আজম খান: আমি তারে পেয়েও হারাইরে
আমি আমার মনে মনে
গাইছি একটা গান
আমি জানি এই গানটা
শুনছেন আজম খান
আমি−আমরা।
আমরা মনে করি, তার মতো কেউ নাই।
'আমার মতন একা কেউ নাই আর।'
−জীবনানন্দ দাশ।
পৃথিবীর সব একা মানুষের কথা।
কারা একা? ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, মেরিলিন মনরো, জীবনানন্দ দাশ, ফ্রিডা কাহলো, জন লেনন, সিলভিয়া প্লাথ, বব মার্লে বা আজম খান এরা, সব থেকে একা মানুষ তাদের সময়ের। তারার-তিমির-রূপ সৃজনশীলতার কারণে একা। সময় যায় তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার অবস্থান তৈরি করে নিতে। বুঝলাম না বলে দিলাম 'উন্মাদ'। বুঝলাম না বলে দিলাম 'অপসংস্কৃতি'। আচ্ছা, 'নক্ষত্রের রাত' আঁকতে পারে যে মানুষটা, তাকে কাদের 'উন্মাদ' মনে হয়? কেন? তারা কারা?
অ্যান্ড হোয়েন নো হোপ ওয়াজ লেফট ইনসাইড
অন দ্যাট স্টারি, স্টারি নাইট
ইউ টুক ইয়োর লাইফ অ্যাজ লাভারস ওফেন ডু
বাট আই কুড হ্যাভ টোল্ড ইউ ভিনসেন্ট
দিস ওয়ার্ল্ড ওয়াজ নেভার মিন্ট ফর ওয়ান
অ্যাজ বিউটিফুল অ্যাজ ইউ
−ডন ম্যাকলিন
চিহ্নিত একাদের জন্য পৃথিবী কখনোই প্রস্তুত থাকে না। পৃথিবীতে তাদের সময়। আজম খানের সময় কি ছিল?
দোদুল্যমান মনোটোনাস সংস্কৃতির-বোধ কীর্ণ এক আইল টানা বিস্তার। সেই 'আইল ডিঙায়ে' হঠাৎ একদিন এক সোল্লাস চিৎকার বাংলাদেশের মাটি থেকে উঠল
ওরে সালেকা
ওরে মালেকা
ওরে ফুলবানু
পারলি না বাঁচাতে...
শোর উঠল, গেল! গেল!
অপসংস্কৃতি! অপসংস্কৃতি!
কী সর্বনাশ! পারলি না বাঁচাতে!
আমার গানে আজম খানের
হাত ধরে দাঁড়ান
জিম মরিসন, পিট সিগারের
সঙ্গে বব ডিলান...
উনসত্তরে বিশ্ববিখ্যাত উডস্টক মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেছে, আমাদের গণ-আন্দোলন চলছে, আমাদের যুদ্ধ। একাত্তরে একুশ বছরের তরুণ আজম খান। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। সম্মুখ সমরের গেরিলা যোদ্ধা। রণাঙ্গনের হাওয়ায়, ইথারে জমা হয়ে গেছে তার মাটির কণ্ঠস্বর।
যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো।
সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, তা-ও রঙিন। স্বপ্নে, সৃষ্টির উল্লাসে রঙিন। এই সময় নিনাদ, 'ওরে সালেকা!'
সহজে কে নেয়? যারা নেওয়ার তারা নিল। সালেকা মালেকার গান মনেপ্রাণে নিল। অন্যরা ল্যান্ড মাইন হলেন উন্মাদ আক্রোশে। এ কী গান! গিটার ড্রামসের সঙ্গে বাংলা গান! এত দিনের পালিত বাংলা গান এ কোন দিকে যাচ্ছে? কাঁঠালের আমসত্ত¡ হচ্ছে? তলে তলে তালপাতার সেপাই যে এদিকে প্লাস্টিকের তালপাতার সেপাই হয়ে গেছে, সে খবর নাই কারও। সব সময় তারা এমন। আরে, বাংলা গানের জগৎ এমনিতেই মহা সমৃদ্ধ। সেটাকে কি অস্বীকার করেছিলেন নাকি ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন আজম খান? অপসংস্কৃতি। কী ব্যাপারটা?
স্প্যানিশ গিটার অপসংস্কৃতি! আফ্রিকান ড্রামস অপসংস্কৃতি! বারে! তবে আর শব্দ ব্রহ্ম কোন অর্থে? শব্দব্রহ্ম। আফ্রিকান ড্রামসের বিটে কী থাকে? কালো মানুষের নিশ্বাস, শোণিতের ছলাৎছল। অপসংস্কৃতি বলে দেগে দিলেন! কুতর্কের দোকানদারি থাক। সে সময় আজম খান কেন ভাবলেন যে এভাবে বাংলা গান করবেন? নতুন ধারার গান, বাংলা রক। নতুন এই ধারা পরে পত্রেপুষ্পে শোভিত হয়েছে। বহু বিস্ময়কর বাংলা রক আমরা শুনেছি। অপসংস্কৃতির সিল মেরে একটা জনরাকে অপাঙক্তেয় করে রাখা যায় নাই।
আমাদের রক গুরু আজম খান। বাংলা রকগুরু।
লাল নীল হলুদ সবুজ শার্ট, পাঞ্জাবি পরে মে পারফর্ম করতেন। রকিং।
তার 'আলাল দুলাল' মানুষ কত দিন শুনবে?
'যে মেয়ে চোখে দেখে না'?
'বাংলাদেশ'?
'ও চাঁদ সুন্দর'?
যতদিন ততদিন। আমরা শুনব।
'আলাল দুলাল' নিশ্চয় পুরান ঢাকার সুন্দরতম স্কেচ এখনো। চানখাঁর পুল নাই আর, হাজীজান নাই, সেই আলাল সেই দুলালও নাই। কিন্তু কোথাও যখন বাজে, 'আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল', আমরা আলাল দুলালকে দেখি, চানখাঁর পুল দেখি, হাজীজানকে 'প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি' দেখি। জলজিয়ন্ত।
অসামান্য সমস্ত লিরিক।
যে মেয়ে চোখে দেখে না
সে মেয়ে দৃষ্টিহীনা
আমি যদি পাই জীবনে এমন সাথি...
এমন লিরিক বাংলায় আগে আর হয়েছে?
ও চাঁদ সুন্দরের মতো লিরিক?
কী শুনি!
ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার
তার চেয়ে রূপে রাঙা প্রিয়া আমার
আগে আর কেউ লিখেছেন,
পূর্ণিমার চাঁদের আলো সবটুকুই ধার
আমার প্রিয়ার রূপের আলো নিজস্বই তার?
কী কঠিন অপমান চাঁদকে।
আবার মরমী গান যখন,
এত সুন্দর দুনিয়ায়
কিছুই রবেনারে
হে আল্লাহ হে আল্লাহ হে...।
আমরা এই আজম খানের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি বা হই নাই– যুদ্ধের কিছু আগে বা কিছু পরে আমরা যারা জন্মেছি। বিগত অর্ধশতাব্দী নিশ্চয় সময়ের পকেট ছিঁড়ে পড়ে যাবে না। আজম খান আমাদের আছেন এই অর্ধশতাব্দী ধরে। সপাটে আছেন। আরও থাকবেন। আমাদের প্রথম রকস্টার। কী যায় আসেÑকে বা কাহারা তার কী মূল্যায়ন করল না করল?
কথা হলো−
এ পৃথিবী একবার পায় তারে।
−জীবনানন্দ দাশ
একবার কেন?
একবার পেলেই হয়ে যায় বলে।
যদিও পৃথিবী প্রস্তুত থাকে না। কখনোই প্রস্তুত থাকে না একা একজন ভিনসেন্ট ভ্যান গখ কিংবা একা একজন রকিং আজম খানের জন্য। একবার যদি পায়, তা-ও অপ্রস্তুত। মানুষ সভ্যভব্য হওয়ার পর থেকে এই একই রকম সব হয়ে আসছে তো। কিছু বলার নাই।
কেউ না শুনুক আমি জানি
শুনছেন আমার গান
আমার ঘরে আমার পাশে
বসে আজম খান
আজম খান আমার পাশে বসে থাকেন। আমার-আমাদের।
নোটা বেনে: সিলেট রেডিওতে এখনো কি সকালে পপ গানের অনুষ্ঠান হয়? আগে হতো। সকাল পৌনে নয়টা থেকে নয়টা। আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদের গান বাজত। আজম খান মাস্ট। আমরা শুনতাম−
আমি যারে চাইরে
সে আছে মোরই অন্তরে
আমি তারে পেয়েও হারাইরে
আমি তারে পেয়েও হারাইরে।
এখনো শুনি। আজম খান মগজে বাজেন আমাদের,
আমি তারে পেয়েও হারাইরে।