছেন লি হার্ভে অসওয়াল্ড।
ফ্যানিয়া (ফ্যানি) কাপলানের নামও বিশ্ব জানত। কিন্তু তা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। ভ্লাাদিমির ইলিচ লেনিন তার পিস্তলের গুলিতে মারাত্মক আহত হলেও নিহত তো আর হননি। ব্যাপারটা তখনই ঘটে গেলে লেনিনের মৃত্যু বার্ষিকী পালন করতে হতো ১৯১৮ সালে। কিন্তু জখম নিয়েও তিনি টিকেছিলেন আরও প্রায় ৬ বছর। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই হত্যাপ্রচেষ্টা এবং ফ্যানি কাপলানকে নিয়ে এই নিবন্ধ।
লেনিনের সৃষ্টি করা রুশ গোয়েন্দা পুলিশ 'চেকা'র (যাদের হাতে লেনিনের আমলে লাল সন্ত্রাসের সৃষ্টি, যাদের উত্তরসূরি কেজিবি) কাছে দেওয়া ফ্যানিয়া কাপলানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি:
'আমার নাম ফ্যানিয়া কাপলান। আজ আমি লেনিনকে গুলি করেছি। আমি আমার নিজ উদ্যোগেই এটি করেছি। কার কাছ থেকে আমি রিভলবার নিয়েছি, বলব না। আমি বিস্তারিত কোনো কিছুই জানাব না। আমি অনেক আগেই লেনিনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি মনে করি, লেনিন বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কিয়েভে জারের এক কর্মকর্তাকে হত্যাপ্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের জন্য আমাকে আকাতুয়েতে নির্বাসন দেওয়া হয়। আমি কঠোর শ্রমে সেখানে ১১ বছর পার করেছি। বিপ্লবের পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি নির্বাচিত গণপরিষদকে সমর্থন করেছিলাম এবং এখনো তারই পক্ষে।'
৩০ আগস্ট ১৯১৮ ভ্লাাদিমির লেনিন মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলে হ্যামার অ্যান্ড সিকল নামক অস্ত্র কারখানায় ভাষণ দেন। লেনিন ভবন থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে ঢুকছিলেন, কাপলান তাকে ডাকলেন, যখন লেনিন তার দিকে ঘুরলেন, তিনি তার হাতের এফএনএম ১৯০০ পিস্তলে তাকে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি ছোড়েন। একটি গুলি তার কোটের ভেতর ঢুকে যায়। একটি বাঁ ফুসফুস ছিদ্র করে তার ডান কলার বোনের কাছে এসে আটকে যায়। আর একটি বুলেট বাঁ কাঁধে ঢুকে পড়ে।
লেনিনকে ক্রেমলিনে তার আবাসিক কোয়ার্টাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে অন্যরাও হয়তো তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে থাকতে পারে। চিকিৎসা লাভের জন্য তিনি ক্রেমলিনের নিরাপত্তা ছেড়ে যেতে সম্মত নন। তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আনানো হলো, কিন্তু হাসপাতালে নয় বলে তারা বুলেট অপসারণ করতে পারলেন না। তার জখম গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেঁচে গেলেন, কিন্তু কখনই এই আক্রমণের জখম থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেলেন না। অনুমান করা হয়, এই গুলিই পরবর্তী সময় তার স্ট্রোকের কারণ হয়, তা লেনিনের কর্মক্ষমতা হরণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্যানিয়া কাপলানের ধরা পড়া নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ডেপুটি কমিশনার এম এন বাতুলিন বলেছেন, যখন তিনটি গুলির শব্দ শোনেন; তিনি লেনিনের কাছে থেকে ২০ কদমের মধ্যেই ছিলেন, তিনি দেখেছেন মুখ থুবড়ে লেনিন মাটিতে পড়ে আছেন। তারপর তিনি একজন নারীকে দেখেন, তাকে খুব সন্দেহভাজন মনে হচ্ছিল, তিনি তাকে আটকে ফেলেন। পরে দেখা যায় এই নারীই ফ্যানি কাপলান।
অন্যদিকে ফ্যাক্টরি কমিশার এন আই আইভালভ বলেন, বেশ কয়েকটি শিশু রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছে এমন একজন নারীকে অনুসরণ করছিল, তারা তাকে দেখিয়ে দিলে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফ্যানিয়া কাপলান তার সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলশেভিকদের ক্রমবর্ধমান স্বৈরতন্ত্র এবং ১৯১৮-এর জানুয়ারিতে বলশেভিকদের জোর খাটিয়ে গণপরিষদ বন্ধ করার কথাই বলেছেন। এই নির্বাচনে বলশেভিকরা পরাজিত হয়েছিল। যখন স্পষ্ট হলো কাপলান অন্য কাউকে তার সাথে জড়াবেন না, তাকে আলেক্সান্ডার গার্ডেনে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ক্রেমলিন কমান্ডার সাবেক বাল্টিক নাবিক পিডি ম্যালকভ এবং একদল লাটভিয়ান বলশেভিক ৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ এই আদেশ তামিল করে। পেছন দিকে তার মাথায় গুলি করা হয়। তারপর মৃত ফ্যানি কাপলানের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বলশেভিক পার্টি প্রশাসক এবং নিখিল রাশিয়া বলশেভিক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াকভ স্ভেরদলভ তাকে হত্যা করার আদেশ দেন। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে তিনিই জার এবং তার পরিবারের সকলকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সোসালিস্ট রেভল্যুশনারি পার্টির সামরিক কমান্ডার গ্রিগরি সেমিয়োনভ পরে দলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী হয়ে যান এবং ১৯২২ সালে আদালতকে জানান যে কাপলান তার সংস্থার একজন সদস্য ছিলেন, লেনিনের ওপর আক্রমণ চালাতে তাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে তিনিই দায়িত্ব প্রদান করেছেন।
দিমিত্রি ভোলকোগোনভ, আরকাভে ভাকসবার্গের ডোনাল্ড রেয়ফিল্ড তিন ঐতিহাসিক হত্যাপ্রচেষ্টার মামলায় কাপলানের প্রকৃত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভোলকোগোনভ বলেন, এটার সম্ভাবনা বেশি যে কাপলান প্রকৃত অপরাধী নন। আর হত্যাপ্রচেষ্টাটি রহস্যময় বলশেভিক ইতিহাসের এমনই একটি অধ্যায়। ভাকসবার্গ বলেছেন, অপর একজন সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি লিডিয়া কলোপলেভা আসল দোষী এবং তিনি মনে করেন, অখ্যাত এক নারী জাতীয় জীবনের এমন একজন বীরকে গুলি করবে এবং অল্পের জন্য তার প্রাণ বেঁচে যাবে, এটা গল্পকথার মতোই শোনাবে। তারা মনে করেন, কাপলান আসলে অন্য কারও ফরমায়েশ পেয়ে কাজটা করতে এসেছে এবং গ্রেপ্তার হবার পর সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছেন।
অন্য যুক্তিতে বলা হয়েছে, নির্বাসিত জীবনে কাপলান আসলে প্রায়ান্ধ হয়ে পড়েছিলেন। সাক্ষীদের কেউই তাকে গুলি করতে দেখেনি। সাথে আরও একটি দাপ্তরিক বক্তব্য যোগ হয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশের অন্যতম কর্মকর্তার রেডিওগ্রামে দেখা গেছে, এই ঘটনায় একজন নয়, অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অধিকন্তু, লেনিনের মৃত্যুর পর তার ঘাড় থেকে যে বুলেট বের করা হয়, তা কাপলানের ব্যবহৃত অস্ত্রের নয় বলেও জানা গেছে। এমনও বলা হয়েছে, কাপলান আদৌ সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি ছিলেন না। কাপলান শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গী হিসেবে কাউকে না জড়ালেও কর্মকর্তারা স্তোর্দলভকে আসামি হিসেবে সংযুক্ত করে দেয়।
ফ্যানিয়া কাপলান ফিকশন ও মিডিয়ার বিষয় হয়ে ওঠেন। মাইকেল রসের ১৯৩৯ সালের রুশ সিনেমা 'লেনিন ইন ১৯১৮'-এ নাতালিয়া এফরন কাপলানের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৪৩-এর হলিউড সিনেমা 'ব্রিটিশ এজেন্ট', মাইকেল কার্টিজ পরিচালিত, এতে কাপলান চরিত্রে কর্নি উইলিয়ামস এবং জোজিয়া তানিয়া অভিনয় করেন। 'মাই গ্র্যান্ডমাদার ফ্যানি কাপলান', ২০১৬ সালের 'হার নেইম ওয়াজ ফ্যানি কাপলান'ও একটি বিখ্যাত সিনেমা। বহু রুশভিত্তিক ফিকশন ও সিনেমায় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে তার উল্লেখ রয়েছে।
লেনিনকে হত্যা করার বেশ কটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১ জানুয়ারি ১৯১৮ লেনিনকে পেট্রোগার্ডে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফ্রেডেরিখ প্ল্যাটেনকে আঘাত করে। লেনিনের সৃষ্ট গোয়েন্দা পুলিশ চেকার ভাষ্য রুশ উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতা দিমিত্রি শাখাভস্কয় (১৮৬১-১৯৩৯) এই হত্যাপ্রচেষ্টায় মূল হোতা। তাকে সাইবেরিয়া নির্বাসনে পাঠানোর কয়েক বছর পর প্ল্যাটেন স্বীকার করেন, লেনিনকে হত্যার করার জন্য পাঁচ লক্ষ রুবল বরাদ্দ করেছিলেন। প্রভিশনাল সরকারের একজন মন্ত্রী এই হত্যাপ্রচেষ্টার পর নাম পাল্টে লেবাস পাল্টে কাজান চাল যান। তিন বছর পর ১৯২১ সালের মার্চে গ্রেপ্তার করে তাকে মস্কো পাঠানো হয়। তিনি সে মাসে লেনিনের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান। লেনিন তাকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেন।
জানুয়ারির মাঝামাঝি আর একটি হত্যা ষড়যন্ত্র উদ্যোগ গ্রহণের আগে ধরা পড়ে। মিখাইল বঞ্চ-ব্রুভিচ নিজেই ঘোষণা করেন, তিনিই লেনিনকে পৃথিবী থেকে অপসারণের হুকুম দিয়েছিলেন।
১১ মার্চ ১৯১৮ বলশেভিকরা যখন সোভিয়েত রাজধানী পেট্রোগার্ড থেকে মস্কোতে স্থানান্তরিত করছিল, সে সময়ও লেনিনকে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তবে ফ্যানিয়া কাপলানের উদ্যোগটাই ফলপ্রসূ হবার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যা ছটায় ফ্যাক্টরিতে দেওয়া লেনিনের ভাষণের শেষ পঙ্ক্তিটি ছিল: আমরা মরব, না হয় বিজয়ী হব।
তিনি যখন গাড়িতে উঠছিলেন, অপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদার বলেন, লেনিনকে উদ্দেশ্য করে এক নারী বলেছেন রেলস্টেশনে আমাদের রুটি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। কথা শুনে ফিরে তাকাতেই সেই নারী তাকে পরপর তিনটা গুলি করেন। ভাগ্য প্রসন্নই—লেনিন বেঁচে যান। পেট্রোগার্ড গোয়েন্দা পুলিশ চেকার প্রধান মইসে উরিৎস্কি লেনিনের ওপর আক্রমণের দুই সপ্তাহ আগে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার পরপরই লেনিনের ওপর আক্রমণে একটি যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়। লেনিনকে গুলি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একজন কর্মকর্তা রেড টেরর জারির ডিক্রি ঘোষণা করেন—যারা বিপ্লবের বিরোধিতা করছে, সেই শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের ডাক দেন। পরবর্তী কয়েক মাসে বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিদের অন্তত আট শ জনকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে।
লেনিনের পুলিশ চেকা হত্যা করেছে জারের অনুসারীদের; স্টালিনের পুলিশ চেকা ও এনকেভিডি (পিপলস কমিসারিয়েট ফর ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স) হত্যা করেছে লেনিনের অনুসারীদের, কেজিবি (স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরপর প্রতিষ্ঠিত) হত্যা করেছে স্টালিনের অনুসারীদের।
লেনিনের মৃতদেহ থেকে ফ্যানি কাপলানের রিভলবারের বুলেট বের করা হয়।