‘বিষ-ঘাতক’ আগাথা ক্রিস্টি
১৯৭৭। ফরাসি এক দাপ্তরিক কর্মী রোনাল্ড রাসেল বিষ দিয়ে হত্যা করলেন চাচিকে। বিষ মিশানো ছিল আই ড্রপে। তদন্ত কর্মকর্তারা ঘাতক কর্মীর বাসা তল্লাশি করলেন। আই ড্রপে বিষ মেশানোর ধারণা কোথা থেকে পেয়েছে ৫৮ বছর বয়সী ঘাতক রোনাল্ড রাসেল, জানার জন্য হন্যে হয়ে উঠলেন কর্মকর্তারা। তল্লাশি চালানোর পর ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘরে মিলল আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল সিরিজের বই 'দ্য টুইসডে ক্লাব মার্ডারস'। বইতে বিষ দিয়ে হত্যার বিবরণ দাগানো আছে। তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, টুইসডে ক্লাব মার্ডারস পড়েই হত্যাকাণ্ডে নেমেছে খুনি, সে কথা বলতে চাই না। তবে বইয়ে বিষ দেওয়াসংক্রান্ত পাতাগুলো দাগানো হয়েছে।
এর উল্টোটাও ঘটেছ।
'আ ইজ ফর আর্সেনিক: দ্য পয়জনস অব আগাথা ক্রিস্টি' বইতে সে ঘটনা তুলে ধরেন রসায়নবিদ ক্যাথারিন হারকুপ। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ক্রিস্টিকে এক নারীর লেখা চিঠির কথা তুলে ধরেন তিনি। চিঠিতে বলা হয়েছে, এক পরিচিতিজনকে তার তরুণী স্ত্রী বিষ দিয়েছে বলে সন্দেহ করেন ওই নারী। চিঠিতে নারীটি উল্লেখ করেন, আপনার লেখা 'দ্য পেল হর্স' বই থেকেই থ্যালিয়াম বিষক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। বইটি পড়া না থাকলে এ বিষক্রিয়া সম্পর্কে কখনোই জানতে পারতাম না এবং আমার পরিচিত ব্যক্তিটির প্রাণ রক্ষা পেত না।
আগাথা ক্রিস্টি মারা যান ১৯৭৬-এর ১২ জানুয়ারি। দুই বছর পরের কথা। কাতারে ১৯ মাসের এক বাচ্চাকে থ্যালিয়াম বিষ দেওয়ার উপসর্গ নজরে আসে এক নার্সের। রহস্যগল্পের প্রতি এ সেবিকার অপরিসীম টান ছিল। প্রতিবেদনে শিশুবিশেষজ্ঞরা ক্রিস্টির প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ জাতীয় বিষক্রিয়ার চমৎকার এবং বাস্তব বর্ণনা দেওয়ার জন্য আমরা পরলোকগত আগাথা ক্রিস্টির কাছে কৃতজ্ঞ। একইসাথে আধুনিক সাহিত্যের সাথে যোগসূত্র বজায় রাখার জন্য কৃতজ্ঞ নার্স মেটল্যান্ডের কাছে।
অপরাধকাহিনির সম্রাজ্ঞী ক্রিস্টি তার ৬৬টি বইয়ে নানা চরিত্রকে হত্যা করতে বিভিন্ন ঘাতকের ভূমিকায় নেমেছেন। ছুরিকাঘাতে, পানিতে ডুবিয়ে, এমনকি বাদ্যযন্ত্রের তারে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে এসব চরিত্রকে। কিন্তু বিষ প্রয়োগের প্রতি ছিল তার প্রায় প্রেমের টান। তার বইগুলোর অর্ধেকের বেশি ভিক্টিমকে নিকেশ করতে 'বিষ-ঘাতকতার' পথ ধরেন ক্রিস্টি। এ কাজ প্রায় বাস্তব অনুরূপ করে তোলেন বলেই তার বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ। কেউ কেউ তো বলেই বসেন, ক্রিস্টির বই ভবিষ্যৎ ঘাতকের ব্যবহারের জন্য সারগ্রন্থ বা হ্যান্ডবুকও হতে পারে।
ক্যাথারিন হারকুপ জানান, ক্রিস্টির প্রিয় বিষের তালিকায় রয়েছে আর্সেনিক, সায়ানাইড, ডিজিটালিস বা ফক্সগ্লোভ, হেমলক, নিকোটিন, আফিম, ফসফরাস, রিসিন, স্ট্রাইকাইন। সক্রেটিসকে হত্যার পর হেমলক বিষ প্রয়োগের ঘটনা আর ঘটেনি উল্লেখ করে হারকুপ আরও জানান, রিসিন প্রয়োগে খুনের ঘটনায় নিজ সময়ের চেয়ে বহুবছর এগিয়ে ছিলেন আগাথা ক্রিস্টি। ১৯৭৮-এ বুলগেরিয়ার ভিন্ন মতাবলম্বী লেখক জর্জি মার্কোভকে রিসিন প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
হারকুপের বিবরণ থেকে জানতে পারি, ২০ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনের অতি সহজপণ্য ছিল বিষ। সেঁকো বিষের ব্যবহার এতই ব্যাপক ছিল যে ফরাসিরা এর নাম দিয়েছিল 'উত্তরাধিকার গুঁড়া'।
১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে লেখার পেশায় নামেন আগাথা ক্রিস্টি। এ দশককে 'রহস্য কাহিনির সোনালি সময়' বলা হয়। কিন্তু হারকুপের গবেষণার মাধ্যমে বোঝা যায়, এটি ছিল বিষেরও সুবর্ণ সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিষ নিয়ে সরকারি কড়াকড়ি শুরু হয়। তার আগে, প্রথমবারের মতো জৈব রসায়নের ব্যাপক বিকাশের মধ্য দিয়ে এ কাণ্ড ঘটে। এর আগে বা পরে সম্ভাব্য ঘাতক বা রহস্যলেখক কেউই সহজপ্রাপ্য বিষের এমন ব্যবহার আর করেনি।
এদিকে আগাথা ক্রিস্টি নিজেই বলেন যে সব চরিত্রকে তো বিষ দিয়ে মারা যায় না। তবে কাহিনির চরিত্রকে বিষ দেওয়ার মতো সুযোগ পেলে আমি সত্যিই খুশি হই। তিনি নাকি আরও বলেছেন, আমাকে এক বোতল ভালো বিষ দাও এবং আমি নিখুঁত অপরাধ কাহিনি তৈরি করে দেব।
তিনি রহস্য কাহিনিতে ৩০ পদের বিষ উপাদান ব্যবহার করেন। এসব উপাদান খুবই সঠিক মাত্রায় বাস্তবসম্মতভাবেই প্রয়োগ করা হয়েছে। ক্রিস্টি তার কাহিনিতে বিষ প্রয়োগের ঘটনা এতই নিঁখুতভাবে পরিবেশন করেন যে তার প্রশংসা পর্যন্ত করেছে পেশাসংক্রান্ত সাময়িকী। 'দ্য মিস্টেরিয়ারস অ্যাফায়ার অ্যাট স্টাইল' প্রকাশ হওয়ার পর বইটির পর্যালোচনা করে ব্রিটেনের রয়েল ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির (আরপিএস) মুখপত্র ফার্মাসিউটিক্যাল জার্নাল। পর্যালোচনায় বলা হয়, উপন্যাসটির সঠিকভাবে লেখার বিরল যোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
আগাথা ক্রিস্টির বিষ-আসক্তি তৈরির পেছনে ফার্মেসি সহকারী হিসেবে কাজের ভূমিকা রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টরকেয়ের এক হাসপাতালে ফার্মেসি সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। এ জন্য তাকে কিছু পরীক্ষায় পাস করতে হয়। স্থানীয় এক ওষুধ-বাণিজ্যে জড়িত ফার্মাসিস্ট ক্রিস্টিকে গৃহ-শিক্ষণ দেন। যাতে এ-সংক্রান্ত পরীক্ষায় উতরে যেতে পারেন ক্রিস্টি।
ক্রিস্টি যে ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন, তার নাম মি. পি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলেও বেশ অদ্ভুত চরিত্রের ছিলেন মি. পি। ওষুধ তৈরির সময়ে একবার বিপজ্জনক ভুল করেন এবং তা হাতেনাতে ধরেন ক্রিস্টি। মি. পি সব সময় পকেটে এক শিশি মারাত্মক বিষ রাখতেন। তিনি একে 'নিরাময়' বলে উল্লেখ করতেন। দাবি করতেন, এ বিষ তার নিজের মধ্যে একটি শক্তিশালী মনোভাব সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতাল, লন্ডনে আবার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ যোগ দেন। পুনরায় প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারও ফার্মেসির কাজে ফিরে যান। হাসপাতালে কাজের মধ্য দিয়ে তিনি ওষুধ খাতে নতুন নতুন আবিষ্কারের খোঁজখবর রাখতেন। একই সাথে তার মাথায় শিউরে ওঠার মতো নতুন নতুন গল্পের কাহিনি আনাগোনা শুরু করে।
ক্রিস্টির লেখার জীবনজুড়ে ওষুধের প্রতি নিজ আগ্রহকে ধরে রাখেন। ওষুধ এবং আইনবিষয়ক বিশাল পুস্তকভান্ডার ছিল তার। বেশি ব্যবহারের কারণে তার প্রিয় বই মার্টিনডেল: দ্য একট্রা ফার্মাকোপিয়া জরাজীর্ণ হয়ে যায়।
প্রায় অর্ধশতক পরে মি. পি-এর দেখা পাই আমরা। মি. পি-এর আদলেই রহস্য কাহিনি 'দ্য পেল হর্সের' চরিত্র তৈরি করেন ক্রিস্টি।
(ক্রিস্টির লেখা কাহিনি পড়ে সে পদ্ধতিকে কাউকে বিষ দেওয়ার কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন—হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করবেন। প্রথমত, ওসব বিষ আজকাল জোগাড় করা কঠিন। বিষ জোগাড় করতে গিয়েই আইন প্রয়োগকারীদের নেক নজরে পড়তে হবে। দ্বিতীয়ত, ময়নাতদন্তের পদ্ধতি অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে বিষ প্রয়োগের ঘটনা ধামাচাপা থাকবে না, বা কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে যাবে না। সোজা কথায়, অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। অতএব, সাধু সাবধান!)