বৃষ্টি বিচিত্রা
কান্নার ফোঁটা বৃষ্টির ফোঁটা বৃষ্টি আর কান্নাকে কবি ও শিল্পী যতই তুলনীয় মনে করুন না কেন, বৃষ্টির ফোঁটা আর অশ্রুর ফোঁটা মোটেও এক রকম নয়। কান্নার ফোঁটা কেমন দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। বৃষ্টির ফোঁটাও দেখেছি—তবে কখনো পাশাপাশি মিলিয়ে দেখিনি। বৃষ্টিকে বাতাসের বাধা পেরিয়ে আসতে হয়; ধাক্কা খেয়ে ফোঁটার প্রান্ত সমতল হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যখন নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা তখন 'উপগোলাকৃতি'—অনেকটা দুপাশ চ্যাপ্টা কমলালেবুর মতো।
বৃষ্টির ফোঁটার আকার নির্ভর করে বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, গতি, ও ঘূর্ণনের ওপর। বৃষ্টির ব্যাস ১ থেকে ৬ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কখনো কখনো এই ব্যাস ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত পৌঁছায়—সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ফোঁটা একেকটি ছোট মার্বেলের মতো। বৃষ্টির ফোঁটা যত বড় বড় হয়, বর্ধিত ভরের কারণে দ্রুত বাতাসে ভেসে থাকার শক্তি হারায় এবং পৃথিবীতে নেমে আসে। বড় ফোঁটা হলেও বৃহত্তম ফোঁটাও সরাসরি আঘাত করে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এক একটা ঝড়ের সাথে বড় পরিমাপের বৃষ্টির ফোঁটা ভেঙে স্রোতোধারা হয়ে নেমে আসে। এক ইঞ্চি ঝড়োবৃষ্টি এক একর জমির ওপর ৬০ লক্ষ গ্যালন পানি জমায়। গড়ে বৃষ্টির ফোঁটার আয়তন ০.০৫ মিলিমিটার, এক একর জমিনের ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার সংখ্যা ১২০ বিলিয়ন।
ইউরোপীয় বৃষ্টি প্রবচন ও বিশ্বাস
আপনি যদি হাঙ্গেরিতে বাস করেন, তাহলে সতর্ক থাকবেন। যদি ৮ জুন বৃষ্টি শুরু হয়, তাহলে এ বৃষ্টি আর থামার নয়। ৪০ দিন ঝরার পর ক্ষ্যান্ত হবে। ২৫ মে যদি বৃষ্টিস্নাত দিন হয়, তাহলে পানীয় মদ টক হয়ে যাবে। পোল্যান্ডের তৃণভূমিতে যদি কোনো গরুকে শুয়ে থাকতে দেখেন, তাহলে নিশ্চিত হতে পারেন বৃষ্টি আসছে।
ফ্রান্সের পার্বত্য এলাকায় ভেড়ার গলায় ঝোলানো ঘণ্টার ধ্বনি যদি কেউ শুনে থাকেন—তারা ভুল শোনেননি। ফরাসি পার্বত্য অঞ্চলে গলায় ঘণ্টা বাঁধা ভেড়ার ঘণ্টাধ্বনি না শুনে উপায় নেই। এখনই বৃষ্টি আসছে।
ফ্যান্টম বৃষ্টি
অত্যন্ত উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে যখন বৃষ্টিপাত হয়, কখনো বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে মাটিকে ভেজাতে পারে না, তপ্ততা নিচে নেমে আসতে থাকা বৃষ্টিকে মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্পীভূত করে ফেলে। পড়তে গিয়ে পড়তে পারল না—এই যে অবস্থার বৃষ্টি তার নামই ফ্যান্টম রেইন বা অলীক বৃষ্টি। পরিবেশবিদ এডওয়ার্ড অ্যাবে লিখেছেন, আপনি দেখছেন বৃষ্টির পর্দা আকাশ থেকে ঝুলে আছে আর নিচে জীবন্ত বৃক্ষ ও প্রাণী বৃষ্টির আশায় ওপরে তাকিয়ে আছে, গরমে কুঁকড়ে যাচ্ছে। দোদুল্যমান আশা তাদের যন্ত্রণা দিচ্ছে—এর মধ্যেই দেখতে পেল তাদের স্পর্শ করার আগেই বৃষ্টি শূন্যে মিলিয়ে গেছে। অতএব বৃষ্টি ভেজায় এ কথা সব সময়ই সত্য নয়।
চেরাপুঞ্জি হেরে গেল
স্কুলপাঠ্য বই থেকে অন্তত শতবর্ষ ধরে আমরা শিখছি—পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। পরীক্ষা প্রশ্নোত্তরেও বছরের পর বছর এই নামটিই লেখা হয়েছে। শীর্ষ স্থান ভারতে থাকলেও এখন আর চেরাপুঞ্জি নয়। এখন শীর্ষে মেঘালয়ের মওসিনরাম। এখানে বার্ষিক গড় ১১,৮৭১ মিলিমিটার বা ৪৬৭ ইঞ্চি। আর দ্বিতীয় স্থানে চেরাপুঞ্জি ১২,৭৭৭ মিমি বা ৪৬৩ ইঞ্চি। মওসিনরাম চেরাপুঞ্জি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যায়। সে জন্য ঘরের ছাদে ঘাস রোপণ করা হয়। তাতে শব্দের তীক্ষèতা হ্রাস পায়। চেরাপুঞ্জিতে ১৫ থেকে ২১ দিন টানা বৃষ্টিপাত হয়; এত যে বৃষ্টি সেই চেরাপুঞ্জিতে বছরের একটা সময় চলতে থাকে খরা, পানির জন্য শুরু হয় হাহাকার, বিশেষ করে শীত মৌসুমে। বৃষ্টি বহুল মেঘালয়ের বাসিন্দাদের বৃষ্টিজুতো নেই; কিন্তু এখানকার চার ভাগেরও কম বৃষ্টি হলেও ওয়েলসে ঘরে ঘরে প্রতিজনেরই এক জোড়া করে ওয়েলিংটন বুট বা বৃষ্টিজুতো রয়েছে।
তৃতীয় স্থানে কলম্বিয়ার টুটেনডো। পাশের কুইবডো পৃথিবীতে সবচেয়ে সিক্ত শহর হিসেবে পরিচিত। টুটেনডোর বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১,৭৭৭ মিমি। চতুর্থ স্থানে নিউজিল্যান্ডের ক্রুপ রিভার। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১১,৫১৬ মিমি। পঞ্চম স্থান ইকুয়াটোরিয়াল গিনির সান আন্তানিও দ্য ইউরেকা, গড় বৃষ্টিপাত ১০,৪৫০ মিমি। ষষ্ঠ স্থান আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ক্যামেরুনের পাদদেশ দেবুন্দশা, ১০,১৯৯ মিমি; সপ্তম স্থানে হাওয়াই-র রিগ বগ, গড় বৃষ্টি ১০,২৭২; সবুজ বৃক্ষ ও ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনাতে পরিপূর্ণ এই স্থানটি অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। অষ্টম স্থানেও হাওয়াইর মাউস্ট ওয়েলিয়েন, গড় বৃষ্টি ৯,৭৬৩ মিমি; নবম স্থানে হাওয়াইর কাজুই ৯,২৯৩ মিমি। দশম স্থানে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের এমি শান, বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৮,১৬৯ মিমি, বর্ষায় অঞ্চলটির আকাশ মেঘে এতটাই ঢাকা থাকে যে একে তখন বলা হয় মেঘ সমুদ্র বা ক্লাউড সি। মেঘালয়ে বৃষ্টির প্রধান কারণ বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত জলীয় বাষ্প। ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১৫.৬৩ মিমি—এক দিনের হিসাবে এটাই এখন পর্যন্ত বিশ্বরেকর্ড।
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
সালাত-আল-ইসতিসকা
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে আল্লাহ মেঘ—এ শতবর্ষী সুর খরা এলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কণ্ঠে ভেজে ওঠে—যেন আব্বাস উদ্দিন নিজেই গাইছেন। বৃষ্টির জন্য সালাত-আল-ইসতিসকা নামাজ হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে: আল্লাহ বৃষ্টি দে। বৃষ্টির জন্য ইউরোপ ও আমেরিকাতে আছে রেইন ড্যান্স রিচ্যুয়াল। এই বৃষ্টি নাচন আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সংস্কৃতির অবিভাজ্য অংশ ছিল। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে রেইন ড্যান্স হয়ে থাকে। চীনে উৎসব করে স্বাগত জানানো হয় প্রেইন রেইনকে। চীনা পঞ্জিকার ষষ্ঠ সৌর পর্বে (এপ্রিল) বৃষ্টিবরণ হয়ে থাকে। এই বৃষ্টি উৎপাদন ও সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। ভারতবর্ষের জীবন ও পর্যাপ্ততার প্রতীক বৃষ্টি।
সবচেয়ে কম বৃষ্টি মরুভূমিতে হয়
এমন ধারণা হতেই পারে, বৃষ্টির অভাবেই তো মরুভূমি সৃষ্টি হয়—মরুভূমিতে বৃষ্টি দুর্লভ। আসলে মরুভূমিতেও বৃষ্টি হয়; বৈশি^ক জলবায়ুর পরিবর্তনে মরুভূমিতে বৃষ্টি বেড়েছে। সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয় অ্যান্টার্কটিকায়, বছরে গড়ে ৬.৫ ইঞ্চি।
বৃষ্টির ফোঁটাতে কি কেবলই পানি
লৌহবৃষ্টি
অবশ্যই পানি। কিন্তু মহাজাগতিক পর্যবেক্ষকেরা দেখেছেন মহাকাশে যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তাতে বিভিন্ন ধাতব পদার্থ থাকে। ৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে বিজ্ঞানীরা বৃষ্টিপাতের যে প্রমাণ পেয়েছেন, তাতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সব লোহার, একে লৌহবৃষ্টি বলা যায়।