শতবর্ষ আগের হজযাত্রীর ডায়েরি
'আমি তোমার নরকের ভয় করি না, স্বর্গের লোভ করি না; তবে কেন আমারে অন্তর্দাহে দগ্ধ করো? দগ্ধই যদি করিতে থাকো, অনন্তকাল সহ্য করিতে থাকিব, যদি পুনর্মিলন হইতে বঞ্চিত না করো।' সেই মিলনের প্রত্যাশাতেই ছিলেন আহ্ছানউল্লা—সেকালের খান বাহাদুর, শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম একজন সারথি এবং লেখক।
কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরেও সেই প্রত্যাশারই স্ফুরণ:
বক্ষে আমার কাবার ছবি, চক্ষে মোহাম্মদ রসুল
শিরোপরি মোর খোদার আরশ, গাই তারি গান পথ বেভুল।
কিংবা আবদুল আলীমের কণ্ঠে জসীমউদ্দীনের সেই গান:
মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়
সালাম আমি করব গিয়ে নবীরও রওজায়
আরব সাগর পারি দেব নাইকো আমার তরী
পাখি নই গো উড়ে যাব ডানাতে ভর করি...
২০১৯ সালে প্রকাশিত ড. মোহাম্মদ আলী খানের 'একজন হজযাত্রীর রোচনামচা' গ্রন্থটির চতুর্থ সংস্করণ চলছে। বইটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ শুধু এ কারণেই যে তা ২০০৯ সালে সস্ত্রীক হজ পালনের একটি বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য রোজনামচা, বরং বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে এনে লেখক এতে হজের ইতিহাস এবং সাহিত্য বেশ ভালো প্রাসঙ্গিকভাবেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হজ যেসব বাঙালি মুসলমান লেখকের বিষয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো দিনের সেসব দুর্লভ গ্রন্থ ছেঁকে কোনো কোনো বিষয় পুনরুপস্থাপন করেছেন। কোনোটি সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে ছেপে দিয়েছেন। শত বছরের বেশি সময় আগে আহ্ছানউল্লা ১৯২০ সালে হজ পালন করে পরের বছরই প্রকাশ করেছিলেন 'হেজাজ ভ্রমণ'। তার পীর ছিলেন বিহারের হযরত সৈয়দ গফুর শাহ আল হোসসামি আল ওয়ারেসি। হজে যাবার উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালের ১ মে তিনি চট্টগ্রাম উপস্থিত হন। খবর পেয়েও আহ্ছানউল্লাও তাৎক্ষণিকভাবে তার পীর মুর্শিদের সফরসঙ্গী হওয়ার নিয়ত করেন। তিনি তিন মাসের আগাম বেতন গ্রহণ করেন এবং তিন মাসের ছুটি নেন। চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার তার পাসপোর্ট ইস্যু করেন। বিদায় নেবার জন্য তিনি যখন সাতক্ষীরা কালীগঞ্জের নলতায় আসেন, তখন তার বাড়িতে এমনই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেন তিনি চিরবিদায় নিচ্ছেন। 'বহুকষ্টে ভূ-পতিতা স্ত্রী ও বৃদ্ধা জননী হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।' বাকি অংশ তার হেজাজ ভ্রমণ ও রোজনামচা থেকে:
১৯২০-২১ সালের জন্য প্রযোজ্য সুনির্দিষ্ট কোনো জাহাজ ভাড়া ছিল না। তবে হজযাত্রী পরিবহনকারী টার্নার ও মরিসন কোম্পানির জাহাজে বোম্বাই বা করাচি থেকে জেদ্দা ভাড়া: প্রথম শ্রেণী ৫৫০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণী ৪৫০ টাকা এর তৃতীয় শ্রেণী ২৬০ টাকা। আর কলিকাতা থেকে জেদ্দা তৃতীয় শ্রেণী কিংবা ডেক যাত্রীর ভাড়া ২০৫ টাকা। রিটার্ন টিকেট গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তবে রিটার্ন টিকেট ১৮ মাস পর্যন্ত বহাল থাকে। সাধারণ জাহাজযাত্রীর প্রতিদিনের খোরাকি ব্যয় ১৩ আনা। হজযাত্রীর পাসপোর্ট ইস্যু করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও, পুলিশ কমিশনার কিংবা বোম্বাই বা করাচির প্রোটেক্টর অব পিলগ্রিমস। কলেরা ও গুটি বসন্তের টীকা নেওয়া বাধ্যতামূলক, ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেট প্রদর্শনও বাধ্যতামূলক। তবে টীকা নেওয়া না হলে পিলগ্রিমস ডিপার্টমেন্ট বন্দরেই এই আয়োজন করে থাকে। ডেকযাত্রীর জন্য ডেকের উপর ছয় ফুট দীর্ঘ ও আড়াই ফুট প্রস্থ স্থান বরাদ্দ করা থাকে। আহ্ছানউল্লা হজযাত্রীদের ৯০০ টাকা সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, এ টাকার মধ্যে ৮৩০ টাকা ৮ আনা খরচের একটি ফর্দও তিনি উপস্থাপন করেছেন। বিদ্যমান নিয়মানুসারে জাহাজ কোম্পানি জাহাজে থাকার সময় খাবার এবং জাহাজে মৃত্যু হলে কাফন সরঞ্জাম সরবরাহ করতে বাধ্য।
কলিকাতায় হজ কমিটিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সদস্য ছিলেন মোট সদস্য ১৯ জন।
১. খান বাহাদুর মৌলবি মোহাম্মদ আবদুল মোমেন (চেয়ারম্যান)
২. ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ কলিকাতা পোর্ট
৩. হেলথ অফিসার, কলিকাতা পোর্ট
৪. মি. আবদুল আজিজ খাঁ
৫. হজ কমিটির কার্যকারক অফিসার
৬. মি. আবদুর রহিম সিআইই
৭. মি. জে সি ফস্টার, টার্নার মরিসন কোম্পানি
৮. মৌলবি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড
১০. মি. আমীন আহমেদ
১১. মি. আবদুল হালিম গজনবী
১২. মৌলবি শহীদউদ্দীন মোহাম্মদ
১৩. মৌলবি আবদুল আজিজ
১৪. মি. মোহাম্মদ রফিক, কলিকাতা কর্পোরেশন
১৫. মৌলবি শামসুদ্দিন আহমদ, কলিকাতা কর্পোরেশন
১৬. হাজী বদি আহম্মদ চৌধুরী
১৭. হাজী আবদুর রশীদ খাঁ, কলিকাতা কর্পোরেশন
১৮. খান সাহেব ফরিদউদ্দীন আহমদ চৌধুরী
১৯. খান বাহাদুর মৌলবি জালালউদ্দিন আহমদ
আগেকার দিনের হাজিগণ অনেক কষ্ট স্বীকার করে হজ পালন করতেন। শুধু কষ্ট নয়, জীবনের ঝুঁকি ছিল, যাত্রাপথে মৃত্যুবরণের আশঙ্কা ছিল। এখনকার মতো উন্নত সড়কব্যবস্থা ছিল না, উট, অশ্ব বা পদব্রজ প্রধান অবলম্বন থাকায় পথে পথে অনেক ঝুঁকি থাকত। তখন জাহাজে করে এ দেশ থেকে জেদ্দা পর্যন্ত যেতে হতো। জাহাজেই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সব মিলে তিন মাসের অধিক সময় লাগত হজ সমাপ্ত করে দেশে ফিরতে।
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লার ডায়েরি থেকে কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরা হলো, ঠিক যেভাবে তিনি তাঁর বইয়ে মুদ্রিত করেছেন; শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন: 'যে সকল হজ্জ্বযাত্রী উষ্ট্রপৃষ্ঠে মদিনা শরীফে জিয়ারত করিবার ইচ্ছা করেন, তাঁহাদের জন্য নিম্নলিখিত রোজ-নামা উপাদেয় হইবে।'
'১৯ শে জুন, ১৯২০
অদ্য বাটী হইতে রওয়ানা হইয়া কলিকাতা পৌঁছিলাম।...
৩রা জুলাই, ১৯২০
আমাদের সমস্ত জিনিস-পত্র অদ্য ডকে আনিয়া 'হুমায়ুন' জাহাজে উঠাইয়া দিলাম।...
৫ জুলাই, ১৯২০
অদ্য সমুদ্রে ভয়ানক তুফান ছিল। যাত্রীগণ হঠাৎ অস্থির ও বিচলিত হইয়া পড়িল, বমন ও শিরোঘুর্ণনবশতঃ অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলেই অধীর হইয়া পড়িল। ...জিনিসপত্র পড়িয়া ভাঙ্গিতে লাগিল। আরোহীগণ শয্যাশায়ী হইল। সকলেরই আহার-বিহার বন্ধ রহিল।
৮ই জুলাই, ১৯২০
তরঙ্গের মধ্যে জাহাজ টলটলায়মান ছিল ও মহাসমুদ্রের মধ্যে সামান্য একটি বয়ার ন্যায় বোধ হইতেছিল। প্রতি মুহূর্তে জাহাজখানি সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হইবে, সকলের মনে এই আতঙ্ক ছিল।...
১৭ই জুলাই, ১৯২০
অদ্য অপরাহ্ন ৪ ঘটিকার সময় আমরা জেদ্দা বন্দরে পৌঁছিলাম। যাত্রীগণ উদ্বিগ্ন ভাবে জেদ্দা বন্দরে অবতরণ প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। যাত্রীদিগের মধ্যে কাহারও মৃত্যু ঘটে নাই কিংবা কোন সংক্রামক রোগের চিহ্ন পাওয়া যায় নাই।...
১৯ শে জুলাই, ১৯২০
আমরা অদ্য প্রাতঃকালে শহরের বহির্ভাগে হজরত উম্মে হাওয়ার পবিত্র সমাধি জেয়ারত করিলাম। কবরটি অতি দীর্ঘ এবং তাহার প্রাচীর-গাত্রে কয়েকটি দরজা আছে। কথিত আছে প্রাচীন কালের লোক অতি দীর্ঘকায় ছিল। তাই কবরটি এত দীর্ঘ।
২০শে জুলাই, ১৯২০
এখানে পানীয় জলের বন্দোবস্ত সন্তোষজনক নহে। বর্ষাকালে কূপে-তালাবে যে পানি জমিয়া থাকে, হজ্জের সময় উহাই বিক্রীত হয়। এক মশক পানির মূল্য দুই আনা হইতে বার আনা পর্য্যন্ত উঠিয়া যায়। বহু লোকের সমাগমহেতু পানি পঙ্কিল হইয়া উঠে।...
২১শে জুলাই, ১৯২০
জেদ্দা হইতে রওয়ানা হইবার পূর্বে অত্যাবশ্যক জিনিস-পত্রব্যতীত সমস্তই বাক্সে বন্ধ করিয়া মোয়াল্লেমের জিম্মায় রাখিয়া গেলাম। স্বতন্ত্র উষ্ট্র-পৃষ্ঠে এক মাসের উপযোগী চাউল, ডাউল, ঘৃত ও চা লইলাম...
২২শে জুলাই, ১৯২০
অদ্য বেলা একটার সময় ১৮০টি উট লইয়া কাফেলা রওয়ানা হইল। প্রত্যেক উটের উপর সুখ্দুফ বা শিবির ছিল।...
২৪শে জুলাই, ১৯২০
...পথিমধ্যে একটি শিবির ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল এবং উহার আরোহীগণ শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল। উহাদের জিনিসপত্র দস্যুগণ লুটপাট করিয়া লওয়ায় উহারা জিদ্দায় ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইলেন।...
২৬শে জুলাই, ১৯২০
সূর্যের উত্তাপ অসহনীয়। দুইপার্শ্বে দুইটি সুখ্দুফ রাখিয়া উপরে কম্বল ঝুলাইয়া যৎসামান্য ছায়া করিয়া প্রাতঃকাল হইতে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অবস্থান করিতাম। জোহরের নামাজ অন্তে কাফেলা রওয়ানা হইত... অদ্য পথিমধ্যে দস্যুগণ গুলি ছুঁড়িয়াছিল। তজ্জন্য কাফেলা কয়েক স্থানে থামিতে বাধ্য হইয়াছিল।...
১লা আগষ্ট, ১৯২০
বেলা সাড়ে দশ ঘটিকার সময় অতিকষ্টে আমরা মঞ্জেলে উপস্থিত হইলাম। বিশ্রাম লইবার সময় ঘটিল না। ঘর্মাক্ত দেহে সূর্য্যরে প্রচণ্ড কিরণের মধ্যে পাকের বন্দোবস্ত করিতে হইল। একদিকে অনবরত মস্তক জলসিক্ত করা হইতেছে, অপরদিকে বালুকার মধ্যে চুলা প্রস্তুত করিতে হইতেছে। কখন কখন বাতাসের ঝাপ্টা আসিয়া সমস্ত বিফল করিয়া দিতেছে। দুই ঘণ্টা কাল অনবরত চেষ্টার পর খিচুড়ী প্রস্তুত হইল। আমি অগ্নিতাপে দগ্ধীভূত হইয়া বারংবার শরীর ও মস্তক জলসিক্ত করিতে লাগিলাম। অন্যান্য আরোহীগণ পানির অভাব দেখিয়া আমাকে ভর্ৎসনা করিলেন।...
২রা আগষ্ট, ১৯২০
বেলা মধ্যাহ্নের পর যাত্রীগণ মদিনা 'তৈয়বায়' উপস্থিত হইল। ...রওজা শরীফে উপস্থিত হইয়া 'বাবে-ছালামে' প্রবেশ করিলাম ও রওজা শরীফ জিয়ারত করিয়া 'আসর' নামাজে যোগদান করিলাম। ...মদিনাবাসীগণ উগ্র স্বভাবাপন্ন নহেন। ইহারা সুপরিচ্ছদে পরিচ্ছন্ন, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও শুভ্রকায়, হাজিদিগের পরিচর্য্যায় সর্বদা আনন্দিত ও অল্প পুরস্কারেই সন্তুষ্ট।...
৫ই আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য কাফেলা জেদ্দা প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত। প্রায় সহস্র ব্যক্তি হজ্জযাত্রা করিবার জন্য উদগ্রীব। উহাদের মধ্যে পাঞ্জাবী সিন্ধী ও যাভাবাসী অত্যধিক... আমরা শেষবারের মত রওজা শরীফের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। হৃদয়পটে বিদায়ের ছবি অঙ্কিত হইল।...
৮ই আগষ্ট, ১৯২০
...বৈকালে তিনটার সময় কাফেলা পুনরায় বাধাপ্রাপ্ত হইল। শত্রুপক্ষ হইতে গুলিবর্ষণ হইতে লাগিল।...
১১ই আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য 'লু' চলিতে আরম্ভ হইল। সমস্ত দেহ সূর্য্যতাপে দগ্ধ হইবার উপক্রম হইল। শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িল, স্বাস্থ্যভঙ্গ হইল। বলিতে কি, প্রাণ ওষ্ঠাগত হইল। অদ্য তিনটি যাত্রীর দাফন-কাফন হইল। হেজাজ মরুভূমির বালুকারাশির মধ্যে তাঁহারা চিরতরে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। আমরা দুই দিবসের পানীয় জলসহ অতি কষ্টে এখান হইতে রওয়ানা হইলাম।
১৩ আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য 'বারেক' পৌঁছিলাম। পথিমধ্যে রাত্রিকালে বন্দুকের আওয়াজ শুনা গিয়াছিল। জনৈক ইরাকী আরোহীর রসদ ও তিনশত টাকা লুট হইয়াছিল। শত্রুদের সহিত সংঘর্ষ হইয়াছিলও ফলে দুইটি লোক হত হইয়াছিল।...
১৫ আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য আমরা 'কাদিমা' পৌঁছিলাম। এখানে জনৈক যাত্রীর দাফন-কাফন হইল।
১৭ই আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য প্রাতে ৭ ঘটিকার সময় আমরা জেদ্দা নগরের বাহিরে পৌঁছিলাম।...
২০শে আগষ্ট, ১৯২০
শুক্রবার; অদ্য প্রাতে ৫টার সময় মক্কা মোয়াজ্জমায় উপস্থিত হইলাম। আমরা মোহ্রেম অবস্থায় বাবছ্ছালাম পৌঁছিয়া সসম্মানে হারাম শরীফে প্রবেশ করিলাম। তৎপর মোয়াল্লেমের সহিত লাব্বায়েক ও নির্দিষ্ট দোয়া পড়িয়া হাজরে আছওয়াদ তাজিমের সহিত চুম্বন করিলাম ও উক্ত হাজরে আছওয়াদকে বামদিকে রাখিয়া ডানদিক হইতে দ্রুতবেগে যথাক্রমে সাতবার খানায়ে কাবা তওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করিলাম।...
২৩শে আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য হারাম শরীফ তওয়াফ-অন্তে আমরা মিনার দিকে রওয়ানা হইলাম।...মিনা মক্কা শরীফ হইতে চারি মাইল দূরে অবস্থিত। অদ্য এখানে আমরা রাত্রিযাপন করিলাম। পরদিবস প্রাতে এখান হইতে আরাফাত রওয়ানা হইলাম।
২৪শে আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য প্রাতে আমরা মিনা পরিত্যাগ করিয়া কিয়দ্দুর অশ্বপৃষ্ঠে, কিয়দ্দুর উষ্ট্রোপরি পবিত্র আরাফাত ময়দানে বেলা ১০ ঘটিকার সময় উপস্থিত হইলাম।...
২৫শে আগষ্ট, ১৯২০
আজ জিলহজ্জ চাঁদের দশম দিবস। এই দিবস প্রাতে ৮ ঘটিকার সময় মিনায় উপস্থিত হইলাম এবং ঐ স্থানে একটি প্রস্তর শলাকার প্রতি নির্দ্দেশ করিয়া সাতটি প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করিলাম। মিনা-ভূমিতে এইরূপ তিনটি স্থানে প্রাচীন প্রথা অনুসারে ইবলিসকে লক্ষ করিয়া কঙ্কর ছুঁড়িতে হয়। মিনায় আসিয়া হাজিগণ কোরবানী সম্পাদন করেন। ...আমরা দুইটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়া ছাগল ক্রয় করিয়া কোরবানী-ব্রত সম্পন্ন করিলাম; অতঃপর এহরাম পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিলাম।
২৬শে আগস্ট, ১৯২০
আমরা অদ্য তিনটি স্থানে পুনরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করিলাম। এইদিন প্রাতঃকালে আমাদের নিকটবর্তী জনৈক হাজী টাকার থলিয়া বালিশের নীচে রাখিয়া কূপে স্নান করিতে গিয়াছিল। স্নানের পর আসিয়া সে উক্ত টাকার আর কোনো সন্ধান পায় নাই।
২৭শে আগস্ট, ১৯২০
এই দিবস অপরাহ্নে মিনা পরিত্যাগ করিয়া আমরা সন্ধ্যাকালে মক্কা নগরীতে উপস্থিত হইলাম।...
২৯শে আগষ্ট, ১৯২০
অদ্য আমরা 'মছজিদে আয়শা' নামক প্রার্থনাগাহে অশ্বতর-পৃষ্ঠে উপস্থিত হইলাম। হজরত এই স্থানে অশ্বতর-পৃষ্ঠে শুভাগমন করিতেন। সেই জন্য হাজীগণও পদব্রজে বা অশ্বতর-পৃষ্ঠে আসিয়া থাকেন। ...
৩১শে আগষ্ট, ১৯২০
আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা মক্কানগরী হইতে বিদায়ের জন্য হারম শরীফ তওয়াফ করিলাম। হজ্জ সমাপনান্তে খোদাতা'য়ালার অসীম দয়া ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ-হৃদয় ও অতি দুঃখের সহিত সসম্ভ্রমে কাবা-পাক পরিত্যাগ করিলাম।...
৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯২০
অদ্য প্রাতে খোদাওয়ান্দ করিমের নাম স্মরণ করিয়া তাঁহার প্রভূত অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অন্তরে আমরা জাহাজে চড়িলাম।...জাহাজে তিনটি লোকের মৃত্যু হয়। দুর্ব্বলতাই মৃত্যুর প্রধান কারণ। ইহাদের মৃত্যুতে কেহ বিচলিত হয় নাই।...হজ্জব্রত জীবনকে যে নূতন ছাঁচে গড়িতে পারে, সে বিশ্বাস অনেকেরই নাই।...
৭ই-৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০
আমরা ক্রমে সকোত্রা অতিক্রম করিলাম। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা আরোহীদিগের মস্তিস্ক-বিকৃতি ঘটাইয়াছিল। যাহারা হেজাজের প্রখর সূর্য্যতাপে অভ্যস্ত হইয়াছিল, তাহারা সামুদ্রিক শৈত্যে অসুস্থ হইয়া পড়িল।...
১০-১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০
জাহাজ আপনমনে ধীরগতিতে অগ্রসর হইতে লাগিল... জেদ্দা হইতে এডেন পর্য্যন্ত ৭০৩ মাইল ও এডেন হইতে বোম্বাই ১৬৬০ মাইল। জাহাজ ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে বেলা ৪টার সময় জেদ্দা বন্দর পরিত্যাগ করিয়া ১৩ই সেপ্টেম্বর প্রাতে সাড়ে চারিটার সময় বোম্বাই নগরে উপস্থিত হইল।...
১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০
আমরা অদ্য অপরাহ্নে সাড়ে চারিটার সময় 'বোম্বে' মেইল যোগে কলিকাতায় পৌঁছিলাম।
১৮ই সেপ্টেম্বর
অদ্য প্রাতে চট্টগ্রাম পৌঁছিয়া আমি পুনরায় কার্য্যভার গ্রহণ করিলাম।
সেই ১৯২০ সালের হজভ্রমণের এই বিবরণ এখন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তখন কতই না কষ্টের ছিল হজ পালন। আমরা সে তুলনায় অনেক ভাগ্যবান। সর্বত্র যানবাহনের ব্যবস্থা, পানীয় জল ও খাদ্যের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, চিকিৎসা ইত্যাদিও জন্য কর্তৃপক্ষের প্রশংসা প্রাপ্য, অভিবাদন কর্তৃপক্ষকে।
শুধু আমাদের দেশের হজযাত্রীদের এই কষ্ট ছিল, তা নয়, লেখক-পণ্ডিত মুহম্মদ আসাদের বিখ্যাত গ্রন্থ 'মক্কার পথ'-এ (ঞযব জড়ধফ ঃড় গধশশধয) তাঁর হজযাত্রার একটি বিবরণীতেও এই কষ্টকর যাত্রার বিবরণ পাওয়া যাবে:
'জাহাজে কেবল হজ্ব-যাত্রীরাই রয়েছে এবং তারা সংখ্যায় এতো বেশি যে, এতোগুলি লোককে বহন করার ক্ষমতা জাহাজের নেই বললেই চলে। সংক্ষিপ্ত হজ্ব মৌসুমের মুনাফার জন্য পাগল লোভী জাহাজ-কোম্পানীই যাত্রীদের আরাম-আয়েশের দিকে লক্ষ্য না রেখে, আক্ষরিক অর্থেই জাহাজটিকে বোঝাই করছে কানায় কানায়। ডেকের উপর কেবিনগুলিতে, প্যাসেজে, প্রত্যেক সিঁড়িতে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাইনিং রুমগুলিতে, যাত্রীবহনের জন্যই জাহাজের যে খোলগুলি খালি করে মই লাগানো হয়েছে, সেগুলিতে: প্রত্যেকটি খালি জায়গা ও কোণে মানুষকে একত্র গাদাগাদি করে ঠাসা হয়েছে খুবই যন্ত্রণাদায়কভাবে। ওদের প্রায় সকলেই মিসর এবং উত্তর আফ্রিকার হজ্বযাত্রী। পরম নম্রতার সাথে, কেবল এই সফরের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ওরা কোনো প্রতিবাদ ও অভিযোগ না করে সহ্য করে যাচ্ছে এহেন অনাবশ্যক কষ্ট। কিভাবে ওরা—নারী, পুরুষ, শিশু-গাদাগাদি ঠাসাঠাসি একেকটা দল হিসাবে ডেকের পাটাতনের উপর পশুর মতো শুয়ে আছে এবং অতিকষ্টের সাথে তাদের গেরস্থালীর বাসনপত্র ঘষামাজা ক'রে পরিষ্কার করছে; রাঁধছে (কারণ, কোম্পানী কোনো খাবার সরবরাহ করছে না) কেমন ক'রে সবসময় ঠেলাঠেলি ক'রে ওরা পানির জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে টিনের মগ বা ক্যানভাস মোড়া পানির পাত্র নিয়ে, প্রতি মুহূর্তেই একটি যন্ত্রণা মানুষের এই চাপাচাপির মধ্যে; কেমন করে ওরা দিনে পাঁচবার জামায়েত হয় পানির কলের চারপাশে—কেননা অতোগুলি মানুষের জন্য অতি অল্প কটি ট্যাপই রয়েছে সালাতের আগে ওযু করার জন্য। কেমন করে ওরা যাতনা ভোগ করছে জাহাজের গভীর খোলের দম বন্ধ করা বাতাসে, ডেকের দুই তলা নীচের খোলগুলিতে যেখানে অন্য সময়ে, কেবল গাঁট এবং জিনিসপত্রের কেসই ভ্রমণ করে—যে কেউ তা দেখলে সে-ই উপলব্ধি করবে ঈমানের জোর, বিশ্বাসের শক্তি, যে শক্তিতে এরা—হজ্বযাত্রীরা শক্তিমান; কারণ মক্কার চিন্তায় ওরা এমনি মশগুল, এমনি নিমগ্ন যে, ওদের এই কষ্ট ওরা আসলে অনুভব করছে বলেই মনে হয় না। ওদের মুখে কেবল হজ্বেরই কথা এবং যে আবেগ নিয়ে ওরা ওদের আসন্ন ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছে, তাতে দীপ্ত-উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওদের মন। মেয়েলোকেরা প্রায়ই কোরাসে গাইছে পবিত্র নগরীর গান আর বারবার ঘুরে-ফিরে উঠছে একটি ধ্বনি—'লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক।' (ড. মোহাম্মদ আলী খানের 'একজন হজযাত্রীর রোচনামচা')
মক্কায় ইব্রাহিম খাঁ
'অসহ্য গরম। শুনলাম, আট হতে দশ হাজার হাজী কেবল গরমে মারা গেল। বিগত বিশ বছরের মধ্যে নাকি এমন গরম পড়ে নাই। মীনায় থাকতে একদিন খবর পেলাম, একজন পাকিস্তানি হাজী পথে পড়ে আছে—শিগগিরই মরবে। আমি আর আলী আকবর খাঁ চললাম। খুঁজে বের করে তার মাথায় বরফ দিলাম। চোখ মেলে চাইল। তারপর সরকারী হাসপাতালে নিয়ে রেখে এলাম। এই বর্ণনা প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর 'বাতায়ন গ্রন্থে' মক্কা শিরোনামের রচনার অংশ। তবে এই কষ্ট তার হয়নি, জেদ্দা হতে সুলতান ইবনে সউদের অতিথি হবার সৌভাগ্য তিনি অর্জন করেছিলেন। বাদশাহের তরফ থেকে পাঠানো মোটরে চড়ে তিনি মক্কা রওয়ানা হন। 'পথ লোকে লোকারণ্য, হজযাত্রীরা সব চলেছে। কেউ কেউ হেঁটে, কেউ কেউ উটে, বেশির ভাগই লরীতে। মক্কায় পৌঁছে দেখলাম শহর যাত্রীতে ভর্তি। আমরা বায়তুল্লাহর সন্নিকট সরকারি হোটেলে উঠলাম। সুন্দর হোটেল। পাশ্চাত্য নিয়মে পরিচালিত, নিয়ন্ত্রণভার মিশরী কর্মচারীর হাতে। পরদিন সকালে চললাম মীনা, তারপর গেলাম আরাফাত, তারপর মুজদলফা, তারপর ফের মক্কা। হজের সমস্ত শরীয়ত পালন করলাম।
'মক্কা হতে জেদ্দা হয়ে উড়োজাহাজে মদীনা এলেন, গরম কম, মানুষের ভিড় কম, মক্কার তুলনায় গাছপালা বেশি। মদীনা শরীফের সবচেয়ে বড় কথা মহানবীর সান্নিধ্যবোধ। তাঁর মাজারের কাছে গেলে মনে হতো চৌদ্দশত বছরের দূরত্ব পার হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি সেই মহাপুরুষেরে সালাম যিনি তার হৃদয়ের সমস্ত দরদ, তার জীবনের সমস্ত তপস্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের জন্য।'
ত্রিশের দশকের এই কষ্টের ছবি এখন শুধুই স্মৃতি।
হেজাজ ভ্রমণ, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা, প্রথম প্রকাশ ১৯২১
আহ্ছানিয়া মিশন পাবলিকেশনস ট্রাস্ট, পঞ্চম মুদ্রণ ২০১৯