সম্রাট আজম খান
১৯৭৭ নাগাদ বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেষমেশ ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁর লোকজন দেশে রাস্তায় রাস্তায় মোরাল পুলিশিং শুরু করে। লম্বা চুল রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সে সময় আজম খানের কনসার্ট ও জনসমক্ষে আসা বেশ কমে যায়। এর আগে ১৯৭৬ সালের দিকেই অনেক আশা নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর নতুন ব্যান্ড 'উচ্চারণ'-এর দ্বিতীয় প্রজন্মও গুটিয়ে যায়।
গিটারিস্ট নয়ন মুনশি সে বছরই কানাডায় পাড়ি জমান এবং সেখানেই ১৯৮১ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ১৯৭৬ সালে নিজেদের অনবদ্য ড্রামার ইদু আমেরিকা পাড়ি জমালে 'উইন্ডি সাইডস অব কেয়ার'ও ভেঙে যায়। তাদের বেইজিস্ট মুসা রহমান ব্যান্ডটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ফুয়াদ নাসের বাবু আর মুসা রহমান উইন্ডি সাইডস অব কেয়ারের শূন্যতা পূরণ করতে পরে ফিডব্যাক গঠন করেন, যা পরবর্তী সময়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের চাম্বেলি হলের নিয়মিত ব্যান্ড হয়ে ওঠে।
এত ঘটন-অঘটনের মধ্যে ১৯৭৮ সাল নাগাদ বাংলা রক মূলত অদৃশ্য হয়ে যায়।
টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে পড়ে লাইভ পারফরম্যান্স কিংবা বিটিভিতে নিয়মিত উপস্থিতি। কিন্তু নিজের 'কুছ পরোয়া নেহি' রকার স্বভাবের কারণে আজম খান লাইভ পারফরম্যান্সের জন্য পুলিশের অনুমতি পেতেন না। সর্বস্বান্ত হলেও অর্থ, যশ ইত্যাদি ছিল তাঁর কাছে গৌণ ফলে তিনি একরকম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে শুরু করেন। এ বিষয়ে তখন তাঁর ভাষ্য ছিল যে তিনি অবসরে নয়, বিশ্রামে রয়েছেন।
১৯৮২-এ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে রকের ভগ্নদশা আরও ত্বরান্বিত হয়। পূর্বসূরির নীতিই অবলম্বন করেন তিনিও।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯০-এর মাঝামঝি সময়টায় আজম খানের কয়েকটা অ্যালবাম মুক্তি পেলেও যে কেউ শুনেই বলে দিতে পারত যে গ্রেট আজম খানের সেই স্পর্শটুকু সেগুলোতে অনুপস্থিত। উনি সে সময় কেবল অন্যদের করা গানই গাইছিলেন এবং সংগীত ডিরেকশনের ওপর তখন তাঁর কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে টিভি বা সংগীত পরিবেশকদের কোনো প্রস্তাবই ফেলতে পারতেন না তিনি।
১৯৭৬-এর শীতে ফিডব্যাকে যোগ দিলেও ১৯৮৫ সালে রিলিজ হওয়া ব্যান্ডটির সেলফ টাইটেলড 'ফিডব্যাক—ভলিউম ১' অভিষেক অ্যালবামটিতে আমি ছিলাম না। আজম খান ভেবেছিলেন ব্যান্ডের সাথে হয়তো আমার কোনো সমস্যা চলছে। ফলে ১৯৮৬-এর দিকে তিনি প্রায়ই আমাকে ডেকে পাঠাতেন এবং বাংলায় কিছু করার চেষ্টা করছি কি না, জানতে চাইতেন। আমিও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাঁকে বলতাম যে বাংলা ভাষাকে আমার 'খ্যাত' মনে হয়, ওটা আমাকে দিয়ে হবে না। এর জবাবে তিনি একদিন অনেকটা ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টার মতো বললেন:
'তোর মতো শিক্ষিত লোকেরা, যারা মিউজিকে অনেক বছর ধরে কাজ করছে, চাইলে বাংলাতেও রক করতে পারে। আমার যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল যেন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতাটুকু অর্জন করতে পারি, আমাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি আর এসব করার জন্য নষ্ট করার মতো সময়ও হাতে বেশি নেই, কথাটা কি বোঝা গেল?'
এরপর বছরখানেক পর ১৯৮৭ সালে বের হওয়া ফিডব্যাকের 'উল্লাস' অ্যালবামটির ৬টি গানের সাথে আমার নিবিড় সংশ্লিষ্টতা ছিল। অ্যালবামটি আসার পরপরই আমি ক্যাসেট টেপটি নিয়ে আজম খানের সাথে দেখা করতে যাই। তাঁর হাতে টেপটি তুলে দিয়েই দৌড় দিই। উনি তখন আমাকে পেছন থেকে বলছিলেন, 'শোন, শোন, থাম, থাম!' এর দিন কতক পর তাঁর ফোন আসে, সেদিন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, 'কি রে ইংলিশম্যান, শেষমেশ তাইলে বাংলা গান তুই গাইলি?' তাঁর কথা শুনে ফোনেই ফোঁপাতে শুরু করি আমি। যত দূর মনে পড়ে, ফোনে আজম খানের সাথে সম্ভবত সেটিই আমার প্রথম ও শেষ আলাপ।
আজম খানের সাথে ১৯৭৬-এ আমার পরিচয় হলেও খুব জরুরি বিষয় ছাড়া আমাদের খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হতো না। প্রয়োজন পড়লে তিনি নিজেই আমাকে টিংকু বা এজাজ মারফত খবর দিয়ে বাসায় ডেকে পাঠাতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওরা ছিল তাঁর বিশ্বস্ত সহচর।
অল্প কথার মানুষ তিনি ছিলেন না। ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতেন। আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং আমার কথাবার্তা শুনে বলতেন, 'লড়াইটা চালাইয়া যাইতেই হইব।' পরের দিকে তাঁর এই কথা আরও ছোট হয়ে যায়। আড্ডা শেষে চলে যাওয়ার সময় হাত মুষ্টি করে বলতেন, 'ফাইট!'
সতেরো বছর পর: হয়েও না হওয়া এক নতুন সূচনা।
১৯৯২ সালে আজম খান আমাকে একটা লড়াই করার প্রস্তাব দিতে ডেকে পাঠান। লড়াইটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রক-পপ গানের কিংবদন্তি পাঁচ খলিফা ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, পিলু মুমতাজ এবং অতি অবশ্যই আজম খান প্রমুখের ১৭ বছর পর পুনর্মিলনী উপলক্ষে যেকোনো মূল্যে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
আমার মা তখন প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যুশয্যায়। ফলে এমন একটা কাজের দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় আর ছিল না। আয়োজকদের এ বিষয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুধু প্রবল আগ্রহ থেকেই তারা এই আয়োজনের দায়িত্ব নিয়ে বসে। অনুষ্ঠানের যখন আর মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি, তখন আজম খান চাইছিলেন যে করেই হোক ভেন্যু (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট) সামলানো থেকে শুরু করে লাইট, সাউন্ড—সবকিছুর দায়িত্ব যেন আমি নিই।
তো খবরটি পেয়ে যখন তাঁর সাথে দেখা করলাম, তখন তাঁকে অনুষ্ঠানটি নিয়ে খুবই সিরিয়াস মনে হলো। গেরিলা অধিনায়কসুলভ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি আমাকে নির্দেশনা দিলেন, বললেন, 'এটা কোনো অনুরোধ নয়, আদেশ। সুতরাং নিজের সর্বস্ব ঢেলে দাও। কোনো রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন না হয় আর অনুষ্ঠানটি যেন সর্বাঙ্গীণ সাফল্য লাভ করে। ১৭ বছর আগের সেই রঙিন দিনগুলোতে যখন আমরা একেকজন একেকটি পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু নাড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেই সময়টিতে আবার ফিরে যেতে চাই।'
এ কথা বলেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, 'তুই গেলি।' আমি জবাব দিলাম, 'জি বস।' আর সেবারই প্রথম তিনি চলে যাওয়ার সময় আমি বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্যালুট জানাই। তিনি ইংরেজিতে জবাব দেন, 'গুড, ভেরি গুড (ভালো, খুব ভালো)।'
১৯৯২ সালের সেই কনসার্টের আয়োজকেরা অনুষ্ঠানটির প্রচার চালান 'সতেরো বছর পর' শিরোনামে, যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রক কিংবদন্তিদের আবারও একটি মঞ্চে একত্র করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা, যারা দীর্ঘ ১৭ বছরের অনুপস্থিতির কারণে কোনো দিন সেই কিংবদন্তিদের তাঁদের লাইভ পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ পায়নি।
এর আগে ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে 'বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)' কর্তৃক আয়োজিত প্রথম ওপেন এয়ার কনসার্টটি ছিল এ দেশের রক সংগীতের বাহুতে মাইলস্টোনের এমন এক টিকা, যার প্রয়োজন ছিল অপরিসীম।
আরেকটা ব্যাপার বলতে হয়: সোলস, চাইম, অবসকিওর, ফিডব্যাক এবং রেনেসাঁ ১৯৭৫-১৯৮৫-এর ডামাডোলের ফলে তৈরি সাংস্কৃতিক শূন্যতাটুকু বেশ ভালোভাবেই পূরণ করেছিল। ১৯৯১ সালের দিকে মাইলস তাদের প্রথম বাংলা অ্যালবাম বের করে। বাংলা রক রীতিমতো একটা বিস্ফোরণ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করে এবং দর্শকসংখ্যাও বেড়ে যায় বহুগুণ। আর এটি সম্ভব হয়েছিল কেবল পেশাদারির সর্বোচ্চ প্রদর্শনীর কারণেই। সে সময় শব্দ প্রকৌশল ও আলোকসজ্জার আগমন শোবিজের সংজ্ঞাই পাল্টে দেয় এবং এই নবজন্ম রক সংগীতকে এনে দেয় বড় মাপের সম্মান আর আস্থা, যা আজ পর্যন্ত টিকে আছে।
চাইমের ব্যান্ড লিডার আশিকুজ্জামান টুলুর (পরে আর্কের ব্যান্ড লিডার) ওপর শহরের সেরা মিউজিশিয়ানদের জোগাড় করে পাঁচ কিংবদন্তির জন্য একটা কমন লাইনআপ গঠনের দায়িত্ব পড়ে। রিহার্সাল যখন শুরু হলো, তখন অনুষ্ঠানের আর দশ দিনও বাকি নেই। সবারই পাগলপ্রায় অবস্থা। সমস্ত উত্তেজনা আর উত্তাপ তুঙ্গে পৌঁছাল, যখন শোর তিন দিন আগে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে কনসার্টের মোট ১২০০ টিকিটের সবই বিক্রি হয়ে গেল।
এদিকে আজম খান এক দিনের জন্যও রিহার্সালে আসেননি আর তা ঠিক কী কারণে, সেটাও কারও জানা ছিল না। টুলু ফোনে ব্যাপারটা আমাকে জানায় এবং অনুরোধ করে যেন আমি গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি এবং কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা জিজ্ঞেস করি। অবশেষে যেদিন আজম খানের সাথে দেখা করতে গেলাম, সেদিন অনুষ্ঠান নিয়ে তাঁকে খুবই উৎসাহী মনে হলো। তবে কনসার্টে তিনি আয়োজকদের ঠিক করা পেশাদার মিউজিশিয়ানদের বাদ দিয়ে পারফর্ম করবেন নিজ ব্যান্ড উচ্চারণের সাথে, জানালেন।
এতে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল যে নিজের ব্যান্ডের তরুণ, আনকোরা আর অশ্রুত মিউজিশিয়ানরা তাদের জীবনের একটি অন্যতম অর্জন থেকে বঞ্চিত হোক, তা তিনি চাননি।
শো শুরু হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ছয়টায়। বিকেল চারটায় আমি ভেন্যুতে পৌঁছে দেখি বন্ধ দরজার পেছনে দর্শকেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকতেই পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম গ্রিনরুমে যে একটিমাত্র মানুষ বসে আছেন, তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় আজম খান। সবার আগে বেলা ২টা ৩০ মিনিটে তিনি ভেন্যুতে চলে এসেছেন।
আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। জানালেন যে পুরো মঞ্চটি তিনি চারপাশ থেকে দেখেছেন, এমনকি যন্ত্রপাতিগুলোও পরখ করে দেখেছেন, 'আজ রাতে ভুল হওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই।' এরপর পকেট থেকে একটা ঝালমুড়ির ঠোঙা বের করে আমাকে আদেশ করলেন, 'এখন একটু বস, এগুলো খা। তারপর আমার সাথে সিগারেট আর ঠান্ডা খাবি। এরপর যা করার করিস।'
দশ দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির ধন্যবাদ জানানোর এই ছিল তাঁর সাদামাটা তরিকা।
কনসার্টের দিনের কথা: অনুষ্ঠান যতই এগোচ্ছিল, ভিড়ও ক্রমেই বেড়ে চলল এবং যতক্ষণে আজম খানের পালা এল, ততক্ষণে হলের ভেতরে দর্শকসংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এমন অবস্থায় আরও মানুষ প্রবেশ করলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমনকি আগুন লাগারও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ঠিক তখনই আজম খান আমাকে একটা অনুরোধ করলেন। বললেন, 'শিগগিরই আয়োজকদের কাছে গিয়ে বল যে তারা ইতিমধ্যেই অনেক টাকা কামিয়ে নিয়েছে। এবার গেটগুলো খুলে দিক, যাতে দর্শকেরা আসতে পারে। ওদের আমি সামলাব, ভয়ের কিছু নেই।'
এরপর আর কোনো উপায় না থাকায় সব গেট খুলে দেওয়া হলো। ফলে বন্যার জলের মতো মানুষ ঢুকে পড়ল ভেতরে। ভেন্যুতে আর তিলধারণের জায়গাও রইল না। আজম খান আর তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণের জন্য মঞ্চের মাঝে একটু জায়গা রেখে গোল হয়ে বসে গেল পাঁচ শর মতো মানুষ। এ রকম একটা অবস্থায় হঠাৎ আজম খান প্রবেশ করলেন আর সাথে সাথে চিৎকাররত দর্শকদের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
তাঁর ব্যান্ডের সাউন্ড ছিল একদম আনকোরা; অনভিজ্ঞ মিউজিশিয়ানরা গানের কর্ড ঠিক রাখতে গিয়ে গিটারগুলো বাজেভাবে টিউন করেছিলেন। কিন্তু এগুলো কোনো ব্যাপারই ছিল না। রক সাউন্ড আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ৭০-এর দশকে। আর আজম খান যতক্ষণ ভোকালে আছেন, ততক্ষণ এসব বিষয়ে এত খুঁতখুঁতে না হলেও চলে। ভোজবাজির মতো সবকিছু কেন যেন ঠিকঠাকই হচ্ছিল। ক্যাকোফোনি/কর্কশ আওয়াজ সত্ত্বেও নিজের কাজটাও ঠিকই করে যাচ্ছিলেন তিনি।
অবশেষে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর ভক্তরা সবাই উদ্দাম উল্লাসে ফেটে পড়ল। কয়েকটা গান পুনরায় গাওয়ার অনুরোধের পর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কয়েকটা অভিজ্ঞতার একটা আমি দেখতে পেলাম। আজম খান শেষ করলেন, মঞ্চে থাকা সব ভক্ত একসাথে তাঁকে স্যালুট ঠুকল। অস্বীকার করার আর কোনো উপায় রইল না যে আজম খান জীবনকেও ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছেন। তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি আর শুধু একজন রক কিংবদন্তি ছিলেন না। যারা তাঁর ফেনোমেননটা জানত ও বুঝত, তাদের কাছে তিনি অবিসংবাদিতভাবে ছিলেন একজন অবতারের চেয়েও বেশি কিছু যেন।
অগ্নিদীক্ষা: গেরিলা থেকে রক হিরো।
১৯৭১-এর জুন মাসের বৃষ্টিস্নাত এক রাত। মুক্তিবাহিনীর তিন দুর্ধর্ষ গেরিলা এক ঘণ্টার বেশি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তাঁদের লক্ষ্য কুমিল্লার সালদাহে অবস্থিত পাকিস্তানি আর্মির একটা সুসজ্জিত বাংকার। প্রথমে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প থেকে তারা বিরতিহীনভাবে হেঁটেছেন চার ঘণ্টা। জোঁক, মশা, পোকামাকড়, ঘন কাদা আর অবসন্ন দেহ তাঁদের অগ্রযাত্রাকে করে তুলেছে ধীর, কষ্টসঙ্কুল। চারদিকে বিষধর সাপের উৎপাত। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ, অ্যামবুশ করার আগে শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে এবং লাইন অব ফায়ারের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
এভাবে এগুতে এগুতে নিজেদের সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে না নিতেই হঠাৎ দলটি টের পেল তারা লক্ষ্যস্থল থেকে মাত্র আধা মিটারেরও কম দূরত্বে পৌঁছে গেছে! তাদের অবস্থান থেকে শত্রুপক্ষের সেনাদের বাংকার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিন মিটার পর্যন্ত জায়গা পরিষ্কার দৃশ্যমান। একদিকে ছয়জন দশাসই পাকিস্তানি সেনা একসাথে তেরপলের ছাউনির নিচে রাতের খাবার খেতে বসেছে।
তবে শিগগিরই বোঝা গেল তাঁদের লক্ষ্যস্থল মোটেও মামুলি কোনো বাংকার নয়, বরং এটি ভারী মেশিনগানের ঘাঁটি। কাজেই তাদের ধরাশায়ী করতে হলে কোনো রকম ভুল করা চলবে না। সবকিছু ভেবেচিন্তে দলনায়ক তাঁর কমরেডদের ইশারায় জানালেন যে তিনি গুলি আরম্ভ না করা পর্যন্ত যেন তাঁরা চুপচাপ শুয়ে থাকেন। এর ঠিক পরপরই তিনি শোয়া অবস্থা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজের অস্ত্রটাকে প্রস্তুত করে নিলেন। একবার তাকালেই শত্রুপক্ষ দেখে ফেলবে তাঁকে কিন্তু ভাগ্য ভালো যে পাকিস্তানি সেই সৈনিকেরা তখন খোশগল্পে মশগুল।
বাতাসে ভাসছে ভাত, ডাল, মাংস, সালাদ আর সবজির ঘ্রাণ। গেরিলাদের পেট মুচড়ে উঠল ক্ষুধায়। যুদ্ধ শুরুর পর কত দিন যে পেট পুরে খাওয়া হয়নি, তার হিসাব নেই। ক্ষুধা তাদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল বারবার। তারপরও শত্রুদের কয়েক গ্রাস খাবারের স্বাদ নিতে দিলেন দলনেতা। ততক্ষণে তাঁর দিক থেকে এ বিলম্ব দলের বাকি সদস্যদের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে দলনেতার মনে খেলে গেল এক অদ্ভুত চিন্তা; 'মৃত্যুর আগে বিদায় সম্ভাষণ হিসেবে তাদের এমন কোনো ভাষায় একটা গান শোনালে কেমন হয়, যা তারা বুঝতে পারবে?' তো এই ভেবে তিনি ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তান, ভারত-দুই দেশেই খুব জনপ্রিয় একটা সিনেমার গান গাইবেন বলে ঠিক করলেন।
তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় 'এইসা মওকা ফির কাঁহা মিলেগা (এমন মওকা আর কোথায় পাব)' গানটি গাইতে গাইতে গুলি করতে শুরু করে দিলেন। প্রথম ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেল চোখের নিমেষেই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে লাগল পাকিস্তানি সেনারা। কোনো সুযোগই পেল না তারা। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে আটাশটি বুলেটের দ্বিতীয় ম্যাগাজিনটিও ব্রাশফায়ার করা হলো দ্রুত।
পাঁচ মিনিটেই কেল্লাফতে। নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরার সময় সাফল্যের ঝুলিতে তখন ছয় পাকিস্তানি সেনা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর শত্রুপক্ষের একটি বিধ্বস্ত বাংকার।
২ নম্বর সেক্টরের সেই ২১ বছর বয়সী সেকশন কমান্ডার ও গেরিলা দলনেতাটি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন আজম খান ওরফে মাহবুবুল হক খান, যিনি ২০১১ সালের ৫ জুন রোববার ৬১ বছর বয়সে ঢাকায় দেহত্যাগ করেন।
১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ: রক হিরোর উত্থান।
আজম খান ও তাঁর সংগীত বুঝতে হলে আমাদের ১৯৭১ সালের সমসাময়িক বিশ্বের গতিপ্রকৃতির পাশাপাশি '৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের টালমাটাল সময়ের ঘটনাপ্রবাহও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ২১ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে (১৯৭৫)। যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের সচেতনতাকে ঘিরে গড়ে উঠছে এক নতুন আন্দোলন। হেয়প্রতিপন্ন করতে সেই আন্দোলনটিকে 'হিপি' নামে ডাকা হতো, অন্যভাবে বলতে গেলে তাদের সমাজচ্যুত বা সামাজিকভাবে ব্রাত্য বা অপদার্থের দল বলা হতো।
১৯৬৯ সালে যখন লাখ লাখ মানুষ উডস্টক কনসার্টে জড়ো হলো, তখন স্যান্টানা থেকে শুরু করে রোলিং স্টোনস, স্লাই অ্যান্ড দ্য ফ্যামিলি স্টোনস, দ্য হু, ক্রসবি স্টিলস ন্যাশ অ্যান্ড ইয়াং (সিএসএনওয়াই), ক্রিডেন্স ক্লিয়ার ওয়াটার রিভাইভাল (সিসিআর), জিমি হেনড্রিকসের মতো রক নায়কেরা, এমনকি রবিশঙ্কর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী সেই শান্তি আর সুরের যজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আর্তচিৎকারে মুখর সেই বিশাল গণজমায়েতের মূল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার জনগণের পক্ষ থেকে পৃথিবীবাসীর আত্মা আর বিবেকের প্রতি শান্তির বার্তা পাঠানো। হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষ এসব শুনেও না শোনার ভান করে বসে ছিল। তারা ভেবেছিল, সংগীত দিয়ে আর কী এমন হবে!
১৯৭১ সালে রবিশঙ্কর, বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ উদ্বাস্তুর জন্য সহায়তা সংগ্রহ করতে যে শ্রম দিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জড়ো হয় চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ এবং সেখানেই জর্জ হ্যারিসনের মহাকাব্যিক রক এনথেম 'বাংলাদেশ' রাতারাতি তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে দেয়। কনসার্টটি নিয়ে তৈরি ট্রিপল অ্যালবামটি রিলিজের কয়েক দিনের মাথায়ই তা গোল্ড ক্যাটাগরির মর্যাদা লাভ করে।
পৃথিবীতে এমন ঘটনাই ছিল প্রথম। সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটা কনসার্ট আয়োজন করা সহজ নয় মোটেও। উপরন্তু আমেরিকার মাটিতে, তাদেরই সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের সপক্ষে এমন একটা কনসার্ট আয়োজন ছিল আরও দুঃসাহসিক কাজ।
'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' সারা বিশ্বের সংগীতকেই বদলে দেয়।
আজম খানেরও আকর্ষণ ছিল বিশেষ করে বিটলস ও জর্জ হ্যারিসনের প্রতি। আমাদের দাবি আদায়ে হ্যারিসনের অবদান ও বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার চর্চাকারী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজম খান যে তাঁকে সাধুবাদ জানাবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক।
নিজের শীর্ণ দেহে রকের লেবাস গায়ে চড়িয়ে আজম খান যে আরেকটি লড়াইয়ে নামবেন, তা বাস্তবে দূরে থাক, কল্পনা করাটাও ছিল অবিশ্বাস্য। নিজের সমস্ত অপমান, বদনামের মোকাবিলা করেছেন তিনি সহ্যশক্তি, প্রাণোচ্ছলতা আর রসবোধ দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে আজম খানই ছিলেন হিরোর প্রাথমিক ধারণা। প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা কিংবা দেশপ্রেম—সব দিক দিয়েই তাঁর বিশ্বস্ততা ও গ্রহণযোগ্যতা সব সময়ই ছিল প্রশ্নাতীত।
পশ্চিমা সংগীতে ন্যূনতম শিক্ষাও নেই, এমন লোকজন আজম খানের সংগীতকে 'পপ' বলে। কেউ কেউ তাঁর গায়ে হয় 'পপগুরু' কিংবা 'পপসম্রাট'-এর তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে না। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো যে তিনি নিজে এই দুটি খেতাবই অপছন্দ করতেন।
শব্দ হিসেবে 'পপ' অর্থ 'যা জনপ্রিয়', যদিও জনরা হিসেবে এর একেবারেই আলাদা আর নিজস্ব একটা অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে, তা হলো 'স্কুল', অর্থাৎ অপরিশোধিত, যার কোনো কিছুর বালাই নেই, নেই কোনো সংবেদনশীলতা। আরও ব্যাখ্যা করলে, পপসংগীত হলো ওয়ালপেপার সংগীত। এটা না পেইন্টিং, না ভাস্কর্য, এর কোনো স্থায়িত্ব নেই।
আজম খানের সংগীত আর যা-ই হোক না কেন, পপ নয় মোটেও। তাঁর সংগীত গত প্রায় ৩৮ বছর হলো টিকে আছে; আর তা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে।
আজম খান মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বেঁচেও ফিরেছিলেন। তিনি মেহনতি মানুষের প্রতিভূ; তাঁর অস্ত্র ছিল সংগীত।
রক দর্শনে বাঙালি হিসেবে আজম খানের অবদান ছিল 'ঝাঁকি আর দোলা', যা পরে শুধু 'ঝাঁকি' বা রক হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। আর এ কাজের জন্য তাঁর চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ ছিলেন না। আমার সাথে দেখা হলেই তাঁর চিরাচরিত ঠাট্টা ছিল, 'ঝাঁকি দিতে হইব!'
বাংলায় রক অ্যান্ড রোল এককথায় বোঝাতে 'ঝাঁকি'র চেয়ে উপযুক্ত পাঞ্চ ওয়ার্ড আর কী আছে?
আজম খানের স্টেজে সম্মোহনী উপস্থিতি ও প্রথম হিট গান 'হে আল্লাহ হে আল্লাহ রে'তে মিশে থাকা আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে কথা ছিল বেশি। ভেতরের দানবকে পোষ মানিয়ে, বেদনাগুলোকে আড়াল করে তিনি ছড়িয়ে গেছেন ভালোবাসা ও শান্তির বাণী, এমনকি একেশ্বরবাদে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের কথাও।
'হাইকোর্টের মাজারে', 'ধুয়া/জিগির', 'এই যে দুনিয়ায় মানুষ ছাড়া কিছুই নাই'—নিজের এসব গানে তিনি ভণ্ড ফকির ও তাদের ভক্তদের কাল্টের গোমর এবং ভঙ্গুর বিশ্বাসের আসল চেহারা তুলে ধরেন, যা প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সুপ্রাচীন বাউল ঘরানার সাথে তার আত্মিক যোগাযোগ ছিল।
আজম খানের চাপা স্বভাব কারও অজানা নয়, মাইজভান্ডারি সুফি ঘরানার সাথে তাঁর গোপন যোগাযোগ ছিল কি না, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সম্ভবত অনানুষ্ঠানিকভাবে তিনি দীক্ষা লাভ করেছিলেন। সে সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। অসংখ্য কনসার্টে তাঁরা সেই আগুনঝরা স্তবগান 'গাউসুল আজম বাবা নুরে আলম, তুমি ইসমে আজম বাবা, তাড়ানেওয়ালা' একসাথে গেয়েছেন। আজম খান আমাকে বলেছিলেন যে তিনিই এ কে এম ফিরোজ আলমের নামের শেষে 'সাঁই' (জ্ঞানী) জুড়ে দিয়েছিলেন। পরে ফিরোজ সাঁই তাঁর প্রথম হিট 'গাউসুল আজম মাইজভান্ডারি স্কুল খুইলাছে'র মাধ্যমে মাইজাভান্ডারি সুফি ঘরানাকে সবার সামনে নিয়ে আসেন।
আমাদের দেশে মাদকের মহামারির শুরুটা হয়েছিল মূলত প্রজন্মগত বিভক্তি, নিজেদের মধ্যেকার বোঝাপড়া আর পারস্পরিক সহানুভূতির অভাব থেকে। ফলে রক আইকন ও সাবেক মুক্তিবাহিনী গেরিলা কমান্ডার আজম খান যখন ১৯৭৩-৭৪-এ তাঁর মহাকাব্যিক 'ফ্রাসট্রেশন' গানটিতে গেয়ে উঠলেন 'জ্বালা জ্বালা জ্বালা শুধু মনে রে, জ্বালা জ্বালা জ্বালা শুধু প্রাণে রে', তখনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আগুনটা আসলে কোথায় লেগেছে আর পুড়ছেই-বা কী।
তখন স্বীকৃতি না দেওয়া হলেও আজম খান আসলে তাঁর সংগীতের ভেতর দিয়ে অনন্য এক সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।
১৯৭৩ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই প্রথমবারের মতো আজম খানের লাইভ কনসার্ট দেখতে যাই। আজম খানের সাথে সেবার যে মিউজিশিয়ানরা ছিলেন, তাঁরা ছিলেন নামী ব্যান্ড উইন্ডি সাইডস অব কেয়ারের সদস্য। সে সময় তারাই ছিল সেরা। লাইভে সান্টানা, ডিপ পার্পল, এমনকি চিক কোরিয়ার মাথা খারাপ করে দেওয়া সব কাভার ভার্সন বাজাতেন তাঁরা চাম্বেলি রুমে। চাম্বেলি ছিল তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ১০০ আসনবিশিষ্ট অভিজাত রেস্তোরাঁ, যেখানে ডাইনিং সুবিধার পাশাপাশি একটা ব্যান্ড স্ট্যান্ডও ছিল।
ড্রামসে ছিলেন ইদু, লিড গিটারে ইশতিয়াক আর বেইজ গিটারে আমার বন্ধু প্রয়াত লারি বার্নাবি, রিদম গিটারে নীলু, কি-বোর্ডে গ্যাব্রিয়েল এবং ট্যাম্বুরিন আর ভোকালে আমাদের অবিস্মরণীয় বাবু। বাংলাদেশে তখন রক সম্পর্কে সামান্য ধারণাও যাঁদের ছিল, তাঁরা সবাই আজম খান ও এই মিউজিশিয়ানদের চিনতেন। তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার। একেবারেই আলাদা একটা জনরার জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা। সেটাই ছিল বাংলা রকের প্রথম লাইভ ভার্সন।
১৯৭৩-এ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অডিটরিয়াম সাইকেডেলিক ঘোরগ্রস্ত দর্শক: 'গাউসুল আজম হুহ হাহ' জিকির ছিল অভাবনীয় দৃশ্য— ঠিক তখনই মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে যিশুর মতো শ্মশ্রুমণ্ডিত, কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে যাওয়া দীর্ঘ চুলের অধিকারী এক লোকের। তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর একজন গেরিলা কমান্ডার। নাম আজম খান। নিজের ব্যান্ড 'উচ্চারণ'কে সাথে নিয়ে আমাদের সবার মনকে উদ্বেলিত করেছিলেন তিনি তাঁর সম্মোহনী সংগীত দিয়ে।
'ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে' আর 'হাইকোর্টের মাজারে' গানগুলোর মাধ্যমে আজম খান পৌঁছে গেলেন মানুষের ঘরে ঘরে।
দেশের যেখানেই হোক না কেন, তাঁর কনসার্টগুলোতে তিলধারণের জায়গা থাকত না। তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা এতই উদ্দাম আর উৎসুক ছিল যে সিনেমা হল, অডিটরিয়াম—যেখানেই আজম খানের অনুষ্ঠান থাকুক না কেন, সেখানেই নিজেদের প্রিয় কিংবদন্তিকে শুধু একনজর দেখার জন্য জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে মারামারি পর্যন্ত বাধিয়ে দিত। এসব ঘটনা তখন অস্বাভাবিক ছিল না মোটেও।
১৯৭৪-এর কোনো এক সময়ে ঢাকা কলেজের ক্যারিশম্যাটিক শিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখনকার একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে বিনোদনের খরায় ভুগতে থাকা দেশের জন্য একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। ওই অনুষ্ঠানে আজম খান ও তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণ পারফর্ম করবে, তখন আমরা রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। গর্বও হচ্ছিল খুব।
সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দার সামনে আমরা সেদিন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম। আজম খান মঞ্চে এসেই নিজের স্বভাবসুলভ ঢঙে গাইতে শুরু করলেন। তূরীয় আনন্দে হেড ব্যাংগিং করতে করতে তিনি শুরু করলেন, 'ওরে সালেকা, ওরে মালেকা', এরপর (আমার সর্বকালের প্রিয়) 'আসি আসি বলে তুমি আর এলে না'। এরপর তাঁর তিনটি গানে সাজানো সেটটির শেষটির আগে যখন তিনি এলেন, তখন কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘোষণা দিলেন। বললেন, 'যারা ইতিমধ্যেই মৃত বা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এই নতুন গানটি তাদের জন্য।' এ কী বললেন তিনি? এরপর যা হলো, তা আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর বিদ্যুচ্চমকিত করে দিল। কণ্ঠের হৃদয়বিদারী কান্না আর সুরের মূর্ছনায় ভরপুর তাঁর 'রেল লাইনের ওই বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে। ছেলেটি মরে গেছে। হায় রে হায় বাংলাদেশ' গানটি যেন আমাদের রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছিল। 'বাংলাদেশ' গানটি ছিল সুপারহিট। এর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। এখানেই শেষ নয়। তখনকার সরকার আজম খানের ভক্ত-অনুসারীদের আমলে নেয়নি, লাখ লাখ মানুষ সেদিন তাঁর পারফরম্যান্স দেখতে টিভির সামনে বসে ছিল। বিটিভির যেহেতু ভিটিআর (ভিডিও টেপ রেকর্ডিং) ছিল না, সেহেতু প্রোগ্রামগুলো সেন্সর করার সুযোগ থাকত না, ফলে সেগুলো সরাসরি সম্প্রচারিত হতো! ফলে রাতারাতি গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে উপজীব্য করে কেউ অন্তত এমন একটা গান বেঁধেছেন, এ বিষয়টি আমাদের অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদেরও গভীরভাবে নাড়া দেয়। মানবসৃষ্ট এক অভূতপূর্ব দুর্যোগ ছিল—সেটি আজম খান আঁচ করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৪ সালের সেই দুর্ভিক্ষে নিয়ে এটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র গান।
'বাংলাদেশ' গানটার ক্ষুরধার কথাগুলো আজম খান লিখেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। দেশের নানান প্রান্ত থেকে লাখ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষকে তিনি কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে নামতে দেখেছেন, প্রাণ হারাতে দেখেছেন। স্টেশনের অনতিদূরেই বাড়ি হওয়ায় রোজ তাঁকে এসব ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো এবং কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব তাঁকে অসাড় করে দিত। গান করে উপার্জিত অর্থের সবটুকু তিনি সেসব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
সামান্য খাবারের জন্য ভিক্ষা করতে রাস্তায় নেমে এসেছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সহায়-সম্বলহীন প্রান্তিক দরিদ্র মানুষেরা—চারদিকের মর্মান্তিক এসব দৃশ্য একজন স্পর্শকাতর মানুষ হিসেবে আজম খানকে হতবিহ্বল করে দেয়।
বিটিভিতে প্রচারের পরপরই 'বাংলাদেশ' গানটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৭৫ সালে এসে আজম খান হাতে নেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ। সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যান্ড 'উচ্চারণ' পুনর্গঠনের কথা জানান তিনি। এখানেই শেষ নয়, কাজটি করতে তিনি যে আনকোরা নতুন মিউজিশিয়ান চাইছিলেন, সেটাও পেয়ে যান। তারা কেউই তাঁর প্রজন্মের ছিল না। এই সিদ্ধান্তটিও কিন্তু খুব সহজ ছিল না। অনেকেই ভাবতেন, তাঁর ব্যাকআপ ব্যান্ড উইন্ডি সাইডস অব কেয়ারের মিউজিশিয়ানদের শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তারপরও নতুন প্রজন্মের তরুণ রকারদের প্রতিভা ও সামর্থ্যে আস্থা রেখে নিজের কাজটুকু করে যেতে থাকেন আজম খান। কিংবদন্তি রক গিটারিস্ট প্রয়াত নয়ন মুনশির মাধ্যমে তিনি সে সময় ডিম্পল রেস্তোরাঁয় (বর্তমানে মোহাম্মাদপুরের যেখানে আড়ং অবস্থিত) কাভার সংগীত বাজানো এক হাউস ব্যান্ডের কাছে তাঁর পরিকল্পনার খবর পাঠান।
তাঁর প্রস্তাবে ব্যান্ডটির বেইজিস্ট ফুয়াদ নাসের বাবু আর ড্রামার পিয়ারু খান ও (ফিডব্যাক) রিদম গিটারিস্ট দুলাল তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান। আজম খানের মতো একজন আইকনের সাথে বাজানোর প্রস্তাব ছিল তাঁদের জীবনের এক পরম পাওয়া। ফলে তাঁরা দল বেঁধে আজম খানের দলে ভিড়ে যান। আজম খান কোনো কি-বোর্ডবাদক না চাওয়ায় কি-বোর্ডবাদক ছাড়াই শুরু হয় তাঁদের পথচলা।
তিনটা গিটার, ড্রামস আর একটা ভোকালই ছিল ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে তাঁদের অনুশীলন শুরু হয়।
১৯৭৬-এর গোড়ার দিকে বিটিভিতে সম্প্রচারিত পাঁচটি গান দিয়ে সাজানো একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আজম খানের আবার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটে এবং পুনরায় তিনি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। কিন্তু এ এক নতুন আজম খান।
সেদিন যখন তিনি টিভির পর্দায় উপস্থিত হলেন, তখন তাঁকে দেখে আমরা ভীষণ ধাক্কা খাই। লম্বা চুলগুলো ছোট ছোট করে কাটা, একেবারে ক্লিন শেভড চেহারায় তাঁকে চেনাই যাচ্ছিল না! না, তিনি রক অ্যান্ড রোলকে অস্বীকার করতে চাননি। ফলে আমরা দেখছিলাম মূলত দৃশ্যমান আওয়াজ, যার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে হয়েছিল আমাদের। ঘটনাচক্রে তাঁর এই 'নতুন চেহারা' আমৃত্যু বজায় ছিল।
নতুন গানগুলোও ছিল একেবারেই আলাদা। যেমন 'আলাল ও দুলাল', 'যে মেয়ে চোখে দেখে না', 'প্রেম চিরদিন দূরে দূরে এক হয়ে থাক না' এবং তাঁর ক্যারিয়ারের একমাত্র সেমি ক্ল্যাসিক্যাল নিরীক্ষা 'আমার বধূয়া কি গাইতে জানে গান'।
ক্রমশ বিপ্লবী রক নায়ক অনেকটাই শান্ত হয়ে যান। তাঁর প্রথম দিককার গানগুলোর সেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী রেটরিক বা আধ্যাত্মিক মেজাজ আর চোখে না পড়লেও তিনি যে সেই গানগুলোকে একেবারে বাতিল করে দিয়েছিলেন, তা-ও নয়। নতুন লাইনআপটি পুরোনো গানগুলোতে আরও ইম্প্রোভাইজেশন যোগ করে, যা তাঁর ভক্তকুলের প্রসার ঘটাতে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শুরু হয়েছিল আজম খান ও তাঁর মিউজিকের যুগ। তবে তা হয়েছিল ক্ষণস্থায়ী।
- (সংক্ষিপ্ত, দি হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশ রক, দি লিগেসি অফ আজম খান বই থেকে নেওয়া)