হে বৃষ্টি, তোমারই প্রতীক্ষায়...
সৌরমণ্ডলে পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী লোহিত গ্রহ মঙ্গল। গ্রহটিতে বৃষ্টিপাতের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মার্কিন লেখক রে ব্র্যাডবেরি। তার লেখা বিজ্ঞান-কল্প 'দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকলস'-এ মঙ্গলে মঙ্গলময় বৃষ্টির এ বর্ণনা দেন। তার বর্ণনায়, কোমল ধারায় বৃষ্টিপাত হয়। মঙ্গলের মাটি এ বৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। কখনো নামে নীল বৃষ্টি। বর্ষণ এমন অঝোর ধারায় নেমে আসতে পারে যে রাতারাতি গাছে গাছে ভরে যায় এ গ্রহ। বাতাসে বাড়ে অক্সিজেন। হয়ে ওঠে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী। বিজ্ঞানীরা এককালে ভাবতেন, পৃথিবীর মতোই মঙ্গল গ্রহেও রয়েছে পানি এবং জীবন। ১৯৫০-এ ব্র্যাডবেরির এই পুস্তক প্রকাশিত হয়। ধারণায় অবশ্য তখনই উল্টো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা জানাতে শুরু করেছেন, শুষ্ক এবং শীতল গ্রহ মঙ্গলে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা কম, প্রায় নেই। তবে বিজ্ঞানের বাস্তবতা নয়, বরং যেকোনো গ্রহ নিয়ে মানবিক গল্প শোনানোর অসীম আগ্রহ ছিল ব্র্যাডবেরির। তার গল্পে শুক্র গ্রহেও বৃষ্টি হয়েছে। তবে শুক্রকে মহাকাশের ভেজা গ্রহ হিসেবে মেনে নেননি বিজ্ঞানীরা। তারপরও বর্ষণের গল্পে শুক্রের নাম ব্যবহারে ইতস্তত করেননি ব্র্যাডবেরি।
বৃষ্টিপাতের প্রতি ব্র্যাডবেরির ছিল অন্তহীন আকর্ষণ; বৃষ্টিপাত তার কাছে সুখ সময়ের স্মৃতি বয়ে আনে। ইলিনয় এবং উইসকনসিনের বৃষ্টিমুখর নিজ বালককালের কথা তার মনে ভেসে আসে। লস অ্যাঞ্জেলেসে কৈশোরের কাজের দিনগুলোতেও বৃষ্টি ব্র্যাডবেরিকে অবিরাম টেনেছে। গোটা লেখক জীবনে তার গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে বারিপাতের কথকতা।
ব্র্যাডবেরির কাহিনিতে বৃষ্টি সৃষ্ট দৃশ্যপট শান্তিপূর্ণ হতে পারে। হতে পারে ভীতিকর। বৃষ্টির ফলে মানুষের মনে দুঃখবোধ সৃষ্টি করতে পারে। উন্মাদনা ডেকে আনতে পারে। কিংবা দিতে পারে সুখবোধ। 'লং রেইন' নামের একটি গল্পে বৃষ্টি একটি পূর্ণ চরিত্রের রূপ ধরে এসেছে। অবিরাম বর্ষণ, কুয়াশা, বন্যা এবং মানুষকে যা চাবুকের মতো আঘাতের পর আঘাত করে গেছে। (বৃষ্টির বর্ণনায় তিনি লেখেন, 'মুষলধারে বৃষ্টি, চিরকালের বৃষ্টি, বাতাসে জলীয় বাষ্প জমে ঘাম নিয়ে আসে। নিয়ে আসে বাষ্পীভূত বৃষ্টি। এ যেন এক অশেষ ঝিঁঝির আওয়াজ। জলধারা পাকে নিচের দিকে টেনে ধরে, এটি ছিল বৃষ্টির এক চূড়ান্ত রূপ; যা আগের যেকোনো বৃষ্টির স্মৃতিকে বর্ষণ ধারায় ডুবিয়ে দেয়।'
রে ব্র্যাডবেরি প্রায় জীবনের পটভূমি হিসেবে বৃষ্টিকে ব্যবহার করেছেন। বৃষ্টির এমন প্রয়োগকে পুরোপুরি ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা জীবনের যে রূপ দেখতে পাই, সেখানে পানি হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যকীয়। পৃথিবী নামের গ্রহকে বিশেষ এক নীল গ্রহ হিসেবে বা মহাকাশের নীল মার্বেল দানা হিসেবে চিহ্নিত করেছি। ধরিত্রীই একমাত্র ভেজা এবং পানিতে ভরপুর গ্রহ বলে দাবি করছি। মঙ্গলের সাগর-মহাসাগর নিয়ে ব্র্যাডবেরি যে বর্ণনা দিয়েছেন, বাস্তবতার কষ্টিপাথরে এমন দাবিও হয়তো সে কাতারেই পড়তে পারে। আধুনিক কালের বিজ্ঞান বলছে, গোটা সৌরসভায় পৃথিবীই একমাত্র পানিপূর্ণ গ্রহ নয়। পৃথিবী, মঙ্গল এবং শুক্র—সবার সৃষ্টির সূচনাতে হয়তো পানি ছিল।
পানি ছিল সে জন্য পৃথিবী ব্যতিক্রমী গ্রহ নয়। বরং ব্যতিক্রম হলো, পৃথিবী নিজের পানিকে ধরে রাখতে পেরেছে। শুক্র বা মঙ্গলের পানি অন্যদিকে মহাকাশে উবে গেছে। জীবনের উৎস হিসেবে বিবেচিত পানিকে দিব্যি ধরে রেখেছে পৃথিবী। সুনীল গ্রহের অধিবাসী, অর্থাৎ আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে যে দিগন্তরেখায় মেঘের আনাগোনা ছিল, ছিল বৃষ্টির পূর্বাভাস।
পৃথিবীর পরিবেশ এখন শান্ত এবং 'সুবোধ'। চিরদিন পৃথিবীর এ চেহারা ছিল না। জন্মলগ্ন পৃথিবী ছিল অতি রুক্ষ। সূর্যের জন্ম হয় ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি বছর আগে। পৃথিবীর সৃষ্টি ৪.৬ বিলিয়ন বা ৪৬০ কোটি বছর আগে। আদিমকালের সেই পৃথিবী ছিল গনগনে গরম। সূর্য সৃষ্টির পর মহাজাগতিক ধুলো এবং ধ্বংসাবশেষের বাদবাকি অংশ থেকে তৈরি হয় পৃথিবী। কল্পনাতীত উষ্ণ এই উপাদান গুচ্ছকার রূপ ধারণ করে সূর্যের কাছাকাছি চার গ্রহের জন্ম দেয়। এগুলোর সবারই সৃষ্টি-উপাদান একই।
প্রথম অর্ধবিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছর পৃথিবী ছিল গনগনে তরল উপাদানের নরককুণ্ড। সে সময় তাপমাত্রা ছিল ৮০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আদিমতম সেই নরককুণ্ডের তাপ আজকের দিনের সূর্যের চেয়ে বেশি। ভূগর্ভস্থ গ্রিক দেবতার নাম অনুসারে সে সময়কালকে হেডেন বলা হয়। হেডেন পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ তৈরি করে। কিন্তু মহাকাশ থেকে ছুটে আসা অগ্নিময় উল্কাখণ্ডের বিরামহীন আঘাতের তুফানে তা অগ্নিকুণ্ড হয়ে ওঠে।
আগুনের এই ঝড়-বাদল পৃথিবীতে শাপে বর হয়ে ওঠে। পৃথিবী গঠন হয়েছে যেসব শিলায়, তাদের বেশির ভাগেরই ভেতরে ছিল পানি। পানি নিজ রূপ পরিবর্তনে দক্ষ। তরল। নিরেট (বরফ) বা গ্যাস (বাষ্প)। টগবগিয়ে ফুটন্ত পানির কড়াই থেকে বাষ্প বের হয়। একইভাবে উল্কাপিণ্ডরাশির হামলায় জর্জরিত পৃথিবী থেকে বাষ্প বের হতে থাকে।
ক্রমেই উল্কাপিণ্ডের তপ্ত আঘাতে আঘাতে এবং পৃথিবীর সদ্য গড়ে ওঠা আগ্নেয়গিরিমালা থেকে পানির বাষ্পসহ অন্যান্য গ্যাস আবহমণ্ডলে জমতে থাকে।
অদৃশ্য পানির এই বাষ্পমালা পৃথিবীর জন্য ত্রাণ ডেকে আনে। আজকের দিনে দুনিয়ার সব নদীনালা দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয়, তার চেয়ে অনেকে বেশি বারিধারা বয়ে চলে আবহমণ্ডলের হাওয়ায় হাওয়ায়। এই জলকণিকাদের নিজেদের সাথে এবং সাগর থেকে ওঠে আসা ধুলা বা নুনের মতো অন্যান্য কণিকার সাথে সংঘর্ষ ঘটতে থাকে অবিরাম। বাতাসের উষ্ণতা কমলেই একে অন্যের সাথে লেগে থাকে। খুদে খুদে জলবিন্দু সৃষ্টি হয়। এ রকম অযুত-নিযুত বা বিলিয়ন বিলিয়ন জলবিন্দু মেঘমণ্ডলী তৈরি করে। অবশেষে ভাসমান সে পানি বর্ষণ ধারা হয়ে আবার নেমে আসে পৃথিবীর বুকে।
পৃথিবী যখন তপ্ত তরলাকারে ছিল এবং হেডেনের মতো অকল্পনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করেছে, তখন জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হতে পারেনি। বরং এ সময়ে জলীয় বাষ্প মহাকাশে হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এ বাষ্পই তরুণ পৃথিবীর আবহমণ্ডল গড়ে তুলতে থাকে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের ভূমিকা পালন করে বাষ্প। তাপ আটকে দেয়। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভূপৃষ্ঠ তৈরির যেকোনো প্রচেষ্টাই এ সময় ভেস্তে যায়। তবে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। প্রায় এক বিলিয়ন বা এক শ কোটি বছর পরে আগ্নেয় উল্কারাজির আসমানি হামলা কমে যায়। পৃথিবীর ললাটে শীতল হওয়ার অবকাশ জোটে।
শীতল হওয়ার সাথে সাথে জলীয় বাষ্প বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হতে থাকে। তারপর শুরু হয় মুষলধারায় বৃষ্টি।
বিজ্ঞানে কল্পনার ব্যাপক খরা নিয়ে মনোবেদনার গাথাকে লামিয়া নামের কবিতায় ১৮২০-এ প্রকাশ করেন কবি জন কিটস। পৃথিবী এবং স্বর্গের যাত্রাপথকে রংধনু হিসেবে কল্পনা করা হতো। কিন্তু বৃষ্টির কণিকারাজিতে সূর্যের আলোর প্রতিসরণকেই বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন রংধনু সৃষ্টির কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। ফলে রংধনুকে ঘিরে যে কল্পগাথা গড়ে উঠেছিল, তার মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু নিউটনের কল্পনাশক্তির ঘাটতি ছিল—সে কথা খাটবে না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কল্পনা করতে গিয়ে তিনি ধারণা করলেন, গাছ থেকে খসে পড়া আপেলকে পৃথিবী নিজের দিকে টানছে। একই শক্তিতে চাঁদকে নিজ কক্ষপথে টেনে ধরে রাখছে পৃথিবী। এমনি বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিতে ধরিত্রীর বুকের প্রথম বর্ষণের কথা কল্পনা করা যায়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল সে ঝড়-বৃষ্টি। হাজার হাজার বছর ধরে অবিরাম চলেছে সে ঝড়, ব্রজপাতসহ বৃষ্টিপাত।
আজকের দিনের বৃষ্টিপাতের সাথে তার মিল খুঁজতে গেলে নিরাশ হতে হবে। ভূপৃষ্ট ছিল তখন প্রচণ্ড তপ্ত। বৃষ্টির পানি মাটিতে পৌঁছানোর আগেই তাপে আবার বাষ্পীভূত হয়ে যেত। এভাবেই একটি চক্রের সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় গভীর মেঘমণ্ডলীর। বৃষ্টিপাত-বজ্র-বিদ্যুতের অবিরাম খেলা চলতে থাকে। আদিম ভূমণ্ডলের সে ঝড়-বর্ষণ এবং বজ্র-বিদ্যুতের খেলা উপলব্ধি করাও সম্ভব নয়। একসময় পৃথিবী তুলনামূলকভাবে শীতল হয়ে ওঠে। এবারে বৃষ্টির বারিধারা মাটিতে পড়তে থাকে। পৃথিবীর প্রথম বর্ষণমুখর দিনগুলো কেমন ছিল জানতে চাওয়ার প্রেক্ষাপটে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাসায়নিকের অধ্যাপক ডোনাল্ড লো এ চিত্র তুলে ধরেন।
পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের প্রথম নজির খুঁজে পাওয়া গেছে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক হিলে। খুদে খুদে জিরকনের স্ফটিক পাওয়া গেছে। এগুলোর বয়স ৪.২ বিলিয়ন বা ৪২০ কোটি বছর। পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাদান এই সব জিরকন। জিরকনগুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন, বৃষ্টিপাত তখন শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে পৃথিবীর বুকে তত দিনে জলাধারও তৈরি হচ্ছে।
রে ব্র্যাডবেরির ১৯৫০-এর দশকে লেখা বই 'দ্য লং রেইন' পরবর্তীতে 'দ্য ইলাসট্রেডেড ম্যান' নামে চলচ্চিত্রও হয়েছে। অভিনয় করেন রড স্টেইজার। বইটির কাহিনি গড়ে উঠেছে পৃথিবী থেকে যাওয়া চার আরোহীর রকেট শুক্র গ্রহে বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনি নিয়ে। শুক্র গ্রহে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের মুখে পড়তে হয় তাদের। নানা ঘটনায় জেরবার অবস্থা অভিযাত্রীদের।
১৯৬০-এর দশকের মহাকাশ অভিযানের পর জানা যায় শুক্রের আসল স্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে এটি শুষ্ক এবং তপ্ত গ্রহ। ব্র্যাডবেরির দীর্ঘ অফুরান বৃষ্টি এখানে নেই।
গ্রহ নিয়ে পিএইচডিকারীদের বেশির ভাগের কাছে শুক্র অতীতে পানিময় ছিল—এই আলামতই ফুটে উঠেছে। কিন্তু পানিকে কেন যেন ধরে রাখতে পারেনি শুক্র। মঙ্গল গ্রহও তার জীবনের শুরুতে উষ্ণ এবং ভেজা জলবায়ুতে পরিপূর্ণ ছিল। পানির বিশাল মহাসাগর গ্রহটির এক-তৃতীয়াংশ জুড়েই ছিল। বৃষ্টির মধ্য দিয়ে নদীর উপত্যকা সৃষ্টি হয়েছে। হয়েছে আমাজনের মতো বদ্বীপের জন্ম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মঙ্গলও তার পানি ধরে রাখতে পারেনি।
লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের জ্যোতির্জীববিজ্ঞানের প্রধান ডেভিন গ্রিনস্পুনের মতো অনেক গ্রহ বিজ্ঞানীই মহাকাশবিদ্যার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান-কল্পের কল্যাণে। তাদের বালককালে বিজ্ঞান কল্পলেখকদের মধ্য ব্র্যাডবেরি ছাড়া ছিলেন আইজ্যাক অ্যাসিমভ। অ্যাসিমভের 'লাকি স্টার' এবং 'দ্য ওসান অব ভেনাস' শুক্র গ্রহের হারানো সাগর-মহাসাগর নিয়ে গ্রিনস্পুনের মনে আগ্রহের সৃষ্টি করে। হাউস ব্যান্ড অব দ্য ইউনিভার্স নামের একটি গায়ক দলের কণ্ঠশিল্পীও গ্রিনস্পুন। তিনি বলেন, পৃথিবী, মঙ্গল এবং শুক্র জলীয় বাষ্পপূর্ণ বা ভেজা গ্রহ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মঙ্গল এবং শুক্রের ক্ষেত্রে বৃষ্টি হওয়া নয়, বরং বৃষ্টি কীভাবে বন্ধ হলো—তা এক মহাজাগতিক রহস্য। ক্রিডেন্স ক্লেয়ার ওয়াটার রিভাইভার সঙ্গীতের পঙ্ক্তি এখানে স্মরণ করা যায়: হোয়াট স্টপ্টড দ্য রেইন? কী বৃষ্টিপাত থামিয়ে দিল?
সৌরমণ্ডলে শুক্রের অবস্থান সূর্যের কাছাকাছি। সৌরতাপে মনে হয় গ্রহটি একসময়ে প্রচণ্ড তেতে ওঠে। সাগর-মহাসাগরের পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়। তাপের প্রচণ্ডতায় জলীয় বাষ্প আর ঘনীভূত হওয়ার অবকাশ পায়নি। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার আবহ-চক্রকে পূর্ণতা দেয়নি। বৃষ্টিপাত কমে আসার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে শুক্রের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। এ চক্রটি 'গ্রিনহাউস গ্যাসের পলায়ন' নামে পরিচিত। এতেই শুক্রর পানিচক্র ভেঙে পড়ে। তাপে জ্বলেপুড়ে যায় শুক্রগ্রহ।
মঙ্গল, অন্যদিকে হয়ে ওঠে মাত্রাতিরিক্ত শীতল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, লোহিত গ্রহটি এককালে পুরু আবহমণ্ডলের আরামদায়ক চাদরে মোড়ানো ছিল। সে সময় অঝোরে বৃষ্টিপাত হতো। নাসার পাঠানো গ্রহ পরিদর্শক মহাকাশ যান এবং মঙ্গলপৃষ্ঠের অনুসন্ধান যানগুলোর পাঠানো আলামত থেকে বোঝা যায় নদ-নদী, খালবিলের মতো পানির অনেক আধেয় ছিল। এমন সব বদ্বীপ ছিল, সেখান দিয়ে প্রবাহিত হতো মিসিসিপির থেকেও অন্তত ১০ হাজার গুণ বেশি জলধারা। তারপরও শতকোটি বছর ধরে আরামদায়ক মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল শীতল এবং অতি ক্ষীণ হয়ে যায়। বৃষ্টিপাতের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাহিত পানি মিলিয়ে যায়।
তবে মঙ্গল গ্রহে এখনো পানি রয়েছে, বলা হচ্ছে। পানি রয়েছে এ গ্রহের মেরু শীর্ষে, রয়েছে মাটির অনেক নিচে, আর আবহাওয়ায় জলীয় বাষ্পের হালকা স্পর্শ রয়ে গেছে। কিন্তু হিমশীতল সেই জলাবর্ত বা 'হাইড্রোলজিক সাইকেল' আর বৃষ্টিপাত চালিত হয় না।
প্রচণ্ড তাপে তেতে উঠেছিল শুক্র। মঙ্গল হয়েছে হিমশীতল। কিন্তু পৃথিবী পানি ধরে রাখার মতো ঠিক তাপমাত্রার আবহমণ্ডল ধরে রাখে। বৃষ্টিধারা বজায় রাখার মতো আবহ-চক্র অব্যাহত থাকে। এরই কল্যাণে অগ্নিতপ্ত নবীন গ্রহ হয়ে ওঠে নীল ধরিত্রী। বর্ষণ ধারায় উল্কাপাতে সৃষ্ট পৃথিবীপৃষ্ঠের খানাখন্দক পানিতে ভরে ওঠে। টইটুম্বর পানি এবারে উপচে পড়ে প্রবাহিত নদীর সৃষ্টি করে। নদীবাহিত পানি নিম্ন ভূমিতে গিয়ে পড়তে থাকে। হ্রদের সৃষ্টি হয় এভাবেই। বৃষ্টিপাতের অব্যাহত ধারায় নিম্ন ভূমিতে পানি জমতে জমতে জন্ম নেয় সাগর-মহাসাগর। ভূপৃষ্ঠ চুঁইয়ে পানি ভূগর্ভের ভেতরে চলে যায়। ভূগর্ভস্থ জলাধার এভাবেই হয়েছে। পৃথিবীর হ্রদ-নদীমালায় যে পরিমাণ পানি রয়েছে, ভূগর্ভে রয়েছে তার তুলনায় অনেক অনেক বেশি পানি। এমনকি কোনো কোনো মরুভূমির তলেও পাওয়া গেছে পানির ভান্ডারের খোঁজ!
পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে প্রথম বৃষ্টিই জীবনের উন্মেষ ঘটিয়েছে। চালর্স ডারউনের 'উষ্ণ খুদে জলাশয়ে' আদিম কোষরাজি হিসেবে জীবন বিকশিত হয়েছে। আজকের দিনে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, গভীর সাগরতলের উষ্ণ-প্রসবণে আদিম জীবনের যাত্রা শুরু। সে যা-ই হোক, জীবনের বিকাশে প্রথম পর্বে বৃষ্টিপাতের অমোঘ ভূমিকা রয়েছে।
জীবনের উদ্ভব বা বিকাশের জন্য পানি এককভাবে থাকলেই হবে না। গ্রিনস্পুন আরও বলেন, ওখানেও পানি আছে। শুক্রর আবহমণ্ডলে এবং মঙ্গলের মেরুতে। কিন্তু ওই দুই জায়গার কোথাও জীবনের বিকাশ ঘটেনি। (হাল আমলে চাঁদের ভূগর্ভেও পানির সন্ধান পাওয়া গেছে দাবি।) পানিকে জীবনশক্তি হতে হলে তাকে আকাশে থাকতে হবে। হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে হবে। বারি বর্ষিত হয়ে ভূপৃষ্টে নেমে আসতে হবে। পানির ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ কাজ বার বার চলতে থাকতেই হবে।
চার বিলিয়ন বা চার শ কোটি বছর আগের সেই প্রথম বৃষ্টিপাতের পর আজও প্রতিদিনের বৃষ্টিধারা নদীনালাকে ভরিয়ে তোলে। ভূমিকে ভেজা রাখে। জীবনের জন্য বৃষ্টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ১৮৭৮-এ স্ক্রাইবনার সাময়িকীর ৯ পাতার রচনায় প্রকৃতিবিষয়ক মার্কিন লেখক জন বুরোস লেখেন, সূর্যের আলো রয়েছে সর্বত্র। কেবল বৃষ্টি বা শিশির ঝরে সেখানেই জীবনের দেখা মিলবে।
জীবনে কেবল টিকে থাকার জন্যেই বৃষ্টি প্রয়োজন, তা-ও নয়। আমাদের মন-হৃদয় জুড়ে রয়েছে বৃষ্টির সুর ও ছন্দ। ফসলের জন্য চাই বৃষ্টিপাত। মানবগোষ্ঠীকে টিকে থাকতে এবং বিকাশ ঘটাতে প্রয়োজন বৃষ্টিপাতের। একজন চাষিকে বৃষ্টি আশার সুরধ্বনি শোনায়।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বৃষ্টিপাতের আরও ভূমিকা রয়েছে। 'জল পড়ে পাতা নড়ে'—বৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে সৌন্দর্য এবং বিস্ময়ের এক অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে আসে। বৃষ্টি কেবল পানির উৎসই নয়। জীবনে ছন্দ ও সৌন্দর্য বোধের উৎসও।
উপমহাদেশের প্রাচীন সাহিত্যে বর্ষাকে বিরহের ঋতু হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বৃষ্টির ঋতু বর্ষাকে বিরহের আবহে প্রথম শব্দ-চিত্রে তুলে ধরেন সংস্কৃত কবি কালিদাস তার কবিতায়। 'কালিদাস তার 'মেঘদূত' কাব্যগ্রন্থে যক্ষের বিরহ বার্তা, যক্ষ প্রিয়ার বেদনা, কুবেরের অভিশাপ আর মেঘের দৌত্য অভিযানকে অভিনব কাব্যিক রূপে সাজিয়েছেন। বাংলা ভাষার কবি না হলেও কালিদাস পাঠকের হৃদয় জয় করেন। বাংলা ভাষার 'মেঘদূত' অনূদিত হয়ে আসছে শত শত বছর পূর্ব থেকেই। বর্ষা যেন বাংলার চিরন্তন ঋতু।'
মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে গোড়া থেকেই জড়িয়ে আছে বৃষ্টিপাত। সভ্যতার উত্থান-পতন নির্ভর করেছে আকাশ থেকে নেমে আসা এই জলধারার ওপর। খরা, বৃষ্টিহীনতা দেখা দেওয়ার পর বনগুলো তৃণভূমিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। বৃষ্টি নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে ওঠার চল দেখতে পাওয়া যাবে মানুষের গোটা ইতিহাসে। বৃষ্টি-দেবতার উপাসনা করার গুহাচিত্র থেকে আধুনিক কালে ঝড় কামনা করে প্রার্থনা পর্যন্ত নানা রূপে এর দেখা পাওয়া যাবে।
পাগলা হাওয়ার বাদলা দিনে গানে গানে সুমধুর শোনালেও পাগলা হাওয়ার মাতামাতি মারাত্মক ঝড় হয়ে দেখা দিতে পারে। এমন এক ঝড় বয়ে গিয়েছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল সরকারি হিসাবে অন্তত ৫ লাখ মানুষ। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। অন্যদিকে 'বাকেরগঞ্জের মহাঝড়' বয়ে যায় এরও প্রায় ৯৪ বছর আগে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং নোয়াখালীতে এ মহাঝড়ে অন্তত ২ লাখ মানুষ মারা যায়। সম্পত্তি ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ের পরেই দেখা দেয় মহামারি এবং দুর্ভিক্ষ।
প্রাচীর রোমের বৃষ্টির দেবতা জুপিটার প্লুভিয়াস। খরাসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রকোপের দুর্যোগে অ্যাজটেকরা বৃষ্টির দেবতা তলালোকের কাছে বলি দিত অল্পবয়সী কয়েকজন সন্তানকে। মধ্যযুগের ইউরোপে ছোট বরফ যুগের সূচনায় চরম বৃষ্টিপাতে ফসল নষ্ট হয়। ইউরোপ জুড়ে অনাহার দেখা দেয়। পাশাপাশি নরখাদকের চলও বাড়ে। বাড়ে অন্যান্য ভয়াবহতা। সে সময় এসব ঠেকানোর জন্য ডাইনি খুঁজে বের করে তাদের প্রাণদণ্ডে নেমেছিল ইউরোপ।
বৃষ্টি নামানোর নানা তুকতাক, মন্ত্র বা অর্চনার পথ এবারে এসেছে মেঘ-বীজ বপনের বা ক্লাউড সিডিং-এর প্রক্রিয়া। রাসায়নিকভাবে মেঘকে দোহন করে বৃষ্টি নামানোর এ পদ্ধতি নিয়ে নানা বুলি শোনা যায়। আমেরিকান ওয়েস্টসহ বিশ্বের আরও জায়গায় চলছে এ প্রক্রিয়া। মেঘ দোহন করে বৃষ্টি নামানোর সবচেয়ে বড় তৎপরতা চলেছে চীনে। চীনের সরকারি বিজ্ঞানীদের দাবি, সিলভার আয়োডাইডে পূর্ণ রকেট ছুড়ে শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে।
যত কয় তত না—কথাটা মনে রাখতে হবে। মেঘ-বীজ বপন যদি সত্যিই বৃষ্টির কামধেনু, অর্থাৎ যখন-তখন খেয়ালখুশিমতো বারিপাত এভাবে ঘটানো সম্ভব হতো, তবে হয়তো চীনের ইয়াংজি নদী শুকিয়ে যেত না; শুকিয়ে যেত না এ নদীর কাছাকাছি হ্রদগুলো, জলাধারগুলো। নষ্ট হতো না শস্য এবং ব্যাপক মানুষের জীবনযাত্রা। আমেরিকার অংশবিশেষ মারাত্মক খরার রাহুগ্রাসে পড়ত না।
বৃষ্টি আজও তার সব রহস্য প্রকাশ করেনি। বৃষ্টিপাত পরিমাপক উপগ্রহ, ডপলার রাডার এবং ১০ লাখ আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য একসাথে প্রক্রিয়া করতে সক্ষম সুপার কম্পিউটার হাতে থাকলেও বৃষ্টির সবকিছু জানা হয়নি। মাছ বা ব্যাঙ বৃষ্টির সাথে ঝরার মতো ঘটনা ঘটে। বলা নেই কওয়া নেই—হঠাৎ বৃষ্টি এসে বিয়ের দিন মাটি করতে পারে। বৃষ্টি কুড়াতে পারে নববধূর ক্রোধ। কিংবা উল্টোও ঘটতে পারে। হঠাৎ বৃষ্টি আরও মধুময় করে তোলে বাসররাতকে।
বৃষ্টি নিয়ে অনেক কথা হলো। এবারে প্রশ্ন—বৃষ্টি ফোঁটা দেখতে কেমন? পানির কল থেকে টুপটাপ করে ঝরা পানির ফোঁটার মতো হবে। এমন ভাবনাই স্বাভাবিক। আগার দিক সরু বা সুচালো। তলার ঠিকটা গোলাকার। না, এ ধারণা ভুল। মেঘ থেকে ঝরা বৃষ্টির সাথে খুদে প্যারাসুটের মিল রয়েছে। নিচের বাতাসের চাপে আগার দিকটা গোলাকার হয়ে থাকে।